বাজপেয়ি থেকে মোদি: হিন্দুত্বের বিবর্তন

গৌতম রায়

 


২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি এককগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর ভারতকে তার প্রবহমান ধারা থেকে কীভাবে পরিবর্তিত করে আরএসএস তার নিজের মতাদর্শগত দিকটিকে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে এবং নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিকে নিয়োজিত করল, সেটা এখনও পর্যন্ত খুব বিশদভাবে আলোচনায় উঠে আসছে না। এই পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি, পদ্ধতি এবং প্রচেষ্টা— এগুলি যদি সমাজবিজ্ঞানীরা দেশের নাগরিকদের কাছে তুলে ধরতে না পারেন, তাহলে আগামী ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে পরিচালিত করবার লক্ষ্যে নিজেদের শতবর্ষপূর্তির সময়টিকে কেন্দ্র করে আরএসএস একটা লক্ষ্যমাত্রা ধরে এগোচ্ছে, তাকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ এবং সমস্ত অ-বিজেপি, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করবার ক্ষেত্রে হয়তো-বা খানিকটা বিভ্রান্ত হবে

 

নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি যখন ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে আবার এককগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে সরকার গঠন করল, ঠিক সেই সময় থেকেই আরএসএস, গোটা ভারতে তাদের আদর্শগত দিককে সমাজজীবনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আগের থেকে অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠল। আরএসএসের এই কার্যক্রমের অর্থ এমনটা নয় যে, তার আগে নিজেদের তথাকথিত রাজনৈতিক আদর্শ, যেটাকে তারা সামাজিকতার একটা খোলস দিয়ে আবৃত করে রাখে, তার প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রটিকে অবহেলা করে চলত। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর নিজেদের আদর্শগত প্রচারটিকে ভারতীয় জনমানসে একদম গেঁথে দেওয়ার স্বার্থে, এবার যে পদ্ধতি আরএসএস নিতে শুরু করল, তেমন পদ্ধতি অতীতে তারা কখনও নেয়নি।

নেওয়ার চেষ্টা করেনি এটা বললে ভুল হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে উত্তীর্ণ হতে গেলে রাষ্ট্রশক্তির যে ধরনের সহযোগিতা দরকার, সেটা পরিপূর্ণভাবে তাদের করায়ত্ত ছিল না। ২০১৯-এর পরে যে আদর্শগত প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত পরিবর্তন, সেটা তারা অতীতে করে উঠতে পারেনি। রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে, নিজেদের আদর্শগত দিকগুলিকে প্রসারিত করবার ক্ষেত্রে সে সুবিধা আগে তারা পুরোপুরিভাবে পায়নি। ২০১৯-এর ভোটের ফলের পরবর্তী সময় থেকে আরএসএস একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ধরে এগোতে শুরু করল।

সেই লক্ষ্যটি মোদিকে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দিতে পেরেছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর যে সমস্ত সামাজিক রীতিনীতি প্রচলিত ছিল, যার মধ্যে দিয়ে একটা মূল্যবোধের উপরে ভারতের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মত-পথের অবলম্বী হয়েও, মূলত একটি সমন্বয়ী, বৈচিত্র্যময় সুরে তাদের জীবনকে অতিবাহিত করত, সেই জায়গা থেকে ভারতবাসীকে একদম বিপরীতমুখী একটা ধারায় নিয়ে আসাটাই হল আরএসএসের লক্ষ্য। তাই ২০১৯ সাল-পরবর্তী সময়ে নিজেদের তথাকথিত আদর্শগত দিকগুলিকে ভারতবাসীর জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রসারিত করাই ছিল সঙ্ঘের টার্গেট।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে বিজেপি এককগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর ভারতকে তার প্রবহমান ধারা থেকে কীভাবে পরিবর্তিত করে আরএসএস তার নিজের মতাদর্শগত দিকটিকে প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে এবং নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিকে নিয়োজিত করল, সেটা এখনও পর্যন্ত খুব বিশদভাবে আলোচনায় উঠে আসছে না। এই পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি, পদ্ধতি এবং প্রচেষ্টা— এগুলি যদি সমাজবিজ্ঞানীরা দেশের নাগরিকদের কাছে তুলে ধরতে না পারেন, তাহলে আগামী ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে পরিচালিত করবার লক্ষ্যে নিজেদের শতবর্ষপূর্তির সময়টিকে কেন্দ্র করে আরএসএস একটা লক্ষ্যমাত্রা ধরে এগোচ্ছে, তাকে প্রতিহত করবার ক্ষেত্রে দেশের মানুষ এবং সমস্ত অ-বিজেপি, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করবার ক্ষেত্রে হয়তো-বা খানিকটা বিভ্রান্ত হবে।

তবে একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছে। রাষ্ট্রশক্তিকে বিজেপি যেভাবে পরিচালিত করছে, তাতে সমাজবিজ্ঞানীরা আগামী দিনে কতখানি স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিজেদের গবেষণাকর্মকে পরিচালিত করতে পারবেন, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই একটা সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে।

বিগত ২০১৯ সালের ২৩ মে সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়। ফলাফলে দেখা যায় বিজেপির ৩০৩টি আসন দখল করে ৫৪৫ আসন (দুটি আসন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ভিতর থেকে মনোনীত হয়) বিশিষ্ট লোকসভায় এককগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। স্বাধীনতার পর এই প্রথম আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি সংসদীয় রাজনীতিতে জাতীয় স্তরে এই ধরনের সাফল্য পেল।

২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার পেয়েছিল ৩৭.৪ শতাংশ ভোট। ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ১৮২টি আসন। আর শতাংশের হিসেবে ২৩.৭৫ শতাংশ ভোট। তবে এই কথা বলতেই হয়, এককগরিষ্ঠতা না থাকলেও এনডিএ নামক নীতিবিহীন সুবিধাবাদী জোটের মধ্যে দিয়ে শেষ পাঁচ বছর একটানা সরকারটি পরিচালনা করবার কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছিলেন বাজপেয়ি। যদিও তার আগে ১৩ দিনের এবং ১৩ মাসের সরকারকে তিনি টিকিয়ে রাখতে পারেননি বহু চেষ্টা করেও। মোট সাড়ে ছয় বছরের তিন দফার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে এই জোট-রাজনীতিতে বহু শরিককেই শেষ পর্যন্ত এনডিএ-তে ধরে রাখতে পারেননি বাজপেয়ি। এদিক থেকে বলতে হয়, জোটরাজনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর যে বিরামহীন সাফল্য, সেই রেকর্ড আজ পর্যন্ত সরকার পরিচালনার নিরিখে অন্য কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পারেননি।

দ্বিতীয় দফায় যখন মোদি এককগরিষ্ঠতা নিয়ে আবার সরকার গঠন করলেন, তখন কোনওরকম শরিকদের বাধ্যবাধকতা না থাকার কারণে আরএসএসের যে নিজস্ব কর্মসূচিগুলি ছিল, সেগুলি রূপায়িত করবার ক্ষেত্রে আরএসএস বা বিজেপির কাছে আর কোনও বাধা রইল না। এই প্রসঙ্গে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে দেওয়া মোদির একটি সাক্ষাৎকার বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। সেই সময় মোদি বলেছিলেন, হিন্দুত্ববাদীরা তাদের যে সমস্ত নিজস্ব কর্মসূচি, যেমন বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির নির্মাণ, সংবিধানের ৩৭০ ধারা এবং ৩৫-এর ক ধারার অবলুপ্তি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করবার পরিকল্পনা, ইত্যাদি থেকে কখনওই সরে আসেনি। যখন যেরকম অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েই তারা তাদের কর্মসূচিগুলিকে রূপায়িত করবার পথে হেঁটেছে এবং ভবিষ্যতেও হাঁটবে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, এই যে কর্মসূচিগুলির কথা বলা হল সেগুলিকে সাধারণভাবে আরএসএসের গোপন কর্মসূচি হিসেবেই এতকাল বলা হত। কিন্তু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদি সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে খুব খোলাখুলিভাবেই ওইসব কর্মসূচি যে কোনও অবস্থাতেই আরএসএসের গোপন কর্মসূচিতে আর আবদ্ধ থাকছে না, একেবারে প্রকাশ্য কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে, শুধু সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় তাঁরা রয়েছেন— এই কথাটা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন। আরএসএসের নেতারা তাঁদের সাংগঠনিক স্তরে এ বিষয়গুলি স্বীকার করলেও প্রকাশ্যে এগুলি নিয়ে তাঁরা কখনও মুখ খুলতেন না। বিজেপি নেতারাও মুখ খুলতেন না। সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়িও মুখ খোলেননি। সাধারণভাবে সেই সময়ের বিজেপিকে ঘিরে, আরএসএসকে ঘিরে সমাজবিজ্ঞানীরা যে মুখ আর মুখোশের খেলার কথা বলতেন, সেটা কিন্তু এই প্রথম মোদি ভেঙে দিলেন।

ভারতের প্রচলিত রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক আইনকানুনজনিত যে প্রবহমান ধারা, প্রয়োজনীয় আসনসংখ্যা সংসদে অর্জন করতে পারলে সেই ধারাকে বিজেপি ভেঙে তছনছ করে দেবে। এটা রাজনীতিসচেতন মানুষেরা জানতে পারলেও মোদি কিন্তু সেই প্রথম প্রকাশ্যে এই ব্যাপারগুলিকে স্বীকার করলেন।

অটলবিহারী বাজপেয়ির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যে কথাগুলি বলেছিলেন, তার বাস্তবায়ন শুরু হতে আমরা দেখলাম মোদি দ্বিতীয় দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবার অব্যবহিত পরেই। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কাশ্মিরের ভারতভুক্তির সময়কালে ওই রাজ্যটিকে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫-এর ক ধারা অনুযায়ী যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল তার অবলুপ্তি ঘটালেন। পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মিরের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের গৃহবন্দি করা হল। গোটা কাশ্মির উপত্যকা চলে গেল কারফিউয়ের কবলে। সেখানকার কোনও খবর বাইরের দুনিয়া জানতে পারল না। গোটা সংবাদমাধ্যমকে কাশ্মির উপত্যকায় কার্যত নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল। বর্তমান সময়ের যেটি প্রয়োজনীয় বিষয়, সেই ইন্টারনেট ব্যবস্থা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ করে রাখা হল কাশ্মির উপত্যকায়।

আদর্শগতভাবে বিজেপি মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য থেকে যে সংবিধানপ্রদত্ত বিশেষ অধিকার অবলুপ্তির প্রতিশ্রুতি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার থেকে শুরু করে সমস্ত স্তরে দিয়েছিল, বলা যেতে পারে, এইভাবেই সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করল তারা। তার পরের যে অধ্যায়টি আরএসএসের আদর্শগত আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য বিষয় সেটি হল ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের পাঁচজন বিচিরপতির ডিভিশন বেঞ্চের রায়। সংশ্লিষ্ট রায়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমিটিকে অযোধ্যার বিতর্কিত রামমন্দির কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দেওয়া হল। এই জমি আইনগতভাবে সংশ্লিষ্ট মন্দির কর্তৃপক্ষকে দিয়ে দেওয়ার ফলে বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির নির্মাণ, যেটি গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা, তা রূপায়িত করবার ক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আর কোনও বাধা রইল না।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দুত্ববাদী শক্তি ভারতের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদটি ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন ভারতে অন্যতম প্রধান সুপরিকল্পিত অপরাধ সংঘটিত করেছিল। যে অপরাধের মূল লক্ষ্য ছিল সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজকে আক্রমণ। সেই অপরাধ এবং অপরাধীদের ঘিরে আইনব্যবস্থা যে ধরনের অবস্থান গ্রহণ করল তা আইনব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা ঘিরে একটা সংশয়ের পরিবেশ তৈরি করল।

গোটা ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ জাতীয় আন্দোলনের কালে বা স্বাধীন ভারতে দ্বন্দ্ব-বিরোধের মধ্যে দিয়েও যে সম্প্রীতির, সহমর্মিতার একটা বাতাবরণের মধ্যে দিয়ে নিজেদের জীবনকে পরিশীলিত করছিলেন, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের জীবনকে, প্রবাহিত অর্থনীতি এবং সামাজিকতার মূল স্রোতের মধ্যে দিয়ে, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত দিক থেকে নিজেদের আরও উন্নত করবার চেষ্টা করছিলেন, সেই গোটা প্রক্রিয়াটাই বিশেষরকমভাবে বাধাপ্রাপ্ত হল।

যে রায়ের ভিত্তিতে বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর মন্দির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করল হিন্দুত্ববাদী শক্তি, সেই মসজিদ ধ্বংসের কাজকে বেআইনি কাজ বলে অভিহিত করলেন সুপ্রিম কোর্ট। অথচ সেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জমি দিয়ে দেওয়া হল হিন্দুত্ববাদীদের। এক অদ্ভুত ধাঁধার মধ্যে যেন ওই রায়ের বিষয়বস্তুটি থেকে গেল।

মসজিদ ধ্বংস ব্যাপারটি যখন সুপ্রিম কোর্টের কাছে বেআইনি বলে মনে হল, তখন কীভাবে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের জমি অপর একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হাতে অর্পণ করা হল তা ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। এখানেই থেমে থাকল না সুপ্রিম কোর্ট। ইসলামীয় আইনে মসজিদ স্থানান্তরের কোনও সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও মসজিদকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করবার জন্যে মুসলমান সম্প্রদায়কে বাবরি মসজিদের এলাকা থেকে অনেক দূরে সুপ্রিম কোর্ট জমি দিল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেখানে খুব পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছিল, ভারতে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মীয় এবং নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের সমস্তরকমের ব্যক্তিগত আইন বজায় রাখবার সুযোগ স্বাধীন সার্বভৌম ভারতে পাবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই চুক্তি মোতাবেক ভারতের সংবিধান রচিত হয়েছে। ফলে ইসলামে যেখানে মসজিদ স্থানান্তরের কোনওরকম বিধি-বিধান নেই, তাই এই বিষয়টি মুসলমান সমাজের ব্যক্তিগত আইন হিসেবে স্বীকৃত। ভারতীয় সংবিধান ভারতীয় মুসলমানদের নিজস্ব ব্যক্তিগত আইন বজায় রাখবার অধিকার প্রদান করেছে। এমন বেশ কিছু ব্যক্তিগত আইন হিন্দুরাও ভোগ করে থাকে।

বাবরি মসজিদের জমি হিন্দু সম্প্রদায়কে দিয়ে দেওয়ার পর মসজিদ স্থানান্তরের জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে বাবরি মসজিদ থেকে বেশ কিছুটা দূরে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক যে জমিপ্রদান, সেটি সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনবিরোধী এবং অবশ্যই সংবিধানবিরোধী।

গোটা ব্যাপারটি ঘিরে এক আশ্চর্য ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদে সামিল হতে পর্যন্ত দিল না আরএসএস, বিজেপি। এই জায়গা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে, এককগরিষ্ঠতাকে অবলম্বন করে আরএসএস যে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে শুরু করেছিল মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবার সময়কাল থেকে, তা যত দিন গেছে তত আরও তীক্ষ্ণ হয়েছে, উগ্র হয়েছে।

বাবরি মসজিদের জমি রামমন্দির কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া— গোটা ব্যাপারটা হল হিন্দুত্ববাদী শক্তির যে মতাদর্শগত বক্তব্য তারই একটা স্বীকৃতি। কিন্তু এই স্বীকৃতিটি বিজেপি কখনওই নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদীদের দিল না। এই স্বীকৃতিটি অত্যন্ত কৌশলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টকে ব্যবহার করে এমন একটা পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে দেশবাসীর সামনে আরএসএস এবং বিজেপি উপস্থাপিত করল, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয়, গোটা ব্যাপারটি হল কোর্ট দ্বারা নির্ধারিত একটি ফয়সালা। আর এই ফয়সালের মধ্যে দিয়ে মধ্যযুগে ভারতে মুসলমান শাসকেরা মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন— এই যে অসত্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তত্ত্ব হিন্দুত্ববাদী শক্তি পরিবেশন করে, সেই তত্ত্বকে প্রশাসনিকভাবে স্বীকৃতির তকমা না দিয়ে আদালতের মধ্যে দিয়ে স্বীকৃতির তকমা দেওয়া হল।

এইভাবে ঘুরিয়ে নাক দেখানোর মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করবার সাম্প্রদায়িক তত্ত্বটিকে সামাজিকভাবে জল-চল করে দেওয়া হল। সাধারণ মানুষের মধ্যে মন্দির ভেঙে মসজিদ করবার আরএসএসীয় তত্ত্বটিকে সত্য বলে প্রমাণ করবার জন্যই, এভাবে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ব্যবহার করল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে দিয়ে এটা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হল। এই আদর্শগত ভিত্তিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রসারিত করবার লক্ষ্যেই মোদিজমানায় সংসদে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে কাজ করাই হল আরএসএসের পরিবর্তিত কৌশল।

মধ্যযুগে ভারতে শাসকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেহেতু ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান ছিলেন, তাই মুসলমানের হাতে হিন্দু মন্দির ধ্বংসের তত্ত্ব আরএসএস কার্যত তাদের জন্মলগ্ন থেকে নিজেদের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বইপত্রে, বক্তৃতায়, প্রচারের সবরকম ক্ষেত্রগুলিতে বলে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পরে মুসলমান শাসক কর্তৃক হিন্দু মন্দির ধ্বংসের ব্যাপারটিকে সামাজিক গ্রহণযোগ্য করে তোলবার জন্যে আরএসএস চেষ্টার ত্রুটি করেনি।

এই কাজে জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তাদের সহায়ক হয়েছিলেন কংগ্রেসের ভেতরেরই কিছু দক্ষিণপন্থী, সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন নেতৃত্ব। যার মধ্যে ছিলেন ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদ, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, বসন্ত শ্রীহরি আনে, পুরুষোত্তম দাস ট্যান্ডন, গোবিন্দ বল্লভ পন্থ প্রমুখ ব্যক্তিত্বেরা। জওহরলাল নেহরুর প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের ভেতরের এই দক্ষিণপন্থী অংশকে যথেষ্ট কোণঠাসা করে দিতে পেরেছিল।

সেই সময় থেকে এই মন্দির ভেঙে মুসলমানদের মসজিদ করবার তত্ত্বকে সাধারণ মানুষের মগজে পুড়ে দেওয়ার জন্য আরএসএস বা তার বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন নামের রাজনৈতিক সংগঠন আর শাখা সংগঠনগুলি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই প্রচেষ্টা নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে আদালত কর্তৃক স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে মতাদর্শগত প্রসারের জায়গাটি একটা শক্ত বনিয়াদের উপরে দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম হল আরএসএস এবং তার বর্তমানে রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।

এই প্রচেষ্টার সঙ্গে যে মানসিকভাবে বাজপেয়ি সম্পৃক্ত ছিলেন না এমনটা মনে করবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু জোট রাজনীতির ভেতর দিয়ে সরকার পরিচালনা করবার কারণে বাজপেয়ির পক্ষে এটা করা সম্ভব হয়নি। মোদি হিন্দুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করছেন সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে উগ্র করে, সঙ্ঘের শতবর্ষ উদযাপনের যাবতীয় পরিকল্পনাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে।

কৌশলগত কারণে বাজপেয়ি তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সঙ্ঘের প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলির প্রশ্নে কিছুটা নীরবতা, কিছুটা কৌশলী ভূমিকা পালন করে জনমানসে নিজের একটা অন্যরকম ভূমিকা রাখবার চেষ্টা করে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মন্ত্রিসভার উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি সেটা একবারের জন্যেও করেননি। মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ, তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর উপক্রমে আদবানি নরেন্দ্র মোদির চেয়ে কোনও অংশে আলাদা ছিলেন না। বরং বলা যেতে পারে, ঘৃণা ছড়াবার শব্দচয়নের ক্ষেত্রে আদবানি আর মোদির মধ্যে একটা সাদৃশ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে এই মুসলমান বিদ্বেষের প্রশ্নে খুব একটা ফারাক আমরা দেখতে পাই না।

যদিও নিজেদের এককগরিষ্ঠতা না থাকার জন্য কৌশলগত কারণে আদবানিকে কিছুটা হলেও সংযমী ভূমিকা পালন করতে হত। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখে নরেন্দ্র মোদি সেই সংযোমের ধার ধারেন না।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4802 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...