ছায়াপাখি, এক আকাশের নিচে — পর্ব ৬ (দ্বিতীয়াংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ঘুঘুডাঙা

দুই.

হীরক সেই রাত্রেই বাড়িতে ফোন করেছিল। মা আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ আমি শুনেছি। জানি।

—তাহলে আমাকে বলোনি কেন? ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল হীরক।
—তোকে বলে কী হবে বল? এত দূরে থাকিস, পাড়ায় কতকিছু হয় আমি তোকে সব বলব? তোর বাবার তো গত চারদিন জ্বর। বিছানায় শুয়ে আছে। আমাদের কারও মুখে একবারও সেই কথা শুনতে পাবি? চিন্তা করা ছাড়া আর কী করতে পারবি তুই? সেই জন্যেই বলি না।

নীলিমা কিছুই হয়নি ভাব করে বলল বটে, কিন্তু তার মনের মধ্যে ঘণ্টা বেজে উঠল। তার মানে ছেলের সঙ্গে রেখাকে নিয়ে যা ভেবেছিল সেটাই। ভাগ্যিস আগে বলেনি।

ফোন রেখে দিয়ে হীরক ভূতের মতো বসে রইল। কী করা উচিত এখন? আগে না হয় বিজু বলেছে বলে যায়নি, এখন? কী করা উচিত তার?

হীরককে দেখেই বিজুর সন্দেহ হয়েছিল। এমন হাসিখুশি আড্ডা দিচ্ছিল, হঠাৎ হীরকের ব্যবহারের ফারাকটা ওর চোখ এড়ায়নি। সবাই চলে গেলে ওরা কয়েকজন কোথাও বসে ড্রিঙ্ক করবে এরকম কথা ছিল। কিন্তু হীরক যে কোন ফাঁকে চলে এসেছে জানতেও পারেনি। তাই সবকিছু চুকলে মণীশকে নিয়ে বিজু হাজির।

—কী হয়েছে হীরু? তুই এমন হঠাৎ করে নিপাত্তা হয়ে গেলি। একবার বলেও এলি না?

এতক্ষণ অন্ধকার ঘরে চোখ টিপে বসেছিল হীরক। চোখ রক্তাভ, মুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। দুপুরের হীরকের সঙ্গে এই মুখের কোনও মিল নেই। বিজু পাশে এসে বসল। কী হয়েছে বল না হীরু? আমার তো টেনশনে বুক ধড়াস ধড়াস করছে। বাবামায়ের কিছু খবর এসেছে?

মণীশ চেয়ার টেনে বসল। হীরকের ব্যাপারস্যাপার সেও কিছু বুঝতে পারছে না। এই হাসছে, কথা বলছে। এখন এরকম বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে বসে।

—রেখার কথা বলেছিলাম তোকে বিজু। ওর উপর অ্যাসিড অ্যাটাক হয়েছে। মণীশের মুখ থেকে দুপুরবেলায় শুনলাম।
—মণীশ? কই, তুই আমাকে তো বলিসনি কিছু?
—আরে আমি কী করে জানব যে তুইও রেখাকে চিনিস। বাই দ্য ওয়ে তুই ওকে চিনলি কী করে?

বিজু আবডালে চোখ দিয়ে দেখাল হীরককে। মণীশ এ ব্যাপারটা কোনওদিন আন্দাজ করতে পারেনি। স্কুলে থাকতে ক্লাসে এর সঙ্গে ওকে নিয়ে অনেক কথা হত, দেওয়ালে প্লাস চিহ্ন সহযোগে এসব লেখাও হত। কিন্তু হীরক আর রেখার খবর তো কেউ জানত না। বরং রেখার সঙ্গে শানুর একটা কেস জানা ছিল মণীশের।

—এখন আমি কী করব বল বিজু। এবারও কি আমার যাওয়া উচিত নয়? এখনও বলবি কোনও দরকার নেই?
—আমি সেরকম বলব না। তবে বলছিস ওরা দুর্গাপুর ছেড়ে চলে গেছে। তুই কোথায় যাবি, কোন কোন জায়গায় ওদের খুঁজে বেড়াবি? তোর কাছে কোন ফোন নাম্বার আছে?

মাথা নাড়ল হীরক।

—ওদের কোনও আত্মীয়স্বজন? কিংবা রেখার কোনও প্রিয় বন্ধু? কেউ? তাদের থ্রুতে একটু খোঁজখবর কর। এত দূর থেকে হুট করে চলে গিয়ে শুধু লাভ নেই।
—বিজু ঠিকই বলছে হীরু। এমনি এমনি দেবদাস সেজে ঘুরে বেরিয়ে তুই কিছু করতে পারবি না।
—তুই থাম তো। এত ইনসেনসিটিভ কেন তুই? ঝাঁঝিয়ে উঠল বিজু। কোনও প্ল্যান দিতে পারলে বল, ফালতু জোক করিস না এই সময়ে।
—সরি ফর দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ। একটুও না দমে বলল মণীশ। কিন্তু যা করবে ভেবেচিন্তেই করা উচিত। এ তো এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়া নয়। গেল, পেল না। ফিরে এল। কী লাভ হবে? আগে খোঁজ নে। একটা অন্তত হদিশ পেলে তারপর তুই নিজে যা। তার আগে যাস না।

বিজুরও কথাটা মনঃপূত হল। মণীশ কিন্তু এটা ঠিক বলেছে হীরু। তুই তোর ভাইকে বল খোঁজ নিতে। ডেফিনিটিভ। যদি রেখার কোনও বন্ধুকে জানিস বল তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। একবার ও কোথায় থাকে জানা হয়ে গেলে তারপর পনেরো দিনের জন্য ঘুরে আয়। রেখার সঙ্গে দেখা কর। দ্যাখ কী করা যায়।

বিজুরা বেশিক্ষণ বসেনি। একদিন বাদেই ওদের টেক্সাস চলে যেতে হবে। বিজুর অনেক গোছগাছ আছে। তাছাড়া হীরককে একা ভাবার সময় দেওয়া দরকার। যা বললাম ভেবে দ্যাখ হীরু। বলে বিজু আর মণীশ চলে গেল।

হীরক সেদিন রাতেই আবার বাড়িতে ফোন করল। এবার চিনুকে। চিনু, তুই তোর রেখাদির একবার খোঁজ নে।

—ওরা তো কোথায় চলে গেছে দাদা, কেউ জানে না। ওদিক থেকে চিনুর শুকনো গলা। ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল নীলিমা। নিজের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে বেশি কথা বলতে না করে দিল।
—এমন তো হয় না চিনু। কেউ না কেউ ঠিক জানবে। তুই একবার ভাল করে খোঁজ, ঠিক জেনে যাবি। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল হীরক। তোকে খোঁজ পেতেই হবে। শুনলাম বীরুর কাজ এটা। ওই বাস্টার্ডটাকে জিজ্ঞেস কর গিয়ে। এরকম ঘটনায় পুলিশে নিশ্চয় এফআইআর করেছে। থানায় গিয়ে খোঁজ নে, ওরা ঠিক নতুন অ্যাড্রেস জানবে।
—আচ্ছা দাদা, কিছু ভাবিস না। আমি দেখছি।

ওদিক থেকে চিনু ফোন রাখতেই বিমল আর নীলিমা ঘিরে ধরল। কী বলছে হীরু?

—তুমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনলে মা। নতুন করে আর কী বলব তোমায়?

নীলিমা এই খোঁচাটা গায়ে মাখল না। বরং ধমকে উঠল, মুখে মুখে কথা বলিস না চিনু। আমি তোকে পেটে ধরেছি না তুই আমাকে? আমি তোর কথা শুনেছি, হীরু ওদিকে কী বলছে আমি কী করে জানব?

বিমল এসে নীলিমাকে শান্ত করল। আহা ওর উপর কেন রাগ করছ। আয় তো চিনু, এখানে এসে বস। বল কী কথা হল।

সব শুনে নীলিমা বলল, তুই খোঁজ নিবি?

—দাদা এতবার করে বলল, নেব না?
—খবরদার না। তুমি কলেজে পড়ছ। এত কচি খোকা নও যে বোঝো না কী কথার কী মানে হচ্ছে। যে মেয়ের এমন বড় একটা ব্যাপার হয়ে গেছে, হীরু যদি তার জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরে পারব আমরা আটকাতে? ওই মেয়েকে বউ করে ঘরে তুলতে হবে?
—আহা এমন করে কেন বলছ? মেয়েটার কী দোষ?
—দোষগুণ জানি না। আমারো তো মেয়ে ছিল বাপু, কই কেউ তো অ্যাসিড ছুড়তে আসেনি। মেয়েদের একটু সামলে রাখতে হয়। গনগন করে উঠল নীলিমা। একবার ভেবে দেখেছ যদি খোঁজ পাওয়া যায় তাহলে কী হবে? ছেলে যদি ওই মুখপোড়ানো মেয়েকে এনে ঘরে তুলতে চায়, তখন মুখ ফুটে না করতে পারবে?
—আগে থেকে অত কিছু কেন ভাবছ? হীরক কি তোমাকে বলেছে ওই মেয়েকেই বিয়ে করবে?
—আমি মা। জানো তো? আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না অত সহজে।
—তুমি যাই বলো মা, দাদা এতবার করে বলেছে আমাকে একবার খোঁজ নিয়ে দেখতেই হবে। দাদা এসে যদি সহজেই হালহদিস করে নেয় তখন আমি কীভাবে মুখ দেখাব দাদার কাছে?
—সেটা চিনু ঠিকই বলেছে। যদি ধরো হীরু নিজেই চলে এসে খোঁজখবর করতে যায়, পারবে তখন আটকাতে? শুধু শুধু ছেলেটার একগাদা পয়সা জলাঞ্জলি হবে ওই দেশ থেকে আসতে। শুনেছ তো, গরমের ছুটিতে দুই শিফটে কাজ করে টকা জমাচ্ছে ও। সব উড়ে যাবে তখন।
—যা ভাল বোঝো করো। কিন্তু এরকম বিয়ে আমি হতে দেব না আমার বড় ছেলের। তখন আমাকে আর কিছু বলতে এসো না। নীলিমা রাগ করে রান্নাঘরে আশ্রয় নিল।

চিনু খোঁজ করে কিছুই হদিস করতে পারল না যদিও। থানায় গিয়ে জানল, দুর্ঘটনার একমাসের মধ্যে রতনকাকু এসে এফআইআর তুলে নিয়েছে। তারপর ওরা কী করেছে, কোথায় গেছে ওরা তার খবর রাখে না। হসপিটালে ওদের দুর্গাপুরের বাড়ির ঠিকানা দেওয়া ছিল, আর কিছু নেই। সেই বাড়িতে এখন নতুন লোক। তাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইল যদি রতনকাকুর কোনও খবর পাওয়া যায়। ভদ্রলোক সজ্জন। মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, রতনবাবু বারবার আমাকে বলে গেছেন ওর ব্যাপারে কেউ জানতে চাইলে যেন কিছু না বলি। আমি জানিও না সেরকম কিছু। কিন্তু জানলেও বলা যেত না। ওনারা এমনিতেই এত দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, কেন আবার ওদের টানাটানি করছ ভাই?

চিনু মাথা নিচু করে চলে এসেছিল। এরপর রেখাদির দুই বন্ধুর সঙ্গেও কথা বলল। কোনও খবর নেই। ওই অ্যাটাকের পর আবার বোমাবাজি হয়। ভয়ে ওরাও রেখার সঙ্গে সেভাবে দেখা করেনি। নিজেরা চাইলেও বাড়ির লোক রেখার ধারেকাছে যেতে দেয়নি। চারদিকে তাকিয়ে চিনুর মনে হচ্ছিল কীরকম একটা ভয় মানুষের চারপাশে নাগপাশের মতো জাপটে ধরেছে। আজকাল পলিটিক্স সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেঁধিয়ে গেছে। কলকাতার কাছাকাছি হলে তবুও হয়তো খবর হত কোনও। জেলার খবর আটের পাতায় লুকিয়ে থাকে। আর এসব তো কোনও খবরই নয়। নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

সব শুনে ফোনের অন্য প্রান্তে হীরক স্তব্ধ হয়েছিল। একটা জলজ্যান্ত জীবন, একটা পুরো পরিবার তার জীবনের শিকড় ছিঁড়ে কোথায় চলে গেল, কেউ একবার খোঁজ নিতে পারল না! পাশে দাঁড়ানোর কথা ভাবল না! যেন ওরা কোনওদিন ছিল না, এতগুলো বছর এক পাড়ায় রইল, জীবন ভাগ করে নিল তার আর কোনও মূল্য নেই!

বিজু যাওয়ার আগে এক সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, দ্যাখ ডিপ্রেশনটা একটা অসুখ। আমাদের দেশে এগুলো পাত্তা দেয় না, ভাবে শুধু পাগলরাই যায় এইসব ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আমার এখানকার অনেক বন্ধুকে দেখি এই বয়েসেই কয়েকবার ডাক্তারের কাছে ঘুরে এসেছে। যাবি তো হীরু, আমাকে কথা দে।

শুকনো হেসে আশ্বস্ত করেছিল হীরক। বলছিস যখন যাব। এদেশে এসেছি থেকে এখানকার সব রকমের ডাক্তারের সঙ্গেই তো মোলাকাত হয়ে গেল। এটাই বা বাদ থাকে কেন।

ডাক্তারের সঙ্গে বেশ কয়েকটা সিটিং দিয়ে হয়তো ভালই হল। কাউকে নির্দ্বিধায় মনের কথা বলতে পারার একটা শান্তি আছে। এছাড়া সময়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন শান্ত হয়। মেনে নিতে শেখে। তা না হলে মাস্টার্স কমপ্লিট করে এক বছর বাদে যখন বাড়ি যাওয়ার সময় হল আর মা ফোনে বিয়ের কথা বলল, কোথায় সেইভাবে প্রতিবাদ তো করতে পারল না হীরক!

—তোমরা যা ভাল বোঝো করো মা।

নীলিমার বুকে স্বস্তির হাওয়া খেলে গেল। মুখে বলল, আহা বিয়ে করবি তুই। ডিসিশন তো তোকেই নিতে হবে। আমি দুই একটা মেয়ে দেখে রাখতে পারি। আমরা জোগাড়যন্ত্র করে রাখব। তুই এসে একবার মেয়ে দেখে হ্যাঁ বলে দিবি, ব্যস তারপর আমরা না হয় সব কিছু করলাম।

ডিসিশন কি তাহলে হীরকই নিল? ডাক্তার তাকে বার বার পিছনের দিকে না তাকিয়ে সামনে তাকাতে বলেছিল। সে কি এখন থেকে শুধু সামনেই তাকাবে? শুধুই ভবিষ্যৎ? যে ভবিষ্যৎ থেকে রেখাকে মুছে দেওয়া হয়েছে নির্মমভাবে? এই নিয়ে ভাবেনি হীরক তেমন নয়। কিন্তু ভেবে ভেবে কোন কূলকিনারা পায়নি। কোনও পথ দেখতে পায়নি।

—আমি দুটো মেয়ের ছবি পাঠাতে বলছি তোর বাবাকে। আমরা দেখে এসেছি। তোর দিদি পছন্দ করে এসেছে। এইবার ছবি দেখে তুই যাকে ফাইনাল করবি, তাদের সঙ্গেই পাকা কথা বলে নেব।
—তুমি কোনও ছবি পাঠাবে না মা। তোমাদের যাকে পছন্দ, আমার তাতেই হ্যাঁ। একবার মনে হয়েছিল এখন কি বিয়ে না করলেই নয়? কিন্তু এই দুঃসহ দিনগুলো একা কাটিয়ে দেওয়ার জোরও হীরক পাচ্ছিল না।

বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে দেখল ম্যারাপ বাঁধার কাজ চলছে। কোনও আনন্দ হল না হীরকের। নতুন জীবনের কোনও স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল না ওর মনে। রূপা ওকে আলাদা করে ডেকে নিল। দ্যাখ হীরু, যা হয়ে গেছে আর ফেরাতে পারবি না। এখন তুই একটা অন্য মেয়েকে জীবনে আনছিস, তার কথাটা ভাব। ওর জন্যে তো এটা একটা বিশাল দিন। আমাদের সবার জন্যেও। এমন কিছু করিস না, যাতে মেয়েটা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে। তাহলে তোর নতুন সংসারের ভিত প্রথমেই আলগা হয়ে যাবে।

—কী করতে বলিস?
—একবার দেখা করে আয়। দুজনে কটা কথা বল। বিয়ের আগে একটু জানা-পরিচিত হোক। আজকাল তো এমন না দেখে শুনে কেউ বিয়ে করে না।
—মনে কর এখন দেখা করলাম। মেয়েটার আমাকে পছন্দ হল না, কিংবা আমার ওকে মনে ধরল না। বিয়ে ক্যান্সেল করা হবে?
—সেটা তো এখন আর করা যাবে না।
—তাহলে?
—একেবারে বিয়ের রাতে প্রথম দেখবি?
—দেখব। মেয়েটাকে আমার একটা ছবি পাঠিয়ে দে, ওর অপছন্দ হলে ক্যানসেল।
—সে তো ওদের দেওয়া হয়েছে আগেই। আমার ভাইকে কে অপছন্দ করবে। অনেকদিন বাদে হীরকের মাথায় আঙুল চালাল রূপা। চোখ দিয়ে মমতা ঝরে পড়ছিল।
—ব্যস, তাহলে তো সব চুকে গেল। এবার সানাই বাজা।
—সেটা বললে হয় না। মার কথা ভাব। বড় ছেলের বিয়ে, কত আহ্লাদ থাকে মানুষের। বাবা কদিন ধরে তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে, ছেলের বিয়ে ছেলের বিয়ে করে। কিন্তু এখনও মেনু ফাইনাল করেনি, তুই না দেখলে এসব হবে না। বউয়ের গয়না শাড়ি মা মঞ্জিনিকে নিয়ে পছন্দ করে কিনে রেখেছে। কিন্তু তুই তো বউকে কিছু দিবি। বিদেশ থেকে কিছু এনেছিস?

মঞ্জিনি নামটা মাথার মধ্যে গুনগুন করে উঠল হীরকের। কে জানে কেমন সে মেয়ে। সে যেই হোক, বিয়ে যখন করছে তাকে অবহেলাও করতে পারে না হীরক। একটা জীবন নষ্ট হয়ে গেছে বলে, আরেকটা জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে না সে। সে কি ঠিক করছে? একজনকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে আরেকজনে নিজের মন কি পুরোপুরি সমর্পণ করে দিতে পারবে সে কোনওদিন?

—বললি না তো কিছু এনেছিস কি না?

মাথা নাড়ল হীরক।

—তাহলে মুখে হাসি আন। বিয়ে মানুষ বারবার করে না। বলেই ফিক করে হাসল রূপা। তুই অবশ্য যে দেশে গেছিস, ওখানে লোকে বারবার করে। কিন্তু মোটেই সুখের হয় না সেই জীবন। যাকগে, তুই নিজে কিনতে গেলে কিনে আন কিছু। না হলে আমার সঙ্গে চল, পছন্দ করে অন্তত একটা ভাল দেখে আংটি কিনে আন। ফুলশয্যার রাতে দিতে হয়।

সবই করল হীরক।

মা যখন মেঝেতে চাদর বিছিয়ে বিয়ের সব কেনাকাটা, মেয়ের গয়না, শাড়ি, শ্বশুরবাড়ির সব নমস্কারি দেখাল মাথা নেড়ে নেড়ে দেখল সব।

বাবা মেনু দেখিয়ে লুচি হবে না রাধাবল্লভি, ইলিশমাছের পাতুরি না চিংড়িমাছের মালাইকারি করা ভাল হবে সেটা জিজ্ঞেস করল, নিজের মতামত দিল হীরক।

রূপা পছন্দ করে বিয়ের পাঞ্জাবি বানিয়ে এনেছিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেগুলোর তারিফ করল।

বন্ধুদের বাড়ি গিয়ে গিয়ে নিমন্ত্রণ করে এল।

এমনকি বীরুকেও। ছোটবেলার বন্ধু। আর সবাইকে বলে ওকে বাদ দিলে সবার খুব চোখে লাগবে। তার উপর এখন আবার বড় রাজনৈতিক নেতা। নিমন্ত্রণ না করলে জলঘোলা হবে শুধু শুধু। আর তো কেউ জানে না হীরকের সঙ্গে রেখার কী কথা হয়েছিল। কেন শুধু শুধু পাঁচকান করা। বুঝিয়েছিল নীলিমা। মেনেও নিয়েছিল হীরক।

জীবনে মানিয়ে নেওয়াটা একটা খুব দরকারি ব্যাপার। কোনও রাগ বা দুঃখই চিরকাল মনের মধ্যে পুষে রাখা যায় না। মানুষের মনটাকেই পোষ মানাতে হয়।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4802 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...