স্টেশনমাস্টারের কলম
…২০২৪ নির্বাচনের এই জলবিভাজিকাটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠবে কিনা, আগামী পাঁচ বছরের গতিপ্রকৃতি তা নির্ধারণ করবে। এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে প্রমাণিত যে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির বদলে দেশের মানুষ তাদের মৌলিক সমস্যাগুলিকে নিয়ে উত্তরোত্তর বেশি ভাবিত, কারণ তাদের জীবনসংগ্রাম দিনের পর দিন কঠিনতর হয়ে পড়ছে। যদিও শাসক দল বিজেপি এখনও ক্ষমতায় এবং এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তাদের আগ্রাসী একচক্ষু রাজনীতির বিরুদ্ধ কণ্ঠ ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে।…
২০২৪-এর সদ্যোসমাপ্ত সাধারণ নির্বাচন ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক ইতিহাসে স্পষ্টত একটি জলবিভাজিকা। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি-প্রণীত কুখ্যাত জরুরি অবস্থার ঠিক পরে, ১৯৭৭ সালে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি অধিকার করে আছে, ২০২৪-র নির্বাচনকেও নির্দ্বিধায় তার পাশে বসানো যায়।
‘৭৭-এর মতো ‘২৪-এও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ভারতীয় গণতন্ত্রের চরিত্র রক্ষার করার লড়াইয়ে নেমে পক্ষাবলম্বন করলেন। আমরা বিশ্বাস করি, ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতন্ত্র, তার হাজারো ত্রুটিবিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, এই মুহূর্তে আমাদের হাতে থাকা সবচেয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা, যার দ্বারা দেশের প্রান্তিকতম মানুষটির ক্ষমতায়ন ঘটানো সম্ভব৷ ২০২৪-এর নির্বাচনে দেশের সাধারণ মানুষের সচেতন প্রতিরোধে গণতন্ত্রের সামগ্রিক সর্বনাশ আপাতত এড়ানো গেল। এখানে ‘আপাতত’ শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, প্রিয় পাঠক। গত দশ বছর ধরে যাদের কুশলী কার্যকলাপে দেশে গণতন্ত্রের একটা সামগ্রিক অগস্ত্যযাত্রা আমরা প্রত্যক্ষ করছিলাম, তা সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব না হলেও, সেই গণতন্ত্র-হন্তারকদের হাতে ও পায়ে অন্তত দুটি শেকল পরানো গেছে, এই নির্বাচনের এটা নিঃসন্দেহে অন্যতম বড় প্রাপ্তি।
২০২৪ নির্বাচনের এই জলবিভাজিকাটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে উঠবে কিনা, আগামী পাঁচ বছরের গতিপ্রকৃতি তা নির্ধারণ করবে। এই নির্বাচনের ফলাফল থেকে প্রমাণিত যে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির বদলে দেশের মানুষ তাদের মৌলিক সমস্যাগুলিকে নিয়ে উত্তরোত্তর বেশি ভাবিত, কারণ তাদের জীবনসংগ্রাম দিনের পর দিন কঠিনতর হয়ে পড়ছে। যদিও শাসক দল বিজেপি এখনও ক্ষমতায় এবং এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু তাদের আগ্রাসী একচক্ষু রাজনীতির বিরুদ্ধ কণ্ঠ ধীরে ধীরে তীব্রতর হচ্ছে। এই মুহূর্তে অ-বিজেপি ও সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী দলগুলির প্রধান কাজ, যাদের মধ্যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের দায়িত্ব ও কর্তব্য সবচেয়ে বেশি, সংসদের বাইরে গ্রামে-শহরে পথে-ঘাটে, কারখানায়-কৃষিক্ষেত্রে মানুষের কাছে পৌঁছনো, তাঁদের সমস্যাগুলি শোনা ও বোঝার চেষ্টা করা, এই সমস্যাগুলির কথা সংসদে আলোচনা করা। ভারতবর্ষের রাজনীতির অভিমুখ ধর্ম ও পরিচয়ের ঘৃণাবাদী রাজনীতি থেকে পুনরায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ও সামাজিক ন্যায়ের জরুরি ময়দানে ফিরিয়ে নিয়ে আসার সুযোগ এই নির্বাচনের মাধ্যমে পাওয়া গেছে, সংসদে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার ছাড়া আমাদের দেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। আমরা নিশ্চিত নই, হয়তো নিজ নিজ ক্ষুদ্র ক্ষমতার সমীকরণ নিয়ে ব্যস্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত একাধিক বিরোধী দলের কাছ থেকে এগুলি চাওয়া বড় বেশি আশা করা হয়ে যাবে, এবং সংসদে বামদলগুলির যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বের অভাব প্রতিপদে অনুভূত হবে, কিন্তু পাশাপাশি এটাও বলবার এই নির্বাচনী লড়াইয়ে বিরোধীরা তাদের ব্যক্তিগত মতবিরোধ ভুলে বিজেপির বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ গড়ে তুলেছিল ও বজায় রেখেছিল, তা প্রশংসার দাবি রাখে। এই রাজনৈতিক লড়াইয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে দুটি আসমুদ্র-হিমাচল ভারত জোড়ো যাত্রা রাহুল গান্ধিকে যেমন একটি পরিণত নেতা হিসেবে তুলে ধরেছে, তেমনভাবেই দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নানা আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের সাধারণ মানুষের মূল সমস্যাগুলি রাজনৈতিক চর্চার পরিসরে উঠে এসেছে। এই সদর্থক রাজনীতির পথরেখা বিরোধী শিবির আগামী পাঁচ বছরে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটুকু আশা করা যায়।
প্রসঙ্গত, সংসদে বামদলগুলির প্রতিনিধিত্ব জরুরি কেন, কেন তাঁদের উপস্থিতি আমাদের দেশের গরিব মানুষের পক্ষে হিতকর, এই দেশে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী— অনেক পাঠকের মনে বিরক্তি অথবা বেদনার সঙ্গে এই প্রশ্নগুলি উঠে আসতে পারে। নানা সময়ে ভুল ও আত্মঘাতী রাজনীতি পথ অবলম্বন করলেও ভারতের রাজনীতিতে বামদের প্রয়োজনীয়তা বেশি শব্দ খরচ না করে আপাতত একটিমাত্র তথ্যসহযোগে বুঝিয়ে দেওয়া যাক। সিপিআই (এম-এল), সিপিআই (এম), সিপিআই-সহ বামদলগুলিই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী যারা গত পাঁচ বছরে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে সারা দেশে একটি টাকাও অনুদান হিসেবে গ্রহণ করেনি, বরং স্বাধীনতার পরে শাসক-পোষিত সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ভাণ্ডটি সুপ্রিম কোর্টে তাঁদেরই অভিযোগের ভিত্তিতে দেশের মানুষের সামনে উদ্ঘাটিত হল। অধিক মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জুলাই সংখ্যায় আমরা নানা দিক থেকে দেখার চেষ্টা করেছি নির্বাচন ২০২৪ ও আগামী পাঁচ বছরের সময়কাল ধরে নানা বুনিয়াদি ক্ষেত্রে আমাদের আশা ও আশঙ্কাগুলিকে। রাজনীতির নানা দিক, অর্থনীতি, সমাজে নারীর অবস্থান, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার— এরকম নানা প্রসঙ্গ আলোচিত ছটি প্রবন্ধে, লিখেছেন আশীষ লাহিড়ী, আশিস গুপ্ত, আইরিন শবনম, দেবাশিস মিথিয়া, প্রতীক, এবং, সঙ্গে রাম পুনিয়ানির একটি নিবন্ধ প্রকাশ করা হল বাংলায় তর্জমা করে। প্রচ্ছদভাবনার শিরোনাম— নির্বাচন ২০২৪: আশঙ্কা, আশা।
এছাড়াও রইল অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ।
পড়বেন, জানাবেন। অলমিতি…