মৃন্ময় চক্রবর্তী
আজ ফের ঝামেলা হবে চরের জমিটা নিয়ে। মারপিটও হতে পারে। এই ধু ধু চরে মোটে দুজন লোক, অথচ একখণ্ড মাটি নিয়ে রোজ লড়াই।
মাচার উপর আয়েস করে পা ছড়িয়ে বসে মাইকেল সর্দার। বোতল বের করে গলায় ঢালতে ঢালতে বলে,
–না মঈন, এই দুটো পায়রায় কী হবে বল? একটা সেরা মন্ত্র নিতি গেলি একখান গরু না হলি হয় না, তার উপর আবার একটা দুশমনমারা কবচ। না এতে হবেনে!
–পায়ে পড়ি ওস্তাদ সেবারে তোমারে দুটো মোরগ দিলুম। ফসল উডলি ঠিক পাবা তুমি, আল্লার কিরা!
–কথা দিলি কিন্তু!
–এই তোমার চরন ছুঁয়ে বলতিচি ওস্তাদ। মন্তরডা দেও, নইলি শালার গদাই জমিটা দখল নে নেবে!
মাইকেল কানে কানে ফিসফিস করে কীসব মন্ত্র পড়ে, হাতে তাবিজ গুঁজে দেয়। কাজ হয়ে গেলে বাঁশঝাড় পেরিয়ে পুকুরপাড় ঘেঁষা সরু পথ দিয়ে মঈন চলে যায়। তার ছায়া বৃষ্টির ভেতর আবছা হতে থাকে।
মাঠে মাছখোর বক নেমেছে অনেক। সবুজ ধানচারার ভিড়ে সাদা বক বেশ লাগে তার। পায়রাদুটো ঝোলায় পুরতে পুরতে হাসে মাইকেল। বাকি পাঁইট গলায় ঢেলে ঠোঁট মোছে।
খানিক পরে আড়মোড়া ভেঙে উঠেই মাইকেল দেখে, কলাবাগানের আড়ালে একটা মানুষের ছায়া। সে বুঝতে পারে গদাই আসছে। কাত হয়ে বসে থলেটা আড়াল করে ঝিমোনোর ভান করে সে।
–ওস্তাদ, ঘুমুলে?
–কে, ও গদাই, কী এনিচিস দেখি!
–এই মুরগির ডিম কটা নাও, আর কিছু দিতি পারব না।
–ডিম, ছোঃ ওতি কী হয়?
–ওস্তাদ মেয়েটার খুব শরীল খারাপ, তার মুখের খাবার ছিনিয়ে নে এলুম। আগের বার হাঁসটা তো দিচি তোমারে!
–একটা এত দামী মন্তর আর শত্রুমারা তাবিজের জন্যি চারটে মুরগির ডিম?
–ধানডা উডতি দেও, সুদি আসলি ঠিক দে দেব, এবারে দয়া করো, চরণে ধরি তোমার! মন্তরটা না হলি এবারে শালার মইনির প্যাঁচে পড়ি যাব। জমিটা চলে যাবে গো!
–কতাডা খেয়াল রাকিস!
–ভুল হবে না ওস্তাদ!
শত্রুমারা মন্ত্র আর তাবিজ নিয়ে গদাই চলে যায় কলাবন পার হয়ে। মাইকেল একা একাই হাসে, হাসতে হাসতে ঝোলায় ভরে ডিম। মাচা থেকে নেমে আসে। আজ আমদানি কম হলেও খারাপ হয়নি।
বকগুলো মাঠে চরছে, বেশ মাছ হয়েছে মাঠে, খলবল শব্দ শুনলেই বোঝা যায়! সবুজ ধানের চারার মাঝখানে সাদা বক বড়ই সুন্দর লাগে মাইকেলের।
সে বাঁধের উপর উঠে আসে, পশ্চিমে নদীর দিকে চলে যায়। তার ধূর্ত চোখ একবার পিছন দেখে একবার সামনে তাকায়।