যোগেন্দ্র যাদব, রাহুল শাস্ত্রী, শ্রেয়স সরদেশাই
এবারের নির্বাচনী ফলাফল সরাসরি শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে— এমন কথা কি স্পষ্ট করে বলা সম্ভব? আমাদের মধ্যে একজন, যোগেন্দ্র যাদব, এই মতের সমর্থক।[1] এনডিএ জোটের হাতে সরকার গড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও, বিজেপি কেবল যে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে তাই নয়, সার্বিক জনসমর্থন আদায় করে নিতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপি একক বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এসেছে, যে কোনও প্রতিপক্ষের চেয়ে তার প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা অনেকটাই বেশি, কিন্তু তাদের এই সংখ্যাকে তাদের নিজেদেরই জনসমক্ষে বেধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা চার শতাধিক আসন বা পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ভোট পাওয়ার প্রেক্ষিতেই বিচার করতে হবে। সর্বোপরি, এই ফলাফল বিচার করতে হবে এই রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে যে অর্থবল, সংবাদমাধ্যম, প্রশাসনিক সমস্ত ব্যবস্থা এমনকি শেষতক নির্বাচন কমিশনকেও এই নির্বাচনে সরাসরি বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল।
এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে অবশ্য পালটা যুক্তি হিসেবে একটি তথ্য এখানে পেশ করা চলে। প্রাপ্ত ভোট-শতাংশের নিরিখে বিজেপির ভোট কমেছে মাত্র আগের ৩৭.৪ শতাংশ থেকে এবারে ৩৬.৬ শতাংশে, যা একরকম নগণ্যই বলা চলে। ওড়িশায় বিজেপির নাটকীয় আগমন ঘটেছে, কেরলের দুর্গ ভেঙেছে, অন্ধ্র ও পঞ্জাবেও তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে। তর্কাতীতভাবেই বিজেপি এখন প্রকৃত জাতীয় দলে পরিণত, দেশের সবকটি রাজ্যে তাদের প্রাপ্ত ভোট-শতাংশের হার দুই-অঙ্কে গিয়ে পৌঁছতে পেরেছে। বিজেপির কলমচিরা এই তথ্যগুলির ভিত্তিতেই নিজেদের ‘জয়ী’ ঘোষণা করছেন।[2] স্বাধীন পর্যবেক্ষকেরাও এই ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন, এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন বিজেপির শিকড় বরং এই নির্বাচনে আরও গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছে।[3]
রাজ্যওয়াড়ি ভোটবিন্যাসের হিসেব যদি দেখা যায়, তাহলে লক্ষ করা যাবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দেশের কোনও অংশে ভোট খুইয়েছে, বাকি অংশে ভোট বাড়িয়েছে— বিষয়টি অতটাও সরল নয়। এই নির্বাচন নিঃসন্দেহে প্রতিষ্ঠানবিরোধী নির্বাচন, কেবল মনে রাখতে হবে দেশের সমস্ত অংশেই কিন্তু বিজেপি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করেনি। আসুন, আমরা ভেবে নিই দুটো বিজেপি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে: প্রতিষ্ঠান বিজেপি এবং বিরোধী বিজেপি। প্রতিষ্ঠান চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী-বিজেপির কাছে এটা কিন্তু একটা ভাল নির্বাচনই গেছে। এখন, যেহেতু কোনও কোনও রাজ্যে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় ভর করে বিজেপির ভাল ফল কিছুটা হলেও জাতীয় স্তরে তাদের বিরুদ্ধে সার্বিক প্রতিষ্ঠানবিরোধী রায়কে আড়াল করতে পেরেছে, কিন্তু এই বিষয়টির ওপর ভরসা করা তাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক। কারণ এই ফল, যদি শুধু এইবারের জন্যই মাত্র না-ও হয়, একেবারেই স্বল্পমেয়াদি সন্দেহ নেই।
এই সূত্রে আমরা সারণী ১-এর দিকে তাকাতে পারি। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ আসনে (৩৫৬টি), বিজেপিই ছিল এই মুহূর্তে প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, তার মধ্যে এমন কিছু রাজ্যও রয়েছে যেখানে এই মুহূর্তে তারা হয়তো ক্ষমতায় নেই। এই এলাকাটি পশ্চিমে মহারাষ্ট্র-গুজরাত থেকে শুরু করে পূর্বে বিহার-ঝাড়খণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত, এবং এর মধ্যে কর্নাটক বা হিমাচল প্রদেশও পড়ছে যেখানে, যেমন বলা হল, বিজেপি এই মুহূর্তে ক্ষমতায় নেই। এই সমস্ত রাজ্যে বিজেপি সাংঘাতিক নির্বাচনী পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের যে প্রায় রাজনৈতিক একাধিপত্য ছিল, তা কার্যত ধূলিসাৎ হয়ে গিয়ে বিগত নির্বাচনে এই অংশ থেকে জিতে আসা ২৭১টি আসনের মধ্যে ৭৫টি আসনে তারা পরাজিত হয়েছে। কর্নাটক থেকে শুরু করে বিহার অবধি বিস্তৃত অংশে, গড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ৫ শতাংশ অবধি ভোট-স্যুইংয়ের হার লক্ষ করা গিয়েছে।
সারণী ১[4]
মোট আসন | জয়ী আসনের সংখ্যা (হ্রাস/বৃদ্ধি) | ভোট-শতাংশ (স্যুইং) | প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনে প্রাপ্ত ভোট-শতাংশ (স্যুইং) | |
সর্বভারতীয় বিজেপি | ৫৪৩ | ২৪০ (-৬৩) | ৩৬.৬ (-০.৮) | ৪৪.৫ (-১.৬) |
বিজেপি (প্রতিষ্ঠান) | ৩৫৬ | ১৯৬ (-৭৫) | ৪২.১ (-৪.৬) | ৪৯.৯ (-৫.৩) |
বিজেপি (বিরোধী) | ১৮৭ | ৪৪ (+১২) | ২৫.৫ (+৫.৯) | ৩৩.৪ (৬.৮) |
শ্রুতি নাথানি, দ্য প্রিন্ট
কিন্তু দেশের বাকি এক-তৃতীয়াংশে (১৮৭টি আসনে), বিজেপি নিজেই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী শক্তি বা বিরোধী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং সরাসরি সেই সমস্ত রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলির, যেমন ওড়িশায় বিজেডি-র, অন্ধ্রপ্রদেশে ওয়াইএসআরপি-র অথবা বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের মুখোমুখি হয়। এই বিরোধী-বিজেপি অংশেরই নির্বাচনী সাফল্য জাতীয় নেতৃত্বের মুখরক্ষার কাজ করল। বিগত নির্বাচনে এই সমগ্র অঞ্চল থেকে বিজেপি যতগুলি আসনে জিতেছিল, এবারের নির্বাচনে তার চেয়ে তারা ১২টি আসন বাড়িয়েছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই অংশের ভোটবিন্যাসের নিরিখে তাদের পক্ষে ৬ শতাংশ পয়েন্ট অবধি ভোট-স্যুইংয়ের হার দেখা যাচ্ছে, যা শেষ অবধি সারা দেশে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট-শতাংশ কমার যে হার সেই সাংখ্যমানকে ১ শতাংশ পয়েন্টের নিচে রাখতে সক্ষম হয়।
একটি গুরুতর বিপর্যয়
আসলে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট আসলে যা দেখা যাচ্ছে তার চেয়েও খারাপ। ২০১৯ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে, দল হিসেবে দুইবারেই যে ৩৯৯টি আসনে সরাসরি বিজেপি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে, তার মধ্যে ২৭৪টি আসনেই তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার কমে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, বিহার, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব এবং জম্মু-কাশ্মিরের সব কটি আসন, এবং দুটি বাদে উত্তরপ্রদেশের সব কটি আসন।
জেতা আসনগুলিতে বিজেপির জয়ের ব্যবধান লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। ২০ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট বা তার চেয়েও বেশি ব্যবধানে জেতা আসনের সংখ্যা গতবারের ১৫১টি থেকে এবারে কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৭-এ।
যে ২১৫টি আসনে সরাসরি বিজেপি বনাম কংগ্রেসের লড়াই হয়েছে, সেই আসনগুলিতে বিজেপির পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট সুইং লক্ষ করে দেখা যাক। আগের নির্বাচনে এমন সরাসরি লড়াই হওয়া আসনগুলির মধ্যে ৯০ শতাংশ আসনেই বিজেপি জয়লাভ করে, এবং সেই আসনগুলিতে তাদের জয়ের গড় ব্যবধানও ছিল ২১ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট। এবারে তেমন ২১৫টি আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছে ১৫৩টিতে, ৬২টি আসনে কংগ্রেস প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। তদুপরি, জেতা আসনগুলিতে বিজেপির জয়ের গড় ব্যবধান কমে ১০ পার্সেন্টেজ পয়েন্টেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০১৯-এর তুলনায় এই আসনগুলিতে বিজেপির বিরুদ্ধে ৫.৫ পার্সেন্টেজ পয়েন্টের কাছাকাছি সুইং হয়েছে যা বেশ গুরুতর ধাক্কা।
এবারে যদি আমরা বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে এমন রাজ্যগুলির দিকে তাকাই (সারণী ২ দ্রষ্টব্য), এবং বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনগুলিতে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হিসেব লক্ষ করতে চেষ্টা করি, আমরা দেখব রাজ্য নির্বিশেষে সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে চরম ভোট সুইংয়ের হার উঠে আসছে। এদের মধ্যে বিশেষ করে রাজস্থান (১২ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট), হরিয়ানা (১২ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট), হিমাচল প্রদেশ (১৩ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট)— এই রাজ্যগুলিতে রীতিমতো দুই-অঙ্কের হিসেবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট শতাংশের হার কমতে দেখা যাচ্ছে। যেখানে এই রাজ্যগুলি থেকে অতীতে বিপুল ব্যবধানে বিজেপি প্রার্থীরা জিতে এসেছিলেন, এবারে এই বিরাট ভোট স্যুইংয়ের হার রাজস্থান বা হরিয়ানার নির্দিষ্ট কিছু জায়গাতে সীমাবদ্ধ থেকে (হিমাচল প্রদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য এমনটা নয়), তাদের যথেষ্ট সংখ্যক আসন খোয়ানোর কারণ হয়েছে।
সারণী ২[5]
রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল | বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হ্রাস/বৃদ্ধির হার (% পয়েন্ট অনুসারে) | কেবল সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনের হিসেবে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হ্রাস/বৃদ্ধির হার (% পয়েন্ট অনুসারে) | আসনসংখ্যার হ্রাস/বৃদ্ধি |
প্রতিষ্ঠান বিজেপি | |||
উত্তরপ্রদেশ | -৮.২ | -৬.৮ | -২৯ |
মহারাষ্ট্র | -১.৪ | -৭.৮ | -১৪ |
বিহার | -৩.১ | -৬.৯ | -৫ |
মধ্যপ্রদেশ | ১.৩ | ১.৩ | ১ |
কর্ণাটক | -৫.৩ | -১.৮ | -৮ |
গুজরাত | -০.৪ | -০.৪ | -১ |
রাজস্থান | -৯.৩ | -১১.৫ | -১০ |
আসাম | ১.৪ | -৩.২ | – |
ঝাড়খণ্ড | -৬.৪ | -৭.০ | -৩ |
ছত্তিশগড় | ২.০ | ২.০ | ১ |
হরিয়ানা | -১১.৯ | -১১.৯ | -৫ |
দিল্লী | -২.২ | -২.২ | – |
জম্মু-কাশ্মীর (কেবল জম্মু ও উধমপুর) | -৭.৪ | -৭.৪ | – |
উত্তরাখণ্ড | -৪.১ | -৪.১ | – |
হিমাচল প্রদেশ | -১২.৭ | -১২.৭ | – |
গোয়া | -০.৩ | -০.৩ | – |
অরুণাচল প্রদেশ | -৯.৭ | -৯.৭ | – |
ত্রিপুরা | ২১.৭ | ২১.৭ | – |
মণিপুর | -১৭.৬ | -১.১ | -১ |
চণ্ডীগড় | -৩.০ | -৩.০ | -১ |
লাদাখ | -১০.৪ | -১০.৪ | -১ |
দাদরা ও নগর হাভেলি | ১৮.০ | ১৮.০ | ১ |
দমন ও দিউ | -৩.৭ | -৩.৭ | -১ |
আন্দামান ও নিকোবর | ৫.৩ | ৫.৩ | ১ |
বিরোধী বিজেপি | |||
পশ্চিমবঙ্গ | -১.৫ | -১.৫ | -৬ |
তামিলনাড়ু | ৭.৬ | -৮.৯ | – |
অন্ধ্রপ্রদেশ | ১০.৩ | ৪৮.১ | ৩ |
উড়িষ্যা | ৭.০ | ৭.০ | ১২ |
কেরালা | ৩.৭ | ৩.২ | ১ |
তেলেঙ্গানা | ১৫.৭ | ১৫.৭ | ৪ |
পঞ্জাব | ৮.৯ | -২৬.৩ | -২ |
মিজোরাম | ১.১ | ১.১ | – |
সিকিম | ০.২ | ০.২ | – |
শ্রুতি নাথানি, দ্য প্রিন্ট
উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নাটকীয় পরাজয় এই নির্বাচনের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। কিন্তু লক্ষ করার মতো বিষয় হল, সে রাজ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট-স্যুইংয়ের হার (৬.৮ শতাংশ) প্রতিবেশী বিহার (৬.৯ শতাংশ) এবং ঝাড়খণ্ড (৭ শতাংশ)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির নতুন করে জেতার মতো জায়গা বিশেষ ছিল না, তার উপর তাকে একটি সুসংবদ্ধ সামাজিক-রাজনৈতিক জোটের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। অন্যদিকে বিহারে বিজেপি মোটের উপর নিজেদের আসন হাতছাড়া হওয়া থেকে ধরে রাখতে পেরেছে, তার প্রধান কারণ হল এর আগেই সেই রাজ্যে তাদের জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ২৩ পার্সেন্টেজ পয়েন্টের কাছাকাছি, তার উপর তারা নিজেদের পক্ষেও একটি সুসংহত জোটের সুবিধা পেয়েছে।
বিজেপির ভোট হারানোর প্রবণতা সবচেয়ে কম দেখা গিয়েছে কর্নাটক, আসাম, দিল্লি এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যে। এই প্রতিটি রাজ্যে তারা নিজেদের প্রায় সব কটি জেতা আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একমাত্র কর্নাটকে তাদের বিরুদ্ধে বিপুল হারে ভোট-স্যুইং কিছু বিশেষ অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সেই রাজ্যে বিজেপিকে বেশ কিছু আসন খোয়াতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় বিজেপির ভোট কমার এই যে পরিসংখ্যান, এর একমাত্র ব্যতিক্রম দেখা গিয়েছে গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়ে— যে রাজ্যগুলিতে দুর্বল বিরোধী পক্ষ বিজেপির ভোটব্যাঙ্কে সামান্যতম প্রভাব ফেলতে পারেনি।
আমরা এই স্রোতের বিপরীত প্রবাহ প্রত্যক্ষ করলাম যে সব রাজ্যে বিজেপি বিরোধী হিসেবে ভোটের ময়দানে নেমেছে। যদিও তার মধ্যে রাজ্য-ভেদে মাত্রার তারতম্য আছে। যেমন তেলেঙ্গানায় হঠাৎ বিআরএস দলের ভোটব্যাঙ্কে ধস নামায়, এবং তাদের কিছুটা পরোক্ষ সাহায্যের কারণে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার সেই রাজ্যে এক ধাক্কায় ১৫.৭ শতাংশ অবধি বেড়ে যেতে পেরেছে। একইভাবে প্রায় ৭ শতাংশ ভোটবৃদ্ধির কারণে ওড়িশায় বিজেপির একতরফা জয় পরিলক্ষিত হয়েছে। বিরাট না হলেও, কমবেশি ৩ শতাংশ ভোটবৃদ্ধির হার কেরলে বিজেপিকে তাদের খাতা খুলতে সহায়তা করেছে।
তামিলনাড়ু এবং পঞ্জাবে তাদের পুরনো সহযোগীদের সঙ্গে বিচ্ছেদের কারণে সেইসব আঞ্চলিক দলের সামাজিক ভিত্তিও বিজেপির পেছন থেকে সরে গেছে। এই রাজ্যগুলিতে আগের তুলনায় বেশি আসনে লড়ার ফলে সামগ্রিকভাবে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার সামান্য বাড়লেও, কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আসনগুলিকে ধরলে দেখা যাবে আদতে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার এই দুই রাজ্যেও বেশ কিছুটা কমে গেছে।
সেই দিক থেকে দেখলে পশ্চিমবঙ্গকেই বরং ব্যতিক্রম বলতে হয়। বিরোধী হিসেবে এই রাজ্যে নির্বাচনে লড়তে নেমেও বিজেপি ভোট বাড়ানোর পরিবর্তে এ-রাজ্যে ১.৩ শতাংশ ভোট খুইয়ে বসেছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তাদের শোচনীয় হার থেকে পশ্চিমবঙ্গে এখনও তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
এই নির্বাচনের মূল প্রশ্ন ছিল, বর্তমান এই যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তা কি আবারও জনতার সমর্থন আদায় করতে পারবে? অবাক হওয়ার কিছু নেই— এই নির্বাচন ছিল বিজেপির নিজের কাছেই নিজেদের লক্ষ্যপূরণের নির্বাচন— ৪০০-র বেশি আসন এবং ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পাওয়ার নির্বাচন। এটা এমন এক নির্বাচন ছিল যেখানে সরকারি সূচি ঘোষণারও অনেক আগে থেকেই বিজেপিকে জয়ী ভেবে নেওয়া হয়েছিল। বিরোধীদের আসনসংখ্যা নিয়ে কারও বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না। জোটসঙ্গীদের কথা তো দূর-অস্ত। কেবল মোদি ও তাঁর দলকে ঘিরেই ছিল ক্ষমতা দখলের সমস্ত আয়োজন-জল্পনা যত।
এখন ভবিষ্যতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, কতদিন অবধি বিরোধী-বিজেপি এভাবে প্রতিষ্ঠান-বিজেপিকে উদ্ধার করতে পারবে? স্থান ও কালের দুয়ের বিচারেই এই ধারা খুব দীর্ঘমেয়াদি হবে মনে হচ্ছে না। নতুন করে রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করতে পারবে এমন প্রায় একটিও রাজ্য বিজেপির হাতে নেই এখন। সব রাজ্যেই কমবেশি তাদের অস্তিত্বের মাত্রা সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছে। আজ নয়তো কাল, প্রাতিষ্ঠানিক বিজেপিকে সেই পথ খুঁজে বের করতে হবে যদি তারা তাদের পরিণতিও প্রাতিষ্ঠানিক কংগ্রেসের মতো হওয়া ঠেকাতে চায়। আর সেই কাজটাও করতে হবে এমন এমন একটা সময়ে যখন মোদি-ক্যারিশমাও ফিকে হতে শুরু করেছে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই নির্বাচন বিজেপিকে স্বস্তিতে রাখবে না।
[1] Yadav, Yogendra. BJP has numbers, not mandate. Indian Express. Jun 7, 2024.
[2] Prakash, Abhinav. A vote for continuity, stability. Indian Express. Jun 7, 2024.
[3] Palshikar, Suhas. The challenge for INDIA. Indian Express. Jun 6, 2024.
[4] ১. সমস্ত তুলনাগুলি করা হয়েছে ২০১৯-এর একই লোকসভা কেন্দ্রগুলির হিসেব অনুযায়ী। ভোট-শতাংশ কদেওয়া হয়েছে শতাংশের হিসেবে এবং ভোট-সুইং পার্সেন্টেজ পয়েন্টে। ২. বিজেপি (প্রতিষ্ঠান): আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, বিহার, চণ্ডীগড়, ছত্তিশগড়, দাদরা ও নগর হাভেলি, দমন ও দিউ, দিল্লি, গোয়া, গুজরাত, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মির (জম্মু, উধমপুর), ঝাড়খণ্ড, কর্নাটক, লাদাখ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মণিপুর, রাজস্থান, ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড। বাকি সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে বিজেপি (বিরোধী)।
[5] মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, লাক্ষাদ্বীপ এবং জম্মু-কাশ্মির (শ্রীনগর, বারামুলা এবং অনন্তনাগ) সারণীতে নেই কারণ বিজেপি এবার এই রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতে প্রার্থী দেয়নি। আর পুদুচেরি সারণীতে নেই কারণ ২০১৯-এ বিজেপি সেখানে লড়েনি।
যোগেন্দ্র যাদব ‘ভারত জোড়ো অভিযান’-এর জাতীয় আহ্বায়ক, রাহুল শাস্ত্রী গবেষক এবং শ্রেয়স সারদেশাই ‘ভারত জোড়ো অভিযান’-এর সঙ্গে যুক্ত একজন সমীক্ষা-গবেষক। এই নিবন্ধটি দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় গত ১১ জুন ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেছেন থেরেস সুদীপ। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জন্য নিবন্ধটি বাংলায় তর্জমা করেছেন অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখকদের মতামত ব্যক্তিগত।