পরী ও পঞ্চতাণ্ডব

শঙ্খদীপ ভট্টাচার্য

 

পৃথিবীর এইদিককার এলাকায় তখন চকচকে সকাল। মর্নিংওয়াকের জন্য বরাদ্দ সময় শেষ হয়েছে ঘন্টা তিনেক হল। ঘাস আর মাটি লাগা স্নিকারটা খুলেই হাল্কা গরম জলে স্নান সেরে নিলেন তারা। তারপরেই হাত লাগালেন ডায়েট ব্রেকফাস্টে। আজ মধ্যমণি হানি ফ্লেভার্ড কর্নফ্লেক্স। সঙ্গে মাখন লদকানো টোস্ট। এসব খেলে পেটের মেদ ঝরে ঝড়ের গতিতে। চৌকস সুপার মডেল কদিন আগেই তো টিভিতে উদোম পেট দেখিয়ে তাই প্রমাণ করতে চেয়েছে।

কর্নফ্লেক্সের সম্পূর্ণ আমেজ আর পরিমিত দম্ভ চোখেমুখে মেখে তাদের মধ্যেই একজন বললেন,

—কী রে তোরা কি জানতিস মানবেন্দ্রর পূর্বপুরুষের ঘোড়াশালে তিনশো হাতি আর হাতিশালে দুশো ঘোড়া ছিল। কয়েকশো উটও। সেসব নিয়ে আফগানদের বিরুদ্ধে কী ফাইটটাই না দিয়েছিল! যে যাই বলুক ভাই ওরা না থাকলে না দেশটা আজ পাক্কা সিরিয়া ফিরিয়া গোছের কিছু একটা হয়ে যেত। কাল একটা আর্টিকেলে পড়লাম। পড়িস।

অন্যজন লাফিয়ে উঠে উত্তেজনায়,

—তাই নাকি! আর কী পড়লি বল। মানবেন্দ্রবাবুর ওপর লেখা যে কী করে মিস করলাম। বল বল তাড়াতাড়ি বল।
—আফগানদের খেদানোর পর যখন শান্তি, বীভৎস শান্তি চারদিকে, তখন ওরা মানে মানবেন্দ্রর পূর্বপুরুষরা কাকভোরে পবিত্র বনস্পতির নিচে ধ্যানমগ্ন হত। কাক ছাড়া সমস্ত বক কাকাতুয়া সব তখনও ঘুমাচ্ছে। এই বৃক্ষ যেমন তেমন নয় ভায়া। শুনে শুনে যখন বেদ লেখা হত সেই সময়ের গাছ এটা। তা সেই বনস্পতির পাশেই ছিল গান্ধর্ব জলাশয়। জল তিরতির করে কেটে এগিয়ে চলেছে রাজহাঁস। ছড়িয়েছিটিয়ে টাটকা পদ্মফুল। সেই জলে অবগাহন করে পদ্মাসনে পাঁচ ঘণ্টার ননস্টপ ধ্যান। এমনই ছিল ওদের কন্সেন্ট্রেশন, পায়ে বিছে টিছে কামড়ালেও কেউ টের পেত না। যেমন তেমন মেডিটেশন নয়, মেডিটেশন উইদাউট এনি কমার্শিয়াল ব্রেক।
—কী বলিস! কমার্শিয়াল ব্রেক! এটাও লেখা ছিল নাকি আর্টিকেলটায়?
—আরে ধুর। ওটা আমার সেন্স অফ হিউমর।

তারা এবার হাসলেন। দুজনেরই দাঁত ও গায়ের রং সাদা। দাঁতে জড়িবুটিওয়ালা মাজন আর ত্বকে আয়ুর্বেদিক লোশন। তারা সেগুলোই কেনেন দাম বেশি হলেও। হাসতে হাসতে আস্তে আস্তে তারা জুস খেলেন। ব্রেকফাস্ট টেবিলের পাশেই ছিল জানলা। পুষে রাখা মানিপ্ল্যান্ট গ্রিল পেঁচিয়ে অনেক ওপরে যাতে উঠতে পারে তার জুতসই ব্যবস্থা। জানলায় চোখ রাখলে দেখা যায় দুটো নির্মীয়মান হাইরাইজ, বুলডোজারে পতনশীল তিনটে উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটা জমজমাট শপিং মল আর তার থেকে দূরে, অনেকটাই দূরে কিছু ভাগশেষ জমিতে খুচরো ধানক্ষেত।

ইতিমধ্যেই হোর্ডিং পড়ে গিয়েছে শহর জুড়ে। এয়ারপোর্ট থেকে মানবেন্দ্রর বাড়ি পর্যন্ত, এক কিলোমিটার অন্তর। মানবেন্দ্রর বাড়ি অবশ্য আহামরি তেমন কিছু নয়। সচ্ছল মধ্যবিত্তের যেমন হয় আর কী। কত লোকে বলেছে, দ্যাখ, মানবেন্দ্রবাবুর মতো অত বিদ্বান পয়সাওয়ালা লোক, চাইলে পুরো এলাকাটাই কিনে নিতে পারত, কিন্তু কত সাধারণভাবে থাকে, দিন কাটায়। অত বড় সেলিব্রিটি হয়েও, পাড়ায় রাস্তার পাশে ঠেলাগাড়ি থেকে ফল কেনে। ভাবা যায়!

আপাতত হোর্ডিঙে মানবেন্দ্র বাঘছাল পরে ধ্যান করছেন। কোলের শিশু হরিণটা তার পায়ের লোমগুলো কচি ঘাস ভেবে মচমচ করে খেয়ে নিচ্ছে। মানবেন্দ্র নির্বিকার। অন্য হোর্ডিঙে ময়ূরের ঠোঁটে তিনি আফগানি আখরোট তুলে দিচ্ছেন। শ্যাম্পু করে দিচ্ছেন আরবের উটগুলোকে। পাশেই কিছু তাগড়াই চিতা। সামনে অ্যান্টিলোপের মাংস। কিন্তু ব্যাটাদের খিদে নেই।

বাজারে কলরব, দিন সাতেক পরেই মানবেন্দ্র দেশে ফিরছেন।

দেশের হালচাল, দিনকাল নিয়ে বড় বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ে আলোচনায় মেতে উঠেছিলেন ছত্রপতি শিভাজি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ও সেচ দফতরের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। বছর দুয়েক আগে আঞ্চলিক ইয়োগা ইভেন্টে দুজনেই যোগ দিয়েছিলেন অনলাইন অ্যাপ্লিকেশন সঠিক সময় জমা দিয়ে। সেখানেই যোগসাধনার লাঞ্চব্রেকে মিটিমিটি হাসতে হাসতেই তাদের যোগাযোগ। দেশের শত্রু-মিত্র সম্পর্কে দুজনেরই মতের মিল ছিল নিবিড়। এই নিবিড় মিল যাচাই করে নিতে মোবাইলে তাদের কথাবার্তা শুরু হয়। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে রোজ সকালে গুড মর্নিং মেসেজ। মানবেন্দ্রর দেশে আসার খবর দুজনেই শুনেছেন। চনমনে মেজাজে শিক্ষক বললেন,

—কজন পারে বলুন তো মুখের ওপর সত্যি কথাটা বলতে। মনু আমাদের ঘরের ছেলে। স্কুল থেকেই বরাবর ব্রিলিয়ান্ট। কখনও সেকেন্ড হয়নি। তিন তিনটে ডক্টরেট। আমি জানতাম ও পারবে। কমেন্ডেবেল ওয়ার্ক।

ইঞ্জিনিয়ার মাথা চুলকে প্রশ্ন করলেন,

—ওয়ার্কটা কীসের ওপর যেন?
—আরে ওই যে অশ্বমেধ ভ্যাকসিন। এবার নোবেলটা উনি পাচ্ছেনই। আমি ড্যাম সিওর। কী মাইন্ড ব্লোইং কনসেপ্ট! ভাবা যায়! ভ্যাকসিনটা পড়লেই নাকি মানুষের ভিতরের মানুষটা গলগল করে বেরিয়ে আসবে।
—ভিতরের মানুষ মানে?
—মানে আসল মানুষটা যেটাকে সে লুকিয়ে রাখে। সব তো শালা মুখোশ পরে আছে। ভিতর ভিতর কী চলছে সেটা কি আমরা থোড়াই প্রকাশ করি। প্যান্টের ভিতর, বুকপকেটে, মানিব্যাগে, টুপির নিচে, সিগারেটের প্যাকেটে, ড্রয়ারে ফয়ারে লুকিয়ে রাখি। কী তাই তো? কিন্তু মন! মনকে লুকোবে কী করে! ভ্যাকসিনটা পড়লে মন আর প্রাইভেট প্রপার্টি থাকল না বস। ওপেন টু অল। ইনহিবিসনের এক্সিভিসন। কি এবার বুঝলেন?
—আচ্ছা, মানে… ওরে বাবা এ তো পুরো গুবলুট কেস মশাই। আমার গায়ে এই ভ্যাকসিন পড়লে তো সর্বনাশ!… কে জানে কী আছে মনে… এ তো কেলেঙ্কারি কাণ্ড! আমি এই ভ্যাকসিন নেবই না। নট অ্যাট অল।
—কিন্তু ভ্যাকসিন কমপালসারি মশাই। নিতেই হবে সবাইকে। কোনও ছাড় নেই। আপনি তো শুধু নিজেরটা ভাবছেন, এবার ভাবুন তো কত চোর, ডাকাত, ধর্ষক, কালোবাজারি আর বিশেষ করে ওই সিউডো আঁতেলেকচুয়ালগুলোকে আলাদা করা যাবে। তারপরে সবকটার পেছনে ক্যাঁত করে লাথি মেরে দেশ থেকে বিদায়। থেকে যাবে শুধু সাদা মনের মানুষগুলো। পিওর ব্লাড। কমেন্ডেবল ওয়ার্ক। কী বলেন?
—হ্যাঁ, এ বিষয়ে আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে একমত। মানে দেশের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস তো করাই যায়। বউয়ের কাছে নয় একখান থাপ্পড় খাব। আর দুদিন হোটেলে খাব। কিছু কাঁচা খিস্তি। তারপর দুটো গয়না, কসমেটিক্স কিনে দিলেই তো… আচ্ছা ভ্যাকসিনের এফেক্ট কদিন থাকবে? পারমানেন্ট নয় তো?
—না না, বড়জোর মাসখানেক।
—আর সাইডএফেক্ট?
—সাইডে না। ওপরে আর নিচে আছে।
—মানে?
—মানে যারা ওপরের সারিতে আছে তারা আরও ওপরে যাবে, সেখানে স্কাই ইজ অলসো নো লিমিট, মানে আরও দূর, পৃথিবী ছাড়িয়ে স্টেলার, ইন্টারস্টেলার… যতদূর যাওয়া যায়… আর নিচের জন আরও নিচে… ম্যানহোলের নিচে… সেখান থেকে পাতাল হয়ে যতদূর নামানো যায়… তবে বলছে এই এফেক্ট টেম্পোরারি।
—সবই তো বুঝলাম কিন্তু একটু টেনশন হচ্ছে মশাই। ডিটেলসটা কোথায় পাব বলুন তো?
—গুগলে মানবেন্দ্র প্লাস অশ্বমেধ লিখে সার্চ মারুন। সব বলে দেবে। আরও ডিটেল আর ভরসা নিতে নেশন টিভি চ্যানেল চোখ রাখুন। আর এটা তো আর মানবেন্দ্রবাবুর ফার্স্ট ইনভেনশন নয়। আরও কত ভ্যাকসিন আছে ওনার নামে। সব পেটেন্ট করা। এক-একটা দেশের জন্য এক-একরকম। যস্মিন দেশে যদাচার।
—তাই নাকি? আরও ভ্যাকসিন আছে! কীরকম?
—আরে এই তো কিছুদিন আগে ট্রায়াল হল। তার যা মহিমা বুঝলেন! ইনস্ট্যান্ট ব্ল্যাক টু হোয়াইট। যা কিছু কালো তাকে সাদা করে দেবে। একটা কালো ভাল্লুককে ফুটিয়েছিল। ব্যাটা দু মিনিটে পোলার বিয়ার। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা। খবরে পড়লাম নর্থ পোলে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। বিদেশি ভ্যাকসিন তো, কস্টলি। নাহলে বউ আর কাজের মেয়েটাকে দিতাম। আরে, কী ব্যাপার! আপনি তো শুনে পুরো ব্যোমকে গেলেন দেখছি।
—না না। সত্যিই তো। কমেন্ডেবেল ওয়ার্ক বটে। আমার তো মানবেন্দ্র মুখার্জিকে দেখার ইচ্ছেটা অনেক বেড়ে গেল। এয়ারপোর্ট যাবেন নাকি?
—আলবাত যাব। ছুটি অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম আগেই।
—ছুটি নিলেন? কাল বলছিলেন অফিসে দারুণ চাপ। প্রোজেক্ট ডেলিভারি মিস হলে চাকরি চলে যেতে পারে। ছুটি পাবেন?
—বসও তো ছুটি নিয়েছে মশাই। বসের বস। বসের বসের বস। ব্যস, মানবেন্দ্র বলতেই সিক লিভ অ্যাপ্রুভড।

মানবেন্দ্রর হাতে এই মুহূর্তে একটা ভ্যাকসিনের শিশি। এ অবশ্য আসল মানবেন্দ্র নয়। লুক অ্যালাইক রবিদাস বাউড়ি। আর ভ্যাকসিনটাও। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রবিদাস বলল,

—নতুন জগৎ, নতুন দেশ
সাদার শুরু, কালোর শেষ
মোর মস্তি চিন্তা লেস
আহা বেশ বেশ বেশ।

সঙ্গে সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এল। নাম পরী। সে বোবা। সে কিছুতেই হাসে না। কাতুকুতু দিলেও না। তাকে কোলে তুলে নিল মানবেন্দ্র। পরম আদরে চুমু খেল। পরীর মধ্যে তবু কোনও হেলদোল নেই। গোমরা মুখের কোনও পরিবর্তন নেই। পরীকে ভ্যাকসিন দিল মানবেন্দ্র। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরল। খুব আদর করল। মেয়েটির সারা মুখ জুড়ে এখন শুধুই হাসি। পরী আসল হলেও পরীর এই পরিবর্তন কিন্তু আসল নয়। রবিদাসের মুখের গ্ল্যামার থেকে পরীর হাসি, সবই ছিল আধুনিক প্রযুক্তির ভেলকিবাজি। এটা ছিল অশ্বমেধ ভ্যাকসিনের প্রোমোশনাল ক্যামপেইনের একটা অংশ। সমস্ত টিভি চ্যানেলে দেখানো হয়েছে। তারপর থেকেই সবার মুখে মুখে কেবল মানবেন্দ্র আর পরীর নাম। প্রায় সবাই একই সুরে বললেন, সত্যিই, এতদিন পর একটা স্ট্রং লিডার পাওয়া গেল। মানবেন্দ্র মুখার্জি। আর পরী মেয়েটা কী কিউট না!

এই বিজ্ঞাপন সম্প্রসারণের পরের দিনই সারা দেশ জুড়ে সকল শ্রেণির মানুষকে অশ্বমেধ ভ্যাকসিনের ফার্স্ট ডোজ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সাহস করে স্বেচ্ছায় অনেক মানুষ এই ভ্যাকসিন নিয়েছেন। সকলেই নিজের আত্মার হদিশ পেতে চান। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে মাসখানেক পরে মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া বুঝে।

ওহ, আগে বলা হয়নি, আজ তো আবার মানবেন্দ্রর জন্মদিন আর আজই তিনি দেশে ফিরছেন। আজ নিজের হাতে পরীকে তিনি ভ্যাকসিন দেবেন। উত্তাল মহাসাগর থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে মানবেন্দ্রর মুখে স্মিত হাসি। এয়ার-হস্টেসের গাঢ় লিপস্টিক মাখা সমস্ত অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিনয়ী গলায় যখন বললেন, মা আমার, দেশের মাটিতে পা রাখা পর্যন্ত চা, কফি, স্কচ কিছুই স্পর্শ করব না আমি, কয়েক হাজার মাইল দূরে পৃথিবীর সেই দেশে তখন দুপুর। হোয়াটসঅ্যাপে ব্যস্ত স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক ও এক সার্জেন। চিন্তায় দুশ্চিন্তায় দুজনের মনের মিল অনেক। তাই তারা বন্ধু।

—কী মুশকিলে পড়লাম মাইরি।
—কেন কী হল?
—শুটিঙে শালা কেউ আসেইনি। কত লোকসান বল তো! ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কী জানি কী হয়েছে, সব ব্যাটা মন্দিরে গিয়ে ভিড় করেছে। দুর্গা, কালী, চণ্ডী, বিশালাক্ষী, ঘুমন্ত, জাগ্রত কোনওটাই বাদ নেই। নাগালে যা পেয়েছে সেখানেই হাটু গেঁড়ে বসে পড়েছে। এ তো আফিমের নেশার মতো। মনে মনে এই ছিল! কবেকারের ফরওয়ার্ড করা মেসেজে পড়েছিলাম, যে যত বেশি অসহায় সে তত বেশি মন্দিরের দিকে যায়। ব্যাপারটা কি সত্যি? চারপাশে এত লোক গিজগিজ করছে, সব কটা মাল এরকম অসহায়!
—আর বলিস না মাইরি। আমাদের পাড়ায় শ্যামলদা, আইপিএস অফিসার, পাড়ায় একটা ছোট শিবমন্দির আছে, সেখানে সকাল থেকে ঢুকে শিবলিঙ্গটাকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আর মদের দোকানগুলো! পুরো মৌচাক। আমার বউ কলেজে গিয়ে বলল নাইন্টি পারসেন্ট স্টুডেন্ট টিচার হাওয়া। জাস্ট গন। কোথায় বডি ফেলেছে কে জানে! ভাগ্যিস বউ নেয়নি। ডেঞ্জারাস ভ্যাকসিন মাইরি। আমিও জোর বেঁচে গিয়েছি। ডাক্তারদের নাকি সবার শেষে দেওয়া হবে। কী করে যে বানাল এমন? মিডিয়া বলল, কোনও মেডিকেল সায়েন্সই নাকি এক্সপ্লেন করতে পারছে না।
—এইখানেই তো আটকে গেলেন। আপনারা ভাই সায়েন্স ছাড়া কিছু বোঝেন না। সায়েন্স দিয়ে তো হয়নি সাহেব। খবরে তো বলল প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যা কাজে লাগিয়ে হয়েছে। মুনিঋষি শেকড়বাকড় জড়িবুটি কী সব বলছিল।
—সুপার অ্যাডভান্সড বায়োজেনেটিক্স ছাড়া এমন ভ্যাকসিন কিন্তু তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ লক্ষ বছরের প্রাচীন বিজ্ঞানকেও অবজ্ঞা করা যায় না। তখন তো প্রায় সবই জানা ছিল। অলৌকিক সব ক্ষমতা! কেবল এক্সপেরিমেন্টের জন্য প্রপার ইন্সট্রুমেন্টটা ছিল না। হাইব্রিড কিছু একটা বানিয়েছে মনে হয়।
—তাই হবে। আরে শোন না, মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছে। রামায়ণের যে রিমেকটা করব ভাবছিলাম সেখানে মানবেন্দ্রবাবুকে একটা চরিত্রে রাখব ভাবছি। অবশ্য যদি তাঁর সময় হয়। চেহারায় ব্যক্তিত্বে ফাটাফাটি একটা তেজ আছে আই মাস্ট অ্যাডমিট। অনেকটা বশিষ্ঠমুনির মতো দেখতে না!
—না না, খবরে তো বলছিল যাজ্ঞবল্ক্যর রক্ত নাকি ওঁর শরীরে।
—দাঁড়া দাঁড়া, মনে পড়েছে। কাশ্যপ কাশ্যপ। নতুন আবিষ্কারের চিন্তায় যখন ডুবে বুঝলি, মেধায় ধার দিতে নাকি সোজা কৈলাশের গুহায় দিনরাত তপস্যা। ইন্সটাতে ছবি দিয়েছিল তো। তখনই মনে হয়েছিল। কী ক্ষমতা! ওইরকম দুর্গম জায়গায় খাবার বলতে বরফকুচি আর ইয়াকের দুধ। তাই খেলেন। তারপর পাহাড় থেকে সোজা মরুভূমি! আমরা তো শালা কথায় কথায় হাক্কা চাউমিন বার্গার পেস্ট্রি হটডগের খোঁজ করি। আর তিনি কী খেলেন! ফণিমনসার ছাল, ক্যাকটাস! ইনক্রেডিবল হজমক্ষমতা!
—আচ্ছা কাঁটা কি উনি বেছে খেয়েছিলেন?
—ধুর, সে কি আর আমার তোমার খিদে ভায়া! খিদের চোটে পথের যা কিছু কাঁটা মানবেন্দ্র সব গোগ্রাসে সাবাড় করেছিলেন।
—আচ্ছা তোরা তো মানবেন্দ্রবাবুকে একটা উপাধি টুপাধি দিতে পারিস। মানবেন্দ্রর রেকমেন্ডেশনে একটা ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ডও তো পেয়েছিস। ওয়ার্ল্ড সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিও তো এখন তোর হাতের মুঠোয়।
—মন্দ বলিসনি। কিন্তু শালা কী দেবটা কী?
—কেন! ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অফ কোর্স।
—আছিস কোথায়! অলরেডি পাঁচটা ঝোলাতে।
—ও বাবা, তাই! তাহলে এ বছরের অস্কারটা ওঁকে দিলে কেমন হয়?
—অস্কার! সে তো শুধু সিনেমার জন্য দেয় রে। ওঁকে কী করে দিই।
—অস্কার পাওয়া লোকজন আজকাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট পাচ্ছে। তাহলে ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট অস্কার পাবে না কেন? আমরা সবাই মিলে গলাবাজি করলেই আলবাত পাবে। দরকার পড়লে আন্দোলন করব।

মানবেন্দ্রর জন্য এদিকে গণ্ডারের চামড়ায় তৈরি বিশেষ কার্পেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রানওয়ে থেকে মানবেন্দ্রর প্রাসাদের সিংহদরজা পর্যন্ত। মাঝখানে জল জঙ্গল জমিন যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবই সাফ করা হয়েছে আগেভাগেই। স্মার্ট সিটি হবে এলাকার আনাচকানাচ।

সন্ধে সাতটা। উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনিতে এয়ারপোর্ট মাতোয়ারা। সমস্ত এলইডি ব্যানারে শুধুই মানবেন্দ্র। ভক্তদের ভিড় সামলাতে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে। তাই সামাল দিতে সামরিক বাহিনিও হাজির। প্রণাম, সেলফি, হ্যান্ডশেকের জন্য মুখিয়ে আছে উত্তেজিত উল্লাসিত লাখো জনতা। এই ভ্যাকসিন সম্পূর্ণ নিরাপদ, বাচ্চাদের বাবা-মাকে তা বোঝাতে উড়োজাহাজের ভিতরেই তিনি আজ নিজের তৈরি ভ্যাকসিন নিয়েছেন। ছুঁচ ফুটতেই তাঁর মুখে ক্রমশ ছড়াতে থাকা প্রশান্তির ক্লোজআপ লাইভ টেলিকাস্ট করেছে দেশের সমস্ত নিউজ চ্যানেল সমস্ত ভাষায়। আদিবাসী ভাষাতেও। কার্পেটের ওপর ভিড়ের দিকে টাটা করতে করতে তিনি হাঁটছেন, মানুষের প্রতি সহানুভূতি, করুণা, ভালবাসা সবকিছু মিলেমিশে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে চালচলন ঠিক যেমন হয়। ভাই ও বোনেরা সবই হল আমার অশ্বমেধ ভ্যাকসিনের সুফল। হাত নেড়ে জনতাকে উদ্দেশ্য করে এই মনের কথাটুকু জানালেন মাত্র। খড়ম পায়ে টকাস টকাস শব্দে মানবেন্দ্র চড়ে বসলেন গোলাপ ক্যালেন্ডুলায় ঢাকা প্রাইভেট হেলিকপ্টারে। নাম পুষ্পক। গন্তব্য তপোবন। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার এই তপোবনটি হবে মানবেন্দ্রর ভবিষ্যতের গবেষণাগার। গিনিপিগ থেকে আরবের উট সবই আছে সেখানে। কদিন পরে ব্রাজিলের কালো বাঘও এসে পড়বে। আপাতত পরীকে আনা হয়েছে সেখানে। তপোবনের একদম মাঝখানে চমৎকার মঞ্চে সে একাই দাঁড়িয়ে। পরীকে নিজের হাতে ভ্যাকসিন দেবেন মানবেন্দ্র। তাঁর গবেষণা বলছে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই পরী হয়ে উঠবে তপোবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেখানকার আজীবন সেবাদাসী।

পরীকে কোলে তুলে নিলেন মানবেন্দ্র। গোটা বিশ্বের চোখ আটকে টিভিস্ক্রিনে। পরী বোবা। পরীর মুখে হাসি নেই। ভ্যাকসিনের ভিতরের তরল পরীর নরম মাংসের ভিতর চালান করলেন মানবেন্দ্র। আস্তে আস্তে পরীর মুখে হাসি ফুটল। অনাবিল সেই হাসির পরতে পরতে মানুষের প্রতি নিবিড় সহানুভূতি, করুণা, ভালবাসার স্পষ্ট আভাস। অ্যানিমেশন নয়, ভেলকি নয়, শতভাগ খাঁটি। পরীর হাতের মুঠোয় ছিল অন্য একটা সিরিঞ্জ। মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা আসল মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে সিরিঞ্জের ভিতর ঠাসা তরল। তিরিশ ফুট দূরের ব্যারিকেডের ওপারে লাখো মানুষ গোল চোখে দেখছেন মানবেন্দ্রর ম্যাজিক। জনতার ভিড়ের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলেন মানবেন্দ্রর লুক অ্যালাইক রবিদাস বাউরি। আজ সে বিশেষ কারণে মুখে ভুষোকালি মেখে এসেছে। সেই বিজ্ঞাপনের পর থেকেই তার সঙ্গে পরীর বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে। রবিদাসের নাতনি বেঁচে থাকলে এতদিনে ঠিক পরীর মতোই হত। কার্পেটের পথ করতে যেদিন পরীদের বস্তি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল তখন থেকেই পরীর দায়িত্ব নিয়েছে সে। রোজ দুবেলা রান্না করে নিজের হাতে খাইয়েছে। মাথার চুল আঁচড়ে দিয়েছে। রূপকথার গল্প শুনিয়েছে প্রতিদিন শোওয়ার আগে। পরীকে সে বুঝিয়েছে দুনিয়ার আজব সব নিয়ম। ভালমন্দের চমকে দেওয়া সব খেলা। কতরকম ফুল কীভাবে ফোটে, মৌমাছির পরাগমিলন আর কতরকমের মানুষ কতরকমভাবে মরে যায় প্রতিদিন। পরী সবই শুনত মন দিয়ে। সাড়া দিত না।

নিজের চেহারার মাহাত্ম্য কাজে লাগিয়ে তরতাজা একখানা ভ্যাক্সিন রবিদাস জোগাড় করেছে। তার গভীর বিশ্বাস উড়োজাহাজে মানবেন্দ্রর ভ্যাকসিন নেওয়া আসলে দেখানেপনা। অ্যানিমেশনের ভেলকিও হতে পারে। রবিদাস সিরিঞ্জটা আজ পরীকে দিয়েছে। সেটাই হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রেখেছিল পরী। মানবেন্দ্রর হাত তার পেটের ওপর পড়তেই হাসতে হাসতে পরী সিরিঞ্জটা গেঁথে দিল মানবেন্দ্রর গলায়। তারপর ব্যারিকেড ভেঙে প্রচণ্ড উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে রবিদাসের পিঠে।

পরবর্তী ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ঘটে যাওয়া যে-সমস্ত খবরগুলো দেশের প্রত্যেকটি নিউজ চ্যানেল আড়াল করেছে তার মধ্যে সভ্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো দুটি ঘটনা হল এইরকম। মানবেন্দ্র তিনটি বোবা নাবালিকাকে ধর্ষণ করেই থেমে থাকেননি, তপোবন লণ্ডভণ্ড করে আরবের উট এবং গিনিপিগের সঙ্গেও সঙ্গমের চেষ্টা চালিয়েছেন। নিজের প্রাসাদের প্রাইভেট রুমের মখমলি কোলবালিশদুটি নখের আঁচড়ে ফর্দাফাই করে ভিতরে জমে থাকা হাজার হাজার ডলারের নোটগুলো চিবিয়ে খেতে খেতে উদোম শরীরে দু-হাতে ফণা বাগিয়ে হাওয়ায় লাগাতার ছোবল মেরেছেন।

এমন বিশৃঙ্খল সময়ে, কী ভাল আর কীইবা মন্দ তা হাড়েমজ্জায় বুঝে নিয়েছিলেন কিছু হাতেগোনা মানুষ। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর তাদের সকলেরই ভালর প্রতি চূড়ান্ত সহানুভূতি, করুণা, ভালবাসা আর মন্দের প্রতি ঠিক ততটাই ক্রোধ, ঘৃণার সবটাই শরীরের চামড়া ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চায়। তারা সকলেই জড়ো হয়েছেন শহর পেরিয়ে দূরের এক জঙ্গলে। রবিদাস জানে তার ঠিকানা। পরীকে কাঁধে নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে সে সেদিকেই।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4802 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অসামান্য স্যাটায়ার। খুবই ভাল গল্প।

আপনার মতামত...