স্বাতী ভট্টাচার্য
যৌনসংসর্গে মেয়েটির আপত্তি যেমন ধর্ষক গ্রাহ্য করে না, তেমনই যৌনসংসর্গে মেয়েটির সম্মতিও তার পরিবার গ্রাহ্য করে না। যৌনসম্পর্ক কখন স্বেচ্ছায় সহবাস, আর কখন ধর্ষণ, তা মেয়েটির স্থির করার এক্তিয়ার রয়েছে, এমন মনেই করা হয় না পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। বিয়ের ভিতরে তার সম্মতির প্রয়োজন নেই, আর বিয়ের বাইরে হলে তার সম্মতি দেওয়ার প্রশ্নই নেই। মিডিয়াও প্রকারান্তরে এই ‘মডেল’-কেই সমর্থন করে না কি? মিডিয়াতে সেই ঘটনাগুলিই প্রাধান্য পায় যেখানে এক বা একাধিক অপরিচিত লোকের দ্বারা মেয়েটি অকস্মাৎ নিগৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, যে-সব ঘটনায় মেয়েটির সম্মতি বা অসম্মতি জানানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না, মেয়েটি কী বলেছিল তাতে কান না দিয়েই নিশ্চিত হওয়া যায় যে ধর্ষণই ঘটেছিল, সেগুলিকেই মান্যতা দেয় মিডিয়া। বিশেষ প্রাধান্য পায় সেই সব ঘটনা যেখানে মেয়েটি ধর্ষণের পরে খুন হয়ে গিয়েছে
পূর্ব-প্রসঙ্গ: ধর্ষকের পরিচয়
ভারতে বছরে ধর্ষণের যত মামলা হয়, তার মাত্র ২৭-২৮ শতাংশ মামলায়, অনেক বছর তারও কম মামলায়, অভিযুক্তের সাজা হয়। বাকি মামলাগুলিতে অভিযুক্তের দোষ প্রমাণিত হয় না, তিনি ছাড়া পেয়ে যান। অনেক ক্ষেত্রে বিচারাধীন বন্দি হিসেবে বেশ কিছু মাস বা বছর কারাবাসের পরে অভিযুক্ত বেকসুর খালাস পান। একশোজনের মধ্যে বাহাত্তরজন অভিযুক্তই যদি নির্দোষ বিবেচিত হয়, তা হলে ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতায় আস্থা রাখা চলে কী করে?
তা ছাড়া, কেবল পরিসংখ্যান দিয়েই যে লোকে নিজের পারিপার্শ্বিককে বোঝে, তা তো নয়। নিজেদের চেনা-জানার মধ্যে আমরা এমন মেয়ে কম দেখি না, যারা কুচক্রী, প্রতিহিংসাপরায়ণ, আবেগতাড়িত, মিথ্যা অভিযোগ করতে বা মিথ্যা সাক্ষ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে পিছপা নয়। সমাজ হয়তো সাধারণত মেয়েদের প্রতি বৈষম্য ও অবিচার করে, তা বলে সব মেয়ের সব অভিযোগই কি বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য?
আরও দেখা যাচ্ছে, প্রাক-বিবাহ যৌনসম্পর্ক নিয়ে আগের চাইতে কিছুটা খোলামেলা মনোভাব পোষণ করছে সমাজ ও আদালত। অনেক মেয়ে দীর্ঘদিন অবিবাহিত থাকছে, নিজের পছন্দ অনুসারে এক বা একাধিক যৌনসঙ্গী নির্বাচন করছে। কোনও কারণে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলে, বা বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে না রাখলে, কোনও কোনও মেয়ে আবার স্বেচ্ছায় নির্বাচিত সঙ্গীর বিরুদ্ধেই ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করছে।
অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মেয়েটির পরিবার ধর্ষণে অভিযুক্তের পরিবারের সঙ্গে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নিয়ে দরদস্তুরও করেন। সমঝোতায় পৌঁছনোর পরে মামলা তুলে নেন।
ধর্ষণ বা যৌননিগ্রহের অভিযোগ একবার দায়ের হলে কোনও পুরুষের পক্ষে তার মোকাবিলা করা কঠিন, তাতে অনেক ব্যয় ও পরিশ্রম হয়, সম্মান নষ্ট হয়। তা জেনে, তার উপর চাপ তৈরির কৌশলরূপে ধর্ষণের অভিযোগের ব্যবহার হয়।
অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, ধর্ষণের প্রতিকারের জন্য নারীবাদী সওয়াল ও আন্দোলনের চাপে পুলিশ-প্রশাসন পুরুষমাত্রই ‘নন্দ ঘোষ’ বলে ধরে নিচ্ছে। তার ফলে পুরুষমাত্রই বিপন্ন। প্রশ্ন উঠছে, পুরুষদের হয়ে কথা বলবে কে? পুরুষদের সুরক্ষা, মর্যাদার দিকটা কি আজ উপেক্ষিত নয়?
মেয়েরা কি ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ করে না?
অবশ্যই ধর্ষণের ভুয়ো অভিযোগ দায়ের করা হয়। মন্দ উদ্দেশ্য নিয়ে ধর্ষণের ভুয়ো মামলা করেছে, এমন প্রমাণিত হলে মেয়েটির শাস্তিও হয়। আদালতের বিচারে মেয়েদের অভিযোগ ভুয়ো প্রমাণিত হয়েছে, এবং মেয়েটির শাস্তি হয়েছে, এমন ঘটনা কম নয়। এ-বছরই মে মাসে উত্তরপ্রদেশের বেরেলির একটি ঘটনায় আদালত একটি মেয়েকে চার বছর পাঁচ মাসের জেলের সাজা দিয়েছে, কারণ বিচারাধীন বন্দি হিসেবে ওই সময়কাল জেলে কাটিয়েছে অভিযুক্ত। সেই সঙ্গে মেয়েটিকে ৫ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা জরিমানাও করেছে আদালত, কারণ জেলবাসের জন্য ওই রোজগার অভিযুক্ত হারিয়েছে। মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসে এক মহিলার দশ বছরের জেল হয়েছে, যখন প্রমাণিত হয়েছে যে সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য তিনি এক আত্মীয়ের নামে ধর্ষণের ভুয়ো অভিযোগ করেন, এবং মিথ্যা প্রমাণ দাখিল করেন আদালতে। এমন অনেক ঘটনার খোঁজ পাওয়া যায়। ভুয়ো অভিযোগ করার ঝুঁকি যথেষ্ট, এবং মেয়েদের তার ফল ভোগ করতে হয়।
ক্ষুদ্র স্বার্থরক্ষার জন্য, কিংবা প্রতিহিংসা চরিতার্থতার জন্যেও নির্দোষ পুরুষের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনে কিছু মেয়ে, এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। অনেকে এমন একটা যুক্তিহীন ধারণাকে সামনে আনেন যে, নারীবাদীরা সব ধর্ষণের ঘটনাতেই পুরুষদের আগাম দোষী সব্যস্ত করে বসে রয়েছেন। কথাটা ভুল এবং হাস্যকর। নারীবাদীরা মনে করেন, লিঙ্গ-নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে ভাল ও খারাপ রয়েছে। পুরুষমাত্রই খারাপ, এমন কথা যেমন নারীবাদীরা বলেন না, তেমন মহিলা হলেই তিনি সব রকম সৎ গুণের অধিকারী, এমন আজব কথাও বলেন না। তাঁদের আপত্তি এমন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ে, যা বিশেষভাবে পুরুষদের ক্ষমতা, সম্পদ ও মর্যাদা দেয়, কিন্তু মেয়েদের (কেবল মেয়ে বলেই) তা সমানভাবে দিতে চায় না। মেয়েদের দেহ ও শ্রম, এই দুটি সম্পদের উপরেই পুরুষের দখলদারিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করে।
ধর্ষণের সংযোগ যৌন-আবেগের সঙ্গে নয়, ক্ষমতার সঙ্গে, ভারতের সমাজে যা পুরুষই বিশেষভাবে ভোগ করে। মেয়েদের উপর নানা অন্যায় বৈষম্য হয়, যেমন তাদের কাজের জন্য কম মজুরি দেওয়া। কিন্তু ধর্ষণ পুরুষ-নারীর ক্ষমতার বৈষম্যকে এমন নগ্নভাবে সামনে নিয়ে আসে, এবং দু-পক্ষের ক্ষমতার ফারাককে আরওই বাড়িয়ে তোলে, যা আর কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। ধর্ষণ, এবং ধর্ষণের ভয়, মেয়েদের সন্ত্রস্ত, পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে রাখার একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়, যা মেয়েদের মধ্যে আত্মগ্লানি তৈরি করে, নিজেকে হীন বলে ভাবার অভ্যাস তৈরি করে। এতটাই যে, উপর্যুপরি ধর্ষিত হয়েও একটি মেয়ে নিজেকেই অপরাধী বলে মনে করে, নিজের উপর নিগ্রহ লুকোতে চায়।
ধর্ষণের বিচারের ভার পুলিশ-আদালত ব্যবস্থার উপরে। নারীবাদীরা মনে করান, সর্ষের মধ্যে ভূত ঢুকে থাকার মতো, সেখানেও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, আচার-আচরণ ঢুকে বসে আছে। তা ছাড়া ভারতে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মজ্জাগত শিথিলতা তো আছেই। আদালতে দোষ প্রমাণিত না হওয়ার বড় কারণ ত্রুটিপূর্ণ পুলিশি তদন্ত। যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ সময়মতো জোগাড় করতে না পারা, প্রথামাফিক মেডিক্যাল পরীক্ষা না হওয়া, আদালতে দীর্ঘদিন মামলা চলার জন্য যথাসময়ে সাক্ষী না পাওয়া, সাক্ষী বিরূপ হওয়া— পুলিশের এইসব ব্যর্থতা বা অক্ষমতার জন্য মামলা দাঁড়ায় না। এ-বিষয়ে বহু সমীক্ষা-ভিত্তিক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে। অতএব ধর্ষণে অভিযুক্তদের অল্প অংশই সাজা পান, সেই তথ্য দিয়ে এ-কথা দাবি করা চলে না যে, ধর্ষণের অধিকাংশ অভিযোগই ভুয়ো।
যদি-বা কেউ বিশ্বাস করেন যে ধর্ষণের অনেক মামলা আসলে ভুয়ো, তা হলে তাঁকে পাশাপাশি এ-ও মনে রাখতে হবে যে, বাস্তবিক ধর্ষণের অনেক ঘটনা আজও আদালত অবধি পৌঁছয় না। অনেক ক্ষেত্রে মেয়েরাই তা গোপন করতে বাধ্য হন। পরিবার-সমাজের কাছে অপদস্থ হওয়ার ভয় তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে রয়েছে এই ভয় যে কেউ তাঁকে বিশ্বাস করবে না, উলটে তাঁকেই ‘দুশ্চরিত্র’ বলে মনে করবে।
এর একটি মারাত্মক নিদর্শন মেলে সাংবাদিক নেহা দীক্ষিৎ-এর তদন্তমূলক প্রতিবেদনে। ২০১৩ সালে উত্তরপ্রদেশের মুজফফরপুরে যে ভয়ানক জাতি-দাঙ্গা হয়েছিল, তার পরে বহু মুসলিম মেয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন শিবিরে। সেখানে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে তিনি ন-জন মেয়ের কাছে পেয়েছিলেন একই সঙ্গে অন্তত উনিশজনের ধর্ষিত হওয়ার তথ্য। সেই মেয়েরা কেউ সে-বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেননি, পরিবার তাঁদের ত্যাগ করবে এই ভয়ে। তাঁরা দেখেছেন, বিয়ের বাইরে যে-কোনও যৌনসংসর্গকেই ‘পরকীয়া’ বলে ধরা হয় তাঁদের পরিমণ্ডলে।
অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে গেলেও তারা এফআইআর নেয় না। হাথরাসের ধর্ষণের ঘটনার (২০২০) পরে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, দলিত মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রথম চেষ্টাতেই পুলিশ এফআইআর করেছে, এমন ঘটনা দেখাই যাচ্ছে না। বারবার চেষ্টা করেও এফআইআর করানো যায় না, এমন ঘটনা অগণিত সমাজকর্মীর অভিজ্ঞতায় রয়েছে। অতএব ধর্ষণের আইনের অপব্যবহার যেমন হচ্ছে (কোন আইনেরই বা হয় না?) তেমন তার অ-ব্যবহারও হচ্ছে। যাদের সুরক্ষার জন্য আইন তৈরি হয়েছে, তারা সুরক্ষিত হচ্ছে না।
অতএব যাঁরা মনে করছেন যে আইনের পাল্লা বিশেষ ভাবে মেয়েদের পক্ষে ঝুঁকে রয়েছে, তাই পুরুষ বিপন্ন, তাঁদের ফের চিন্তা করতে হবে। মনে রাখা চাই তিনটি কথা।
এক, সমাজের পাল্লা বিশেষভাবে ধর্ষিত মেয়েদের বিপরীতে ঝুঁকে রয়েছে (তাকে লজ্জা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, চুপচাপ ধর্ষণকে মেনে নিতে বলে সমাজ) বলেই আইনকে বিশেষ সুরক্ষা দিতে হয়েছে তাদের।
দুই, আইনের অপব্যবহার করে ভুয়ো ধর্ষণের অভিযোগ যত হয়, আইন অব্যবহার করে প্রকৃত ধর্ষণের অভিযোগ না করার ঘটনা হয়তো ঘটে তার চাইতে বেশিই। কপট রাত্রে গোপন হিংসার সামনে নিঃসহায় মানুষের কথা মনে রেখেই আইন তৈরি হয়। সেটাই তার প্রধান লক্ষ্য।
তিন, আইন সকলের জন্য সমান। তার দুটো অর্থ করা যায়। এক, সকলেই আইনের দ্বারা সমানভাবে সুরক্ষিত। আর দুই, আইনের শাসন মানতে সমানভাবে দায়বদ্ধ, দণ্ড মেনে নিতে সমান বাধ্য। বিচারব্যবস্থা ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, নারী-পুরুষকে সমাজ ওজন দিতে চায় বলেই আইনের দেবীর মূর্তির চোখে কাপড় বাঁধা। দণ্ডদাতার সামনে এই ঝুঁকিতে তফাত করা যায় না অপরাধীদের মধ্যেও। খুন, অপহরণ, মানবপাচার, রাষ্ট্রদ্রোহ প্রভৃতি গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও মিথ্যা মামলা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি অকারণে ঝুঁকিগ্রস্ত, অপদস্থ হন। ধর্ষণের ক্ষেত্রেও তাই হবে। এর প্রতিকার পুলিশি তদন্ত এবং আদালতের বিচারকে আরও তৎপর এবং উৎকৃষ্ট করা। আইন করে কোনও একপক্ষের ঝুঁকি কমাতে গেলে অন্যপক্ষের ঝুঁকি বাড়তে বাধ্য।
বস্তুত, ধর্ষণের অভিযোগ করে যে মেয়েরা, তাদের ঝুঁকিও কম নয়। সামাজিকভাবে অপদস্থ হওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। তার উপর, সত্য অভিযোগ করেও মিথ্যা অভিযোগ করার দায়ে জেলে যেতে হতে পারে। আমেরিকার এক সাংবাদিকের তদন্তের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে নির্মিত ‘সাসপেক্ট/ভিক্টিম’ তথ্যচিত্রটি নেটফ্লিক্সে দেখলে বোঝা যায়, ধারাবাহিকভাবে গোটা দেশে নিগৃহীত মেয়েদের কীভাবে জেলে ভরেছে পুলিশ। এরা অধিকাংশ ছিল অল্পবয়সী, অল্পবিত্ত মেয়ে।
এ-বিষয়ে ভারতে জনপরিসরে বিতর্ক-বিবেচনা হয়নি, তা নয়। মথুরা ধর্ষণ মামলার পরে যখন ভারতের নারী আন্দোলন দাবি করেছে যে ধর্ষণের অভিযোগকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, এবং সহমতের ভিত্তিতে সহবাস ঘটেছে বলে অভিযুক্ত দাবি করলে তাকেই তা প্রমাণ করতে হবে, তখন মানবাধিকার কর্মীরা এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁরা মনে করিয়েছিলেন যে, অভিযুক্তের উপরেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার দায় একবার চাপালে তা এমন ধরনের আরও অনেক কঠোর, নিগ্রহকারী আইন তৈরি করার পথ তৈরি করে দেবে। এ-সব বিতর্কের সম্পর্কে অবহিত হয়েই চারটি আইন কমিশন ধর্ষণের আইন নিয়ে বিভিন্ন সংস্কারের সুপারিশ করে, যা অংশত গ্রহণ করেছে সরকার। সহমতের ভিত্তিতে সংসর্গ হয়েছে, এ কথা দাবি করলে অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হবে সহমত ছিল, এই পরিবর্তন (১৯৮৩) কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে হয়।
মিথ্যা মামলা কেন হয়?
ভুয়ো ধর্ষণের মামলার বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, মেয়েদের নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরুষতন্ত্রের জেদ, পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের ‘ইজ্জত’-এর ধারণা থেকে ভুয়ো ধর্ষণের মামলার একটা বড় অংশ দায়ের হয়।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৬ সালের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছিল, মোট ধর্ষণের অভিযোগের (৩৮,৯৪৭) প্রায় এক-চতুর্থাংশ (১০,০৬৮), অর্থাৎ ৪৫ শতাংশ, বিয়ের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের জন্য ধর্ষণের অভিযোগ।
সাংবাদিক রুক্মিণী শ্রীনিবাসন ২০১৩ সালে নয়া দিল্লির বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন ৪৬০টি ধর্ষণের মামলার বিশ্লেষণ করে দেখেছিলেন যে তার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি প্রাক-বিবাহ, কিংবা বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসম্পর্ক, যা খুব সম্ভব সহমতের ভিত্তিতেই হয়েছিল। কিন্তু মেয়েটির বাবা-মা যখন তা জানতে পারে, তারা থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে। তাদের উদ্দেশ্য ওই সম্পর্ক ছিন্ন করা, এবং পরিবারের সম্ভাব্য ‘বদনাম’ এড়ানো। বাড়ির মেয়ে স্বেচ্ছায় যৌনসংসর্গে মত দিয়েছে, এ-কথা স্বীকার করার চাইতে তাঁদের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ করা ভাল বলে মনে হয়। মেয়েটি অভিযোগ দায়ের করতে ইচ্ছুক কি না, পরিবার তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে না।
লক্ষণীয় যে, যৌনসংসর্গে মেয়েটির আপত্তি যেমন ধর্ষক গ্রাহ্য করে না, তেমনই যৌনসংসর্গে মেয়েটির সম্মতিও তার পরিবার গ্রাহ্য করে না। যৌনসম্পর্ক কখন স্বেচ্ছায় সহবাস, আর কখন ধর্ষণ, তা মেয়েটির স্থির করার এক্তিয়ার রয়েছে, এমন মনেই করা হয় না পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। বিয়ের ভিতরে তার সম্মতির প্রয়োজন নেই, আর বিয়ের বাইরে হলে তার সম্মতি দেওয়ার প্রশ্নই নেই। মিডিয়াও প্রকারান্তরে এই ‘মডেল’-কেই সমর্থন করে না কি? যদিও অধিকাংশ (কোনও কোনও সমীক্ষা বলে, ৯০ শতাংশ) ধর্ষণের ঘটনায় দেখা গিয়েছে যে মেয়েটির চেনাশোনা কোনও লোক (আত্মীয়, প্রতিবেশী, সহকর্মী) মেয়েটিকে নিগ্রহ করে, তবু মিডিয়াতে সেই ঘটনাগুলিই প্রাধান্য পায় যেখানে এক বা একাধিক অপরিচিত লোকের দ্বারা মেয়েটি অকস্মাৎ নিগৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ, যে-সব ঘটনায় মেয়েটির সম্মতি বা অসম্মতি জানানোর কোনও প্রশ্নই ওঠে না, মেয়েটি কী বলেছিল তাতে কান না দিয়েই নিশ্চিত হওয়া যায় যে ধর্ষণই ঘটেছিল, সেগুলিকেই মান্যতা দেয় মিডিয়া। বিশেষ প্রাধান্য পায় সেই সব ঘটনা— দিল্লির নির্ভয়া থেকে হায়দরাবাদের পশুচিকিৎসক পর্যন্ত— যেখানে মেয়েটি ধর্ষণের পরে খুন হয়ে গিয়েছে। মনে হতে পারে, অপরাধের নৃশংসতার জন্যই সেই সব ঘটনা গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু ভুললে চলবে না, নিহত মেয়ে মানে নীরব মেয়ে। কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, সে-বিষয়ে মেয়েটির বয়ান নেওয়ার কোনও প্রয়োজন থাকে না সে খুন হয়ে গেলে। তার নিগ্রহকারীকে সহজেই যৌনক্ষুধায় উন্মত্ত এক দুর্বৃত্ত, অমানুষ, বিকৃত মানুষ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। তাতে ধর্ষণ হয়ে ওঠে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’
অন্যদিকে, যে ক-টি বিরল ঘটনায় ধর্ষিত মেয়েটির নিজের বয়ান মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে, সেখানে ধর্ষণের ‘অর্থ’ নির্মাণ করতে গিয়ে মেয়েরা ‘উন্মত্ত’ পুরুষের ধারণাকে ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছেন পুরুষতন্ত্রে। যেমন, ভাঁওরী দেবী তাঁর গণধর্ষণকে বস্তুত নিম্নবর্ণের প্রতি উচ্চবর্ণের হিংসা বলে বিবৃত করে এসেছেন বরাবর। গত কয়েক বছরে ‘লাভ জিহাদ’-এর যে দৃষ্টান্তগুলি দেখা গিয়েছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েটির পরিবার, কিছু ক্ষেত্রে আদালতও দাবি করেছে যে মেয়েটিকে ভুল বুঝিয়ে অন্য ধর্মের পুরুষ তাকে বিয়ে করেছে। মেয়েটির নিজের বয়ান গ্রাহ্য হয়নি।
যৌনসংসর্গ ধর্ষণ, নাকি সম্মতির ভিত্তিতে সহবাস, তা স্থির করতে চায় পুরুষ, পুরুষতান্ত্রিক পরিবার, এবং পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্র (পুলিশ ও আদালত)। তাই মেয়েরা ধর্ষণ বা যৌননিগ্রহ নিয়ে মুখ খুললেই তার পরিবার, কর্মক্ষেত্র থেকে পুলিশ থানা, সর্বত্র প্রথমেই তার কথার সত্যতায় সংশয় খাড়া করা হয়। গত তিরিশ বছরে তফাত এইটুকুই হয়েছে যে আগে মেয়েটিকে গোড়াতেই ‘চরিত্রহীন’ আখ্যা দেওয়া হত, আজকাল তাকে একই সঙ্গে ‘ধান্দাবাজ’ বলে তুলে ধরা হয়। সেই ‘ধান্দা’ সাধারণত চাপ দিয়ে টাকা আদায়, পণ এড়িয়ে বিয়ে করা, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে অভিযুক্তকে বদনাম করা, সম্পত্তি দখল, ইত্যাদি। এখন তার সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে রাজনৈতিক বিরোধিতা— বিপক্ষ দলকে অপদস্থ করতে তার নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করছে অন্য দলের কর্মী-সমর্থক মেয়েরা। এ এক মারাত্মক খেলার চাল, যা আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক, তীব্র নারীবিদ্বেষী। মেয়েদের কথাকে এভাবে সংশয়যোগ্য করে তুললে মিথ্যাকে, অপরাধকে সমর্থন করা হয়।
তা হলে কি রাজনৈতিক পরিসরে ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা করা যাবে না? অবশ্যই যাবে, করা উচিত, এবং করা দরকার। ধর্ষণ প্রতিরোধে পুলিশ ও শাসক দলের ভূমিকা, ধর্ষণের ঘটনার তদন্ত ও বিচারে কোনও রাজ্য সরকারের তৎপরতার তুলনা অন্য রাজ্যের সঙ্গে, এমনকি আদালতে যে সব ধর্ষণের ঘটনার বিচার শেষ হয়েছে সেগুলিতে দুই পক্ষের বক্তব্যের সত্য-মিথ্যা, এমন যে-কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে। কেবল যে ঘটনা বিচারাধীন, তার সত্যতা নিয়ে মিডিয়া, সমাজমাধ্যম বা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা আদালতের বাইরে বিচারসভা বসাতে পারেন না। তাতে ওই মেয়েটির প্রতি প্রবল অন্যায় তো হবেই, প্রতিটি নিগৃহীত মেয়েকেই আরও সন্ত্রস্ত, সঙ্কুচিত করবে, বিচারপ্রার্থনাকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ মনে হবে তার। অপরাধীর হাত শক্ত হবে, সমাজে অন্যায়ের পাল্লা ভারী হবে।
নারীবাদীরা এরই প্রতিবাদ করেন। যাঁরা বলেন, নারীবাদীরা পুরুষদের বিপদে ফেলতে চান, সব পুরুষকে জেলে ঢোকাতে চান, তাঁরা বস্তুত মনে করেন, নারীবাদ হল পুরুষতন্ত্রের ‘লিঙ্গান্তর’— নারীবাদ মানে পুরুষের উপরে নারীর আধিপত্য। এটা একেবারেই ভুল। নারীবাদ হল পুরুষ-নারী সাম্যবাদ। পুরুষের সুবিচার পাওয়ার অধিকারকে নারীবাদীরা অবশ্যই সমর্থন করেন। ধর্ষণে অভিযুক্ত চার যুবককে তেলঙ্গানার পুলিশ গুলি করে মারলে (২০১৯) দেশের প্রাচীনতম নারী সংগঠন, ন্যাশনাল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান উইমেন, তার প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছিল। যৌননিগ্রহের বিচার তখনই মেলে, যখন আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পর শাস্তি হয় অভিযুক্তের। পুলিশের ‘বিচার’ বিচার নয়।
যেটুকু বিশেষ সুবিধা দাবি করে নারীবাদীরা, তা এই কারণে যে পুরুষতন্ত্র মেয়েদের বিশেষভাবে ক্ষমতাহীন, ঝুঁকিগ্রস্ত করেছে। আইন করে ক্ষমতার ভারসাম্য ফিরিয়ে না আনলে আদালতও সুবিচার করতে পারে না। মথুরা ধর্ষণ মামলার রায়ের অবিচার তার দৃষ্টান্ত।
ক্ষমতার যতগুলি প্রকাশ রয়েছে, তার অন্যতম, নিজের কথা অন্যকে শোনানোর ক্ষমতা। নিজের কথার মূল্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষমতা। ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত, বিচার শুরুর আগেই যে মেয়েটির কথায় সংশয় তৈরি করা হয় নানা দিক থেকে (এমনকি প্রশাসনের দিক থেকেও), তাতে সব মেয়ের কথার অবমূল্যায়ন হয়। মেয়েদের অ-ক্ষমতায়ন হয়। মেয়েদের সক্ষমতা বাড়াতে, সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারের কর্তব্য এমন আইন পাশ করা, যা বিচারাধীন ধর্ষণের অভিযোগের সত্যতা বিষয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলা নিষিদ্ধ করবে।