ভাইরাস

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

কাকভোরে ওঠা অভ্যেস নয় অখিলবন্ধুর। প্রথম রাতে ঘুম চোরপুলিশ খেলে। চলতে থাকে এপাশ, ওপাশ। কখনও ধপাস। সেই ছোটবেলা থেকে ওই এক তক্তপোষে। একটা বড় খাট হলে কুমড়ো গড়ানে কত সুবিধা। কিন্তু একা মানুষের জন্য পেল্লাই খাটের দরকারটা কী? পয়সার শ্রাদ্ধ। শ্রাদ্ধের কথায় মনে হল, এই তক্তপোষে শেষযাত্রাটাও দিব্যি হয়ে যাবে। এটা ফেলে খাট করালে শেষের যাত্রায় আবার খাটিয়ার জন্য মেলা পয়সা খরচ।

সে খাট হোক কি তক্তপোষ, সকালের ঘুমটা বড় আদরখাকি। ভোরের ঘুমটা এমন, যে স্পষ্ট জানা যায় যে সে ঘুমাচ্ছে। শীত গ্রীষ্ম নির্বিশেষে একটু বেলায় ওঠা অভ্যাস। বাইরে লোক ঘুরছে, বাজারে লোক বসছে, রিক্সা ঠনঠন করে চলে গেল। অখিলবন্ধু চোখ দিয়ে ঘুমাচ্ছে, কান দিয়ে শুনছে আর নাক দিয়ে ফোঁড়ত ফোঁ। ঘুমাতে ঘুমাতে নিজের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাওয়ার থেকে বড় আনন্দের আর কিছু নেই।

তাছাড়া আগে উঠে করবেইটা বা কী? বাড়িতে কোনও কাজের লোক নেই যে সকালবেলায় এসে বাবু, দরজা খোলো বলে হাঙ্গামা জুড়বে। তার কোনও কাজে বেরোনোর দৌড়ঝাঁপ নেই, যে নাকেমুখে গুঁজে কারও দোরে গিয়ে পেন্নাম ঠুকতে হবে। এই একটা কাজ জগৎবন্ধু জব্বর করে গেছে। বাপদাদার লাগানো বাঁশঝাড় সাফ করেছে, আর একতলা দোতলা যা পারে বানিয়ে লোক এনে বসিয়ে দিয়েছে। গোড়ার একটা এখনও টালির চাল। হাতে গুনে উনিশ ঘর ভাড়াটে ইহাগ্রামের ফাঁকেফোঁকরে ছড়ানো। অখিলবন্ধুর কাজ তাদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা।

এটা শুনে যদি মনে হয় অখিলবন্ধুর জীবন সুখের প্রাণ গড়ের মাঠ, সে গুড়ে বালি। সবকটা হাঘরের বাচ্চা। কার কবে মাইনে, তার নেই ঠিক। কারও হয় এক তারিখে তো কারও দশে। কারও জোটে হপ্তায়। পেলেও যে তাদের হাত দিয়ে সহজে টাকা গলবে এমন নয়। একেকটা যা তিলেখচ্চড়, সাঁড়াশি প্যাঁচে গেঁজের থেকে টাকা বের করে আনতে হয়। ঠিক সময়ে না নিলে চোলাই গিলে টাকা ফুড়ুৎ।

এই যে সুবিমল বাঁড়ুজ্জে। হাড়হারামি, বামুনজাতের কুলাঙ্গার। বলে কিনা একুশ বছর ধরে টাকা গুনছি। যত টাকা তোমার হাতে মাস গেলে ধরিয়েছি, তাতে আমার অ্যাদ্দিনে তিনমহলা বাড়ি হয়ে যেত।

এখনও হতে পারে তিনমহলা বাড়ি। এই তো গেঁড়ে গণেশ আমাকে এত্তালা পাঠিয়েছিল, এই স্থানটা তার খুব মনে ধরেছে, এখানে একটা ফ্ল্যাট বসাবে, চারতলা। শহরে নাকি খুব হচ্ছে। মেলাই টাকা দেবে। একবার হ্যাঁ করে দিলেই হয়।

এই কথাটা গত ছয়মাস ধরে শোনাচ্ছে অখিলবন্ধু, তাতেই সুবিমলের ছলাকলা সাঙ্গ। কেন্নোর মতো গুটিয়ে পকেট ঘেঁটে পাত্তি ঝেড়ে দেয়। আর কদিন এই মন্ত্রে বশ মানবে কে জানে? সে না হয় দেখা যাবে, টোটকা তার অনেক জানা আছে।

কিন্তু যেটাকে শায়েস্তা করতে পারছে না, সেটা হল রতন সাহা। পুঙ্গির পুত গত কমাস ধরে কী ঝোলান ঝোলাচ্ছে। আগে ব্যাটা হপ্তায় দিত, এখন মাস গেলেও রা কাড়ে না। শেষ কদিন ওর দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। যখনই যায় ওর বউ মালতী বলবে, সে তো বাড়ি নেই বাবু।

সকাল নটায় গেছে। তাতেও নেই।

আটটায়, তাতেও পাখি ভোঁ ভা।

আজ তাই আলো ফোটার আগে চলেছে অখিলবন্ধু। সকাল পাঁচটায় বাছাধন আর যাবেন কোথায়?

নিজের ঘুমের দফাগয়া করে যাওয়া। ভোরের নাকডাকার শব্দ শোনা হল না, মনটা শোকস্তব্ধ। হাঁটতে হাঁটতে নিঃশব্দ গালাগালি মাথায় নিয়ে সকালের আধো অন্ধকার ঠেলে চলেছিল অখিলবন্ধু। রাস্তায় কাকপক্ষীটা নেই। অন্ধকারে চেনা গলিটাও অজানা বোধ হয়।

তখনই গদাম!

নিজের জুতো বাঁচাতে ব্যস্ত না হলে অখিলবন্ধু এমন জোর ধাক্কাটা খেত না। লোকটাও বেয়াক্কেলে। এমন রেসের ঘোড়ার মতো দৌড়ে আসার কী ছিল অ্যাঁ? তাও আবার মোড়ের মাথায়? ধাক্কা খেয়ে অখিলবন্ধু পপাত। ওই লোকটা ঝপাত। অখিল চ, লোকটা ঘেঁটে ঘ। দুজনে মিলে কুমড়োগড়ান। অখিলবন্ধু যদি চিমড়ে হয়, এই লোকটা পাশবালিশের মতো নাদুসনুদুস। তাই জোর কা ঝটকা ধীরেই লাগল অখিলবন্ধুর।

—কে হে এমন উদোর মতো চলেছ? চোখ নেই? বেয়াক্কেলে, হতভাগা কোথাকার!

উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়তে ঝাড়তে হেঁ হেঁ করে হাসল লোকটা। এত জোরে গালি খেল, কোনও হেলদোল নেই। আপনার লেগেছে বুঝি কত্তা? অখিলবন্ধুর গলা যদি চড়াই, সে উতরাইতে। বেশ মিহি গলা। না মিহি নয়, মনে হয় কেউ পাঁউরুটিতে সর মাখিয়ে দিয়েছে, পুরু করে।

তবু তেড়ে উঠল অখিলবন্ধু। হেঁ হেঁ কোরো না, দিলে তো সকালটা মাটি করে আমার। দোষ করে আবার ন্যাকাকেষ্ট সাজা হচ্ছে। চাবকাতে হয় তোমার মতো লোককে।

—একদম, আগপাশতলা। পুরো দোষটাই আমার। কানার মতো পথ চলেছি যাকে বলে, রামধাক্কা মেরে আবার ন্যাকামি করে জিজ্ঞেস করছি লেগেছে কিনা। কষে চাবুক মারুন দিকি।

কে রে এটা? সে যা বলছে সব মেনে নিচ্ছে। আবার বলছে আমায় চাবুক মারুন। আবহাওয়া দপ্তরের ঘোষিত বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির মতো অখিলবন্ধুর রাগটা দিকচিহ্ন ভুলে কেমন মিইয়ে গেল।

—না, না দেখা কি আর যাচ্ছিল ঠিক করে। আলো তো ফোটেনি। আর আমিও একটু অন্যমনস্ক ছিলাম বোধহয়।

বলেই অবাক হয়ে গেল অখিলবন্ধু। এটা তো বলতে চায়নি সে। এটা কোন অখিলবন্ধু রে বাবা! এমন নরম করে পোঁ ধরেছে? যখন কিনা গাটা এখনও টাটাচ্ছে।

—তোমার লাগেনি তো? নিজের বিনীত প্রশ্নে এবার বিষম খাবার জোগাড় অখিলবন্ধুর।
—আমার অভ্যেস আছে, জীবনে কম তাড়া তো খাইনি কত্তা।
—কে তাড়া করেছে তোমায়?

বলতে বলতে একটু সন্দেহ জাগে মনে। চোর নাকি? চুরি করে পালাচ্ছে? হতেই পারে, এখনও রাতের কালো যায়নি মোটে। আহা রে কী কষ্ট এর জীবনে। যদিও এরকম ফুলকো লুচি মার্কা চোর জীবনে দেখেনি অখিলবন্ধু।

জনশূন্য রাস্তায় ফিসফিস করে এবার লোকটা। কেউ তাড়া করেনি, কিন্তু কত্তে পারে। পাইলেছি কিনা?

আরেব্বাস! জেলখানার কয়েদি নাকি? কিন্তু কাছেপিঠে কোনও জেলখানা আছে বলে তো জানে না অখিলবন্ধু। থানার গারদ থেকে? সে তো আর না হোক পাঁচ মাইল দূর। জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠল তার। কোথা থেকে পালাচ্ছ? ওখানে খুব অত্যাচার করত তোমায়?

—বেবাক। সকালের তারাঢাকা আলোয় চর্বি ঠেলে চোখ ভেসে উঠল লোকটার। চোখের আকুতি দেহের আকৃতির সঙ্গে বেমানান যদিও।
—মারত?
—সে হলে সামলে নিতুম।
—খেতে দিত না? এই চেহারায় সেটা কী করে সম্ভব মালুম হচ্ছিল না অখিলের।
—খাওয়ার পরোয়া করেছি কখনও? না খেয়েদেয়ে পড়ে থাকতাম ইস্টিশান চত্বরের খোলা বাতাসে। বিরিজের তলায় মেলা জায়গা ছিল আমার। কেউ দিলে খেতাম, না হলে হরিমটর। সুখ সইল না। ফড়ত শব্দে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল লোকটা।

না খাওয়ার সুখ অখিলও জানে, কটা পয়সা দিব্যি বেঁচে যায়। সুযোগ পেলেই পেটে কিল মেরে পড়ে থাকে সেও।

—লোভে পাপ! মাস কয় আগে খাওয়ার লোভ দেখিয়ে এই পাগল বুড়োটা আমায় তার বাড়িতে ধরে আনে।
—মাগনা খাবার দিত?
—আমার বাপের জন্মে খুচরো পয়সা ছাড়া কোনও নোট হাতে ধরিনি, আমি কোথা থেকে দাম দেব?
—রোজ?
—চারবেলা। গত কয়েক মাস সেই খেয়েই তো আমার গায়ে গতরে এমন গত্তি লেগেছে। আমার মা বেঁচে থাকলে ভিরমি খেত।
—খাটাত বুঝি খুব?
—কোথায়? খাচ্ছি দাচ্ছি বগল বাজাচ্ছি।
—মারধর করত বুঝি?
—না, ভারী ভাল মানুষ সেই বুড়ো।
—কে সে? কী তার নাম? ইহাগ্রামে এমন লোকের হদিশ সে জানে না, কেমন করে হয়?
—বুড়ো তার নাম, আর তো কিছু জানি না।
—এখান থেকে কতদূর তার বাড়ি?
—সে ধরুন এক মাইলও হতে পারে, পাঁচ মাইলও হতে পারে। আমি কি আর রেসে নেমেছি যে জানব। দু-চোখ বন্ধ করে ছুটছি।
—কিন্তু ছুটছ কেন?
—ওই যে বললাম, পালাচ্ছি।
—পালাচ্ছ কেন সেটাই বলো না বাপু।
—কাঁহাতক দিনরাত শুধু বসে বসে খাওয়া যায়? একটা লোক নেই হাপুসহুপুস কথা কইব। সারাদিন ঘরে আটকে থেকে পেটের মধ্যে কথা জমে গ্যাস হচ্ছে, অথচ বুড়োর বাড়ির চারদিকে উঁচু দেওয়াল, সদরে তালাবন্ধ।

এমন পাঁচিলওলা বাড়ির কথা জানা নেই অখিলবন্ধুর। তাহলে আজ পালালে কী করে?

এবার একচোট হাসল লোকটা। বুড়োটা ভুলে গেছিল আজ দরজায় তালা ঝোলাতে। যেই ফাঁক পেয়েছি, পাইলেছি। নাহ, আমি ছুট লাগাই আবার, যদি সেই বুড়ো এসে পড়ে, আবার আটকে দেবে।

অখিলবন্ধুকেও আগে বাড়তে হবে। আকাশ এখন তরমুজের মতো লাল, আর একটু দেরি হলে ফুটির রং নেবে। রতন সাহাও ততক্ষণে বাড়ি থেকে ফুটে যাবে। আজও যদি পাকড়াতে না পারে তাহলে চলবে কী করে?

হাঁটা লাগাল সে, কিন্তু মাথা থেকে লোকটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারল না। এই বুড়োর ঠিকানাটা পেলে বড় কাজে লাগত। রোজকার ছাতু লঙ্কা খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে। একটু ভালমন্দ সাঁটাত কদিন।

তবে সকালটা দিব্যি লাগছে। কাক গলা সাধছে, তাদের কা-কা ধ্বনি সকালের দিকে বেশ মিঠে লাগল কানে। সকাল দেখেনি আজ কত যুগ, মনটা তাই ফুরফুরা শরিফ। এমনি সময়ে অখিলবন্ধু যাওয়ার পথে বাড়ি মাপে, একেকটা বাড়িতে কত ভাড়া নিতে পারে তার একটা হিসেব লাগায়। আজ কেমন গাছের পাতা নড়া, ডোবায় ভোরের আলোর ঝিলিক এইসব দেখতে দেখতে চলেছে। এতই বিভোর হয়ে গেছিল রতন সাহার বাড়ি, মানে বাড়িটা তো তার, ভাড়াটে রতন, সেটাও পেরিয়ে যায় আর কি।

চারদিক এখনও সুনসান। নিচে দু-কামরা, উপরে দুই। নিচে থাকে বিপুল তলাপাত্র। তার ভাড়া মাসের শুরুতে পায় এখনও ঠিকঠাক। বাড়ির বাইরে দিয়ে জং ধরা লোহার সিঁড়ি, সেটা দিয়ে পা টিপে টিপে উঠে রতনের দরজার কড়া নাড়ার আগে একবার থমকাল অখিলবন্ধু, আগে ঠাহর করা যাক ঘরে দুজন আছে কি নেই। হালকা পাটাতনের দরজা, ফিসফিস করলেও ঘর টপকে বাইরে।

কিন্তু কথা না হলে শুনবে কেমন করে? একটু আগেও কথা হচ্ছিল। ফিসফিস গুজগাজ নয়, বরং বেশ কাড়ানাকারা বাজিয়ে। ভুলের মধ্যে টাকা নিয়ে বৌয়ের ফোঁসফোঁসানি শুনতে শুনতে রতন বলে উঠেছিল, আরে দাঁড়া না কটা দিন, একটা খুনের বরাত যা পেইচি, কড়কড়ে পাত্তি আসবে পকেটে। চুরি, রাহাজানি এসব করেছে রতন। হাতে আর কাজ নেই, না হলে খাবে কী? তাই বলে খুনজখম? মালতী প্রথমে হাতপাখা ছুড়েছিল, সেটা বাঁ হাতে আটকে রতন খানিক হ্যা হ্যা করে হেসে নিয়েছিল। আরও রেগে মালতী থালা বাটি খুঁজতে বিছানা ছাড়তেই চিত্তির। দুলকি চালে হেঁটে আসা অখিলবন্ধুকে দেখে ফেলল। বিদেশি হানার সামনে দেশে অখণ্ড শান্তি। তারপর সব কথা ইশারায়। দরজায় মালতীকে দাঁড়াতে বলে রতন নিজের শরীরটাকে গলিয়ে দিল বাথরুমের ছোট জানালা দিয়ে।

দরজার ওপাশ থেকে মালতীর নাকের ফোঁসফোঁস অখিলবন্ধুর সজাগ কানে এসে পৌঁছাল ঠিক। তাহলে কি জানালা দিয়ে বেরোচ্ছে রতন? আহা রে, উপর থেকে পড়ে ব্যথা না পায়! তড়িঘড়ি অখিল জানালার নিচে মজুত। রতন বাথরুমের জানালা দিয়ে নিচে যেই না ঝাঁপ মেরেছে, সরাসরি অখিলবন্ধুর হেফাজতে। রতনের দুই কোমর ধরে রাধিকে স্টাইলে ঝুলে পড়েছেন, ব্যাটার সাধ্যি কি এগিয়ে যায়। নিজেকে একটু সামলে অখিলবন্ধু খ্যাঁকানিটা দিতে গেলেন, কিন্তু মুখ দিয়ে বের হল সুললিতের বাণী। কেন রে রতন, ভাড়া না দিয়ে পালাচ্ছিস যে বড়?

রতনের কোমরে চেম্বারটা মজুত ছিল, খুনের কেসটা আজকেই কি না। বাথরুমের জানালা থেকে ঝুলতে ঝুলতে ভেবেইছিল খুন যদি করব, একটা কেন, দুটোই কেন নয়। কিন্তু সেসব ভুলে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল, আমি কি আর আপনের টাকা মারতে চাই কর্তা, আপনার মতো মানুষ আর কটা হয়। আজ রাতের মধ্যেই যদি না…

বিগলিত অখিল বলল, এই, ব্যস। এইটুকুই। দিবি যে সেটাই আসল। না হয় আজের বদলে কাল দিবি। না পারলে দিবি না। কিন্তু দাদার কাছ থেকে এমন পালিয়ে বেড়াতে হয়?

উপরের সিঁড়ি থেকে মালতী অবাক হয়ে এইসব দেখছিল, এবার অখিলবন্ধুকে একটু নরম দেখেই জমিতে আঁচড় কাটতে নেবে এল।

এতক্ষণে পাঠকেরা নিশ্চয় বুঝে ফেলেছেন যে একটা অদ্ভুত ভাইরাস ছড়াতে শুরু করেছে। সব ভাইরাসের মতোই এটার প্রভাব কারও উপরে বেশি, কারও উপরে কম। কারও কাবু হতে কম সময় লাগে, কারও বেশি। যেমন মালতী খড়খড় করে বলে উঠেছিল, এ কেমন ব্যাভার আপনার, সক্কাল সক্কাল এসে ভাল মানুষের ছেলেকে এমন দৌড়ঝাঁপ করাচ্ছেন— বলে হাত বাড়িয়ে রতনের হাত ধরে টেনে তুলতে গেল— ব্যস! বক্তিমেতে পাশার দান উলটে পপাত। আমরা কোথায় আপনাকে সকালবেলা চা মুড়ি খাইয়ে কেমন করে আপ্যায়ন করব ভাবি…

এত বছরে এত তাগাদায় এসে কোনওদিন এক গ্লাস জলও পায়নি অখিলবন্ধু, আজ সে কিনা রতনের চৌকিতে বসে পা দুলিয়ে চা আর মেরি বিস্কুট খেয়ে তবে ছাড়া পেল?

এর পরে ব্যাপারটা হু হু করে ছড়িয়ে গেল, হু কোনও বিধান দেওয়ার আগেই। রতন সাহা বাঁশবেড়ের খগা মল্লিককে লোপাট করার সুপারি পেয়েছিল। খগা হচ্ছে সাকিন এমএলএ গগন ধারার গোলাগুলিতুতো পোষ্য। তার গায়ের লোম্বাটাও ছোঁয় এমন সাধ্যি সাত গ্রামে কারও নেই। দিনরাত পাহারা, সুলভ সাহার পোষা গুন্ডারা তাকে গেম করবে এমন সাধ্যি হয় না। সুলভের সেনাপতি তাই রতনের মতো এক ছিঁচকেকে বেছেছিল, রতন সাহা খুন করার বরাত পেয়েছিল। তাকে গুলি চালানোর তালিমও দেওয়া হয়েছে। শিখেছিল গোঁফ গজানোর সময়, কিন্তু কারও ঘাড়ে নল গোঁজার সুযোগ ঘটেনি। টুকটাক চুরিতে ছুরির ডগা দেখালেই কাজ হয়। এতদিনে হাতে জং। কিন্তু সুলভদা বলেছিল তোকে তো কেউ সন্দেহ করবে না, বেশি হলে বেপাড়ায় চুরি করতে এসেছিস বলে কয়েক ঘা দিয়ে ছেড়ে দেবে। রতনও বুক ঠুকে হ্যাঁ বলে দিয়েছে। এখন এই ভাইরাসের কল্যাণে সবাইকে যদি ভাইবেরাদর মনে হয়, রতন কী করবে? একবার ভেবেছিল মালতীকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, সে আর এমন কি, তল্লাট থেকে কেটে পড়লেই হয়। কিন্তু ভেবেই শরীরটা কেমন বেয়াড়াপনা শুরু করল, নাকি মনটা? রতনকে যেন চোখ পাকিয়ে বলল, এ আবার কি অসৈরন কথা? এমনভাবে কথার খেলাপ করে মানুষ? তো সেই নতুন হয়ে ওঠা মানুষ রতন সাহা সটান খগা মল্লিকের পায়ে হুপুত, দুই পায়ের পাতার মধ্যে সুলভে পাওয়া রিভলবার, হাতের পাতায় খগার হাঁটু। খগেন রতনের চুলের মুঠি ধরে তুলে পেটে ছুরি গুঁজে দেওয়ার আগেই খগেনের উপর ভালবাসার সুনামি নিয়ে আছড়ে পড়ল ভাইরাস।

—ভাই রতন, কিচু মনে করিস না ভাই। এই দোনলাটা দিয়ে সুলভদা আমাকে হাতে ধরে গুলি চালান শিখিয়েছে। আমাকে ওর কাছে নিয়ে চল।

খগেনের চারপাশে সব সাঙ্গপাঙ্গ জড়ো হয়ে গেল। সে কী কথা খগাদা, ওরা যে আমাদের শত্রুপক্ষ, গেলে গোশ করে দেবে তোমায়। খগাদার হাত পা টেনে ধরে রাখার ফলশ্রুতি হিসাবে রতন আর খগেনের সঙ্গে হরিকীর্তনের দলের মতো পুরো গ্যাং চলল সুলভের সঙ্গে দেখা করতে।

সবমিলিয়ে এক দুর্লভ দৃশ্য! যেন সঙ্কীর্তন চলেছে বাজারের মাঝখান দিয়ে। হাতে পেটো নেই, কোমরে মেশিন থাকতে পারে, মুখে হুঙ্কার নেই। ছিল রাতের রজনীগন্ধা, এখন নেতানো কলি। এই ভাইরাসের এফেক্ট সবার উপরে সমান নয়। গোখরোর ছোবলের মতো এক ছোঁয়াতেই হদয়ে ফল্গু। কিন্তু কারও শুধু কথা মাখন, কারও তার সঙ্গে ফাউ দ্যাখনদারি হাসি। পেটো পবনের হাতে যদি চপলতা দৃশ্যমান হয়, ল্যাংড়া নেলো ঊর্ধ্ববাহু নিমাই। পবন সারা জীবন তার হাতটাকে লুকিয়ে রেখেছে, মুঠিতে পেটো। আজ সে হাতটাকে নিয়ে কী করবে যেন বুঝতেই পারছে না। সবারই এমন দশা।

সামনে রতন আর খগা। পিছনে সাগরেদবাহিনি। বাজারে তোলা তুলতে আসে, সে একরকম। দু-তিনজন একসঙ্গে, কখনও একাও। কিন্তু এমন দল বেধে? দোকানদারেরা ভেবড়ে গেল, সকালবেলার বাজারিরা থতমত। এমনিতেই বাজারে ভিড়, অফিসবাবুদের তড়িঘড়ি বাজার সেরে রান্নাঘরে মাছের ব্যাগ ফেলতে হবে। বসন্ত উকিলের এত তাড়া নেই, খগেনের হয়ে কোর্টকাছারিও করেছেন। উনিশখানা কেস নিয়ে খগেন তার সোনার ডিম পাড়া হাঁস। কাণ্ড কী বুঝতে তিনি খগেনের কানের কাছে মুখ নিয়েছিলেন, ছুঁয়ে ফেলতেই বাজারের ব্যাগ ভুলে দলে ভিড়ে গেলেন। এইভাবে মিছিল দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে শনৈ শনৈ বাড়তে থাকল।

সুলভের কাছে যখন খবর গেল তার হল মেলাই বিপদ। রতনকে সুপারি দেওয়া হয়েছিল খগাকে ভোক্কাট্টা করতে, সে যে পুরো খগেন বংশকে এককাট্টা করে নিয়ে আসবে এমন তো কথা ছিল না। যেন হনুমান বিশল্যকরণী আনতে গোটা বিন্ধ্যপর্বত ঘাড়ে করে হাজির। সঙ্গে গোদের উপর বিষফোঁড়া উকিল?

খগেন এসে ডাক ছাড়ল সুলভদা, সুলভদা গো!

এমন নয় যে সঙ্গে সঙ্গে সুলভ তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে বলে উদ্বাহু হয়ে নেবে চলে আসবে। বরং তার ইশারায় সাঙ্গপাঙ্গ সবাই জানালার ঘুলঘুলিতে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটা কী দাঁড়িয়েছে না বুঝে তো আর ঝমঝমিয়ে গুলি বর্ষানো যায় না। তাই ডাক পড়ল বসন্ত উকিলের।

এতক্ষণ অবধি দেখা গেছে এক গলাগলিতেই যে কেউ কুপোকাত। কিন্তু বসন্ত আদতে উকিল তো, ভালবাসার ভাইরাসের এগেন্সটে তার ইমিউনিটি বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথমে একটু ঝটকা লেগেছিল, কিন্তু উকিলি মাথা ডুডু ও তামাক একসঙ্গে দুটোই খেতে জানে। ভাবেও অনেক দূরের। যদি সবাই সবাইকে এত ভালবাসে, তাহলে কিচাইন করবে কে? তার লাভ দলাদলিতে, সবার গলাগলিতে উকিলের পসার থাকবে? কিন্তু সেটা তো ঝপাস করে বলে দেওয়া যায় না। তাই সুলভের থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে বসন্ত সাবধান করে দিতে চাইল সুলভকে— একটা কেলো হচ্ছে ভায়া, সবাই সবাইকে ভালবাসছে। এক অদ্ভুত সংক্রমণ যেন ইনস্ট্যান্ট নুডলস, একফোঁটা গরম জল পেলেই জড়িয়েমড়িয়ে একাকার।

—তার মানে?
—মানে যদি ওই দলের এমনকি আমাকেও একবার ছুঁয়ে ফেলো, তোমার এই যে এমন পেশিশক্তি, সব ভক্তিভালবাসার জোয়ারে তলিয়ে যাবে।
—ভালবাসা মানে লভ? সুলভের চোখ কেমন জ্বলজ্বল করে উঠল। একি বসন্ত উকিল না বসন্তের মলয় বাতাস, আজ এ কী বারতা নিয়ে এল?
—লভ যদি বলতে চাও, তাই।
—এই ভাইরাসের অ্যাটাক হলে, বুকের ভালবাসা কি মুখে চলে আসবে?
—আমি তো আর কোনও নিস্তার দেখছি না।

এইখানেই সুলভ খপ করে বসন্ত উকিলের হাত ধরে ফেলল, ছলছলে চোখে বলল— তাহলে আমার কি একটা হিল্লে হয়ে যাবে বসন্তদা?

একে বাঁচানো গেল না— ফোঁস করে শ্বাস ফেললেন বসন্ত উকিল।

সুলভ সারাটা জীবন কত লোকের ব্যথাবেদনার কারণ হয়েছে তার কোনও হিসাব নেই। কিন্তু সে যে এমন ব্যথা বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে কি কেউ জানত?

তাও কি না কাকলি কর্মকার? ওই মেয়ের চোপা বসন্ত উকিল জানেন। কবে কোন ছেলে রাস্তায় টিটকিরি মেরেছিল, তাকে চপ্পল খুলে মেরে তার বাপের গুষ্টি উদ্ধার করেছিল। আর সেই বাপ কি যে সে বাপ? কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান। তাই থানা পুলিশ আদালত হয়ে ছেলের পক্ষের উকিল ছিল বসন্ত। মেয়েটা ভরা আদালত চত্বরে বসন্তকে কীভাবে না ধুনেছিল। সেই থেকে মেয়েটার কথা উঠলেই তার মুখে কাঁচা খিস্তি ফেনা তোলে। আজ নেহাত সংক্রমণের কারণে একটাও জুতসই গালি মুখে দানা বাঁধছে না।

—কিন্তু সুলভ, এমন মেয়ের সঙ্গে ইন্টুমিন্টুতে কি কোনও লাভ আছে ভায়া? সারাটা জীবন কেমন কাঁটা হয়ে থাকবে।
—লভ আছে, লভ। দেখছ কাকলির কথা শুনেই আমার রোম কেমন কাঁটা দিয়ে উঠছে? আমি তো ভাবতেও পারছি না, যে আজকের পর কাকলি আমার দিকে— সুলভ চারদিকে বসন্তের কুহুধ্বনি শুনতে শুনতে নিচের সমবেত হট্টরোলে যোগ দিল। তার সাঙ্গপাঙ্গরাও বন্দুকবাজি ছেড়ে একদফা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে নিতেই পুরো উঠোন জুড়ে বিজয়ার কোলাকুলি।

সাব্যস্ত হল কাকলির কাছে যাওয়া হবে। ব্যস একবার ছুঁয়ে দেওয়া, তাহলেই সুলভের ভালবাসার বাণী সে ফেরাতে পারবে না।

কিন্তু ছোঁবে কে? কাকলি যা মেয়ে তার আগেই ছোবল মেরে দেবে না? সুবল কি সেই কোন যুগ থেকে একবারও কাকলিকে ছুঁয়ে দিতে চায়নি? পেরেছে কই।

ঠিক হল যাবে রতনের বৌ আর অখিলবন্ধু।

অখিলবন্ধুর জীবনে কোনও বন্ধু ছিল না। পাওনাদার আর দেনাদার, এই নিয়ে তার দুনিয়া। আজ জীবনের পাশা এমন উলটে গেছে, খগেন আর সুলভের দলবল এককাট্টা হয়ে বল পেটাপেটি করছে আর সবার মাঝে অখিলবন্ধু বসে আছে সসম্মানে। এর মধ্যেই সুলভ তার নতুন নামকরণ করেছে লভগুরু, অখিলের থেকেই সবকিছুর শুরু কিনা। সুতরাং তার সংক্রমণের তেজ সবচেয়ে বেশি। কাকলির কাছে সে তো যাবেই।

আর রতনের বৌ? সে ছাড়া এখানে আর মেয়ে কই? মালতী কেমন রতনের গায়ে লতা হয়ে লেপ্টে আছে কে বলবে সে ভোরসকালে রতনের দিকে হাতপাখা ছুড়েছিল? আহা, এমন ভালবাসা! দেখেই সুলভের বুক টলমল। একদিন কাকলিও… একদিন কেন? আজকেই।

লভগুরু অখিলবন্ধু আর লতিয়ে ওঠা মালতী চলেছে। রতনকে কাছছাড়া করতে মন চায় না, তার সঙ্গে মাখোমাখো হয়ে রতন। কিছুটা তফাত রেখে সুলভ, খগেন আর তাদের দলবল। বরযাত্রী রেডি।

দরজা খটখট করতে দরজা খুলল কাকলির বাবা। ইহাগ্রাম প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার বীরেন কর্মকার, রিটায়ার করেছেন তাও আজ বিশ বছর। চোখে কম দেখেন আজকাল, কানটাও ঠিক জুতে নেই। দরজা খুলেই অখিল আর মালতীকে দেখে ভাবলেন বুঝি ছেলে আর ছেলের বৌ এল। তেনারা শেষ বয়েসের বাবাকে কাকলির জিম্মা করে নিজেরা শহরে ফুরুত হয়েছেন। সচরাচর তাদের টিকিটি দেখা যায় না। বীরেনবাবু কাঁপা কাঁপা হাতে অখিলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ধীরেন এলি বাবা? ঝন্টুটাকে সঙ্গে নিয়ে এলি না?

ব্যস। এমনিতে বীরেনবাবু ধীরেনের বৌকে দুচক্ষে দেখতে পারেন না। ঝগড়াটি মেয়েছেলে, সে আর কাকলিতে যখন ধুন্ধুমার করত, পাড়ার বিড়ালগুলো লাইন করে বেপাড়ায় চলে যেত। কিন্তু আজ বউমার প্রক্সিতে মালতীকে দেখে কেমন যেন গলে গেলেন। কেমন আছ মা? মালতীও ঢিপ করে এক প্রণাম। সত্যি শ্বশুর না হলেও, বাপতুল্য তো বটেই।

যতক্ষণে মাথা তুলেছে অকুস্থলে কাকলির প্রবেশ। সাতসকালে কে এসেছে বাবা?

—ধীরু আর ধীরুর বৌ এসেছে, আয় আয় দেখে যা।

ধীরু? ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ইনি কতকাল, তাই বলে এরকম বদলে গেল? কে হে তুমি, বলে অখিলের থুতনি ধরে উপরে তুলল।

এই যে সংক্রমণ, এর শারীরিক অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়া কী? আমরা, হে পাঠক, এতক্ষণ শুধু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বর্ণনার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছি। আসুন এবার কাকলির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে— আহা এ প্রবেশ সেই প্রবেশ নয়। আপনারা এতটা লেখা পড়ে একটুও কি সংক্রামিত হননি? ভাল ভাবতে শিখুন, ভালাবাসতে শিখুন।

বর্ষাশুরুর নদীর সোঁতা দেখেছেন? এঁদো নালা, এইটুকু জলও নেই যে পাঁক হবে একহাঁটু। তিন বছরের পুঁচকেও তিড়িং তিড়িং করে পার হয়ে যায়। তারপর যেই বর্ষার ঢল নামল সেই টিংটিঙে সোঁতায় কী উৎসব! কাকলিরও সেই দশা। লোকের সঙ্গে লড়াই দিতে দিতে, একা হাতে বাপের তদ্বিরতদারক, দিনরাত ভাই আর তার বউয়ের মুণ্ডপাত তার মনে ও শরীরে যেটুকু স্নেহজাতীয় পদার্থ ছিল সব চেছেপুঁছে নিয়ে নিয়েছে। আর সেই কাকলির কী হল একবার অখিলের থুতনি নাড়া দিতেই। আঙুল থেকে যেন একটা শিরশিরে স্রোত ছড়াল সারা শরীরে, কারেন লাগল কী? রক্তের গতি বেড়ে গেল, কুণ্ঠিত শঙ্খ বুক মাথা চাড়া দিল, সকালের না ধোয়া চোখে কে যেন একগাদা রং ছিটিয়ে দিল আর ঠোঁট, যেখানে একফালি হাসি কেউ দেখেনি বহুদিন, সেখানে চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। কাকলির লভ হয়ে গেল। লভগুরুর সঙ্গে।

ঠিক ধরেছেন, অখিলবন্ধুর সঙ্গে।

আর অখিল? তার কাজকারবার, জীবন সবকিছু শুধু একার তা নয়, মা ব্যতীত অন্য কোনও নারীর ছায়াও জীবনে মাড়ায়নি। আজ সকাল থেকেই এমন উল্টোপাল্টা হচ্ছে, সবাইকে ভালবাসতে ইচ্ছে করছে, মনে মনে সবকটা ভাড়াটের থাকাও ফ্রি করে দিয়েছে, তবু মনটা কেমন আলুকসুলুক যে করছিল। এখন কাকলি একবার ছুঁয়ে দিতেই জীবনটা যেন আমপানার শরবৎ। টক মিষ্টি ঝাল সব কিছু শরীরের পঞ্চেন্দ্রিয়কে একযোগে অ্যাটাক করল আর অখিলবন্ধু কাকলিকে বগলদাবা করে জনতার দিকে হাস্যবদনে এগিয়ে গেল। আর মালতী কনেপক্ষের হয়ে বীরেনবাবুর সঙ্গে পিছনে।

কেলোটা বুঝলেন? সুলভের জন্য কাকলিকে তুলতে এসে অখিল নিজেই কাকলিতে ডুবসাঁতার। এরপর কি মারদাঙ্গা হবে? সুলভ সংক্রমণ কাটিয়ে অখিলের খাল খিঁচে নেবে? কাকলিকে জোর করে নিজের হেফাজতে নিয়ে নেবে? জানতে হলে আপনাদের পরের অধ্যায় পড়তেই হবে।

 

দুই.

আদতে সেসব কিছুই হল না।

কারণ একবার সংক্রামিত হলে লোভ, ঈর্ষা, দ্বেষ— সাদা বাংলায় মারামারি, হানাহানি, কাটাকাটি, বাটপারি, খুনোখুনি করার কোনও উপায় নেই। এমনকি চোখ রাঙানো, রেগে গিয়ে ঝাঁটা তোলা, ভিড়ের মধ্যে কেনো মেরে এগিয়ে যাওয়ার মতো নিরামিষ অপরাধ করতেও গা ম্যাজম্যাজ করে।

তার বদলে নিজের যা কিছু আছে সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছা যায়। আগ বাড়িয়ে অন্যের কাজে হাত লাগাতে দু-হাত নিশপিশ করে। মোদ্দা কথা বুকের মধ্যে ভালবাসার আছাড়িপিছাড়ি। কী ভয়ানক এক অসুখ ভাবুন দেখি। কি অসৈরণ। এতদিনের নিয়মকানুনে মোড়া এই ব্রহ্মাণ্ডটা কি রসাতলে যাবে?

যেতে পারে। ইহাগ্রামের মানুষগুলোকে দেখে সেই ভয়টাই হচ্ছে কিন্তু।

মনে করুন জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সুখেন মোদক— যে কিনা মাছিকেও একটা মিষ্টির উপর বসতে দেয় না, হরেন পাগলা রোজ তার দোকানের সামনে ঘুরঘুর করে আগের দিনের বাসী গন্ধ হয়ে যাওয়া একটা মিষ্টি যদি পাওয়া যায়, সেই সুখেন মোদক হরেনকে ডেকে শালপাতায় দু-দুখানা গরম রসগোল্লা এগিয়ে দেয়? আর সুললিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে আর দুটো দেব রে হরেন?

হরেনকে তখনও কেউ ছোঁয়নি। সে বেচারা তার নর্মাল পাগলামির স্টাইলে হুম হাম করছিল। ভেবড়ে গিয়ে সুখেন মোদকের দু-পা জড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল। ব্যাস, কেল্লা ফতে। একে পাগল, তায় সংক্রমণ। তার দাড়িতে এখন ছোট মাঝারি বড় আকারের সব হাসি দোল খাচ্ছে।

তারপর ধরুন মহীন ডাক্তার। গহীন জলের মাছ। তার ফিজ পুরো না দিয়ে মরারও পারমিশন নেই। বাই চান্স যদি টাকা ফাঁকি দিয়ে কোনও গুয়োর ব্যাটা মরেও যায়, ডেথ সার্টিফিকেট? ওটা ছাড়া স্বর্গের দোরের চাবি খুলবে? পঞ্চাননের বাপ মোলো, ট্যাঁকে যা ছিল, সাতদিনের চিকিৎসায় মহীন খিঁচে নিয়েছিল। ডাক্তারের কাছে বাকি এক হাজার তিনশো চৌষট্টি। পঞ্চা পাবে কই? মহীনও সার্টিফিকেট দেবে না। খাটিয়ায় করে মড়া ডাক্তারের বাড়ির সামনে, মহীন নাকেমুখে রুমাল বেঁধে ঘোরে। শেষমেশ পাড়ার লোক চাঁদা তুলে মহীনের ছাঁদা বাঁধল, তবে গিয়ে সেই মড়া শ্মশানের দ্বার খুঁজে পেল।

এহেন মহীন ডাক্তার নতুন কি একটা ভাইরাস ছড়িয়েছে শুনে খুবই আহ্লাদিত হয়েছিল। যত রোগী, তত ক্যাশ। কিন্তু অসুখটা কি সেটা তো জানতে হবে? একটু সরেজমিনে তদন্ত করতে বেরিয়েছিল। পথে দেখা গুরুদাসের সঙ্গে। গুরুদাস আম বেচে, খালি আমের ঝাঁকা নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। মুখে একগাল হাসি।

—কি হে গুরু, বাজারের দিক থেকে আসছ, আজ এত তাড়াতাড়ি তোমার বেচাকেনা শেষ?
—আম আছে আর আম খাওয়ার লোকেরও অভাব নেই। তাইলে ঝাঁকা শেষ হতে কতক্ষণ। গুরুর মুখের থেকে আমের রসের মতো হাসির ঘন রস গড়িয়ে পড়ে।
—কিন্তু বাজারে শুনলাম কীসের গণ্ডগোল, কীসব অসুখ ছড়াচ্ছে। শুনেছ কিছু?
—সুখ ছড়াচ্ছে গো ডাক্তারবাবু। যেন সাবানের ফেনা, হাওয়ায় বুদবুদের মতো উড়তেছে। একবার হাত লাগালেই…
—হাত লাগালেই তো বুদবুদ ফেটে যাবে হে।
—না গো ডাক্তার, সেসব যেন একদম ভিতরে সিঁধিয়ে যেচ্ছে। আর তখন আনন্দগুলো সব ঝাঁপ ডালা খুলে সারা শরীরে ডালপালা মেলতেছে। উফ, এত আনন্দ সেই বাপের সঙ্গে তিন বছর বয়সে আমবাগানে গিয়ে পেয়েছিলাম। ঝড় এসেছিল, বাপটা মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করছিল আর আমি হুটপাটি করে ঝোড়ো বাতাসে কাঁচাপাকা আম কুড়াচ্ছিলাম। বলতে বলতেই ফিক করে হেসে ফেলে গুরুদাস। বড় আমাশা হয়েছিল ডাক্তার সেইবেলা, সাতদিন পাইখানায় বসেছিলাম। পাছার ছালা উঠে গেছিল এক্কেবারে।

মহীনের এসব তামাশার কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তোমার সেই অসুখ ধরেছে? গায়ে জ্বর তাপ কিছু আছে? মাথাব্যাথা, বমি?

এইবারে গুরুদাস খপ করে ডাক্তারের হাত ধরে ফেলে। এই যে দেখুন, একদম ঠান্ডা। যেন শীতলপাটি।

ব্যস ওখানেই ডাক্তারের দাঁতকপাটি। যে ডাক্তার নগদ ফিজ পেলেও কোনওদিন হাসেনি, এক মুহূর্তে দন্তরুচিকৌমুদী। মহীন ডাক্তার তখন-তখনই ছুটেছে শুকদেব পেন্টারওয়ালার কাছে, মহীন ডাক্তারের দাতব্য চিকিৎসালয়ের বোর্ড আঁকাতে। শুকদেব এত অবাক হয়ে যায় যে মহীনের পায়ে ঢিপ করে প্রণাম করে বসে। অতএব বোর্ড আঁকাটা ফ্রি হয়ে গেল।

এবার ধরো পুলিশ। চারদিকে ধুন্ধুমার, আর তার কাছে খবর যাবে না? খগেন আর সুলভ নাকি জগাই মাধাই হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তিলক কাটাটাই শুধু বাকি। হাওয়ায় এই ভয়ানক অসুখ ছড়াচ্ছে। ছোঁয়াচে। যার হচ্ছে সেই নাকি হ্যা হ্যা করে হাসছে, কোলাকুলি করছে, শাশুড়ি আর বৌ বচ্ছরকার ঝগড়াঝাঁটি ভুলে একসঙ্গে ফুচকা খাচ্ছে। এমনকি কোর্ট থেকে মামলা তুলে নেওয়ার খবরও এল বলে।

থানার দারোগা উমাপতি জানা এমন অদ্ভুত অসুখের কথা বাপের জন্মে শোনেনি। কনস্টেবল গণপতিকে সেনাপতি  করে পাঠাল খবর আনতে, সে ব্যাটা আর ফিরল না। মোবাইলে ফোন করলেও কোনও সাড়া নেই। একা পুলিশ পেয়ে গুম করে দিল নাকি? এরপর পাঠাল আব্দুলকে। এ ব্যাটা আবার ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। উমাপতি তাকে পইপই করে বলে দিল যা দেখবে দূর থেকে, ধারেকাছে যেও না যেন। আমাকে পারলে অকুস্থল থেকে ফটো তুলে পাঠাও। সে ছবি পাঠাতে উমাপতির চক্ষু চড়কগাছ। একটা খাটিয়ায় খগেন, সুলভদের সঙ্গে বসে গণপতি দাঁত কেলাচ্ছে। উমাপতি দাঁত কিড়মিড় করে উঠেছে কি ওঠেনি, আবার ছবি। এবার সেলফি। আব্দুলও ওদের সঙ্গে মুখে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না মেখে বসে গেছে।

উমাপতি এবার কী করে? তার দুজন পেয়াদাকে কবজা করে নিয়েছে এই সুবাদে কেস করে দেবে? কিন্তু কেস করলেও হাজতে ভরা যাবে কি? হাতে লোহার আংটা কে লাগাবে, থানার গাড়ি থেকে নামাবেই বা কে? কত হাত দূর থেকে কেস হ্যান্ডেল করলে সংক্রমণ হবে না? এইসব ভাবনার দশ হাত পানিতে উমাপতি হাবুডুবু খাচ্ছে, এমন সময় ফোন এল গগন ধারার কাছ থেকে। গগন ধারা এলাকার এমএলএ। রাজনীতিতে ঢোকার আগে এই এলাকায় তারই দাপট ছিল, তারপর রাজ্যপাট খগেনের হাতে দিয়ে রাজনীতির ময়দান সামলাচ্ছে। খগেনের কলকাঠি সেই নাড়ে। বিধানসভার অধিবেশন চলছে, এমন সময় ইহাগ্রামের গণ্ডগোলের খবর পেয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ফোন লাগিয়েছে উমাপতিকে।

—কী হচ্ছে তোমার থানায়?

উমাপতি কিছুক্ষণ তো তো করল— একটা অদ্ভুত অসুখ ছড়াচ্ছে স্যার। মারাত্মক ছোঁয়াচে। সবাই শুধু হাসছে।

—হাঁচছে? সে আর নতুন কী?
—না স্যার, হাসছে। সবার জন্য সবার দরদ উথলে পড়ছে। এমনকি— এবার গলাটা নামায় উমাপতি— আপনার খগেন নাকি সুলভের সঙ্গে এক খাটিয়ায় বসে পান সিগারেট খাচ্ছে।
—ওরা কি মিলে গেল? সুলভ তো বিক্রম সিং-এর লোক।
—সবাই মিলে গেছে স্যার, গ্রামের সব লোক।
—হাজতে পোড়ো শিগগির, থানায় বসে করছ কী?
—পেয়াদা পাঠিয়েছিলাম, তাদেরও আর ফেরত পাচ্ছি না।
—মানে? পুলিশকে আটকে ফেলেছে? কী সাঙ্ঘাতিক! উত্তেজনায় গগন ধারার খাটিয়া খাড়া।
—না, না সেরকম নয় স্যার। ওদেরও ছোঁয়াচ লেগেছে, ওদের সঙ্গেই এক খাটিয়ায় বসে রংতামাশা করছে।
—এখুনি ওদের সাসপেন্ড করো। অন্তত কিছু একটা করো! কিসের অসুখ যাচাই করে জানাও। ডাক্তার পাঠাও অকুস্থলে। ঢ্যাঁ ঢ্যাঁ… এক ধাক্কায় গগনের চেম্বার খালি।
—ডাক্তার কোথায় পাব স্যার?
—কেন, তোমাদের মহীন ডাক্তার। ওকে পাঠাও।
—সেও তো আক্রান্ত। শুনেছি মানুষের জন্য তার এখন দরদ উথলাচ্ছে। দাতব্য চিকিৎসালয় খুলে ফেলেছে।
—কী সর্বনাশ। এর পিছনে নিশ্চয় বিরোধী শক্তির হাত আছে। বিক্রম সিং কিছু করছে ঠিক। বিক্রমের কালো হাত গুঁড়িয়ে দাও। হুঙ্কার ছাড়ে গগন।

আর কেউ গুঁড়িয়ে দাও, গুঁড়িয়ে দাও বলে ধুয়ো তোলার আগেই গগন ধারার কাছে মুখ্যমন্ত্রীর তলব। সব খবর জোগাড় করার জন্য নির্দেশ জারি করে গগন তড়িঘড়ি ফোন রেখে দিল।

রাখতেই লাইনে বিক্রম সিং-এর অবতরণ। আবার সেই এক কাহিনি। কিন্তু ইনি আবার এমপি, কেন্দ্রে এনার সরকার, তাই হুঙ্কার আরও বেশি।

—আপনারা সবাই মুখ্যমন্ত্রীর পোষা নোকর হয়ে গেছেন। এখানে মানুষ আক্রান্ত, আর আপনি কোনও খবরই রাখেন না।
—সে কী বলছেন স্যার, আমরা আমাদের সাধ্যমতো সব করছি।
—সে তো দেখতেই পাচ্ছি, ফোন করলে তো পাওয়া যায় না। এতক্ষণ ফোনে কি প্রেমালাপ করছিলে? সবকটা মুখ্যমন্ত্রীর পেয়ারের লোক, আমরা সব জানি। সিবিআাই ডাকতে হবে।
—কী যে বলেন স্যার, আমরা হলাম নিরপেক্ষ, মানে আপনাদের সবার সঙ্গেই আছি।
—এর মধ্যে বিদেশি শক্তির হাত থাকতে পারে। কোনও বিদেশিকে আশেপাশে দেখা গেছে? চিনা বা আমেরিকান?

এইসব হরেক না জানা প্রশ্নের ধাক্কা সামলে সবে ফোন রেখেছে, অন্য প্রান্তে রাজু গোবর্ধন, ডিএসপি।

—কেয়া বাত উমা, গণ্ডগোল কীসে হচ্ছে?
—স্যার, এবার উমাপতি প্রায় কেঁদেই ফেলে। কিছু লোক পাঠান স্যার, আর ডাক্তার। আমি কী করব বুঝতেই পারছি না। আমার ফৌজ পাঠিয়েছি, একবার গেলে আর কাউকে ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। গেলেই লাপাতা।
—মাওবাদী ঢুকে গেছে এলাকায়। কী কী পতা করেছ সব বলো আমায়।

সব শুনে রাজু কিছুক্ষণ স্তব্ধ, একটা হুমম ছাড়া আর কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, আমি ডিস্ট্রিক্ট হাসপাতালের ডাক্তার আর রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাচ্ছি। তুমি ততক্ষণে অকুস্থলে যাও। দেখো আবার বেশি কাছাকাছি যেও না। তোমার বাকি বাঁচা কনেস্টবেলদের নিজের চারপাশে ঘিরে রাখো, কেউ যাতে ছুঁতে না পারে। আর কেউ কাছে আসতে চাইলেই শুট অ্যাট সাইট। আন্ডারস্ট্যান্ড?

—ইয়েস স্যার!

অতএব এবার উমাপতি সঙ্গে কনস্টেবল বোচন আর পরিতোষ— সবার হাতে খোলা বন্দুক জিপে করে চলল সরেজমিনে তদন্ত করতে।

খবর যে কী দ্রুত ছড়ায়। আরও ছড়ানোর জন্য এর মধ্যেই হাজির চোখের দেখা বুকের কথা চ্যানেলের জেলা-প্রতিনিধি সুমন বারিক, সঙ্গে ক্যামেরায় ছোট কার্তিক।

—আমি সুমন বারিক, সঙ্গে কার্তিক। আপনাদের দেখাব আর বুকের কথা শোনাব বলে আজ হাজির ইহাগ্রামে। ইহাগ্রামে এক অদ্ভুত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে একদিনের মধ্যে এটা হয়ে গেছে হাহাগ্রাম। হ্যাঁ ঠিক শুনেছেন, সবাই হাসছে, কোলাকুলি করছে, না পারলে হাত ধরে ঝোলাঝুলি করছে। আক্রমণ করেছে এক অজানা ভাইরাস। আসুন আমরা এবার শুনি মানুষের বুকের কথা। আমাদের সঙ্গে আছেন ইহাগ্রামের মদন প্রামাণিক।

বলতেই গুটিগুটি পায়ে মদন তার হাতবাক্স নিয়ে ক্যামেরার সামনে হাজির।

—আচ্ছা মদনবাবু আপনার পরিবর্তন সম্বন্ধে একটু বলুন, মানে কখন থেকে আপনার শরীরে আনন্দ আর হাসি ফনফনিয়ে উঠল।
—সে তো ঠিক বলতে পারিনে। আমি তো ধরেন রোজকার মতো ক্ষৌরকর্মের জন্য বাজারের ধারটিতে বসিচি। দেখি কীসব হট্টগোল, যেন বে-বাড়ি। হে হে হা হা হাসিতামাশা। আমি দাড়ি কাটতেছিলাম সুখেন সমাদ্দারের। পাশ দিয়ে যেতেছিল ন-পাড়ার গোবিন্দ। একমুখ হাসি নিয়ে সে সুখেনবাবুর পিঠে হাত রেখে কানের কাছে কী মন্তর দিল, সুখেনবাবু সেই একগাল দাড়ি নিয়ে ফিচিক ফিচিক হাসি হাসতেছে। গালে খুর লাগিয়ে নড়লে হয় নাকি, ঘ্যাঁচ হয়ে গেল। মদনের হাতে এমন ধারা কোনওদিন হয় নাকো। আমি একটা ফটকিরি দিয়ে ওনার গাল গলা ঘষে দিছি, কী লজ্জা বলেন। উনি বললেন, এ কিছু নয় মদন, এমন তো হতেই পারে। আর এইসব বলতি না বলতিই আমার মনে কেমন ফূর্তিভাব আছড়ে পড়ল, শরীরটা চনমন করে উঠল, বুঝলেন। ভয়ানক ফূর্তি। যেমন ছোটবেলায় বাপের ঠ্যাঙানি খাওয়ার পরেও প্যান্টের কসি টেনে বল পেটাতে যাওয়ার আনন্দ, ঠিক তেমনটি।
—আপনার কি মনে হয়, এটা ভাল হচ্ছে? কোনও ওষুধ খেয়েছেন?
—ওষুধ আমি বাপের জন্মে খাই না। তার উপর খাবই বা কেন? খেলে ভাল ভাল খাবার খাব। এই তো ভুজিওয়ালার কাছ থেকে খাস্তা কচুরি খেয়ে এলাম, সে ব্যাটা তো পয়সাও নিচ্ছে না আর। দেদার খাও আর খাওয়াও।

এর মধ্যেই হুড়মুড়িয়ে এল রতন। মদনদা, শিগগির চলো। অখিলদা আর কাকলির বিয়ে হবে। অখিলদার দাড়ি কেটে দাও এসে।

সুমন তার মাইকটা এবার গুঁজে দেয় রতনের মুখে। কার বিয়ে হচ্ছে, আর আজকে তো বিয়ের তারিখ নেই, তাহলে হচ্ছেটা কী করে?

রতনের মুখে হাসি। তাই বললে কি হয়, মিয়া বিবি রাজি, কেয়া করেগা কাজি!

—এটা কি মুসলমানের বিয়ে, নিকা হচ্ছে? এই যে বললেন অখিল না কার বিয়ে?
—আমি তো একটা চলতি কথা বললাম স্যার। অখিলদার জন্যেই তো আমাদের সবার জীবনে এমন আনন্দ। উনি জিয়নকাঠি হয়ে আমাদের সবাইকে হাসিয়ে তুলেছেন।
—মানে, এই অখিলবাবুই কি গ্রামে এই ভাইরাস নিয়ে এসেছেন?
—ভাইরাস কী জিনিস কত্তা জানি না, তবে সবাইকে ভাইবন্ধু বানিয়ে দিয়েছে।
—আমি সুমন বারিক, চোখের দেখা বুকের কথার পক্ষ থেকে আপনাদের নিয়ে এসেছি ইহাগ্রামের এই ভাইরাসের ভরকেন্দ্রে। এ কি ভাইরাস না মাওবাদীদের হামলা? অখিল কি চিনা গুপ্তচর নাকি মাওবাদী নেতা? এসেব জানতে হলে সঙ্গে থাকুন, ভরসা রাখুন বিজ্ঞাপনের বিরতির পর।

ক্যামেরা বন্ধ করেই সুমন আর ছোট কার্তিক ছুট মারে রতন আর মদনের পিছনে। কিন্তু তার আগেই উমাপতির খোলা জিপ ঘচাং করে রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়াল।

—এই যে সুমনবাবু, উঠে আসুন গাড়িতে। আর ক্যামেরাটা আমাদের কাছে জিম্মা করুন।
—কেন, কেন এটা বলছেন? এটা তো নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার উপরে হামলা!
—আপনাকে বাঁচাতেই বলছি। একবার ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেলে আপনিও হ্যা হ্যা করবেন, তখন মুখে মাইক ধরবে কে?

সঙ্গে সঙ্গে সুমন লাফ দিয়ে উমাপতির পাশে বসে ওর মুখে মাইক গুঁজে দিল। ক্যামেরা নিয়ে ছোট কার্তিক গাড়ির পাদানিতে। রোল ক্যামেরা।

—আমাদের সঙ্গে এখন ইহাগ্রাম থানার পদাধিকারী উমাপতি জানা। এই ভাইরাস নিয়ে সরকার কী ভাবছেন, উনি জানাবেন আমাদের।

উমাপতির উপর হুকুম ছিল ইহাগ্রামের কোনও খবর যেন বাইরে না যায়। দরকার পড়লে সব কাগজ আর টিভিওয়ালাকে ফাটকে পুরে দেওয়ার হুকুম। কিন্তু জীবনে প্রথমবার কেউ মুখে মাইক ধরতেই, উমাপতি অমায়িক। আমাদের কাছে খবর আছে এখানে চিনা গুপ্তচরবাহিনি মাওবাদীদের সঙ্গে মিলেজুলে একটা সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে চলেছে।

—কোন সরকার, রাজ্য না কেন্দ্র? তাহলে কি এইসব ভাইরাস-টাইরাস কিছু নয়?
—চিনের কোনও ল্যাব থেকে এনে এখানে ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে— উমাপতি বসের কাছ থেকে যা শুনেছে সেটাই ফেনাতে থাকে, টিভিতে আসার এই প্রথমবার। সুযোগ ছাড়া যায়?

এমন সময় একটা ছোকরা ছুটতে ছুটতে এসে কার্তিকের হাত ধরে টানল। দাদা, এদিকে আসুন, আমাদের এখানে বিয়ের কটা ছবি তুলে দিন।

ছোট কার্তিক পাদানিতে দাঁড়িয়ে বেসামাল, হুমড়ি খেল সুমনের ঘাড়ে। আর একটু হলেই মাইকটা উমাপতির মুখব্যাদানে ঢুকে যাচ্ছিল, সুমন লাহিড়ী কোনমতে উমাপতির কাঁধ বাঁ হাতে খিমচে নিজেকে সামলাল। উমাপতির পাশে ড্রাইভার বোচন, নার্ভাস হয়ে ব্রেক চিপতেই উমাপতি তার ঘাড়ে।

এরপর কী হল পাঠককে আর বলার দরকার নেই। পুলিশ এবং সাংবাদিক সহযোগে জিপ চলল বিয়ের মণ্ডপে। ইন্টারভিউ নিতে নিতে সুমনের কপালে একটা পার্মানেন্ট ভাঁজ পড়ে গেছিল, এক হাসির বেমক্কা ধাক্কায় কোথায় কী। উমাপতির হঠাৎ মনে হল ইউনিফর্মটা কেমন হালকা হয়ে গেছে, আর পেটের থেকে একটা আনন্দের কুলুকুলু গলার কাছে এসে বুদবুদ হয়ে ফেটে পড়ছে। জিপের পিছনে বন্দুক ধরে বসেছিল পরিতোষ। এইসব আনন্দযজ্ঞের বাইরে থেকে সে কি আফসোস করবে? তাই বিনীতভাবে উমাপতিকে বলল, স্যার আপনাকে একবার ছুঁতে পারি?

—আলবাত পারো, এই নাও আমিই তোমায় ছুঁয়ে দিলাম। বলে উমাপতি হা হা করে হাসল। মুগাম্বো খুশ হুয়া! কি বোঁচন, হাসিটা অমরিশ পুরীর মতো হয়েছে না?
—আপনার গলায় খুব মানিয়েছে স্যার।

ইহাগ্রাম থানার সমস্ত পুলিশবাহিনির পাহাড়ায়, চোখের দেখা বুকের কথা চ্যানেলের পরিচলানায় অখিলবন্ধু আর কাকলির বিয়ে হল, কন্যা সম্প্রদান করল কাকলির অধুনা মু-বলা-ভাই সুলভ সাহা।

জিলিপি ও খাস্তা কচুরি সহযোগে (নিবেদনে সুরেন মোদক) এই বিবাহ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রসারণে দেখল দেশের কোটি কোটি মানুষ।

 

তিন.

প্রধানমন্ত্রী— কি দাদা, আপনার রাজ্যে এসব কী হাঙ্গামা শুরু করেছেন?
মুখ্যমন্ত্রী— মোটাভাই, এসব তো আপনারা করাচ্ছেন। কেন্দ্র রাজ্য চক্রান্ত, আমরা বুঝি না ভেবেছেন?
প্রধানমন্ত্রী— না না দাদা, গলত বুঝিয়াছেন। আমরা শুধু মানুষের খুশিয়ালি দেখতে চাই, আপনার এক্তিয়ারে আমরা কেন বাওয়ালি করব।
মুখ্যমন্ত্রী— এসব কাওয়ালি এখন থাক, এখন আমাদের খুব দুঃসময়। ভাইরাসে আক্রান্ত আমরা। আমরা কাউকে তার ফয়দা তুলতে দেব না।
প্রধানমন্ত্রী— একদোম, এই চিনা ভাইরাস বেশি ছড়ালেই লোকে এরপর হিন্দি চিনি ভাই ভাই করে দেশটাকে চিনের হাতে তুলে দেবে।
মুখ্যমন্ত্রী— সে তো আপনারাই দিচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রী— দেখো দাদা, এখন কাজিয়ার সময় নয়। আমি খবর পেয়েছি আমার এমপি আর তোমার এমএলএ এক খাটিয়ায় বসে গুড়ের সরবত খাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী— আমিও পেয়েছি। গগন ধারাকে পাঠালাম সব সামাল দিতে, সে নিজেই দিশেহারা হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী— তাই তো বলছি। কী ভয়ানক ভাবিয়ে দেখুন। লোকে তো ভাববে টাকা দিয়ে দল বদলি হচ্ছে। আসলে তো ভাইরাস, যেটা লোকের মাথা ঘুলিয়ে দিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী— নিজের স্বার্থ ভুলিয়ে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী— নিজের দলকে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী— দলাদলি তো একদম ঘুচিয়ে দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী— নিজের বলতে কিছুই ভাবছে না আর। বুঝতে পারছেন এর দিশা কোনদিকে? কারা ছড়িয়েছে এই ভাইরাস? এখুনি সারা দেশের লোককে সতর্ক করে দিতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী— কিন্তু বলব কী? লোকে লোকের ভাল করছে, এমন সৌভ্রাতৃত্ব…
প্রধানমন্ত্রী— নিকুচি করেছে সৌ আর মৌ। দলাদলি না থাকলে আমরা নির্বাচনে লড়ব কার সঙ্গে? তখন আবার বলবেন আমরা দেশে একনায়কতন্ত্র আনছি।
মুখ্যমন্ত্রী— সে তো আপনারা আনছেন। এখন ভয় পাচ্ছেন, সবাই যদি আমাদের দলে ভিড়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী— দাদা, বাঙালি নাকি সবার আগে ভাবিয়ে থাকে, আপনি কেন পিছিয়ে পড়ছেন? দূরেরটা ভাবতে পারছেন না! এই ভাইরাস সমস্ত রাজনীতিকের শত্রু। এখন আমাদের এককাট্টা হতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী— শুনছি সবাই সবাইকে ফ্রিতে খাওয়াচ্ছে, সার্ভিস ফ্রি। লোকে তো এটাই চাইবে। ভাইরাস বললে মানবে কেন?
প্রধানমন্ত্রী— মাওবাদীরা আছে এর পিছনে, বুঝতে পারছেন না। সমাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চক্রান্ত। এটাকে আটকাতে হবে।
মুখ্যমন্ত্রী— কিন্তু লোকে যদি সত্যিটা বুঝে যায়?
প্রধানমন্ত্রী— লোকের বুদ্ধিতে আপনার এত ভরসা নিয়ে রাজনীতি করেন কী করে দাদা? ঢপ মরতে হবে…
মুখ্যমন্ত্রী— কিন্তু কী ঢপ দেব? বাঙালি চপ খায়, ঢপ খাওয়ানো মুশকিল…
প্রধানমন্ত্রী— কী যে বলেন দাদা। ঢপ না খেলে আপনি এখনও গদিতে থাকেন?
মুখ্যমন্ত্রী— আর আপনি বুঝি যুধিষ্ঠিরের ছোটাভাই?
প্রধানমন্ত্রী— হা হা হা, আমি তো মোটাভাই। শুধু আপনি সঙ্গে থাকুন, আমি সামলে নেব। বলব এক মারাত্মক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, পাগলা ভাইরাস। আমি একটা রিপোর্ট বানিয়ে দেব ডাক্তারদের দিয়ে যে এই ভাইরাসের ফলে সব মানুষ পাগল হয়ে যাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী— হ্যাঁ, হ্যাঁ। কি মাথা আপনার। আমি টিভির চ্যানেলে দেখলাম একটা পাগল হুম হুম করছে, আর দাড়ির ফাঁক দিয়ে ফিকফিক করে হাসছে।
প্রধানমন্ত্রী— সেটাই তো, ওটাকে ইস্তেমাল করতে হবে। লোককে বলব এই যে দেখুন, ভাইরাসের কবলে পড়ে লোকে পাগল হতে শুরু করে দিয়েছে। ওই পাগলটাই হবে আমাদের ভাইরাসের ম্যাসকট। ওইটাকে বারবার দেখানো হোক। আমি আজকেই রেডিও আর টিভিতে দেশের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছি। বলব— সবাই সাবধান, ছাদে উঠে পাগলা ঘণ্টা বাজান। বিষে বিষে বিষক্ষয়, পাগলামির ভাইরাস আর ঢুকতে পারবে না। বিএসেফের এক পল্টন পাঠাচ্ছি, পুরো গ্রাম সিল করিয়ে দিন।
মুখ্যমন্ত্রী— খুব ভাল আইডিয়া মোটাভাই। আপনার মাথায় খেলেও ভাল।
প্রধানমন্ত্রী— মিলেজুলে কাজ করতে হবে, বুঝলেন না। কিন্তু আপনি যেন উল্টো গাইবেন না। দেশের বিকাশের প্রশ্ন এটা।
মুখ্যমন্ত্রী— আমরাও মিলেজুলে? তাহলে কি আমাদেরও ভাইরাস অ্যাটাক করল?
প্রধানমন্ত্রী— হা হা হা, আমাদের তো এই ভাইরাস সব সময়েই আছে। তাই তো আপনার দলের লোক আমাদের দলে…
মুখ্যমন্ত্রী— আর আপনার লোক আমাদের দলে…
প্রধানমন্ত্রী— ওহি তো, হাম সব মিলেজুলে হ্যায়। জয় হিন্দ।
মুখ্যমন্ত্রী— জয় হিন্দ।

ফোন রেখেই মুখ্যমন্ত্রী ডাকলেন তার নিজস্ব সচিবকে।

অমিতানন্দ খাতা বগলে হাজির।

—খবর পেয়েছ?
—দেখলাম তো টিভিতে। গ্রামটা যেন হট্টমালার দেশ হয়ে গেছে।
—কী করবে ভেবেছ? মাথা খেলাও।

অমিতানন্দ সহজে হাসে না, মুখব্যাদান করে বলল, ভাবছি নিজেই একবার চলে যাই, দেখি হাসির কত আনা খাঁটি আর কত আনা জল।

—খবরদার, কেউ ওখানে যাবে না। যে ওই গ্রামে ঢুকবে তাকে আর বেরোতে দেওয়া যাবে না। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হল এখুনি, পুরো গ্রামটাকে সিল করে দেওয়া হবে। একটা মাছিও যেন গলতে না পারে— আচ্ছা এই কথায় মনে পড়ল এই ভাইরাসে কি অন্য জন্তুজানোয়ারের উপর কোনও এফেক্ট করছে?
—সিএমওকে ডাকব?
—ডাকার দরকার নেই, তুমি ওকে ব্রিফ করো। আর ইহাগ্রামের চারপাশের সবকটা গ্রাম থেকে আপৎকালীন সুরক্ষাবিধি অনুসারে দূরে কোথাও সরিয়ে দেওয়া হোক, গরুবাছুর সমেত। সবাই কোয়ারান্টাইন হবে। আর একটা কাকপক্ষীও যেন ইহাগ্রাম থেকে বেরোতে না পারে, কোথাও। এখুনি একটা সচিব মিটিং ডাকো। এইসব আজকের মধ্যেই বহাল করা চাই।
—আমি কি নিজেই একবার দেখে আসব স্যার? অকুস্থলে?
—তোমার ধান্দাটা কি বলো তো? ভাইরাসের হামলায় পড়তে চাও? ও কর্মটিও কোরো না, হাসির লোভে ফাঁসি হয়ে যাবে অমিত।
—স্যার, বিরোধী নেতাদের কি তলব করব?
—না না থাক, একটু ইতিউতি তাকান মুখ্যমন্ত্রী, এই ভাইরাস সাঙ্ঘাতিক অমিত। আমি নিজেও বেশি লোকের সঙ্গে দেখা করতে চাই না। কে যে ভাইরাস নিয়ে হাজির হয়ে যাবে, কতদূর ছড়িয়েছে তাও তো জানি না ছাই। বুঝতে পারছ, আমরা রাজনীতিকরা যদি এই ভাইরাসের কবলে পড়ি দেশটার কী হাল হবে?
—চ্যানেলে যা দেখলাম, বেশ আনন্দেই তো আছে ইহাগ্রামের লোকগুলো, হাল তো বেশ ভালই।
—তোমার মুণ্ডু। যদি এরকম চলতে থাকে আমাদের আর দরকার পড়বে? কেউ চুরি ডাকাতি করছে না, পুলিশ কী করবে, আর আইন আদালত? সবাই ফ্রিতে খাবার বিলোচ্ছে, তাহলে টাকার দরকার কী? বন্ধ করে দিই ব্যাঙ্ক? দেশটা রসাতলে যাবে সেটা কি বুঝতে পারছ না?
—কিন্তু স্যার, ফ্লু হলে সেরে যায়, যে কোনও অসুখই তো চিরটাকাল থাকে না। এই ভাইরাস, এটাও আর কদিনের?
—সেটাও তো কেউ জানি না। চারদিন, চার মাস কি চার বছর। চার দিন হলে সামলে নেব, কিন্তু যদি দিকে দিকে ছড়িয়ে যায় আর চলতে থাকে বছরভর, সব নিয়মকানুন বিচারব্যবস্থা সমস্ত কিছু কি এর মধ্যেই ভেঙে পড়বে না?

 

চার.

ভোর হল নড়বড়ে তক্তপোষে, দিন ফুরাতে ফুলশয্যার খাটে। অখিলবন্ধুর জীবনটা একলপ্তে এমন পালটি খেয়ে গেছে। সে খাটের এককোণে বসে, অন্যধারে কাকলি। এই ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়েতে ভাল বেনারসির জোগাড় হয়নি, আর কাকলি তেমন ঘোমটা টানা মেয়েও নয়।

—ঘুমাবে না?
—লজ্জা করছে।
—কেন? পিচিক করে হাসল কাকলি।
—না মানে আমি সকালের দিকে নিজের নাক ডাকা শুনতাম, তখন ঘুমও হালকা তাই নাকের ডাকটাও অত গম্ভীর নয়। কিন্তু ধরো এই প্রথম রাতে, সেই সানাইতে কি পোঁ ধরবে সেটা তো জানি না।
—আর আমার নাকের বাঁশি? তোমার সঙ্গে সঙ্গত দেবে না?
—হে হে তুমিও?
—ও মা নাক রয়েছে ডাকব না নাকি? মেয়েরা কোনও কিছুতেই কম যায় বুঝি?

আগেকার দিন হলে এই নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যেত, কিন্তু এখন ভাইরাস সব রাশ ধরে রাখে। যাই বলো, সবাই বিগলিত যমুনা।

—কিন্তু শুতে যাবে যে, গগনদা কী বলেছে শুনেছ?
—কী নিয়ে?
—এই গ্রাম ঘিরে ফেলছে পুলিশে।
—হ্যাঁ, ওর কাছে তো মুখ্যমন্ত্রীর ফোন এসেছিল।
—তাহলে, এখন নিশ্চিন্তির ঘুম কীভাবে ঘুমাবে?
—সুমনবাবু তো এও বললেন আমাদের পাগলা হরেনের ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছে আর বলা হচ্ছে ভাইরাসের কবলে পড়ে আমরা সবাই পাগল হয়ে যাচ্ছি।
—হওনি পাগল?
—আমি তোমার জন্য পাগল যে…

গেয়ে উঠেই অখিলের মনে পড়ল বাইশ বছর বাদে সে কোনও গানের কলি গাইল। সেই যে বাপ রূপ তেরা মস্তানা গাওয়ার পর গালে বাইশ শিক্কার থাবড়া মেরেছিল, তারপর কারও পক্ষেই গলা দিয়ে সুর খেলানো সস্তা না।

—কিন্তু সত্যি বলো, খারাপ আছি কি আমরা?
—বেড়ে আছি। শুধু ভাবছি সেই লোকটা পালিয়ে কোথায় গেল? আর সেই বুড়োর বাড়িটাই বা কোন মুলুকে।

দপ করে জ্বলে উঠল কাকলির চোখ, তাহলে এখনও আশা আছে।

—কীসের আশা?
—আমাদের গ্রামটা তো ঘিরে ফেলেছে, কাউকে বেরোতে দিচ্ছে না যাতে সব জায়গায় এই আনন্দ ছড়িয়ে না পড়ে। এই লোকটা তো নিশ্চয় এতক্ষণে অন্য গ্রামে ঢুকে পড়েছে।
—ঠিক, ঠিক। আর সেই বুড়োটা? সে কি তবে চাইনিজ?
—চাইনিজ হোক কি সিয়ামিজ, আমাদের কী যায় আসে? আমাদের এই ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে হবে। কাকলির গলায় হাসি, কিন্তু বুদ্ধির ধার কিছু কমেনি।

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ।

দরজা খুলতেই দেখা গেল সবাই দাঁড়িয়ে। কে নেই? রতন, মালতী, সুলভ থেকে শুরু করে গগন ধারা।

—অখিলদা, আমরা সবাই ভাবছি এই ভাইরাস আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে, দিকে দিকে, গ্রামে গ্রামে।
—কিন্তু সেটা হবে কী করে? গ্রামের সীমানা পার করব কী করে?
—যা করতে হবে আজই। এখনও বন্দোবস্ত পুরো হয়নি। আজ রাতেই আমাদের বাইরে বেরোতে হবে।
—সবাই মিলে?
—না একেকবার একজন-দুজন করে বিভিন্ন দিক থেকে। উমাপতি গ্রামের নকশা পেতে ধরল। সে পুলিশের লোক, জানে বন্দোবস্ত কীরকমভাবে হয়।
—একেকঘণ্টায় একেকজন সীমানা পেরোনোর চেষ্টা করবে।
—আমি যাবো। আমরা। কাকলি খপ করে অখিলের হাত ধরল। তুমিই গ্রামে এই ভাইরাস এনেছ, তোমার হাত ধরেই পৌঁছে যাক সব জায়গায়।
—না, না তোমাদের এখুনি আজ বিয়ে হল। সুলভ ঘনঘন মাথা নাড়ল। আমি যাব।

এরপর একেবারে কে বা দিবে প্রাণ, পড়ি যায় কাড়াকাড়ি।

অখিল এবার গলা তুলল, না হে বন্ধুরা। আমাকেই প্রথম যেতে হবে। আমিই এনেছি এই ভাইরাস। কে জানে আমার মধ্যেই হয়তো এই ভাইরাস সবচেয়ে শক্তিশালী। তাই আমার যাওয়া দরকার।

অখিলের বলায় কী ছিল, মেনে নিল সবাই। কিন্তু পরের ঘণ্টার ঘণ্টায় যাওয়ার ভলান্টিয়ার হিসাবে নাম তোলাতেও কেউ ছাড়ল না।

—সবাই শোনো, একবার থানেদারের ভঙ্গিতে উমাপতি গলা খাঁকারি দিল। গ্রামের মধ্যিখানের উৎসব চালিয়ে যাও, গানবাজনা। সবাই জানুক বিয়ের উৎসব চলছে। তাহলে সব পুলিশের চোখ থাকবে ওদিকেই, ওই ফাঁকে বর-বৌ বেপাত্তা হবে।

ঠিক, ঠিক! ছুটল সবাই মজলিশে। গ্রামের সবাই এখন ভেঙে পড়েছে বটতলায়। চলছে ভাইবন্ধু পাতানোর আনন্দোৎসব।

কাকলি বেনারসি ছেড়ে একটা সাধারণ শাড়ি জড়িয়ে নিল। তারপর অখিলবন্ধুর হাত ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল দুজনে, শরীরে বন্ধু বানানোর ভাইরাস।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...