মৃন্ময় চক্রবর্তী
ফ্লাইওভারের রেলিং-এ হাত চেপে গুঁড়ো হতে হতে চিৎকার করে ওঠে অরুণাভ, মা, বুবাই, শিমুল আমি আসছি, তোমরা দাঁড়াও। ভয়াল জলোচ্ছ্বাস গ্রীন আবাসনকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নৌকোর মতো দুলছে বাড়িঘর। সমস্ত দৃশ্যপট মুছে দিচ্ছে বৃষ্টি। আচমকা সেই ধোঁয়াটে বৃষ্টির প্লাবনের ভেতর থেকে একটি হাত অরুণাভকে সজোরে থামিয়ে দিয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছেন, পাগল নাকি? ওদিকে চলুন। আমিও ফিরতে পারিনি ঘরে, আমার অসুস্থ স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়েছিলাম। এই দেখুন। কিন্তু নিয়ে ফেরার আগেই… এত অল্প সময়ে এটা ঘটে গেল… আবহাওয়া দপ্তরের কাছেও খবর ছিল না। পুরো তল্লাট মুছে গেছে আপনি কী করবেন সেখানে গিয়ে? চলুন!
অরুণাভ তড়িদাহতের মতো দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোখের নোনাস্রোত যুদ্ধ করতে থাকে বৃষ্টির সাথে।
চলুন! দাঁড়িয়ে থাকবেন না! দেখছেন না কীভাবে ধেয়ে আসছে স্রোত। সামনের টার্মিনাসে বায়ুসেনার হেলিকপ্টার নামবে শুনলাম। চলুন!
অচেনা মানুষ তাকে ধরে নিয়ে আসে টার্মিনাসে। সেখানে থিকথিক করছে লোক। একফোঁটা শব্দ নেই। কেউ কথা বলছে না। একটা প্রবল অভিঘাত সবাইকে বধির করে দিয়েছে। এখানে কেউ কারও পরিচিত নয় বোঝা যাচ্ছে। অরুণাভ এদিক ওদিক অস্থিরভাবে তাকায়। যদি মা বুবাই কিম্বা শিমুল… না না সম্ভাবনা নেই। তার হাত শরীরের ভার বইতে না পেরে টার্মিনাসের পিলার আঁকড়ে ধরে। প্রবল কান্নায় বেঁকে যায় দেহ।
অরুণাভর ঠিক পাশে একজন মহিলা রেলিং ধরে মাথাটা বৃষ্টিতে ছুঁড়ে দিয়ে ঝুঁকেছিল। তার চুল দুপাশে পর্দার মতো ঢেকে রেখেছিল মুখ। অরুণাভর কান্নার শব্দে সে মাথা তুলে তাকাল বিহ্বল চোখে। তার মুখ দেখে মনে হল সে আর সুস্থ নেই। অরুণাভ মাথা ঘোরাতেই তাকে দেখে চমকে উঠল, শিউলি! তার কান্নার শব্দ বৃষ্টিকে অতিক্রম করতে চাইল। সেই বিহ্বল অপ্রকৃতিস্থ মহিলা একটা জলজ ঝাপটার মতো তার হাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই আর্তনাদকে দ্বিগুণ করে দিল।
শিউলির সঙ্গে অরুণাভর পরিচয় বছর দুয়েকের। সোসাল মিডিয়ায় আলাপ। শিউলি গান করে, আর অরুণাভ সখের বাচিক শিল্পী। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সভায় দেখা হতে হতে সখ্যতা জমে উঠেছিল। সেই শিউলিও এখানে। ওর বাচ্চা, স্বামী? ওরাও কী…?
ফ্লাইওভারের ওপার কি গিলে নিয়েছে জলদানব? গাঢ় অন্ধকারে বিদ্যুতের ঝলকে চমকে উঠছিল টার্মিনাসের অসহায় মানুষগুলো। হেলিকপ্টার কোথায়? আদৌ কি তা নামবে, তাদের উদ্ধার করবে?
শিউলির মুখে হাত ছোঁয়াল অরুণাভ। এই প্রথম। কেন ছোঁয়াল সে জানে না। সহানুভূতি? জানে না সে। স্থির হয়ে দেখল দুজন, দুজনকেই।
শিউলির স্বামী ডাক্তার। ভদ্রলোক মদ্যপ। হাজারদিন বাড়িতে ফিরতেন না। শিশুকন্যা নিয়ে একটা ফ্ল্যাটের কোণায় পড়ে থাকত শিউলি। মেয়ে স্কুলে গেলে সে নিছক একা। শিউলি আকুল হয়ে যন্ত্রণার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল। তারপর গানের ভেতর দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। সেই গানের সূত্র ধরেই অনেক পরে আলাপ হয়েছিল অরুণাভর সাথে।
ব্রিজটা যেন দুলছে। বোবা লোকগুলো গুঞ্জন করে উঠল। হেলিকপ্টারের জন্য অপেক্ষা করে লাভ নেই। জমাট ভিড়টা ভেঙে গেল। কেউ কেউ হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে।
অরুণাভর সঙ্গে শিউলির প্রেম ছিল কি? না না, তা তো ওরা ভাবেনি। আজ এই নিশ্চিহ্ন, দিকচিহ্নহীন প্রহর ওদের আচমকা নৈকট্য বাড়িয়ে দিয়েছে মনে হল। অরুণাভ হাত ধরে টানল তাকে, শিউলি চলুন দেরি হয়ে যাচ্ছে। শিউলি কিছু বলল না, নীরবে এগিয়ে দিল পা।
পিছনে কলরব করছে জল। আকাশ নিচু হয়ে আসছে ক্রমশ। ওরা হাঁটছে, ছুটছেই বলা যায়। শিউলি ওর হাতটা জাপটে ধরল আচমকা, কোথায় যাবেন অরুণাভ?
–আপাতত কোনও শেল্টারে।
–এদিকেও তো জল।
–হ্যাঁ চারদিকে জল জল আর জল।
–কোথায় যাবেন?
–জানি না, সবাই যেদিকে যাচ্ছে।
–আর কেউ তো নেই, কাউকে তো দেখছি না অরুণাভ।
চারদিক আচ্ছন্ন অন্ধকার। বৃষ্টির ধোঁয়া দৃশ্যমানতাকে ক্রমশ ঢেকে দিচ্ছে। অরুণাভ দেখল কেউ কোথাও নেই। জল ক্রমশ পায়ের পাতা ছুঁয়ে হাঁটু পেরিয়ে উঠে আসছে কোমরে।
–কোথায় যাবেন অরুণ?
–আপনার কাছে শিউলি!
–আমার যে ঠিকানা হারিয়েছে।
–আমারও হারিয়ে গেছে সব।
আকাশ ধ্বসে পড়ছে। ওদের বুক ছুঁয়েছে জল। চারপাশে একটাও গাছ নেই, সবুজের চিহ্ন নেই কোথাও। ওরা কোথায় দাঁড়াবে? এই দুঃসময়ে, এই ধ্বংসস্তুপে প্রেম আসছে। কেন আসছে প্রেম?
এরপর আকাশের শেষ আলোটুকু নিভে যাবে।