স্বাধীনতা নিয়ে এক বন্দির অনুধ্যান

গৌতম নওলাখা

 


যাঁরা বন্দি হয়েছেন, এবং যাঁরা হননি, সবাইকেই এখন এমন একটা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন এবং স্বাধীনতা সঙ্কুচিত, তাদের স্বর রুদ্ধ। আমি জেলে গেছি, কারণ আইনটাই (ইউএপিএ) সেরকম। আমাকে এমন একটি অপরাধে জড়ানো হল যে অপরাধে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমাকে কোনওরকম বিচার বা সাজা ঘোষণার তোয়াক্কা না করেই জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ‘অধিকার’-এর ওপর আক্রমণ এবং ‘কর্তব্য’-কে আবাহন— এইভাবেই বিষয়টা প্রতিভাত হয়েছিল আমার কাছে। ভেবে দেখুন, নাগরিক সমাজকে যখন চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধক্ষেত্র বলে অভিহিত করা হয়, তা কি যারা সরকারি ভাষ্য বিনা বাক্যব্যয়ে মানতে অস্বীকার করবে তাদের দমন করা হবে— এই ভবিষ্যদ্বাণীই করে না?

 

…না, স্বাধীনতা একা একা মরে না। তার সঙ্গে সঙ্গেই ন্যায়বিচার নির্বাসিত হয়, দেশ পীড়ায় জর্জরিত হয়, এবং সারল্য প্রতিদিন নতুন নতুন উপায়ে ক্রুশবিদ্ধ হতে থাকে।…

—আলবেয়ার কামু (রেজিস্টেন্স, রেবেলিয়ন অ্যান্ড ডেথ)

বন্দি অবস্থায় স্বাধীনতার উপলব্ধি সবচেয়ে তীব্র হয়। কারণ, এরকম অবস্থাতে এই জিনিসটাই তো খোয়া যায় সবচেয়ে বেশি। অভিব্যক্তি এবং বক্তব্যের ওপর নানা অহেতুক বিধিনিষেধের নিগড় গতিবিধির ওপর হাজারো নিষেধাজ্ঞাকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এতটাই, যে খাবার, জল, চিকিৎসার মতো মৌলিক বিষয়গুলি নিয়েও যদি কোনও বন্দি কথা বলতে চায়— মনে রাখা দরকার, বিষয়গুলি কিন্তু ‘রাইট টু লাইফ’-এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত— জেল-কর্তৃপক্ষের থেকে পাভলভীয় প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। খারিজ হবে, অস্বীকৃত হবে, অথবা, সবচেয়ে ভাল যেটা হতে পারে, বিষয়গুলির প্রতিকার বিলম্বিত হতে থাকবে। এবার ভেবে দেখুন, একটু মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেওয়া, দিনে অন্তত এক ঘন্টার জন্য রোদে থাকা, নিজের পছন্দমতো বই পড়া বা এমনকি জেল-লাইব্রেরিতে যাওয়ার জন্য একজন বন্দির লড়াইটা কেমন হতে পারে। নিজের কথা বলতে পারি— দু-বছর ধরে জেল-কর্তৃপক্ষের কাছে দরবার করে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আমি বাধ্য হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলাম এবং আদালতই আমাকে প্রতিদিন সকালে আধঘন্টার জন্য রোদে হাঁটার অনুমতি দিয়েছিল।

তালোজা সেন্ট্রাল জেলের সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বন্দির মধ্যে একমাত্র আমারই সেই হাঁটার অনুমতি ছিল। আমি যাতে আমার পছন্দমতো বই পেতে পারি, বোম্বে হাইকোর্ট আমাকে সেই অনুমতিও দিয়েছিল। যদিও এ-জাতীয় সুযোগ কিন্তু অন্য বন্দিরা পেতেন না। এখানেই জেলের মধ্যে হায়ারার্কি এবং অসাম্যের গল্পটা তৈরি হয়।

আমি যখন জেলে ঢুকলাম, আমার একটা ধারণা ছিল যে সমস্ত বন্দিরাই নিয়ম মেনে চলেন। কিন্তু আমি দেখলাম সেই নিয়মগুলি যেখানে খোদিত আছে সেই জেল-ম্যানুয়াল যেন “জাতীয় সুরক্ষা” জাতীয় কোনও বস্তু। কেউ-কেউই মাত্র সেটা দেখার অনুমতি পায়, এবং সেটাও পায় জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে ‘আবেদন’ জানানোর পর। একজন নাগরিক অধিকার-কর্মীর কাছে প্রশ্ন করা হল তাঁর দ্বিতীয় চারিত্র্য। রুশ-মার্কিন লেখক ভ্লাদিমির নবোকভ যে বলেছিলেন ‘কৌতূহল হল অবাধ্যতার বিশুদ্ধতম রূপ’, জেলে আমি যেন গভীরভাবে সেই কথার সারবত্তা উপলব্ধি করলাম। জেল-ম্যানুয়ালটা দেখা এবং তাতে কী আছে জানার জন্য আমি যে লড়াই চালিয়েছিলাম সেটা একদমই এই কৌতূহল-সঞ্জাত।

নাগরিক অধিকার-কর্মী হিসেবে আমি বিশ্বাস করি নাগরিক ক্ষমতায়ন— যা গণতন্ত্রের অন্যতম পরিচায়ক— নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে কী হাসিল হবে সেটা জানার থেকে আসে না, আসে সেই সিদ্ধান্ত থেকে যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইটা আমি চালিয়ে যাব। লড়াইয়ের সঙ্গে এই সংযুক্তি ছাড়া মানুষ এক বন্ধনদশায় আবদ্ধ হয়ে পড়ে, অন্যদিকে লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্তি তাকে অসহায়ত্ব বোধ থেকে মুক্ত করে। লড়াইয়ের সঙ্গে সংযুক্তিই আমাদের মধ্যে সক্ষমতার বোধ তৈরি করে, বিরুদ্ধতা এবং ব্যর্থতার বিরুদ্ধে অধ্যবসায়ী করে এবং একই সময়ে স্বাধীনতার জন্য কিছুটা জায়গাও তৈরি করে দেয়।

আমার বই পড়ার প্রচুর সময় ছিল, আর সময় ছিল আমার সহবন্দিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার, তাঁদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক, এমনকি বন্ধুত্ব গড়ে তোলার। আমি আমার সহ-অভিযুক্তদের কথা জানতে পেরেছিলাম। বন্দি অবস্থাতেও তাঁদের দৃঢ় মনোভাব এবং সৃজনশীল কাজকর্ম আমাকে শক্তি দিয়েছিল। আমি উপলব্ধি করেছিলাম, নিজের মনোজগতে আমি নিজেকে মুক্ত রাখতেই পারি, কোনও আইন বা নিষেধাজ্ঞা আমার কাছ থেকে সেই বোধ কেড়ে নিতে পারবে না। নতুন মানুষদের জানা, তাঁদের থেকে শেখা, এবং নিজের কিছু পূর্ব-ধারণাকে বর্জন করা আমার জেলজীবনের একটা উদ্দেশ্য তৈরি করল। আমি এও উপলব্ধি করেছিলাম, যত ক্ষুদ্রই হোক, সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়— তার মধ্যেই লুকোনো থাকে মুক্তির স্বাদ।

কাউকে যদি বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়, তবে তাকে জেলখানায় বন্দি করা হয়— জেল-এর এই অর্থটাই ভারতীয় জেলগুলির ক্ষেত্রে নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের দেশের জেলখানায় যত বন্দি রয়েছেন তার ৮০ শতাংশই বিচারাধীন বন্দি বা বিনা বিচারে আটক। ভারতরাষ্ট্র এবং বিচারব্যস্থা কোনও বিচার না করে বা সাজা না দিয়েই মানুষকে জেলে পাঠিয়ে দেয়। আর প্রতিজন বন্দিই প্রচলিত প্রিজন ম্যানুয়াল-এর আওতায় পড়ে যান। মহারাষ্ট্র জেল ম্যানুয়াল অনুযায়ী বন্দিদের গান করা এবং জোরে হাসা বারণ।[1]

এগুলির মধ্যে হাসি এবং কথার ওপর নিষেধাজ্ঞা আমার কাছে সবচেয়ে গুরুতর মনে হয়েছে। যদি হাসির কোনও কারণ ঘটে, কেন আমাকে বা অন্য কোনও বন্দিকে সেটা চেপে রাখতে হবে? “জোরে কথা বলা”র বিষয়টা পরিপ্রেক্ষিতের ওপর নির্ভর করে। আন্ডা সেলে সেলগুলি একে অপরের থেকে বেশ কিছুটা তফাতে। সেখানে ‘বান্দি’[2] হয়ে যাওয়ার পর বন্দিরা নিজেদের মধ্যে কথা বলবে কীভাবে? ‘বান্দি’ খোলার পর আমরা সাধারণ স্বরে কথাবার্তা বলতে পারি। কিন্তু কেউ যদি অন্য ইয়ার্ডের বন্দিদের সঙ্গে একে অপরের স্বাস্থ্য নিয়ে বা সাধারণ ভাল থাকা-মন্দ থাকা নিয়েও কথাবার্তা বলতে চায়, তবে তো জোরে কথা বলা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। আর গানের কথা? আমার সহ-অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই সাংস্কৃতিক কর্মী যাঁরা গান লিখতেন, সুর দিতেন, গাইতেন, আমাদেরও গাইতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এইসব কারণেই এই অযৌক্তিক বিধিগুলি নিয়মিত ভাঙা হয়।

যখন কোনও অফিসার আমাদের ইয়ার্ড পরিদর্শনে আসতেন, আমরা আমাদের সমস্যাগুলির কথা বলতে কখনওই বিরত থাকতাম না। সবসময়ে নয় অবশ্যই, তবে সময়ে সময়েই কথাও জোরে হত, গানও গাওয়া হত। আসলে বিষয়টা সহজ। নিয়ম আছে মানেই সেটা সবসময়ে অন্ধভাবে মেনে চলতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না।

 

গলা খাদে নামিয়ে

এই সমস্ত অভিজ্ঞতাগুলিই বাইরের পৃথিবীর ঘটনাগুলি সম্পর্কে আমার উপলব্ধিকে আরও সূক্ষ্ম করে তুলেছিল। এখানে অবশ্যই যেটা জানিয়ে রাখা উচিত, দৈনিক সংবাদপত্রই হল বন্দিদের কাছে বহির্জগতের একমাত্র জানালা। কোনও মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ যদি আমাকে খুবই বিপর্যস্ত করত, আমি সেগুলিকে নাকচ করতে পারতাম না। পারতাম না সেই মন্তব্যগুলির মধ্যে যে ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেটা উপলব্ধি করেই। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-এর ২ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী দাবি করলেন যে অধিকারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে “স্বাধীনতার পর থেকে কর্তব্যকে সম্পূর্ণ ভুলে যাওয়া হয়েছে যা দেশকে দুর্বল করে দিয়েছে।” কথাটা আমাকে ১৯৭৫-৭৭ সালের জরুরি অবস্থার কথা মনে করিয়ে দিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সরকারও অধিকারের ওপরে কর্তব্যকে স্থান দেওয়ার কথা প্রচার করেছিল এবং সংবিধান সংশোধন করে তাতে নাগরিকদের কর্তব্যের একটি তালিকা-সম্বলিত আর্টিকেল ৫১ সংযোজিত করেছিল। সেই সময়ে সঠিকভাবেই বোঝা গেছিল যে এ হচ্ছে আসলে নাগরিকদের কাছ থেকে নিঃশর্ত আনুগত্য দাবি করার একটা কৌশল মাত্র। ঠিক যেমনটা হচ্ছে এই “নয়া” ইন্ডিয়ায়, থুড়ি, ভারতে।

যারা ক্ষমতায় বসে আছে, তারা যখন কর্তব্যের উপদেশ দেয় তখন সেটা ব্যতিক্রমহীনভাবেই আনুগত্য দাবি করা বোঝায় এবং সেখান থেকেই সঙ্কীর্ণমনস্কতার জন্ম হয়। অধিকার যখন আহ্বান করে তখনই প্রকৃত কর্তব্যবোধের জন্ম হয়— আমার মুক্ত স্বর এবং অভিব্যক্তির অধিকার আমার মধ্যে এই অন্তর্নিহিত বোধ জাগ্রত করে যে অপরের এই জিনিসগুলিকেও সম্মান দেওয়াটা আমার কর্তব্য। নয়তো অধিকারের কোনও অর্থই হয় না। শাসক সবসময়ই কর্তব্যের কথা বলে জনগণকে লাইনে আনার জন্য— তাদের যা দেওয়া হচ্ছে তারা যেন মুখ বুজে সেটা গ্রহণ করে।

আমাকে যেটা বিস্মিত করত, নাগরিকদের অধিকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির এই ধরনের অযৌক্তিক কথাবার্তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রগুলি তাদের সম্পাদকীয় স্তরেও কোনও মন্তব্য করছে না। আমার কাছে এটা স্পষ্টতই তাদের ভীতির লক্ষণ— প্রধানমন্ত্রীকে সমালোচনা করতে তারা ভয় পাচ্ছে। অধিকারের গুরুত্ব হ্রাস করা সম্পর্কে মোদির এই চলন স্পষ্টতই অশুভ— পরে আমি তাঁর আরও একটি মন্তব্য শুনে বুঝেছি এই প্রসঙ্গে ইচ্ছাকৃতভাবেই তাঁকে জটিল করে দেখানো হচ্ছিল।

২০২৩ সালের ২৬ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাঁর ‘মন কি বাত’-এ বললেন যে সংবিধানের প্রথম সংশোধনী (মে ১৯৫১)-তে বাকস্বাধীনতা “খর্ব” করা হয়েছিল যেটা খুবই “দুর্ভাগ্যজনক”। স্বভাবসুলভভাবেই তিনি বলতে ভুলে গেলেন যে সেই সংশোধনীতেই ‘জমিনদারি’ প্রথার অবসান ঘটানো হয়েছিল এবং দলিতদের ওপর জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধেও সুরক্ষা দেওয়া হয়েছিল। সেগুলির পরিবর্তে তিনি দাবি করলেন যে তিনি এবং তাঁর সরকার বাকস্বাধীনতার সমর্থক। এই ‘মন কি বাত’-টি সম্প্রচারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন জম্মু-কাশ্মির পুলিশ সাতজন ছাত্রকে গ্রেফতার করল এবং তাদের বিরুদ্ধে দানবীয় সন্ত্রাস দমন আইন ইউএপিএ প্রয়োগ করল। তাদের অপরাধ, তারা একদিবসীয় ক্রিকেটের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া ভারতকে হারানোর পর আনন্দ করছিল।

পুলিশের দাবি, এই গ্রেফতারের কারণ নাকি তারা “যারা ভারত-সমর্থক বা পাকিস্তান-বিরোধী বা তাদের এই আনন্দ করার বিরোধী তাদের ভয় দেখাচ্ছিল।” যদিও এক্ষেত্রে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশকে পিছু হটতে হয়। কিন্তু বিষয়টা হল, যারাই সিধা এবং সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদের পথে হাঁটতে অস্বীকার করবে তাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়াটাই হচ্ছে পুলিশের স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া।

২০২১ সালে একটি ক্রিকেট ম্যাচে পাকিস্তান ভারতকে হারানোর পর আনন্দ করার অপরাধে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে জম্মু-কাশ্মির পুলিশ এবং উত্তরপ্রদেশ পুলিশ দুর্নাম কুড়িয়েছিল।[3] পুলিশ এই আনন্দ করার মধ্যে “বিচ্ছিন্নতাবাদ” দেখতে পেয়েছিল। পুনেতে ‘নির্ভয় বনো আন্দোলন’-এর একটি সভা হওয়ার কথা ছিল যার প্রধান বক্তা ছিলেন সাংবাদিক নিখিল ওয়াগলে। সভাটির জন্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় অনুমতি নেওয়া ছিল। পুনে পুলিশ সভাটি আটকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কেন? কারণ দক্ষিণপন্থী সমাজবিরোধীরা সভাটির বিরোধিতা করেছিল এবং সভাটি হলে তা ভেস্তে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়— পুলিশ ওই সভার সংগঠকদের বিরুদ্ধে আইপিসি-র ১৫৩-এ ধারা (সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো)-তে এফআইআর-ও করেছিল।

অন্যদিকে, বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে পুলিশ যারা ঘৃণা ছড়ায় তাদের বাকস্বাধীনতা রক্ষার জন্য খুবই ব্যগ্র। এতটাই ব্যগ্র যে, কিছুদিন আগে বোম্বে হাইকোর্ট পর্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করেছে যে কীভাবে মিরা-ভায়ান্দর এবং ভাসাই-ভিরার-এর পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে বিজেপির ‘তারকা প্রচারক’রা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলল![4]

মতবিরোধ, বৈচিত্র্য এবং ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা এখন ব্যাপক। জাভেদ আহমেদ হাজাম নামে একজন একটি হোয়াটসঅ্যাপ পোস্ট করে যাতে কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদের দিনটিকে “কালো দিন” হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তানকে “স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা”ও জানানো হয়। কোলাপুর পুলিশ জাভেদের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল বোম্বে হাইকোর্ট পুলিশের যুক্তি মেনে নিয়ে বলে যে তারাও সেই পোস্টটির মধ্যে “একটি জনগোষ্ঠীকে উত্তেজিত করে তোলার মতো মশলা আছে” এরকম সম্ভাবনা খারিজ করে দিতে পারছে না।

সৌভাগ্যক্রমে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি অভয় এস ওকা এবং উজ্জ্বল ভুঁইয়ার বেঞ্চে পৌঁছায়। সেখানে গত ৭ মার্চ তাঁরা হাইকোর্টের নির্দেশ খারিজ করেন এবং “যুক্তিসঙ্গত” বক্তব্য সম্বন্ধে সেই ১৯৪৭ সালে করা বিচারপতি ভিভিয়ান বোসের মানদণ্ডটির পুনরুচ্চারণ করেন। বিচারপতি বোস বলেছিলেন: “…কোনও কথার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা বিচার করতে হবে যুক্তিনিষ্ঠ, দৃঢ়চিত্ত এবং সাহসী মানুষদের মানদণ্ড অনুযায়ী, যারা প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই বিপদের গন্ধ পায় তেমন মানুষদের মানদণ্ড অনুযায়ী নয়।”

আমি ‘সৌভাগ্যক্রমে’ শব্দটি ব্যবহার করলাম কারণ মামলাটি উচ্চতম আদালতের অন্য কোনও বেঞ্চে গেলেও যদি একই রায় হত তবে আমি বিস্মিত হতাম। সব মিলিয়ে, দেশের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিমণ্ডলে স্বাধীনতা এবং ব্যক্তির অধিকার অনুশীলনের ক্ষেত্রগুলি যে সঙ্কুচিত হচ্ছে সেটা স্পষ্ট।

 

আরও খানিকটা খাদে

আমার আশঙ্কা পুলিশ কর্তৃপক্ষ নিজেদের কাজে এই মানদণ্ডই পালন করছে। আরও বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল যখন “নাগরিক সমাজই চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধক্ষেত্র” বলে তাঁর বিখ্যাত উক্তিটি করলেন, তখন থেকে। তাঁর বক্তব্য “জাতীয় স্বার্থে আঘাত দিতে” নাগরিক সমাজকে “ধ্বংস করা, বিভাজিত করা এবং নিজেদের সুবিধামতো কাজে লাগানো যেতে পারে।” একটি প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে এবং তার কাজকর্মকে ‘চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধক্ষেত্র’ বলে চরিত্রায়িত করে এনএসএ ভিন্নমত এবং স্বাধীন অ-সরকারি নাগরিক ক্রিয়াকলাপের ওপর সরকারের উগ্র অসহিষ্ণু মনোভাবের পরিচয়ই ব্যক্ত করেছিল।

‘ধ্বংস করা এবং নিজেদের সুবিধামতো কাজে লাগানো’ জাতীয় অতিশয়োক্তির অর্থ হল চিন্তাভাবনার জগতে নজরদারি চালানো এবং যারা সরকারের বশংবদ হতে অস্বীকার করবে তাদের ওপর হামলা নামিয়ে আনা। আর নাগরিক সমাজের অহিংস কার্যকলাপকে ‘যুদ্ধ’ আখ্যা দেওয়ার অন্যতর, বলা যায় অশুভতর, তাৎপর্য রয়েছে। যুদ্ধ শান্তির মতো নয়— যুদ্ধ বিরোধীকে শত্রুতে পরিণত করে। যুদ্ধে শত্রুকে— যথেষ্ট নরম করে বললে— ‘নিষ্ক্রিয়’ করে ফেলতে হয়। বিপরীতপক্ষে, শান্তিতে, একজন বিরোধী হল একজন সম্ভাব্য মিত্র— যাকে বন্ধু বানাতে হয়, বা, নিদেনপক্ষে সে যেন শত্রু না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে হয়। যদি নাগরিক সমাজকে একটি রণাঙ্গনে পরিণত করা যায়, তবে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র ধুয়ো তুলে সংবিধান-প্রদত্ত স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকারকে অনায়াসেই বলি দেওয়া সম্ভব।

কথাটা হচ্ছে যেহেতু আইনপ্রণেতা, আইন-প্রয়োগকারী বা বিচারদাতারা কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নন— সব মানুষের মতো তাঁদেরও ভুল হয়, কোনও কোনও সময়ে গুরুতর ভুলও হয়— তাই নাগরিক আন্দোলন খুবই জরুরি একটা বিষয়। নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা এবং প্রশ্ন তোলা রাষ্ট্র এবং সমাজের ক্ষয় রোধ করে, দ্বন্দ্ব উসকে তোলে, এবং শাসককে স্বৈরাচারী হতে দেয় না।

ভীমা কোরেগাঁও-১৬ (বিকে-১৬) মামলায় যখন জেল কর্তৃপক্ষ আমাদের চিঠিপত্র তদন্তকারী সংস্থাকে দিল, আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। আমার কিছু সহ-অভিযুক্ত এই নিয়ে বোম্বে হাইকোর্ট এবং মহারাষ্ট্র মানবাধিকার কমিশনেও গেছিলেন। সেইজন্য জেল-সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমাদের অন্য জেলে পাঠানোর কথা ভাবলেন। উনি যখন আমাদের অন্য জেলে যাওয়ার কথা বোঝালেন আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম। বিকে-১৬ মামলার সবাই প্রত্যাখ্যান করল। সুপারিন্টেন্ডেন্ট কি আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এরকম চরম অবলম্বন নিতে পারেন? জেলের কর্তারা কেমন অবাধ ক্ষমতা ভোগ করেন আর উচ্চতর কর্তৃপক্ষ (পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র দফতর) যে তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ প্রায় করেই না, এই ঘটনা তার একটি স্পষ্ট প্রমাণ।

জেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট যে আমাদের অন্য জেলে পাঠানোর জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তার কারণ, অনেকগুলি বিষয়ের জন্য তাঁকে আদালতের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। বিষয়গুলির মধ্যে একটি ছিল জেল-কর্তৃপক্ষের ক্ষমাহীন অবহেলার কারণে ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু। এই স্বেচ্ছাচারী মনোভাবের জন্ম সম্ভবত পরবর্তীকালে— যখন শাসকরা নাগরিকদের অধিকার ক্ষমতায়নের বিষয়গুলিকে খর্ব করার জন্য মনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা একমাত্র পিছু হটেন গণ-প্রতিরোধের মুখোমুখি হলে। যেমন হয়েছিল কৃষক আন্দোলনের সময়ে— যার জেরে সরকারকে অতিমারির সময়ে তাড়াহুড়ো করে পাশ করানো তিনটি কৃষক-বিরোধী বিল প্রত্যাহার করে নিতে হয়। জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টও ব্যাপক সমালোচনা এবং প্রতিবাদের মুখে পড়ে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হলেন। আমার কাছে আমাদের সময়ের এ আরেক চারিত্র্য।

দোভাল গত ২০২১-এর ১২ নভেম্বর হায়দ্রাবাদের এসভিপি ন্যাশনাল অ্যাকাদেমিতে ২০২০ ব্যাচের আইপিএস পরীক্ষার্থীদের সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, গণতন্ত্র হল “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্মিত আইনকানুন”। ‘আইনের শাসন’ আর ‘আইন দ্বারা শাসন’-এর পার্থক্য হল এখানেই। ‘আইনের শাসন’ গণতন্ত্রের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ আর ‘আইন দ্বারা শাসন’ স্বৈরতন্ত্রের। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আইন বানান না, আইনগুলি তাঁরা খতিয়ে দেখে ভাবনাচিন্তা করবেন যে, সেরকমটাও প্রায়শই ঘটে না। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রাটিক রিফর্মস (এডিআর) সপ্তদশ লোকসভা সম্পর্কে একটি রিপোর্টে জানাচ্ছে লোকসভায় পাশ হওয়া ২২২টি বিলের মধ্যে ৪৫টি পাশ হয়েছে একটি মাত্র অধিবেশনে। আরও ২০টি বিল লোকসভা এবং রাজ্যসভায় একসঙ্গে পাশ হয়েছে মাত্র এক দিনে। এর মধ্যেই একটি বিল ছিল ৩৭০ ধারা বিলোপ করার বিল, যার জেরে একটি বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন রাজ্য দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে গেল। অত্যাচারী শাসকের হাতে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে এটাই হয়— সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনওরকম বিবেচনা বা বিতর্ক ছাড়াই আইন পাশ হয়ে যেতে থাকে। এরকম তাড়াহুড়ো করে বিল পাশ করানোর বিষয়ে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টও সরকারকে সতর্ক করেছে। কারণ এর ফলে বিলগুলোতে যা ভুলভ্রান্তি থাকছে সেগুলির বিরুদ্ধে গাদা গাদা মামলা দায়ের হচ্ছে। আমাদের এমনিতেই মামলার ভারে ধুঁকতে থাকা বিচারব্যবস্থা যার ধাক্কায় আরও নুয়ে পড়ছে।

অদ্ভুতভাবে, সুপ্রিম কোর্টের সংবিধান বেঞ্চ এই ৩৭০ ধারা বাতিলের মধ্যে ভুল কিছু খুঁজে পায়নি এবং জম্মু-কাশ্মিরের মর্যাদাহানিকেও যুক্তিযুক্ত বলে সমর্থন করেছিল। ৩৭০ ধারা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গেই জম্মু-কাশ্মিরে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন নামিয়ে আনা হয় যার ফলে রাজ্য জুড়ে ৭০০০-এরও বেশি মানুষ গ্রেফতার হন। জম্মু-কাশ্মির হাইকোর্ট এই ঘটনাগুলিকে পাত্তাই দেয়নি— যাঁরা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁদের তরফে করা কোনও হেবিয়াস কর্পাস গ্রহণ করা হয়নি।

এডিআর আরও দেখিয়েছে পঞ্চদশ লোকসভায় (২০০৯-১৪) যেখানে ৭১ শতাংশ বিল সংসদে পেশ করার আগে স্ক্রুটিনি করা হয়েছিল, ষোড়শ লোকসভায় সেখানে সেই অনুপাতটা মাত্র ২৬ শতাংশ। স্ক্রুটিনিকে এইভাবে বর্জন করার জন্য ‘আইনের শাসন’-এর বাস্তব ভিত্তিটাকেই নস্যাৎ করা হচ্ছে। মনে করে দেখুন, নতুন ক্রিমিনাল ল কোড বিলকে কীভাবে একটি সংসদীয় কমিটিকে দিয়ে আধাখেঁচড়া স্ক্রুটিনি করিয়ে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছিল, এবং সরকার বিলগুলি নিয়ে দেশে বিতর্ক চালাতে কীরকম অনিচ্ছুক ছিল।

‘ভারত কোড’ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য জিনিসটা হল এটা প্রকৃত প্রস্তাবে ঔপনিবেশিক আমলের ভয়ানক ‘পুলিশি রাজ’ ফিরিয়ে আনতে চলেছে। ভারতের পুলিশ এখনও ঔপনিবেশিক আইন (ইন্ডিয়ান পুলিশ অ্যাক্ট, ১৮৬১) দ্বারা পরিচালিত হয় এবং পুলিশের কাঠামোও কোনও কমিউনিটি পুলিশের মতো নয়, বরং অনেকটা আধা-সামরিক বাহিনির মতো। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে কোনওরকম কোর্ট অর্ডার ছাড়াই পুলিশ এখন স্রেফ রুটিন কাজের কায়দায় ‘বুলডোজার জাস্টিস’ চালাচ্ছে। নতুন কোডে সাধারণ অপরাধের জন্যও পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ বর্তমানের ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী ৯০ দিন পর্যন্ত করা হয়েছে। এতে পুলিশকে আদালতের কোনও নির্দেশ ছাড়াই গ্রেফতারি, তল্লাশি এবং বাজেয়াপ্ত করার যথেচ্ছ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার সপ্তম অধ্যায়ে কিছু ভাষার কারিকুরি আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের কিছু ঢিলেঢালা সংজ্ঞা দিয়ে কপট রূপে বর্তমান রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটিই ঢোকানো হয়েছে। সব মিলিয়ে, ঔপনিবেশিকতাকে দূর করা এবং নাগরিকদের স্বার্থ এবং অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিবর্তে এই নতুন কোডে নাগরিকদের রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত করতে চাওয়া হয়েছে।

২০২০ সালের জুলাই মাসে এনআইএ আমাকে যে ১১ দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, আমার সে-কথা মনে পড়ছে। সে-সময়ে আমাকে বলা হয়েছিল সংসদে যদি কোনও আইন পাশ হয়, আর আমার তার বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য থাকে, তবে আমার তা নিয়ে জনসমক্ষে প্রতিবাদ না করে আদালতে যাওয়া উচিত। আমি সে-কথা মানিনি। বলেছিলাম, জনসাধারণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে মানে এই নয় যে তারা পাঁচ বছরের জন্য তাদের সার্বভৌমত্ব বন্ধক রেখে দিল। কোনও আইন যদি অন্যায্য, পক্ষপাতদুষ্ট বা বিভাজনমূলক মনে হয়, তবে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার জনগণের অবশ্যই আছে।

এনআইএ-র তদন্তকারীরা পিপল’স ইউনিয়ন ফর ডেমোক্রাটিক রাইটস (পিইউডিআর)[5]-এর মতো নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলি নিয়ে অসন্তুষ্ট। অসন্তুষ্ট কারণ, তারা ইউএপিএ-র সমালোচনা করে, তারা হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের ঘটনাগুলিতে যে এনআইএ বারবার ব্যর্থ হয় তার সমালোচনা করে। এই সংগঠনগুলি যে ট্রায়াল কোর্টের জিএন সাইবাবা-সহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল, একজন তদন্তকারী তো তা নিয়ে রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। এখন যখন বোম্বে হাইকোর্ট তাঁদের সবাইকে মুক্তি দিল তখন সেই তদন্তকারী ভদ্রলোক স্বীকার করছেন কি না যে আমাদের প্রতিবাদ যুক্তিযুক্ত ছিল জানতে ইচ্ছে করে। এখানে বলে রাখা উচিত, এইসব আলোচনা আপেক্ষিকভাবে শোভনতার সঙ্গেই হয়েছিল— যদিও আমি আসলে তাদের হেফাজতে রয়েছি, যা গোটা পরিবেশের ওপর একটা অশুভ ছায়া বিস্তার করেই রেখেছিল। তবুও এটা স্বীকার করতেই হবে যে আমাকে ভয় দেখানো হয়নি।

 

সব মিলিয়ে যা দাঁড়াল

‘আইনের শাসন’-কে কার্যত একটি শূন্যগর্ভ বস্তুতে পরিণত করে প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য-কে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষে এই যে ওকালতি, এর অর্থ হল নিজেদের স্বাধীনতা এবং অধিকারকে বেড়ি পরিয়ে নাগরিকদের কর্তৃপক্ষের অনুগত হয়ে উঠতে হবে। একটি বিকৃত বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত বিচার এবং ন্যায়বিচার আধিকারিকদের অতি-সক্রিয়তার শিকার হবে, স্বেচ্ছাচার এবং অযৌক্তিক কার্যকলাপ অবাধ হয়ে উঠবে।

লক্ষণীয়, যাঁরা বন্দি হয়েছেন, এবং যাঁরা হননি, সবাইকেই এখন এমন একটা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হচ্ছে যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন এবং স্বাধীনতা সঙ্কুচিত, তাদের স্বর রুদ্ধ। আমি জেলে গেছি, কারণ আইনটাই (ইউএপিএ) সেরকম। আমাকে এমন একটি অপরাধে জড়ানো হল যে অপরাধে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। আমাকে কোনওরকম বিচার বা সাজা ঘোষণার তোয়াক্কা না করেই জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ‘অধিকার’-এর ওপর আক্রমণ এবং ‘কর্তব্য’-কে আবাহন— এইভাবেই বিষয়টা প্রতিভাত হয়েছিল আমার কাছে। ভেবে দেখুন, নাগরিক সমাজকে যখন চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধক্ষেত্র বলে অভিহিত করা হয়, তা কি যারা সরকারি ভাষ্য বিনা বাক্যব্যয়ে মানতে অস্বীকার করবে তাদের দমন করা হবে— এই ভবিষ্যদ্বাণীই করে না? এবং, এর মধ্যেই, একজন বন্দি জেল-কর্তৃপক্ষেরও কোপে পড়বে, যদি সে কৌতূহলী হওয়ার বা বন্দি হিসেবে তার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার স্পর্ধা দেখায়।

সিদ্ধান্ত টানার জন্য আবারও কাম্যুর দ্বারস্থ হওয়ার চেয়ে আর কোনও ভাল রাস্তা নেই— “প্রতিদিন যখন দেখি মুক্তিকামী শক্তিগুলি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, শব্দেরা পতিতাবৃত্তি করছে, ভুক্তভোগীদেরই অপবাদ দেওয়া হচ্ছে, নিপীড়নকে ন্যায্যতা দেওয়া হচ্ছে, শক্তির উন্মত্ত স্তুতি চলছে— তখন যে যন্ত্রণাটা হয় আমি শুধুমাত্র সেই যন্ত্রণাটুকুই প্রকাশ করতে চাই।”

আমাদের সামনে এখন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় উপস্থিত হয়েছে: হয় নীরব থাকব, এবং কর্তৃপক্ষের বশ্যতা স্বীকার করে নেব; নয়তো কী হতে পারে না ভাবে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমার সহ-অভিযুক্ত ফাদার স্ট্যান স্বামী আমাদের যেমন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন— আমরা “নীরব দর্শক” নই।


[1] মহারাষ্ট্র রাজ্যের জেল ম্যানুয়ালের ষোড়শ অধ্যায়টি হল ‘প্রিজন ডিসিপ্লিন’ যার ১৯ নম্বর ধারাটিতে জেলে যে-সব কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে তার একটা তালিকা দেওয়া হয়েছে। এই ধারা রচিত হয়েছে প্রিজন অ্যাক্ট ১৮৯৪-এর এস৪৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। এখানে ১৯(১) নম্বর ধারাতে বলা হয়েছে, বন্দিরা “যখন কোনও অফিসার বারণ করবেন তখন কথা বলতে, গান গাইতে, জোরে হাসতে এবং জোরে কথা বলতে” পারবে না।
[2] বন্দিদের সেলে ঢুকিয়ে লকআপ করে দেওয়া।
[3] In jail for 5 months for celebrating Pak cricket victory, 3 Kashmiri students get bail. The Wire. Mar 30, 2022.
[4] Gokhale, Omkar. Mira Road hate speech: HC directs CPs to personally review BJP MLAs videos and decide on need for FIR. Indian Express. Apr 11, 2024.
[5] আমি পিইউডিআর-এর একজন সদস্য।


*নিবন্ধটি দ্য ওয়ার-এ গত ১৯ মে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4802 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...