শব্দ-আর্তনাদ, সোচ্চার

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় 

 


চপিং বোর্ডে সব্জি কেটে রান্না চাপানোর মতোই মুনরো অক্ষরছুরিতে ফালাফালা করেছেন আধুনিক মনের দ্বিচারিতা-অনৈতিকতা-যান্ত্রিকতা। শব্দস্থাপত্য। শব্দ-সোনোগ্রাফি। বিশ্লেষণী অক্ষর-অটোপসিই তো মুনরোর সাবলাইমিটি, মাহাত্ম্য-কৌলিন্য-কথা

 

 

অক্ষরস্থাপত্যের এডুইন ল্যুটেন্স— তিনিই তো— কল্পনির্মিতির চেকভ-নারী: অভাবনীয় এক অক্ষর-ইকেবানাইস্ট। প্রত্নতাত্ত্বিক হেন— খুঁড়ে তোলেন শব্দের তড়িৎগর্ভতা, অর্থ-প্রাচীনত্ব, অনাধুনিক (অ)-মানবিকতার স্বত্ব-অস্তিত্ব-পরিচয়। গুড আর গ্রেট: পার্থক্য খুঁজে পেতে চায় মন, নজরে পড়ে প্যারিস রিভিউ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার; অ্যালিস জানিয়েছিলেন—

একমাত্র যে-জিনিস দিয়ে জীবনকে গড়ে তুলতে চেয়েছি তা হল লেখা। … অন্য আর-এক জীবন যাকে আমি ভাবতে পারি— [তা হল] পাণ্ডিত্যপূর্ণ জীবন— আমার আদর্শ।

 

সাহিত্যে নোবেল, ম্যান বুকার, কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজ, ’ও হেনরি’ অ্যাওয়ার্ড, ত্রিলিয়াম বুক অ্যাওয়ার্ড (তিনবার), কানাডার গভর্নর জেনারেলের সাহিত্য পুরস্কার, গিলার প্রাইজ ইত্যাদি-প্রভৃতি বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন অ্যালিস লেডলও মুনরো। চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর লেখা গল্প ‘দি বিয়ার কেম ওভার দি মাউন্টেন’। সম্মানিত হয়েছেন ‘আমেরিকান অ্যাকাদেমি অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস্‌’-এ। সুপ্রশংসিত। পেয়েছেন ‘নাইট অফ দি অর্ডার অফ আর্টস্‌ অ্যান্ড লেটারস্‌’ সম্মান। অ্যালিস মুনরোর নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা চালু করেছেন কানাডিয়ান সরকার— ২০১৪-য়। হ্যাঁ, শুরুতেই জানিয়ে রাখি যে উইকিপিডিয়া বা ব্রিটিশ সাংবাদিক রবার্ট থ্যাকারের মতো আমার নজরেও তিনি মুনরো, মানরো নন। মানরো-র মধ্যে কেমন যেন অচেনা যান্ত্রিকতা, বৈয়াকরণিক নিয়মসর্বস্বতা।

আধুনিক মানুষের মন জটিল। ব্যাখ্যাতীত ও অচেতন। মানবীয় সম্পর্কের আপাত-তুচ্ছ বিষয়গুলো কীভাবে জটিল হয়ে ওঠে— সেগুলোকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে মুনরোর শব্দ-আর্তনাদ। ফ্রয়েডীয় ধাঁচে বিশ্লেষণ করেছেন অবচেতন-সচেতনতার গূঢ় অন্তর্দ্বন্দ্ব: যুক্তিবাদিতার পিঠোপিঠি কল্পনাপ্রবণতার দ্বিত্ব-দ্বৈবিধ্য। তাই তিনি সাবলাইম, তাই তিনি সুমহান, তাই তিনি আবিশ্ব-স্বীকৃত। তাঁর লেখালেখি, মনন-চিন্তন যেন কোনও তাত্ত্বিক পদ্ধতির বর্ণনার মতো ওয়েল-প্রোগ্রামড সুনির্দিষ্টতা নয়। বরং অন্টারিও কানাডার আধা-গ্রামীণ পটভূমি-ভিত্তিক মধ্যবিত্তীয় অমুচ্য সারল্য। সুখ্যাত হয়েছেন, বিবাহবিচ্ছিন্নাও বটে, তবু পারিবারিক পদবি ‘লেডলও’ নয়, তাঁর যশোগরিমার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ি্য়ে রয়েছে প্রথম বিবাহবন্ধন-সূত্রে প্রাপ্ত মুনরো পদবিটি, ১৯৫২-১৯৬৩ পর্যায়ের পশ্চিম ভ্যাঙ্কুভারের জীবন-যৌথতা।

‘পর্বত পেরোনো ভালুক’ গল্পটির বুনট, প্রকরণ ও প্রধান তিনটি চরিত্র— গ্রান্ট, ফিয়োনা ও অব্রের ত্রিমুখী আন্তঃ-সম্পর্কের টানাপোড়েন, জটিলতা এবং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বস্তুত অনন্য-সাধারণ। কলির কেষ্ট গ্রান্ট-কে জড়িয়ে নারী-সম্পর্কের বহুধা-ব্যাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েও লেখিকা জানিয়েছিলেন যে বউ ফিওনার প্রতি গ্রান্ট অনুরক্ত— ‘ফিওনার প্রতি ওর ভালবাসা কমেনি কখনও। একরাতের জন্যও গ্রান্ট তাকে ছেড়ে থাকেনি।’ এক মাস বাদে নার্সিংহোমে ফিওনার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় পুরনো দিনগুলিতে যেরকম হত তেমন এক শিরশিরে অনুভূতিতে ভরা ছিল গ্রান্টের মন। এক ফাঁকে লেখিকা জানিয়েছেন ফিওনার বয়স সত্তর। নার্সিংহোমে ফিওনা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে গ্রান্টেরই সমবয়সী অব্রের প্রতি— যার পরিচিতি গল্পকার এভাবে দিয়েছেন— ‘ওর মধ্যে শক্তিশালী, নিরুৎসাহী বয়স্ক এক ঘোড়ার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু ফিওনার বিষয়ে নিরুৎসাহী নয়। অব্রে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ফিওনা ভেঙে পড়ে। ফিওনার এই নতুন বন্ধুত্বকে সমর্থন জোগাতে চায় গ্রান্ট। মাঝমাঝে তাই অব্রের সঙ্গে ফিওনার মুলাকাত সম্ভব করে তোলার লক্ষ্যে অব্রেকে ফিওনার কাছে নিয়ে আসার জন্য অব্রের স্ত্রী মারিয়ানকে প্রস্তাব দেয় গ্রান্ট; মারিয়ান অস্বীকার করে। কিন্তু পরবর্তীকালে মেসেজ করে গ্রান্টকে আমন্ত্রণ জানায়। সম্পর্কের নতুন সম্ভাবনা উঁকি দেয় গ্রান্টের মনে। মারিয়ন যদি রাজি হয়, বিকশিত হয় যদি সম্পর্ক, তবে অব্রেকে হয়তো নার্সিংহোমে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে ওর স্ত্রী মারিয়ন। অব্রে-গ্রান্ট-ফিওনা, বস্তুত, সত্তরোর্ধ্ব সবাই। এই গল্পের বিষয়বস্তু হল বয়স্ক মানুষের রাগ-অনুরাগ-প্রণয়–আত্মীয়তা-পারস্পরিক ছন্দোবন্ধনের কুহেলি-কুয়াশা। এবং দাম্পত্য সম্পর্কের বিশ্বস্ততা ও যৌনসম্পর্কের ইতিকথা।

 

চারটে কোণ নিয়েই আমাদের ঘরগুলো গড়ে ওঠে। ‘পর্বত পেরুনো ভালুক’ গল্পে অবিশ্বস্ততার চারটি কোণের নাম: গ্রান্ট-মারিয়ান-অব্রে-ফিওনা। নিবিড়পাঠে প্রশ্ন জাগবেই ‘ভালুক’টি কে? ‘কেম ওভার’ ক্রিয়াপদটির অর্থই বা কী? ভিন্ন ভিন্ন আরও কয়েকটি অর্থের পাশাপাশি কলিনস ডিকশনারি-কৃত ‘কেম ওভার’-য়ের অর্থ হল ‘to change allegiance’— যা এই গল্পের সারাৎসারের সঙ্গে খুবই মানানসই। উল্লেখনীয় যে ২৪/৫/২৪ তারিখে প্যারিস রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত এক গদ্যে এ-সময়ের প্রখ্যাত গল্পকার স্টার্লিং হোলি হোয়াইট মাউন্টেন লিখেছেন: ‘I must go to Proust to find someone with her emotional and relational intelligence… and I must go to Chekhov to find someone whose stories… leave me as stripped and ragged and human.’ এবং গবেষক মালা শর্মার মতে শিল্পী হিসাবে তাঁর প্রধান অবদান/(শক্তি) হল অনন্য উপায়ে, সততার সঙ্গে, জীবনের সত্যনিষ্ঠ রূপায়ণ। চপিং বোর্ডে সব্জি কেটে রান্না চাপানোর মতোই অক্ষরছুরিতে ফালাফালা করেছেন আধুনিক মনের দ্বিচারিতা-অনৈতিকতা-যান্ত্রিকতা। শব্দস্থাপত্য। শব্দ-সোনোগ্রাফি। বিশ্লেষণী অক্ষর-অটোপসিই তো মুনরোর সাবলাইমিটি, মাহাত্ম্য-কৌলিন্য-কথা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4802 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...