এই বিপন্ন সময়ে আমাদের অরুন্ধতীর পাশে থাকতেই হবে

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 


অরুন্ধতী রায় আজ আর কোনও ব্যক্তিমানুষের নাম নয়। তিনি আসলে এক সমষ্টির চেতনা, এই বিপন্ন সময়ের বিবেক। তাঁকে 'শিরদাঁড়া বিক্রি নেই' বলে পোস্টার লাগাতে হয় না। কোনও সরকারের কাছে তিনি নিজের বিবেক বন্ধক রাখেননি। মোদি জমানার তৃতীয় সংস্করণে তাই তিনি একইভাবে শাসকের কাছে জ্বলন্ত প্রতিস্পর্ধা। সমস্ত হুমকি, কুৎসা, সন্ত্রাস অস্বীকার করে যে মানুষেরা আজও তাদের বিবেকী উচ্চারণে গণতন্ত্র, সমতা, সাম্যের কথা বলে চলেছেন, অরুন্ধতী তাঁদেরই এক অংশ। আমরা নাচার— এই বিপন্ন সময়ে আমাদের অরুন্ধতীর পাশে থাকতেই হবে

 

আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে দিল্লিতে ‘কমিটি ফর রিলিজ অব পলিটিকাল প্রিজনার্স’ আয়োজিত ‘আজাদি: একমাত্র পথ’ শীর্ষক একটি সেমিনারে কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে সওয়াল করার ‘অপরাধে’ বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায় এবং কাশ্মিরের বুদ্ধিজীবী তথা শিক্ষাবিদ শেখ সওকাত হোসেনের বিরুদ্ধে কুখ্যাত ও দানবীয় ইউএপিএ ধারায় মামলা শুরু করার নির্দেশ দিয়েছেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভিকে সাক্সেনা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এই অনুমতি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে এই লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩ এ, ১৫৩ বি, ৫০৫ ধারায় বিচার শুরু করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এই ধারাগুলোর সারার্থ হল বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ ও জাতীয় সংহতির বিঘ্ন ঘটানো। অমৃতকালের তৃতীয় সংস্করণে সরকারের এই সিদ্ধান্ত অপ্রত্যাশিত নয়। সদ্যোসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় যে প্রাথমিক উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে, তা শেষ হলে আমরা উপলব্ধি করতে পারব যে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গঠিত জোট সরকার আগের মতোই ফ্যাসিবাদী পথ অবলম্বন করবে। এই সিদ্ধান্তের পেছনের বার্তাটি স্পষ্ট। মতপ্রকাশের অধিকার, সরকারকে সমালোচনা করার স্বাধীনতাকে একইভাবে দমন করা হবে, নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধ একইভাবে জারি থাকবে।

 

দুই.

অরুন্ধতীর বিরুদ্ধে দেশের ঐক্য বিনষ্টের অভিযোগের মূল কারণ অবশ্য কাশ্মির-বিষয়ক তাঁর ভাবনা। এখানে যে বক্তব্য নিয়ে এত বিরুদ্ধতার কথা বলা হচ্ছে, সেই বক্তৃতাটা পরবর্তীকালে আউটলুক পত্রিকায় (২ ডিসেম্বর, ২০১০) প্রকাশিত হয়। এখানে অরুন্ধতীর বক্তব্যের কোথাও কোনও অস্বচ্ছতা নেই। তিনি পরিষ্কার ভাষায় কাশ্মিরের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের কথা বলেছেন, একই সঙ্গে এ-কথা বলেছেন কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয়। এই বক্তব্যের সঙ্গে কেউ সহমত না হতে পারেন কিন্তু এ কথার ঐতিহাসিক সত্যতা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট যে ভারত ও পাকিস্তান তৈরি হয়, তার কোনওটারই অংশ কাশ্মির ছিল না। কাশ্মিরের ভারতভুক্তি একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সংঘটিত ঘটনা। সেই বিশেষত্বটি স্বীকৃতি পায় সংবিধানে ৩৭০ ধারার মাধ্যমে। একই সঙ্গে এ-কথাও মুছে ফেলার কোনও উপায় নেই যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে আন্তর্জাতিক বিবাদের যে-সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ আছে তার মধ্যে কাশ্মির সমস্যার নাম রয়েছে। আর যে-বক্তৃতাকে নিয়ে এত কথা বলা হচ্ছে সেখানে মণিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরামের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে যেমন আলোচনা রয়েছে, তেমনি সমালোচনা রয়েছে ছত্তিশগড়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের নামিয়ে আনা অপারেশন গ্রিন হান্টের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বড় কথা হল ২০১০ সালে এই বক্তৃতার বিষয়বস্তুকে বিশ্লেষণ করে দিল্লি পুলিশ কোনও মামলা না করার সিদ্ধান্ত  নিয়েছিল। একটা গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্নমতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা আদতে এক স্বৈরাচারী ভাবনার প্রতিফলন।

২০১০ সালে এই বক্তৃতা সংক্রান্ত বিতর্ক যখন তুঙ্গে তখন অরুন্ধতী যে কথাগুলো বলেছিলেন তা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে:

In the papers some have accused me of giving ‘hate speeches’, of wanting India to break up. On the contrary, what I say comes from love and pride. It comes from not wanting people to be killed, raped, imprisoned… Pity the nation that has to silence its writers for speaking their minds. Pity the nation that needs to jail those ask for justice, while communal killers, mass murderers, corporate scamsters, looters, rapists and those who prey on the poorest of the poor, roam free.

এই ভাবনা আসলে এক দীর্ঘ যাত্রার গল্প যাকে স্মরণ না করলে অরুন্ধতীর আখ্যান সম্পূর্ণ হবে না।

 

তিন.

অরুন্ধতী রায়ের কথা আমরা প্রথম জানতে পারি যখন তার প্রথম ইংরেজি উপন্যাস ‘গড অব স্মল থিংস’ বুকার পুরস্কারে সম্মানিত হয়। পুরস্কারের নগদ মূল্য, আন্তর্জাতিক সম্মান আমাদের জানিয়ে দেয় এক নতুন নক্ষত্রের জন্মকথা। এ-পর্যন্ত অরুন্ধতীর গল্পের মধ্যে কোনও অভিনবত্ব নেই। এই চেনা ছকের বাইরে অরুন্ধতী রায় প্রথম আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মধ্যে অংশ নিয়ে। আন্দোলন ততদিনে এক দশক অতিক্রান্ত। জওহরলাল নেহেরু-কথিত ভারতের নতুন মন্দির বড় বাঁধগুলির কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে। এই ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে দেশজুড়ে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অরুন্ধতী বড় বাঁধের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ ধ্বনিত করলেন এক দীর্ঘ প্রবন্ধে (দি গ্রেটার কমন গুড)। একজন সমাজকর্মী ও দায়বদ্ধ সাহিত্যিক হিসাবে তার এই রূপান্তরের ইতিহাস কম রোমাঞ্চকর নয়। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করলেন, নবোকভ বা জয়েসের সাহিত্যকর্মকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন তথ্য, পরিসংখ্যান ও যুক্তির এক আলোকিত বর্ণমালায়। প্রচলিত ও রাষ্ট্র কর্তৃক নির্মিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যে চলমান দীর্ঘ যাত্রার পথিক তিনি, তার শুরু এই আন্দোলনের মধ্যেই। বড় বাঁধকে সূচনাবিন্দু হিসাবে ব্যবহার করে তিনি আরও বহু সামাজিক প্রশ্নকে উপস্থিত করেন। উন্নয়ন কাকে বলে, কাদের জন্য উন্নয়ন, উন্নয়নের নামে বিশ্বব্যাঙ্ক, আইএমএফ-সহ আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানগুলির ভূমিকা, প্রান্তিক ও মূলবাসী মানুষের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস, পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতা— সবই ভাষা খুঁজে পেল তাঁর লেখনীর মধ্যে। সময় যত এগিয়েছে, এই সামাজিক প্রশ্নগুলি আরও ক্ষুরধার হয়েছে অরুন্ধতীর ইস্পাতকঠিন যুক্তির বিন্যাসে। ইংরেজি ভাষার ভারতীয় লেখক হিসাবে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ জীবনকে পাশে রেখে, প্রাতিষ্ঠানিকতার সাহচর্যমুক্ত অরুন্ধতী যাত্রা শুরু করলেন বিপদসঙ্কুল এক অজানা জগতে এবং সামনে উপস্থিত করলেন এক অন্য ভারতবর্ষের কথা। যে ভারতবর্ষের মানুষের দারিদ্র্য, মনুষ্যেতর জীবন যাপন, বঞ্চনা, তদপুরি তাদের মরণ-বাঁচন প্রতিরোধ আমাদের আপাত নিরাপদ সুখী তৃপ্ত জীবনযাপনের স্বার্থান্ধ জগতে অনভিপ্রেত অশান্তি বয়ে আনে। যাকে আমরা পাশ কাটাতে চাই, ঘৃণা করি, এক নিদারুণ হতাশা বা নিয়তিনির্দিষ্ট অনিবার্যতা বলে মেনে নিই। সেই ভারতবর্ষ অরুন্ধতীর কলমে ভর করে আমাদের মগজে ধাক্কা মারে। চেনা ইতিহাস, চেনা নায়ক, চেনা ব্যবস্থার ভিত্তিমূলে নাড়া দিয়ে আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে।

 

চার.

১৯৯৮ সালের মে মাস। পোখরানে সংগঠিত হল দ্বিতীয় পরমাণু বিস্ফোরণ। মরুভূমি কেঁপে উঠল, একই সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় কেঁপে উঠল সারা দেশ। উগ্র জাতীয়তাবাদের স্রোতে ভাসল আসমুদ্রহিমাচল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দাবি করল পোখরানের তেজস্ক্রিয় বালুকণা সারা দেশে প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করার। বোমা নিছক বোমা থাকল না, হয়ে উঠল দেশপ্রেম জরিপ করার একমাত্র মানদণ্ড। পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রচার, বছরে নিয়ম করে হিরোশিমা দিবস পালন বা ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’ স্লোগানের সঙ্গে শান্তির পায়রার মোটিফ— সব এক ধাক্কায় কুপোকাৎ। নির্বাচনী পাটিগণিতের কারণে তথাকথিত প্রগতিশীলরাও মৌন থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই প্রতিকূল সময়ে অসমসাহসের পরিচয় দিয়ে উল্টোদিকে তরী বাইলেন অরুন্ধতী (দি এন্ড অব ইমাজিনেশন)। এই অসামান্য রচনায় একদিকে তিনি পশ্চিমি দুনিয়াকে তাদের কৃতঘ্ন ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, অন্যদিকে পারমাণবিক বোমার মাধ্যমে ভারতীয়ত্ব নির্মানের মৌলবাদী পরিকল্পনাকে প্রত্যাখান করলেন। উচ্চারিত হল এক মুক্তমনা গণতান্ত্রিক মানুষের অমোঘ উক্তি—

আমার বোধের মধ্যে যে পারমাণবিক বোমা-বিরোধিতা রয়েছে তা যদি হিন্দুত্ববিরোধী এবং জাতিবিরোধী হয় তাহলে আমি নাচার। আমি রাষ্ট্র থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছি। আমি নিজেকে এক চলমান স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করছি। আমি এই ধরণীর নাগরিক। আমার কোনও নির্দিষ্ট ভূভাগ নেই। আমার কোনও পতাকা নেই।

এই বক্তব্যকে অনেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন কিন্তু লক্ষ করা উচিত ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটিকে। এ আসলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রত্যেকটি মানুষের কাছে আহ্বান, পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বসুধা গড়ে তোলার।

 

পাঁচ.

৯/১১— ক্যালেন্ডারের এক সাধারণ তারিখ নয় বরং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের প্রতীকচিহ্ন। একদা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট ও স্নেহধন্য ওসামা-বিন-লাদেনের আল-কায়দা গোষ্ঠীর আক্রমণে ভেঙে পড়ল আমেরিকার অর্থনৈতিক প্রভুত্বের প্রতীক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, আক্রান্ত হল আমেরিকান সামরিক শক্তির ম্যাসকট পেন্টাগন। বহু সাধারণ মানুষ মারা গেলেন। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের পর সারা বিশ্বে আমেরিকান আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে— এই ভেবে যারা নিশ্চিত হয়েছিলেন, ৯/১১-র ঘটনা তাদের নাড়িয়ে দিল। এই মর্মান্তিক ঘটনাসঞ্জাত আবেগকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করল আগ্রাসনের নীল নকশা, যার আনুষ্ঠানিক নাম ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। আক্রমণের আশু লক্ষ্য হল গৃহযুদ্ধ-দীর্ণ আফগানিস্তান। মার্কিন রাষ্ট্রপতি পৃথিবীর সব দেশকে হুমকি দিয়ে বললেন— ‘হয় আপনি আমাদের পক্ষে, নয় ওদের পক্ষে।’ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এই তথাকথিত যুদ্ধে সবার কাছে চাইলেন প্রশ্নহীন আনুগত্য, শর্তহীন আত্মসমর্পণ। এই যুদ্ধ-উন্মাদনার সময় মানবিকতা ও গণতন্ত্রে আস্থাশীল যে সমস্ত বিবেকবান মানুষ এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন তার অন্যতম হলেন আমাদের অরুন্ধতী (দ্য অ্যালজেব্রা অব ইনফিনিট জাস্টিস)। পরম প্রত্যয়ে অরুন্ধতী উচ্চারণ করলেন এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার জবাব যুদ্ধ নয় বরং এক বিপন্ন সময়ে প্রয়োজন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ, কাদের নীতির কল্যাণে সন্ত্রাসবাদের জন্ম হয় তার আনুপূর্বিক অবলোকন এবং অবশ্যই ইতিহাসবোধ-প্রাণিত সত্যের অনুসন্ধান।

এই সন্ত্রাসবাদের আরেক মর্মান্তিক অঙ্ক অভিনীত হল ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাই শহরের বুকে। এই সন্ত্রাসী হানার তীব্র নিন্দা করে অরুন্ধতী লিখলেন এক অনবদ্য প্রবন্ধ (নাইন ইজ নট ইলেভেন)। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন যে মুম্বাইয়ের ঘটনা ভারতের ৯/১১ নয়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অমোঘ প্রতিক্রিয়ায় প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের মাটি। রাজনৈতিক নেতা, মিডিয়া পন্ডিত, ইংরেজি শিক্ষিত নাগরিক বা আমজনতা, সবার মুখেই তখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজিগির। অরুন্ধতী এই নির্বোধ যুক্তিমালাকে নাকচ করে সন্ত্রাসের স্থান-কাল-পাত্রকে বিশ্লেষণ করলেন। লস্কর-ই-তৈবার জঘন্য ও মানবিকতা বিরোধী জেহাদের স্বরূপ উন্মোচিত করলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তুলে ধরলেন উগ্র হিন্দু মৌলবাদের কথা, গুজরাত গণহত্যা, কাশ্মিরে নিরবচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও মুম্বাই দাঙ্গার কথা।

 

ছয়.

অরুন্ধতীর লেখায় বার বার উঠে এসেছে সাম্রাজ্যবাদের কথা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এক মেরুর বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রতিভূ কর্পোরেট। মাল্টিন্যাশানাল ও ট্রান্সন্যাশানালের এই যুগে সাম্রাজ্যবাদ যেভাবে সারা পৃথিবীতে লুণ্ঠন চালাচ্ছে, অন্য দেশের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ লুঠ করছে এবং এই লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বর্ণের সরকারগুলোকে আক্ষরিক অর্থে কিনে নিচ্ছে তার এক জ্বলন্ত চিত্র অরুন্ধতীর লেখাতে আমরা পাই। কিন্তু অরুন্ধতী এখানেই থেমে থাকেননি। একজন সমাজসচেতন সাহিত্যিক হিসেবে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধে তিনি অংশ নিতে চান। প্রতিরোধের বাস্তবতা, প্রতিবন্ধকতাকে অনুসন্ধান করতে চান। এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয় দুটি লেখা (পাবলিক পাওয়ার ইন দ্য এজ অব এম্পায়ার এবং কনফ্রন্টিং এম্পায়ার)। কর্পোরেট লুঠের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলির অসীম সম্ভাবনা যেমন তাঁকে আলোড়িত করে তেমনি এই আন্দোলনগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলিও তাঁর নজর এড়ায় না। এক্ষেত্রে এনজিও-দের সম্পর্কে তাঁর নির্মোহ দৃষ্টি উল্লেখযোগ্য:

এনজিওরা জনগণকে রাজনৈতিক প্রতিরোধের রাস্তা থেকে সরিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি নির্ভরতার রাস্তায় নিয়ে যায়। এনজিও রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে এক বাফার জোন হিসাবে কাজ করে। তারা জনগণ ও রাষ্ট্রের মধ্যেকার দ্বন্দ্বে সমঝোতা ও সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে… শেষ বিচারে এনজিওরা দায়বদ্ধ থাকে তাদের আর্থিক অনুদান দেওয়া সংস্থাগুলির কাছে। যে জনগণের মধ্যে তারা কাজ করছে তাদের প্রতি নয়। এই নয়া-উদারবাদী ধনতন্ত্র যত ধ্বংসলীলা চালাবে, এনজিওদের বাড়বাড়ন্ত তত বেশি করে ঘটবে।

 

সাত.

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবি করা দেশের নাগরিক অরুন্ধতী আচরিত গণতন্ত্রকে অণুবীক্ষণের তলায় ফেলেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন কেন স্বাধীনতার এত বছর পরেও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, অর্থাৎ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সামান্য রসদগুলিও বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে। এদেশে পোটা বা ইউএপিএ-র মতো দানবীয় আইনের সাহায্যে সমস্ত মানবাধিকারকে পদদলিত করা হয়। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভে কেন নদী বা অরণ্য বাঁচানোর আন্দোলনকে সমস্বরে প্রগতিবিরোধী বা উন্নয়নবিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অরুন্ধতী সেই অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্রকে আক্রমণ করেন নিজের ভাষায় (লিসেনিং টু গ্রাসহপারস):

এ যেন বর্ণবৈষম্য ও সামন্ততন্ত্রের ভারে জীর্ণ এক প্রাচীন সমাজকে বিরাট এক যন্ত্রের সাহায্যে মন্থন করা হচ্ছে। মন্থনের ফলে সমাজ আজ দুটো স্তরে ভাগ হয়ে গেছে— ওপরে আছে পুরু মাখনের একটা সরু স্তর আর নিচে প্রচুর জল। ওপরের স্তরের মানুষেরাই তৈরি করছে আন্তর্জাতিক পুঁজির কাছে লোভনীয় ‘বাজার’, তারাই কিনতে পারে গাড়ি, সেলফোন, কম্পিউটার, ভ্যালেনটাইনস ডে-র গ্রিটিংস কার্ড আর নিচের জলের স্তরের কোনও গুরুত্বই নেই। তাকে যেমন খুশি ছড়িয়েছিটিয়ে যে কোনও ডোবায় জমিয়ে রাখা যায় এবং শেষে নালানর্দমার মধ্যে দিয়ে দূষিত জলের মতো বার করে দেওয়া যায়।

গণতন্ত্রের অস্ত আলোয় অরুন্ধতীর নতুন পথ চলা শুরু হয় নতুন গণতন্ত্রের খোঁজে।

 

আট.

একজন অ্যাক্টিভিস্ট লেখক হিসাবে তিন দশকের যাত্রাপথে কর্পোরেট মিডিয়া ও সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলির বৃহৎ অংশ তাকে বারংবার ‘মাওবাদী সমর্থক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। নব্বইয়ের দশকে ভারতে কাঠামোগত সংস্কারের নামে ‘উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়ন’-এর নীতি চালু হয়। দেশের প্রাকৃতিক তথা খনিজ সম্পদ, জল-জঙ্গল-জমিনের উপর কর্পোরেট আধিপত্যের নীল নকশার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেন পূর্ব ও মধ্য ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ। প্রতিক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে শুরু করে এক সামরিক অভিযান যার পোশাকি নাম ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। সরকারের দাবি ছিল মাওবাদীদের দ্বারা অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে দখল করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাই এই অভিযানের উদ্দেশ্য। অন্যদিকে আদিবাসী মানুষেরা তাদের জীবন বাঁচাতে প্রতিরোধের পথ বেছে নেয়। এই অনিবার্য গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে অরুন্ধতী লিখলেন— ‘মিঃ চিদাম্বরম’স ওয়ার‘। এই প্রবন্ধে আমরা এক মহাকাব্যিক বিস্তৃতি লক্ষ করি। এই বহু আলোচিত প্রবন্ধে একদিকে দক্ষ আইনজীবীর মতো সমস্যার ভিন্ন প্রেক্ষাপট (খনিজ সম্পদের লুণ্ঠন ও আদিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থা) অরুন্ধতী উপস্থিত করেন ও অন্যদিকে সমস্যা সমাধানের সামরিক পথকে নস্যাৎ করেন। নিরাপত্তাকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সামাজিক ও সুস্থায়ী উন্নয়নের পক্ষে সওয়াল করেন। এখানেই থেমে না গিয়ে অরুন্ধতী এক অনুসন্ধিৎসু সমাজকর্মী হিসেবে পৌঁছে যান মধ্যভারতে মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে। সশস্ত্র প্রতিস্পর্ধার যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া ছিল বিপজ্জনক কারণ সেখানে প্রতিমুহূর্তে এনকাউন্টারে মারা যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিপিবদ্ধ করেন (ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস) যা এক নতুন রাজনৈতিক স্বপ্নের কথা বলে।

 

নয়.

২০১৪ সাল থেকে যখন ভারতে অমৃতকাল শুরু হল, যখন ক্ষমতার অলিন্দ থেকে প্রকাশ্যে কলমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল, তখনও কিন্তু অরুন্ধতী শিরদাঁড়া সোজা রেখে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ভারতরাষ্ট্রের চরিত্র বদলের চেষ্টার বিরুদ্ধে লিখলেন:

আজকের ভারতবর্ষে আমরা ‘পোড়ামাটি নীতি’-র সমতুল্য পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলেছি। বহু বছর ধরে গড়ে তোলা সব প্রতিষ্ঠান আজ ধ্বংসের মুখে, যা আমাদের স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। এক নতুন প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে যাদের ভাবনাচিন্তাকে পুরোপুরি এক ছাঁচে ঢেলে গড়ে তোলা হচ্ছে। দেশের ইতিহাস বা সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা সম্বন্ধে যাদের কোনও ধারণাই নেই। প্রায় ৪০০ টিভি চ্যানেল, অসংখ্য ওয়েবসাইট এবং সংবাদপত্রের সমন্বয়ে তৈরি গণমাধ্যমের সাহায্যে বর্তমান শাসকরা নিরন্তর ধর্মান্ধতা ও ঘৃণার পরিমণ্ডল তৈরি করেছে।

রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে রাজধানী দিল্লি যখন রক্তাক্ত তখন অরুন্ধতীর নির্ভীক উচ্চারণ আমরা শুনতে পাই:

None of this alters the fact that the attack was begun by lumpen mobs chanting ‘Jai Sri Ram’ backed by the apparatus of this new nakedly fascist state. Notwithstanding these slogans, this is not what people like label a Hindu Muslim riot. It is a manifestation of the ongoing battle between fascists and anti-fascists— in which Muslims are the first among the fascists’ ‘enemies’. To call it a ‘riot’ or ‘danga’, or ‘left’ vs ‘right’ or even ‘right’ vs ‘wrong’ as many are doing, is dangerous and obfuscating.

একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এই তমসাঘন সময়ে মানুষের প্রতিরোধের স্বপক্ষে তিনি রাস্তায় নেমেছেন। ভাতিন্দায় বিকেইউ (একতা উরগাহন)-এর সভায় ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে সংহতি জানাতে গিয়ে অরুন্ধতী রাজনৈতিক দল ও কর্পোরেট শক্তির অশুভ যোগাযোগকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় উন্মুক্ত করেন:

Before every election, politicians tell you they are with you, but soon after they get cozy with the corporate sector. If we look into the history, we see that the govt had been providing benefits to some corporates at the cost of the people.

এনআরসি ও সিএএ-বিরোধী আন্দোলনেও অরুন্ধতী ছিলেন সামনের সারিতে।

 

দশ.

অরুন্ধতী রায় আজ আর কোনও ব্যক্তিমানুষের নাম নয়। তিনি আসলে এক সমষ্টির চেতনা, এই বিপন্ন সময়ের বিবেক। তাঁকে ‘শিরদাঁড়া বিক্রি নেই’ বলে পোস্টার লাগাতে হয় না। কোনও সরকারের কাছে তিনি নিজের বিবেক বন্ধক রাখেননি। মোদি জমানার তৃতীয় সংস্করণে তাই তিনি একইভাবে শাসকের কাছে জ্বলন্ত প্রতিস্পর্ধা। সমস্ত হুমকি, কুৎসা, সন্ত্রাস অস্বীকার করে যে মানুষেরা আজও তাদের বিবেকী উচ্চারণে গণতন্ত্র, সমতা, সাম্যের কথা বলে চলেছেন, অরুন্ধতী তাঁদেরই এক অংশ। আমরা নাচার— এই বিপন্ন সময়ে আমাদের অরুন্ধতীর পাশে থাকতেই হবে। আমরা তো তিমিরবিনাশী হতে চাই। পাশে আছি কমরেড।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...