চলুন বেড়িয়ে আসি ভগবানের আপন দেশে

অঞ্জুশ্রী দে

 

কথায় আছে বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে। হাতে একটু পয়সা আর কয়েকদিনের ছুটি পেলেই সদলবলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন পাহাড়, সমুদ্র কিংবা জঙ্গলে। বাঁধনছাড়া জীবনের টানে সাড়া দিয়ে অচেনাকে চেনা বা চেনাকে নতুন করে দেখায় বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। আমিও এই গড়পড়তা বাঙালির ব্যতিক্রমী নই। আমার পায়ের নিচে যদিও সর্ষে নেই। তবুও মনের মধ্যে লুকোনো স্বপ্ন আর অদম্য ইচ্ছায় বেরিয়ে পড়েছিলাম কেরলের পথে। কেরলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য তাকে ভগবানের নিজের দেশ বলা হয়। তবে আমাদের উদ্দেশ্য একই সঙ্গে পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল ও ব্যাকওয়াটার ভ্রমণ। এই ভ্রমণের পরিক্রমা গতানুগতিক ভ্রমণের পথে হয়নি। এ পথ একান্তই নিজস্ব। চলার পথে একটু ঝক্কিঝামেলা থাকলেও আনন্দ অনেক। পচ্ছন্দ হলে এ পথে পাড়ি দিতে পারেন। কুড়িয়ে নিতে পারেন মুঠো মুঠো আনন্দ। এই ভ্রমণের শুরু হয়েছিল পেরিয়ার-এর জঙ্গল দিয়ে। তারপর প্রাচ্যের ভেনিস আলেপ্পির ব্যাকওয়াটার হয়ে কোভালাম সমুদ্রসৈকত। শেষ দু-দিন পোনমুড়ি শৈলশহরে রাত্রিবাস। পথে বাদ যায়নি ড্যাম মন্দিরও। এই ভ্রমণে পাহাড়ি রাস্তায় পথ পেরোনোর অফুরন্ত আনন্দও আপনার মনকে ছুঁয়ে যাবে। আগেই বলে রাখি এই ভ্রমণ বিলাসবহুল নয়। একেবারেই সাধারণ গরিবের ভ্রমণ। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাত্রি কেটেছে অতি সাধারণ হোটেলে। ভ্রমণস্থানের সাধারণ নাগরিকদের ব্যবহৃত যান-ই ছিল আমাদের সঙ্গী। চলুন ঘুরে দেখি পেরিয়ার-আল্লেপি-কোভালাম-পোনমুড়ি।

পেরিয়ার: তামিলনাড়ুর মন্দিরশহর মাদুরাই থেকে সবচেয়ে কম সময়ে বাসে চেপে চলে আসা যায় পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মাথায় অবস্থিত ছোট শহর কুমিল্লি। এই কুমিল্লিই পেরিয়ারের প্রবেশদ্বার। ৭ ঘন্টার বাস জার্নি করেও ত্রিচি থেকে কুমিল্লি পৌঁছনো যায়। এই পথেই আমি মশলার শহর কুমিল্লিতে গিয়েছিলাম। এখানে ছোট বড় অজস্র হোটেলের ভিড়। বাজেট হোটেল যেমন পাবেন, তেমনই পাবেন বিলাসবহুল হোটেল। আপনি যত জঙ্গলের কাছাকাছি থাকবেন হোটেলের চার্জ তত বেশি। খরচ ও পছন্দ আপনার নিজস্ব। কুমিল্লি পৌছে ওখানে আমাদের রাত্রিবাস। পরদিন ভোরে অটোয় চেপে পেরিয়ারের উদ্দেশ্যে যাত্রা। পেরিয়ারের প্রবেশদ্বারেই রয়েছে চেকপোস্ট। আপনাকে এখানে সংগ্রহ করতে হবে প্রবেশের টিকিট। তারপর আরও দু-কিমি পথ পেরিয়ে অবশেষে পেরিয়ার লেকের সামনে। কেরল বন দফতর পরিচালিত লঞ্চের টিকিট কেটে জঙ্গলভ্রমণ শুরু।

 

কেরলের ইডুক্কি জেলার পশ্চিমঘাট পর্বতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পেরিয়ার জাতীয় উদ্যান। ১৮৯৫ সালে তৈরি পেরিয়ার ড্যামের চারপাশের জঙ্গল ১৮৯৯ সাল থেকেই সংরক্ষিত। ১৯৭৮ সালে পেরিয়ার স্যাংচুয়ারি ব্যাঘ্রপ্রকল্প হিসাবে ঘোষিত হয়। ১৯৮২ সালে জাতীয় উদ্যানের তকমা পায়। ৯২৫ বর্গ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এই পাহাড়ি সবুজ জঙ্গলের ৩২৫ বর্গ কিলোমিটার কোর এরিয়া। এখানে নানা ধরনের জীবজন্তু ও পাখির দেখা মিলবে। বন্যরা বনে সুন্দর তা স্বচক্ষে দেখতে ভাসতে হবে পেরিয়ার লেকের জলে। লঞ্চ যত এগোবে তত চোখে পড়বে বিভিন্ন ধরনের জলজ পাখি। কালো গলাযুক্ত সারস ছাড়াও হর্ণবিল, বামনী কাইট, ব্ল‍্যাক উইংড কাইট, নাইড কিং ফিসার, গোল্ডেন ওরিওল প্রভৃতি পাখিতে আপনার চোখ স্থির হয়ে যেতে বাধ্য। এই পেরিয়ারে প্রায় ১৬০ ধরনের পাখি দেখা যায়। দু-দিনের ভ্রমণে সবাইকে খোঁজার চেষ্টা অবাস্তব। দেখতে পাবেন কুমিরের সূর্যস্নান। পদে পদে চোখে পড়বে বাইসন। ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় জাতের হরিণ ‘সম্বর’ দেখতে হলে খুবই সজাগ থাকতে হবে। লঞ্চের আওয়াজে মুহূর্তের মধ্যেই তারা দৌড়বে। দেখা মিলতে পারে বাদামী চুল যুক্ত কালো বাঁদর বা লায়ন টেলড ম্যাকাকিউ-এর। ভাগ্য ভাল হলে মিলে যেতে পারে গাছে ওঠা লেপার্ডের দর্শন। যদিও পেরিয়ারের জঙ্গল ব্যাঘ্রপ্রকল্প হিসাবে স্বীকৃত, তবু বাঘের দেখা পাওয়া সম্ভব নয়।

 

পড়ন্ত বিকেলে লঞ্চ যখন আপনাকে কূলের দিকে নিয়ে যাবে সেই সময় দল বেঁধে হাতির স্নান দৃশ্য আপনার মন ভুলিয়ে দেবে। পুষিয়ে দেবে বাঘ না দেখার মনোকষ্ট। বলা হয়নি, পেরিয়ার শুধু টাইগার রিজার্ভ নয় এলিফ্যান্ট রিজার্ভও বটে। তীরে এসে কিছুক্ষণ খেলা করতে পারেন বুনো বাঁদরদের সঙ্গে। তারা কিছু খাবারের আশায় আপনার পিছু ছাড়তে চাইবে না। ওদের জন্য মায়া পড়ে যাবে। কুমিল্লিতে হোটেলে ফিরে পরদিন আবার লেকের জলে ভাসতে পারেন। নচেৎ পরদিন কুমিল্লি শহরে ঘুরে বেড়িয়ে গন্ধ নিতে পারেন এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গের। সস্তায় কিনতে পারেন নানা ধরনের মশলা।

 

দ্বিতীয় দিন হোটেলে দুপুরের আহার সেরে ঠিক দুপুর ২টো ২০ মিনিটে বাস ধরে কুমিল্লি থেকে বিদায়। গন্তব্যস্থল চেন্নাচেরি। পশ্চিমঘাট পর্বতের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাস ছুটেছে চেন্নাচেরি। পাহাড়ি পথের মনোরম দৃশ্যকে পিছনে ফেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে ৪ ঘন্টা সময় লাগল। পৌঁছানোর পর ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েক মিনিট। দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি এই জার্নিটাই একটা ট্যুর। যাইহোক, ঘোর কাটিয়ে তড়িঘড়ি বাস ধরে ঘন্টা খানেকের মধ্যে ঢুকে পড়লাম প্রাচ্যের ভেনিস বা ব্যাকওয়াটারের শহর আলেপ্পিতে।

 

আলেপ্পি: এর বর্তমান নাম আল্লাপুজা। তবে লোকে পুরনো নামেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। কোচি থেকে সহজেই এখানে আসা যায়। এছাড়াও কোল্লাম, তিরুবন্তপুরম কিংবা এর্নাকুলাম থেকে আলেপ্পি আসেন অনেকেই। এখানে পৌঁছে হোটেল ‘কার্তিক’-এ কোনওরকমে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরেই দৌড় লঞ্চঘাটে। ব্যাকওয়াটারে জলবিহারের জন্য। লঞ্চঘাটে এজেন্টদের দাপাদাপি। আপনাকে কোনওরকমে ডিস্ট্রিক্ট ট্যুরিজম প্রোমোশন কাউন্সিলের লঞ্চে তুলে দেওয়ার চেষ্টা। সেখানে ভাল টাকার বিনিময়ে কন্ডাক্টেড ট্যুরের ব্যবস্থা। না, আমরা এই ফাঁদে পা দিইনি। লঞ্চঘাটে গিয়ে চড়ে বসেছিলাম যাত্রীবাহী সাধারণ বোটে। এই বোটগুলি ব্যাকওয়াটারের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন দ্বীপে জনগণকে পৌঁছে দেয়। জন প্রতি টিকিট মাত্র ২৫ টাকা। সাধারণ যাত্রীবাহী বোটে জলবিহার করলাম প্রায় ৩ ঘন্টা।

 

এভাবেই পৌঁছে গিয়েছিলাম নেড্ডুমুডি দ্বীপে। এক মালয়ালি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে সেরে ফেলা গেল দুপুরের আহার। অযাচিত আতিথেয়তায় কতটা আন্তরিকতা থাকতে পারে না দেখলে কল্পনা করা যাবে না। নেড্ডুমুডি থেকে অন্য বোটে অপর এক দ্বীপে। সস্তায় ব্যাকওয়াটারের মধ্যে দাপাদাপির এমন সুযোগ আর স্বাধীনতা প্যাকেজ ট্যুরে আপনি পাবেন না। দু-দিনে নয় নয় করে ছ-টা দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছি। দ্বীপবাসীদের জীবনযাত্রা অবাক করবে, আতিথেয়তা আপনাকে আটকে রাখবে।

 

চোখে পড়বে বিভিন্ন ধরনের বোট। কোনওটায় পুরো ওষুধের দোকান, কোনওটায় গৃহস্থালীর সরঞ্জাম। বাদ নেই সব্জির বোটও। যেগুলি বিভিন্ন দ্বীপে গিয়ে ঠেকছে আর লোকজন হুড়মুড়িয়ে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনছেন। চোখে পড়বে ছেলেদের মাছ ধরা। নারকেলগাছের সারি আর শানবাঁধানো খাড়ির মধ্যে দৌড়ে চলা বোটেদের লুকোচুরিতে মন ভোরে উঠবে। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় শনিবার ১০০ দাঁড়ওয়ালা ‘স্নেক বোট রেস’ আলেপ্পিকে মাতিয়ে তোলে। তখন আলেপ্পির অন্য চেহারা। দেশি বিদেশি পর্যটকদের চাপে হোটেলে জায়গা পাওয়া কঠিন। সেই সময় যেতে পারলে ‘লাইফটাইম’ অভিজ্ঞতা। একটা কথা বলা হয়নি, পকেটে পয়সা থাকলে এক রাত হাউসবোটে কাটাতে পারেন। সে অভিজ্ঞতা শুনেছি অনবদ্য।

 

ইচ্ছে থাকলেও থেমে থাকার উপায় নেই। তাই এবার আলেপ্পিকে বিদায়ের পালা। যেতে হবে কোভালাম। আলেপ্পি থেকে বাসে চেন্নাচেরি রেলস্টেশন। সেখান থেকে তিন ঘন্টার ট্রেনজার্নিতে তিরুবনন্তপুরম।

 

কোভালাম: হোটেল কীর্তিতে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে তিরুবন্তপুরম শহরের পথে। শহরে মূল বাসস্টান্ডেই শ্রীপদ্মনাভ স্বামীর মন্দির। জামাকাপড় পরিবর্তন করে মন্দিরের পোশাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। এই হ্যাপায় আমাদের মন্দিরে প্রবেশ করা হয়নি। এই দিন বিকেলেই কোভালাম। মিয়ামি বিচের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় সুন্দরতম বিচ কোভালাম। শান্ত সমুদ্রের অর্ধচন্দ্রাকার এই বিচকে যে কোনও বিদেশি বিচের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এই বিচে দেশের পর্যটকের তুলনায় বিদেশি পর্যটকের চাপই বেশি। তাঁরা মূলত সূর্যস্নানেই ব্যস্ত থাকেন। নীল আকাশের নিচে নীল সমুদ্রে দেশি বিদেশি দম্পতিদের জলকেলি, যা কবিকে কবিতার রসদ জোগায়। এই দ্বীপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নির্জনতা। পাহাড়-পাহাড় পরিবেশে কলা, পেঁপে আর নারকেলের ছায়া। রুপোলি বালুবেলা, ছোট ছোট ঢেউ, সাগরস্নানের জন্য অনন্য কোভালাম। বর্ষাকালকে একটু এড়িয়ে, সারা বছরই কোভালাম যাওয়া যায়। তবে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি কোভালামের পিক সিজন। এখানে বিদেশিদের চাপ সবসময়, ফলে এখানে হোটেলভাড়া তুলনমূলকভাবে বেশি। হাতে সময় থাকলে কয়েকদিন এখানে চুপচাপ বসে গাইতে পারেন— “শুধু ঢেউ আর ঢেউ গুনেছি।”

 

পোনমুড়ি: কোভালাম থেকে ফিরে এলাম তিরুবন্তপুরম। যেতে হবে পোনমুড়ি। পশ্চিমঘাটের স্বাস্থ্যনিবাস। এখানে কুয়াশাভরা অসংখ্য পাহাড়চূড়া চক্রাকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে চা-বাগান। যার নৈসর্গিক শোভা অনবদ্য। তিরুবন্তপুরম থেকে ৬১ কিমি দূরে পোনমুড়ি। আপনি কন্ডাক্টেড ট্যুরে সকালে পোনমুড়ি গিয়ে বিকেলে ফিরে আসতে পারেন। যদি দু-দিন পাহাড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুভব করতে চান তাহলে সস্তায় স্বাধীনভাবে চলুন পোনমুড়ি। সকল ৫.৩০-টায় তিরুবন্তপুরম বাসস্ট্যান্ড থেকে রুটের বাসে আমাদের যাত্রা শুরু হল পোনমুড়ির উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণ পর অঝোরে বৃষ্টি। পাহাড়ি পথে বৃষ্টির জলের ধারা ছিটিয়ে বাস ছুটেছে পোনমুড়িতে। রোদ বৃষ্টির লুকোচুরিতে ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম পোনমুড়ি। আশ্রয় মিলল কেরল ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের পোনমুড়ি কমপ্লেক্স-এ। আমাদের পরিকল্পিত ভ্রমণের শেষ গন্তব্য এই পোনমুড়ি। স্বাভাবিক কারণেই শরীর ছেড়ে দিতে বাধ্য। তাই ওইদিন ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্সে পুরোপুরি রেস্ট।

 

পরদিন ভোরে বেরিয়ে পড়লাম পোনমুড়ির রাস্তায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুর্যোদয়ের আলোর ছটা যেন খেলা করছে সারা পোনমুড়ির পাহাড়ে। সঙ্গে ইউক্যালিপটাস ও রবারগাছের ছায়া। চা-বাগানের দিকে তাকালে মনে হচ্ছিল সবুজের গালিচায় মোড়া স্লেটরঙা পাহাড় যেন ঢেউ তুলে ছুটে চলেছে। সকাল বিকাল চেনা অচেনা নানান পাখির কলরব। রংবেরঙের প্রজাপতি পরিবেশকে মধুময় করে তুলছে। এখানে দোকানপাটের খুব একটা বালাই নেই। নেই কোনও জনবসতির ছাপ। মধুচন্দ্রিমার আদর্শ জায়গা পোনমুড়ি। যে কোনও নির্জনতাপ্রিয় মানুষকে টেনে রাখবে। এবার ফেরার পালা। রুটের বাসেই ফিরে এলাম তিরুবন্তপুরম। এখান থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা।


*ছবিগুলি লেখকের তোলা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...