উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় প্রয়োজন বোর্ড অনুসারে নম্বরের সমতুল্যকরণ— একটি জরুরি প্রসঙ্গ

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


উচ্চশিক্ষায় প্রবেশার্থে, বিভিন্ন উচ্চমাধ্যমিক বোর্ডের মোট নম্বরের বিষয়ে, সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের একভাবে যাচাইয়ের প্রয়োজনে এই সমতুল্যকরণ-এর দাবি কিন্তু আজ নতুন করে উঠে আসছে না। বেশ কিছুকাল আগেই অধ্যাপক এসকে জোশির সভাপতিত্বে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে এই বিষয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয়। সেই কমিটি এই বিষয়ে একাধিক সমাধানসূত্র অথবা সেই সমাধানে পৌঁছানোর উপায়গুলি মন্ত্রকের কাছে পেশ করে। তার পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট অথবা সমতুল একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক-বিজ্ঞানীদের আলোচনা-গবেষণাতেও এই সমতুল্যকরণ-এর প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসতে থাকে

 

আমাদের দেশে নম্বরের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। নম্বর বলতে আমি বিশেষভাবে স্কুলজীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় একজন ছাত্র বা ছাত্রীর মোট প্রাপ্ত নম্বরের বিষয়ে উল্লেখ করতে চেয়েছি। যতই আমরা ডাক্তারি অথবা ইঞ্জিনিয়রিং, উচ্চশিক্ষায় এই দুটি বৃহত্তর বিভাগের ক্ষেত্রে একাধিক সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখি না কেন, বিরাট সংখ্যক অন্য যে বিষয়গুলিকে আমরা কিঞ্চিৎ অল্প গুরুত্বের সঙ্গে ‘জেনারেল লাইন’ বা ‘সাধারণ বিষয়সমূহ’ বলে উল্লেখ করে থাকি, দেশের ছাত্রছাত্রীদের বৃহদংশই কিন্তু ‘সাধারণ’ সে-সমস্ত ‘বিষয়’কেই উচ্চশিক্ষার পথে নিজেদের প্রথম ধাপ হিসেবে বেছে নেয়, এবং সেই নির্বাচনের সময়েই তাদের স্কুলজীবনের পরীক্ষার নম্বর, তাদের ব্যক্তিগত মেধার অন্যতম নির্ণায়ক হিসেবে উঠে আসে। অন্যতম নির্ণায়ক কারণ, বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে (হয়তো বা অন্য যে কোনও ক্ষেত্রেও), ভর্তি অথবা নির্বাচনের সময়ে— যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচনের বদলে, অযোগ্য প্রার্থীদের বর্জন করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে প্রতিভাত হয়। বিপুল জনসংখ্যার কারণে ‘গ্রহণ’-এর বদলে বিপুল সংখ্যায় প্রার্থীকে ‘বর্জন’ করাটাই কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই কাজে বিভিন্ন উচ্চ-মাধ্যমিক বোর্ডের নম্বরকে ‘গ্রহণ’ (পড়ুন ‘বর্জন’-এর) একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে তুলে আনাটাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সহজ বলে বিবেচিত হয়।

এই প্রসঙ্গে আমাদের রাজ্যের কথায় আসা যাক। বিগত বেশ কিছু বছরে কেন্দ্র বনাম রাজ্যের হরেক দড়ি-টানাটানির সময়ে, শিক্ষাক্ষেত্রে সামাজিক পছন্দের বিষয়েও কেন্দ্র বনাম রাজ্যের আরও একটি প্রকাশ্য লড়াই দেখা যাচ্ছে। তদুপরি সেই লড়াইয়ে আমাদের রাজ্য কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্রমশই পিছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ, অবস্থাপন্ন বেশিরভাগ অভিভাবক তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের কেন্দ্রীয় বোর্ডের আওতায় স্কুলশিক্ষায় ভর্তি করাতে চাইছেন। সেই ইচ্ছার সঙ্গে তাল মিলিয়ে একের পর এক পূর্বপরিচিত রাজ্য সরকারি বোর্ডের আওতায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইসিএসসি অথবা সিবিএসই-র মতো বোর্ডের পাঠ্যক্রমে নিজেদেরকে রূপান্তরিত করছেন, অথবা সেই প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করছেন। প্রশ্ন এখানেই, কেনই বা বিপুল সংখ্যাতে অভিভাবক-অভিভাবিকারা এমন ভর্তির ক্ষেত্রে, রাজ্য ছেড়ে কেন্দ্রীয় বোর্ডের পরিসরকেই স্কুলশিক্ষার বিষয়ে উপযুক্ত বলে মনে করছেন? পাঠক্রমে কিছু রকমফের থাকলেও, কেন্দ্রীয় বোর্ডগুলির সঙ্গে রাজ্য বোর্ডের পাঠ্যক্রমে বিরাট কোনও উৎকর্ষগত ব্যবধান রয়েছে তা কেউই মনে করবেন না। তাহলে কেনই বা কেন্দ্রের মুখাপেক্ষী মানুষ?

শুভানুধ্যায়ী এক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এই বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি দেখিয়ে দেন, আইসিএসসি অথবা সিবিএসই বোর্ডের ক্ষেত্রে উচ্চ-মাধ্যমিক সমতুল পরীক্ষায় যেভাবে ছাত্রদের মোট প্রাপ্ত নম্বর ‘বেস্ট অব ফোর’-নীতি অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়, তাতে গড়পড়তা হিসেবেই ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বর বেশির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর বিপরীতে রাজ্য বোর্ডের পরীক্ষার ক্ষেত্রে অ্যাডিশনাল সাবজেক্ট বা অতিরিক্ত বিষয়ের গুরুত্ব ক্রমশ কমে আসা, তদুপরি সমস্ত বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বর একসঙ্গে যোগ করেই মোট প্রাপ্ত নম্বরের হিসেব— এগুলির কারণে গড় প্রাপ্ত নম্বরের বিবেচনায় রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার্থে প্রবেশাধিকার অর্জনের সময় ক্রমশ পিছনের সারিতে চলে যায়। স্বভাবতই ‘গ্রহণ’-এর (পড়ুন ‘বর্জন’-এর) সময় গোটাগুটি নম্বরের হিসেবেই রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত অথবা ‘বর্জিত’-এর তালিকায় গিয়ে পড়ে।

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, বর্তমান সময়ে তো রাজ্য বোর্ডের ক্ষেত্রেও ভাল ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই যথেষ্ট ভাল নম্বর তাদের মার্কশিটে তুলে আনছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রথম দশ, একশো বা হাজারজন ছাত্রকে দিয়ে গোটা সমাজের অবস্থা নির্ধারণ চলে না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত আলোকতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কণিক পালধির উক্তি ধার করেই এখানে বলছি, “আমরা দেখতে পাচ্ছি জেনারেল কোর্সগুলিতে কেবল যে কেন্দ্রীয় বোর্ড থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের রমরমা তাই নয়— অন্যদিকে তুলনায় কম নম্বর পেয়ে রাজ্য বোর্ডের হাতেগোনা যে কয়েকজন ছাত্র বা ছাত্রী এই কোর্সগুলিতে ঢুকছে, নম্বরের হিসেবে কেন্দ্রীয় বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের ফারাক থাকলেও, মেধার নিরিখে তারা কেবল পূর্বোক্তজনেদের সমতুলই নয়, অনেক ক্ষেত্রে বেশি নম্বর পাওয়া কেন্দ্রীয় বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরাই উজ্জ্বলতর বলে প্রতিভাত হচ্ছে।” অধ্যাপক পালধি জানান এই বিষয়ে অন্যান্য বিভাগের বরিষ্ঠ অধ্যাপকেরাও তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। তিনিই মনে করিয়ে দেন এই সমস্যার গোড়াপত্তন কোথায়।

পূর্বে যেমনটা বলে এসেছি— ভর্তি-ব্যবস্থায় বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে ‘গ্রহণ’-এর পরিবর্তে ‘বর্জন’ই যেখানে নির্বাচন-পদ্ধতির মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে একাধিক পাঠক্রম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের প্রাপ্ত নম্বরের ভিতরে যদি একটি গুণগত সামঞ্জস্য না থাকে, তখন স্বভাবতই অধিক নম্বর যে বোর্ডে পাওয়া সম্ভব সেই বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরাই ভর্তির ক্ষেত্রে অধিক সুবিধা পেয়ে থাকে। অর্থাৎ, ভর্তির ক্ষেত্রে সুষম প্রতিযোগিতা অথবা প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রত্যেক ছাত্রের প্রাপ্য সমান সুযোগের প্রাথমিক কাঙ্খিত নীতিটিই সেখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এই সমস্যার সমাধান কোথায়?

বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার ক্ষেত্রে আমরা যেমনভাবে, “এই সমস্যার সমাধান কোথায়?” বলে গা ছেড়ে দিতে পছন্দ করি, এখানে কিন্তু নম্বর অথবা সংখ্যার বিষয়টি সমস্যার অধীন বলে, সমাধান পদ্ধতিটিও খুব সহজেই সামনে নিয়ে আসা যায়। যদিও, গণিতবিদ্যা এমনই এক বিষয়— পৃথিবীর সকল সামাজিক সমস্যাগুলির ক্ষেত্রেও সেই অঙ্ক অথবা সংখ্যার মাধ্যমেই সেগুলির সার্থক প্রকাশ ও সমাধান তুলে আনা চলে। অমর্ত্য সেন অথবা সমতুল বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরা, যাঁরা কল্যাণকর অর্থনীতির বিষয়ে ফলিত গবেষণা করেছেন, তাঁদের গবেষণার চুম্বক খতিয়ে দেখলেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়— কিন্তু সে-প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। প্রসঙ্গটি এল কারণ, আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, অঙ্কের জ্ঞান ও সদিচ্ছা— এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই কিন্তু প্রায় যে কোনও সমস্যা নির্ধারণ ও তার সমাধান সম্ভব— এ কেবল নিছকই অত্যুক্তি নয়। কেবল অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয়ের ঘাটতিই একেকটি সমাধানের পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে উঠে আসে।

রাশিবিজ্ঞানের পরিভাষায়, বিভিন্ন রাশির সংখ্যাগত (quantitative) অথবা গুণগত (qualitative) সঠিক মান (বা অবস্থান) নির্ণয়ের প্রয়োজনে, ও তদপরবর্তীতে নির্ণীত মান (বা অবস্থান) অনুসারে, রাশিগুলিকে ক্রমানুসারে সাজানোর (ordering) ক্ষেত্রে, একটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পদ্ধতিটিকে আমরা বলি normalization, অথবা স্বকৃত বাংলা অনুবাদে আমি বলব সমতুল্যকরণ। এই সমতুল্যকরণ কিন্তু নিছকই একটি গাণিতিক প্রক্রিয়া— যার উদ্দেশ্য হল, কোনও একটি চলরাশির (variable, এক্ষেত্রে পরীক্ষায় প্রাপ্ত কোনও ছাত্রের মোট নম্বর) বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত মানকে (value, এক্ষেত্রে বিভিন্ন বোর্ড অনুসারে একজন ছাত্রের প্রাপ্ত মোট নম্বর), সেই উৎস অনুযায়ী ভারযুক্ত করে, সেই ভারযুক্ত মান অনুসারে একটি ভারযুক্ত গড় মান (weighted average) নির্ণয় করা বা প্রস্তাব করা। অর্থাৎ, খুব সহজ করে বললে— বর্তমান সমস্যাটির ক্ষেত্রে আমাদের সমাধান-লক্ষ্য হবে জাতীয় স্তরে এমন একটি সূত্র নির্ধারণ করা— যে সূত্রের মাধ্যমে, স্বাধীন চলরাশি অথবা input হিসেবে যে-কোনও বোর্ড অনুসারে কোনও ছাত্রের প্রাপ্ত মোট নম্বরকে প্রয়োগ করা হলে, সর্বভারতীয় মাপকাঠি অনুসারে সূত্র তার ফলাফল হিসেবে, বা output হিসেবে একটি নম্বর জানাবে যা কিনা অন্যান্য বোর্ডগুলির নম্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সমতুল হিসেবে উঠে আসবে।

উচ্চশিক্ষায় প্রবেশার্থে, বিভিন্ন উচ্চমাধ্যমিক বোর্ডের তরফে প্রাপ্ত মোট নম্বরের বিষয়ে, সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের একভাবে যাচাইয়ের প্রয়োজনে এই সমতুল্যকরণ (normalization)-এর দাবি কিন্তু আজ নতুন করে উঠে আসছে না। বেশ কিছুকাল আগেই অধ্যাপক এসকে জোশির সভাপতিত্বে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে এই বিষয়ে একটি কমিটি তৈরি করা হয় এবং, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেই কমিটি এই উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষাগুলির জন্য মোট প্রাপ্ত নম্বরের সমতুল্যকরণ বা (normalization)-এর বিষয়ে একাধিক সমাধানসূত্র অথবা সেই সমাধানে পৌঁছানোর উপায়গুলি মন্ত্রকের কাছে পেশ করে। তার পরবর্তীতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট অথবা সমতুল একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক-বিজ্ঞানীদের আলোচনা-গবেষণাতেও এই সমতুল্যকরণ বা (normalization)-এর প্রয়োজনীয়তার কথা উঠে আসতে থাকে। কিন্তু সমস্যার গুরুত্ব থাকলেও কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বা সংশ্লিষ্ট আমলা-আধিকারিক, ও ক্ষমতাবান মানুষেরা বিষয়টিকে লালফিতের ফাঁসেই আটকিয়ে রেখে দেন। ফলস্বরূপ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীদের নিরিখে তাদের উচ্চশিক্ষায় ভর্তির মতো যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটিকে আমরা আজও, এই দিন অবধিও গাণিতিকভাবে এক ‘অ’সুস্থ প্রতিযোগিতার গণ্ডিতেই আটকিয়ে ফেলে রাখতে পেরেছি। উচ্চশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে সমস্যার উপরে নির্ভরশীল, অবিলম্বে সেই জরুরি বিষয়টিকে নিয়ে সামাজিক পরিসরে আরও বেশি করে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত বলে মনে করছি।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...