আশিস গুপ্ত
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে ধর্ম ও রাজনীতির ধ্বংসাত্মক সংমিশ্রণে চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় জনতা পার্টি। এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও দল এদের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। কংগ্রেস নেতারা এর মোকাবিলা করতে গিয়ে নিজেদের হিন্দু বা ধার্মিক প্রমাণ করার জন্য মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ান। লাভ নেই। এতে হিতে বিপরীত হয়। কংগ্রেসকে অতীত ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণের বিরোধিতা করতে হবে। ধর্মকে বাজারে টেনে এনে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা সমাজবিরোধী কাজ। বিজেপি নেতারা অস্ত্রশস্ত্র হাতে উশৃঙ্খল যুবকদের রামনবমীর মিছিল করতে উৎসাহিত করবে, এটাই ওদের রাজনীতির জিয়নকাঠি। এর বিরোধিতায় কি কংগ্রেস আর একটা রামনবমীর মিছিল করবে, নাকি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের দাবি নিয়ে মিছিল করবে? হারানো জমি ফিরে পেতে হলে বেকার যুবকদের মিছিলই সংগঠিত করতে হবে
গভীর অন্ধকার খাদের কিনারা থেকে শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেসকে লড়াইয়ের ময়দানে ফিরিয়ে আনল ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন। ভোটের ফল প্রকাশের পরে স্বাভাবিকভাবেই ভারতের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, বিশেষ করে ২০১৪-পরবর্তী সময়ে সংগঠনকে প্রাসঙ্গিক করে রাখার প্রশ্নে কংগ্রেসকে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার রাশ হাতে নিয়েই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গঠনের। আর সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে আদর্শহীন, ক্ষমতালোভী নেতারা কংগ্রেস ছেড়ে মোদি-শাহর বিজেপির কোলে আছড়ে পড়েছে। দলত্যাগের এই হিড়িকে ইডি, সিবিআই এর মতো কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির অবদানও অনেকটাই। গণতন্ত্র মজবুত করতে শক্তিশালী বিরোধীর উপস্থিতি নিশ্চিত করার সর্বজনীন তত্ত্বকে নস্যাৎ করে মোদি-শাহ জুটি শুধু কংগ্রেসেই নয়, ভাঙন ধরিয়েছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলে, এমনকি পরিবারেও। কিন্তু মূল লক্ষ্য ছিল কংগ্রেস। কারণ দেশের রাজনীতিতে বিরাজমান সংসদীয় দলগুলি নিজেদের নামের সঙ্গে ‘সর্বভারতীয়’ যুক্ত করলেও আসলে তারা একটি বা দুটি রাজ্যকেন্দ্রিক। ঐতিহাসিক কারণেই একমাত্র কংগ্রেসই সর্বভারতীয় দল, যার উপস্থিতি আছে দেশের প্রায় সর্বত্র। স্বাভাবিক কারণেই মোদি-শাহ প্রধান শত্রু হিসেবে কংগ্রেসকেই বেছে নিয়ে আক্রমণ শানিয়ে গেছেন। সেই আক্রমণে গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে শালীনতা বজায় থাকেনি। স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে ছুরি মারার আদর্শে প্রতিপালিত একটি দল নিয়মিত কংগ্রেসকে অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে একনায়কত্বের ঔদ্ধত্যে।
বিজ্ঞানমনস্ক বিশ্লেষণ অনুযায়ী গত কয়েক দশকজুড়ে কংগ্রেসের এই বিপর্যয় ছিল অবশ্যম্ভাবী। তবে শুধু কংগ্রেস নয়, এ-ধরনের বিপর্যয় অন্য শাসক দলের জন্যেও অবশ্যম্ভাবী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সুদীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেস একচ্ছত্রভাবে শাসনের রাশ নিজের হাতে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। এই সময়ে যেমন দেশের উন্নয়ন হয়েছে, তেমনই দারিদ্র্য, অনাহার, বেকারত্ব, নিরক্ষরতা এবং দুর্নীতি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। পাশাপাশি ক্ষমতার অলিন্দে দীর্ঘ বিচরণে কংগ্রেস সংগঠনে জন্ম নিয়েছে নেতৃত্বের বহুমুখী সঙ্কট, যার মধ্যে রয়েছে গান্ধি পরিবারের আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ দলাদলি, নেতৃত্বের অকার্যকর পরিবর্তন এবং সাংগঠনিক দুর্বলতা।
গান্ধি পরিবারের আধিপত্য দলের শক্তি এবং দুর্বলতা দুই-ই ছিল। পরিবারের উত্তরাধিকার এবং ক্যারিশমা দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও, পরিবারের বাইরে একজন দৃঢ়, ক্যারিশম্যাটিক নেতার অভাব বা নেতৃত্বের শূন্যতা দলের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধকে তীব্র করেছে। এই মতবিরোধ ছিল শীর্ষ থেকে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত। ফলে ঘুণ ধরে যায় শতাব্দীপ্রাচীন সংগঠনে। শাসনক্ষমতায় থাকলে আত্মতৃপ্ত নজরে নেতৃত্ব এই ঘুণ ধরাটা বুঝতে পারেন না। কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো প্রায়শই সেকেলে এবং অদক্ষ বলে সমালোচিত হয়। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং তৃণমূল স্তরের কর্মীদের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে, যা ধামাচাপা দেওয়া হয় অকার্যকর সমাবেশ এবং প্রচারকৌশলের দিকে পরিচালিত করে। মধ্যপন্থী দল হিসেবে কংগ্রেস ক্রমবর্ধমান দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদ এবং আঞ্চলিক রাজনীতির উত্থানে তার মতাদর্শকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ হয়েছে। যার ফলে ভোটারদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কংগ্রেস থেকে মুখ ঘুরিয়েছে তার পরম্পরাগত সমর্থকরা।
‘৯০-এর দশকে মণ্ডল এবং কমণ্ডল রাজনীতি ভারতের রাজনৈতিক পটভূমিকে উল্লেখযোগ্যভাবে পুনর্নির্মাণ করেছে। কংগ্রেসের রাজনৈতিক কৌশল এবং ভোটারদের সঙ্গে তার সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। জাত-ভিত্তিক রাজনীতির কারণে কংগ্রেসের ঐতিহ্যবাহী ভোটার-ভিত্তির খণ্ডিত হওয়া এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান দলকে একটি জটিল এবং বিকশিত রাজনৈতিক পরিবেশে ঠেলে দেয়। নতুন প্রেক্ষাপটে এগিয়ে চলা, সামাজিক ন্যায়বিচারের সমস্যাগুলিকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা, তার ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা এবং একটি সুসংহত নেতৃত্ব উপস্থাপন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে কংগ্রেস। মণ্ডল কমিশনের বাস্তবায়নের ফলে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলগুলির উত্থান ঘটে যা ওবিসি এবং দলিতদের স্বার্থের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। জনতা দল, রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি), সমাজবাদী পার্টি (এসপি), এবং বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি)-র মতো দলগুলি বিশেষ করে উত্তর ভারতে, কংগ্রেসের ঐতিহ্যগত ভোটার-ভিত্তিকে নিজেদের পক্ষে টেনে নিয়ে যায়। আইএনসিকে জাতিগত গতিশীলতার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছিল। তবে ওবিসি এবং দলিতদের মধ্যে সমর্থন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। কারণ ওবিসি ও দলিতরা তাদের দাবি নিয়ে সোচ্চার বা আরও বেশি মনোযোগী দলগুলির সঙ্গে সারিবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। জাতপাতের এই রাজনীতির সমান্তরালভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং রাম জন্মভূমি আন্দোলনের প্রতি বিজেপির ফোকাস ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সঙ্গে অনুরণিত হয়েছিল, বিশেষ করে হিন্দি বলয়ে। এই ধর্মীয় মেরুকরণ ভোটারদের একটা বড় অংশকে কংগ্রেসের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। হিন্দু ভোট একত্রিত করার ক্ষেত্রে বিজেপির সাফল্য দেশকে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে পরিচালিত করেছিল, যা কংগ্রেস কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি। সাম্প্রদায়িক মনোভাব বেড়ে যাওয়ায় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে পার্টি জোর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল।
রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নানা পালাবদলে শতাব্দীপ্রাচীন কংগ্রেসের ভিত যেমন আলগা হয়েছে, তেমনই গোটা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির দায় সজোরে ধাক্কা দিয়েছে ওই দলকে। যদিও ২০০৯-২০১৪ সালে ইউপিএ-র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিজেপির প্রচার আন্দোলন আমি মনে করি, কল্পনাপ্রসূত মিথ্যাচারের আখ্যানের উপর ভিত্তি করেই সংঘটিত হয়েছিল। বিজেপির আগ্রাসী মিথ্যা প্রচারকে মানুষ সত্য হিসেবে মেনে নিয়েছিল দুর্নীতি রোধে কংগ্রেসের চূড়ান্ত ব্যর্থতার কথা স্মরণ করে। মোদি-শাহ নেতৃত্বাধীন নতুন বিজেপির সেই আগ্রাসী মিথ্যা প্রচারের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল কংগ্রেস। এ সবই আজ ইতিহাস। কিন্তু বর্তমান ও ভবিষ্যতের আলোচনায় ইতিহাসের বিশ্লেষণ এবং তার শিক্ষা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের পরে প্রশ্নটা স্বাভাবিকভাবেই উঠছে, তবে কি কংগ্রেস ঘুরে দাঁড়াচ্ছে? অথবা, কংগ্রেস কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এখনই সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে ২০২৩ সালের শেষভাগেই, অর্থাৎ সদ্যোসমাপ্ত সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগেই পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল। সেই নির্বাচনে অনেকেই মনে করেছিলেন অন্তত তিনটি রাজ্য ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ক্ষমতায় ফিরবে এবং তেলেঙ্গানায় লড়াইয়ে আছে কংগ্রেস। এবং একটি অনুষ্ঠানে রাহুল গান্ধি নিজেও এই ফলাফলের আশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তিনটি রাজ্যেই হেরেছিল কংগ্রেস, তেলেঙ্গানায় জিতেছিল। এই বিষয়টা এ-কারণেই উল্লেখ করলাম এটা বোঝানোর জন্য যে তৃণমূল স্তরে ভোটারদের মন বোঝার জন্য যে সাংগঠনিক শক্তি বা তৎপরতা থাকার প্রয়োজন তা এখন আর কংগ্রেসের নেই। মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে দলের কোন শীর্ষনেতার বিজেপির গোপন বোঝাপড়ায় দলের ভরাডুবি হল তা কংগ্রেস হাইকমান্ড বুঝতে পারল ফল প্রকাশের পর। অর্থাৎ, নিচুতলার কর্মী, জেলা ও রাজ্যস্তরের নেতাদের সঙ্গে কংগ্রেস শীর্ষনেতাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। লোকসভা ভোটের সাফল্যে উজ্জীবিত কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব সেই বিচ্ছিন্নতা কাটাতে কাজ শুরু করল কিনা, তা কিছুটা বোঝা যাবে এই বছরেই, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনী ফলাফলে।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে কংগ্রেসের যে উত্থান, তা দলের সাংগঠনিক শক্তির অবদান নয়। বিজেপির ঔদ্ধত্য, মিথ্যাচার এবং নেতিবাচক পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত রায়ের ফল কংগ্রেসের লড়াইয়ে ফিরে আসা। এই স্বতঃস্ফূর্ততা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। সংসদীয় গণতন্ত্রে টিকে থাকতে হলে সমর্থনের ভিত্তিটাকে শক্তপোক্ত করতে হবে। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মিথ্যা আখ্যান এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণপন্থী বিজেপির যে সাফল্য তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। বর্তমান অবস্থায় বামপন্থীরা দেশজুড়ে বিজেপির বিরুদ্ধে এমন একটা সার্বিক লড়াইয়ে সক্ষম নয়, যে লড়াই দক্ষিণপন্থীদের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে মধ্যপন্থী কংগ্রেসের সামনেই সুযোগ রয়েছে প্রধান বিরোধী শক্তিতে পরিণত হওয়ার। এবং ২০২৪-এর নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে সেটা ভীষণভাবেই সম্ভব। ভারতের তরুণ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী জনগোষ্ঠী নতুন স্বপ্নময় আখ্যান এবং নেতৃত্বের সন্ধানেই নরেন্দ্র মোদির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। সেই স্বপ্ন ভাঙতে শুরু করেছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই জনসংখ্যার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে হবে কংগ্রেসকে। আর এটা করতে কংগ্রেসকে একটি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বকে সামনে নিয়ে আসতে হবে বর্ষীয়ান নেতাদের ‘মার্গদর্শকমণ্ডলী’-তে পাঠিয়ে দিয়ে। নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বই পারবে তরুণদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনতে। অনেকেই বলেন গান্ধি পরিবারের আধিপত্য কংগ্রেসকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটা তাঁরাই বলেন, যাঁদের কংগ্রেসের অন্দরমহল সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। গান্ধি পরিবার ও কংগ্রেসের মধ্যে বিচ্ছেদ হলেই দল টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। তবে সংগঠনের অভ্যন্তরে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ খুবই জরুরি অথবা বলা যেতে পারে, সুস্থতার লক্ষণ। কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ ভারতের পরিবর্তিত রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা মোকাবিলা করা, দলের মতাদর্শগত অবস্থানকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার মতো তাৎপর্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলি গ্রহণের মধ্যে দিয়ে ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার এবং পুনরুদ্ভাবনের সম্ভাবনা কংগ্রেসকে ভারতীয় রাজনীতিতে তার অবস্থান পুনরুদ্ধার করার সুযোগ দেবে।
কংগ্রেস সেই সুযোগ কতটা সফলভাবে কাজে লাগাতে পারবে তা ভবিষ্যৎ বলবে। তবে একটা কথা বলা যেতেই পারে, রাহুল গান্ধির সাম্প্রতিক উদ্যোগ ও পদক্ষেপে কংগ্রেসের মধ্যে এবং বাইরে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। বিজেপি শীর্ষ-নেতৃত্বের ঔদ্ধত্য, অহঙ্কারপূর্ণ মন্তব্য প্রত্যাখ্যান করে মানুষ রাহুল গান্ধিকে সমীহ করে চলার পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে। রাহুল গান্ধির ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ এবং ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’ কংগ্রেসের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ। যার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল বিভাজনমূলক রাজনীতির উত্থানকে মোকাবিলা করা, দলকে পুনরুজ্জীবিত করা এবং দেশের মানুষের সমস্যাগুলি নিয়ে সরাসরি কথা বলা। প্রথম যাত্রার সময়— সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে জানুয়ারি ২০২৩, রাহুল গান্ধি ১২টি জনসভা, ১০০টিরও বেশি যাত্রাপথেই ছোট সভা এবং ১৩টি প্রেস কনফারেন্সে ভাষণ দিয়েছিলেন। ১২টি রাজ্য এবং দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৭৫টি জেলা এবং ৭১টি লোকসভা কেন্দ্র জুড়ে ৪,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি হেঁটেছিলেন রাহুল।
কন্যাকুমারী থেকে শুরু হয়ে কাশ্মিরে শেষ হওয়া পদযাত্রা ৭১টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে কংগ্রেস এবার ৫৬টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং ২৩টিতে জিতেছে। ২০১৯ সালে, কংগ্রেস এই আসনগুলির মধ্যে ৬৫টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং ১৫টি জিতেছিল৷ এদিকে, কংগ্রেসের ইন্ডিয়া ব্লক মিত্ররা এবার এই আসনগুলির মধ্যে ১৪টি আসনে লড়াই করেছে এবং ৬টি জিতেছে৷ ২০১৯ সালে, মিত্ররা ৭১টি আসনের মধ্যে চারটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং দুটি জিতেছিল। শ্রীনগর (জম্মু-কাশ্মির) এবং বাগপত (উত্তরপ্রদেশ) নির্বাচনী কেন্দ্রে ২০১৯ সালে ইন্ডিয়া ব্লকের কোনও দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। দ্বিতীয় যাত্রা এই বছরের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত ৮২টি লোকসভা কেন্দ্র কভার করেছে। মণিপুরের ইম্ফল থেকে মহারাষ্ট্রের মুম্বাই পর্যন্ত প্রায় ৬৭১৩ কিমি, বেশিরভাগ বাসে ভ্রমণ করেছিলেন রাহুল। এই ৮২টি আসনের মধ্যে, কংগ্রেস ৪৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং ১৭টি জিতেছে। ২০১৯ সালে, কংগ্রেস ৭১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ৬টিতে জয়লাভ করেছিল৷ এবার, দল তার সহযোগীদের ৩৩টি আসন দিয়েছে যারা ১৮টি জিতেছে। পাঁচ বছর আগে এই দলগুলো এই আসনগুলোর মধ্যে ১০টিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটিও জিততে পারেনি। এই তথ্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে তৃণমূল স্তরে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে পারলেই কংগ্রেস তার হারানো জমি ফিরে পাবে। ২০২৪-এর নির্বাচনী ফলাফল সেই ঘোষণাই করেছে।
আর একটা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লেখা শেষ করব। বিজেপির পদ্ধতি অনুকরণ করে মোদি-শাহকে মাত দেওয়া যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রাজনীতিতে ধর্ম ও রাজনীতির ধ্বংসাত্মক সংমিশ্রণে চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় জনতা পার্টি। এখনও পর্যন্ত অন্য কোনও দল এদের ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। কংগ্রেস নেতারা এর মোকাবিলা করতে গিয়ে নিজেদের হিন্দু বা ধার্মিক প্রমাণ করার জন্য মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে বেড়ান। লাভ নেই। এতে হিতে বিপরীত হয়। কংগ্রেসকে অতীত ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে ধর্ম ও রাজনীতির মিশ্রণের বিরোধিতা করতে হবে। ধার্মিক হওয়াতে কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু ধর্মকে বাজারে টেনে এনে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা সমাজবিরোধী কাজ। বিজেপি নেতারা অস্ত্রশস্ত্র হাতে উশৃঙ্খল যুবকদের রামনবমীর মিছিল করতে উৎসাহিত করবে, এটাই ওদের রাজনীতির জিয়নকাঠি। এর বিরোধিতায় কি কংগ্রেস আর একটা রামনবমীর মিছিল করবে, নাকি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের দাবি নিয়ে মিছিল করবে? হারানো জমি ফিরে পেতে হলে বেকার যুবকদের মিছিলই সংগঠিত করতে হবে। মণ্ডল-কমণ্ডল রাজনীতির পাকে পড়ে কংগ্রেসের জনভিত্তিতে যে ধস নেমেছিল, তা আবার নতুন করে গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে রাহুল গান্ধির ‘জাতিগণনা’ বা ‘বর্ণসুমারি’র প্রস্তাবে। একটি বর্ণসুমারি বিভিন্ন বর্ণের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আপডেট এবং সঠিক তথ্য সরবরাহ করবে, ইতিবাচক পদক্ষেপ, সংরক্ষণ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার কর্মসূচির জন্য আরও কার্যকর নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে। বর্ণসুমারি থেকে পাওয়া তথ্যগুলি সম্পদের আরও ভাল বরাদ্দ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নীত করার লক্ষ্যে কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে গাইড করতে পারে। অমিত শাহ মুখে যাই বলুন না কেন, বিজেপি বর্ণসুমারিকে ভয় পায়, যা শুধুমাত্র প্রতিটি বর্ণের জনসংখ্যাই নয়, এর সদস্যদের আর্থ-সামাজিক প্রোফাইলও প্রদান করবে। বিজেপির শঙ্কা বর্ণসুমারিতে প্রকাশ হয়ে যাবে যে এক দশক ধরে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার পরে, উচ্চবর্ণের লোকেরা এখনও অসমভাবে ক্ষমতা, অবস্থান এবং সম্পত্তি ব্যবহার করে চলেছে। কংগ্রেস বর্ণসুমারির দাবিতে অটল থাকলে তাদের জনভিত্তি আবার শক্ত জমি খুঁজে পাবে।