খোলা চিঠি লেখার মতো আর কেউ নেই

অনিতা অগ্নিহোত্রী

 


সিঙ্গুরপর্বে এই মানুষটিকে সমালোচনা করে খোলা চিঠি লিখেছিলাম। আমি তখন বাংলায় নেই। নন্দীগ্রামের ঘটনার পর বাংলা আকাদেমি থেকে পাওয়া পুরস্কার ফিরিয়েছিলাম। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতাম না। পুরস্কারফলকে মুখ্যমন্ত্রীর সই। বার বার হাতে তুলে দেখতাম। সমালোচনা করেছি কিন্তু অশ্রদ্ধা করিনি এক পলকের জন্যও। তাঁর হাতে রক্ত, সাদা পোশাকে কালি, এইরকম নাটকীয় চিন্তা আমার ছিল না। যথেষ্ট জটিলতা ছিল, ষড়যন্ত্র ছিল ক্ষমতা দখলের, তাঁর পরামর্শদাতারা যাঁরা আজ অনেকেই বর্তমান শাসনের ঘনিষ্ঠ, সেদিন তাঁর পাশে দাঁড়াননি। যে কুটিলতা, নীচতা, মিথ্যাচার সেদিনের রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতন একজন সৎ, আবেগপ্রবণ, মননশীল রাজনীতিকের পক্ষে তার মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। পরাজয়ের দায় ও বেদনা তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন, মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীর ভাঙতে আরম্ভ করেছিল

 

আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করি। শ্রদ্ধা, সমীহ, সম্মান। অতীতসূচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করছি না, কারণ মানুষটি আমার কাছে বিগত নন। একজন মুখ্যমন্ত্রীকে এক সরকারি পদাধিকারী যেভাবে শ্রদ্ধা করে থাকেন, এ তার চেয়ে অনেক অন্যরকম। এর সঙ্গে তাঁর পদ বা ক্ষমতার কোনও সম্পর্ক নেই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সাদা পাঞ্জাবি-ধুতি পরা ভদ্রব্যক্তি ভাবমূর্তির কথা আজ বার বার ফিরে আসছে। এই সাদা কোনও বাইরের রং ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সুভদ্র আচরণ তাঁর অন্তরের অভিব্যক্তি ছিল। তাঁর সততা, পরিশীলিত আচরণ সবই ছিল মেধা ও সংবেদন লালিত। চিরাচরিত  বাঙালি ভদ্রতার পিছনে আমি অনেক হিংস্র দাঁত নখ দেখেছি। যারা ক্ষমতাবানের পায়ে লোটায়, তারা রিকশাচালক বা পরিচারককে ‘তুই’ বলে অনায়াসে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর শিক্ষা, সহমর্মিতা, আবেগ, পরিশীলন সব নিয়ে একটি অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়েও ক্ষমতা নিয়ে কোনও অহঙ্কার বা মোহ তাঁর মধ্যে দেখিনি।

২০০০ সাল। সত্যজিৎ রায়ের সম্মানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজের সামাজিক সংযোগ প্রতিষ্ঠান রূপকলা কেন্দ্র তৈরি নিয়ে বিলম্বের জন্য উদ্বিগ্ন গৌতম ঘোষ। ইতালি সরকার যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেগুলি অব্যবহারে নষ্ট হচ্ছে। আমাকে বাণিজ্যমন্ত্রক থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারে নিয়ে আসা হবে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, এইরকম কথা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী  নিজেও চান। কিন্তু তিন সরকারের মধ্যে নানা ফাইল চালাচালির পথে বহু বাধা। মুখ্যমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা নিজে আমার আগমন চান না, অথচ এমন জটিল এক কাজ দ্রুত করে ফেলতে পারে এমন কেউ নেই হাতের কাছে। যেদিন দায়িত্বে যোগ দিতে এসে তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম, আমাকে বলেছিলেন, মনের আনন্দে কাজ করুন। আমাদের কাছে আসবেন না, যদি না টাকার দরকার হয়।

অতি অল্প বয়সে মা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আমরা উদ্বাস্তু। এ বাড়ির ভোট যেন ‘কম্যুনিস্ট’রা ছাড়া কেউ না পায়। দাদারা বাম ছাত্ররাজনীতি করত। অসীম দাশগুপ্ত, বিপ্লব দাশগুপ্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারমশাই। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নিয়ে মনে বিরাট আন্দোলন ছিল, বাণিজ্যমন্ত্রকের দায়িত্ব থেকে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করার কাজে নিজের পুরোটা দেব, মনে করেই এসেছিলাম।

কত প্রতিকূলতা ও সচেতন  নিস্পৃহতার সঙ্গে লড়াই করে ১৮ মাসে একটি অস্থায়ী অফিসে বসে কাজ করতে করতে রূপকলা কেন্দ্রর আধুনিক ভবন, স্টুডিও এবং পাঠ্যক্রম তৈরি করেছিলাম, তাতে বহু বিশেষজ্ঞর উদার পরামর্শ ছিল, তার মধ্যে যাচ্ছি না। উদ্বোধনের দিন এসে মুখ্যমন্ত্রী খুশি হয়েছিলেন। পুরো ইন্সটিট্যুট ঘুরে দেখেছিলেন। চলচ্চিত্রে সমাজ সংযোগের মতো একটি বিষয় যা রাজ্যের জন্য কোনও অর্থেই অত্যাবশ্যক নয়, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কত সস্নেহ আগ্রহ ছিল।

একটা দিনের কথা মনে পড়লে আজও অবাক লাগে। অফিসে কাজ করছি। ঘরে একটা ডায়রেক্ট ফোন ছিল, যেটা আমিই ধরতাম। সেটা বেজে উঠল। ওপারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আমি শিহরিত। বললেন, একটা স্টুডিওতে আপনাদের একটা ছবি এডিট হচ্ছে। সুচেতনা (এখন সুচেতন) আমাকে বলল দেখতে। দেখে আমি অভিভূত। আপনি এটা নন্দনে দেখানোর ব্যবস্থা করুন। সিনিয়র অফিসারদের ডাকুন। এর একটা প্রেক্ষাপট ছিল। কয়েক মাস আগে আমলাশোলে অনাহারজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আমলাশোল কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং সীমান্তের অনেকগুলি গ্রাম এই অবস্থার কাছাকাছি, এই নিয়ে গবেষণা করে গৌতম ঘোষ ও আমি একটি ক্যামেরা টিম পাঠিয়ে দিলাম বিহার বাংলা ও জেলা সীমান্তের বেশ কয়েকটি গ্রামে। প্রচুর শুট করে আমাদের টিম তা এডিট করছিল একটি স্টুডিওতে। ভাঙাচোরা পথ, নালার উপর সাঁকো নেই, হাসপাতালে বেডের নিচে ছাগল, উপরে কাঠ ডাঁই করা, অর্ধাহার অনাহারের ছবি— এই সব দেখতে যখন মুখ্যসচিব আর সিনিয়র আধিকারিকদের ডাকা হল, তাঁরা হতবাক। বাংলার গ্রামের এমন হতদরিদ্র অবস্থা তাঁরা কল্পনা করতে পারছেন না। সরকারের যাবতীয় কৃতিত্ব নিয়ে বিজ্ঞাপন করা, আর যাবতীয় ত্রুটির উপর রং বোলানোকে প্রয়োজনীয় মনে করেন না, এমন মুখ্যমন্ত্রী এ জীবনে আর দেখব বলে মনে হয় না।

রূপকলা কেন্দ্র গড়ে তোলার পর্বে অনেকবার মনে হয়েছে তাঁর কাছে যাই, টাকা ছাড়াও তো অনেক দিকনির্দেশ দরকার। গেছিও বেশ কয়েক বার। তিনি নিজেও ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু  স্বস্তি ছিল না। পুরো সময়টাই দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা। খর চোখ রাখতেন আমি যেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পৌঁছতে না পারি। বিভাগের কাছ থেকে পদে পদে বাধা আসত। উদারমনা বিত্তসচিব, পিডব্লুডি-সচিব, পঞ্চায়েতসচিব এঁরা আমাকে সর্বদা রক্ষা করতেন, জানতেন ঘরে আমাকে কী পরিমাণ লড়াই করতে হয়। তখন বাজেট বড় ছিল না, ছাত্রদের ফি কম রাখতে গিয়ে আমাদের টাকা রোজগার করতে হত। প্রোডাকশন উইং ছবি, রেডিও প্রোগ্রাম সব কিছু করত। অন্য বিভাগ নানা কাজ দিয়ে আমাদের হাত মজবুত করত। এর মধ্যে চার বছর কেটে গেছে। রূপকলা কেন্দ্রের পরিসর, তার কাজকর্ম সম্প্রসারিত হয়েছে। ইসরোর উপগ্রহ সংযোগে রূপকলা কেন্দ্র যুক্ত হয়েছে সব কটি পঞ্চায়েতের সঙ্গে। পঞ্চায়েত প্রশিক্ষণে আমরা সংযুক্ত ছিলাম। এবং তা ছিল দক্ষতা ও জ্ঞান বাড়ানোর ট্রেনিং, কোনও সরকারি প্রচারের কাজ  নয়।  আমার নিজের ক্যাডার ওড়িশা থেকে বার বার তাগাদা আসছিল। যাওয়ার ঠিক আগের লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠালেন। ব্রিফ করব, চার বছরে কী কাজ করেছি তার সব কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওঠার সময় যা বললেন, তা শোনার জন্য যে কোনও প্রশাসকের মন পিপাসার্ত হয়ে থাকে। যেতে দিতে চাই না। আচ্ছা, আপনাকে কোনওভাবে ক্লোন করা যায় না? আরও কতজন এমন প্রশাসককে পাব তাহলে!

সিঙ্গুরপর্বে এই মানুষটিকে সমালোচনা করে খোলা চিঠি লিখেছিলাম। আমি তখন বাংলায় নেই। নন্দীগ্রামের ঘটনার পর বাংলা আকাদেমি থেকে পাওয়া পুরস্কার ফিরিয়েছিলাম। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারতাম না। পুরস্কারফলকে মুখ্যমন্ত্রীর সই। বার বার হাতে তুলে দেখতাম। সমালোচনা করেছি কিন্তু অশ্রদ্ধা করিনি এক পলকের জন্যও। তাঁর হাতে রক্ত, সাদা পোশাকে কালি, এইরকম নাটকীয় চিন্তা আমার ছিল না। যথেষ্ট জটিলতা ছিল, ষড়যন্ত্র ছিল ক্ষমতা দখলের, তাঁর পরামর্শদাতারা যাঁরা আজ অনেকেই বর্তমান শাসনের ঘনিষ্ঠ, সেদিন তাঁর পাশে দাঁড়াননি। যে কুটিলতা, নীচতা, মিথ্যাচার সেদিনের রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতন একজন সৎ, আবেগপ্রবণ, মননশীল রাজনীতিকের পক্ষে তার মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। পরাজয়ের দায় ও বেদনা তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন, মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীর ভাঙতে আরম্ভ করেছিল।

আমার জীবনে বাংলা ছাড়ার পরও ঘটনার রেশ রয়ে গেছিল।

ওঁর সরকারি উপদেষ্টার দল আমার স্বাধীন মতামত প্রকাশ করাকে ভাল চোখে দেখেননি। নন্দীগ্রাম পর্বের পর আমার কাজের মূল্যায়ন হল এবং তা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই মূল্যায়নের কাগজে মুখ্যমন্ত্রীর সই ছিল, কিন্তু কোনও সক্রিয় ভূমিকা ছিল না, এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। দিল্লির সিনিয়ররা বললেন, তোমার কি চার বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্ঘাত চলেছিল? এইরকম মূল্যায়ন কী করে হয়? আমি তখন ভাবছি, উনি তো স্নেহ করতেন এত, বলেছিলেন ক্লোন করবেন।

আমার মনে হয় না সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সমালোচনা করে আমি কোনও অন্যায় করেছিলাম। সেদিন চক্রান্ত যাদেরই হোক, প্রশাসনিক ব্যর্থতা শাসকদলের। বুদ্ধদেব মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার  দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু সেই সময়কার ক্লেদ ও সীমাহীন ক্ষমতা লুব্ধতার মোকাবিলা তাঁর পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এড়াতে তিনি চাননি। বরং নিজের উপরেই নিয়েছিলেন সবকিছু। আমি তখন প্রশাসনে। আমার সমালোচনার মধ্যে যারা ঔদ্ধত্য দেখেছিল, তাদের মধ্যে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন না আমি নিশ্চিত। এটা যেমন সত্যি যে বাংলার আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেদিন আমরা কল্পনা করতে পারিনি, এটাও ঠিক, সেদিন যাঁরা আমার প্রভূত নিন্দা করেছিলেন, তাঁরা অনেকেই আজ বর্তমান শাসকদল-ঘনিষ্ঠ।

ক্ষমতার থেকে দূরত্ব বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বিন্দুমাত্র দুর্বল করেনি কারণ ক্ষমতা ও তার নানাবিধ নির্যাসের উপর তাঁর বিন্দুমাত্র নির্ভরশীলতা ছিল না। ছোট ঘরে থাকা, স্বাস্থ্যের কারণে কোথাও যেতে না পারা, এসব তাঁকে কোনওভাবে বিব্রত করেনি। আমাদের চোখ, কথা বলার ক্ষমতা সবকিছু বিনিময় করে আমরা যদি শেষের ক-বছর তাঁকে একটু ভাল রাখতে পারতাম! কুটিল, মতাদর্শহীন, চূড়ান্ত অসৎ রাজনীতির খেলার এই চেহারা আমরাও কিছু কম দেখতাম, তিনিও হয়তো বইয়ে ডুবে থাকতে পারতেন।

একবার সুযোগ পেলে আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বলতে পারতাম, কাজের জীবনে এবং তারপরও আমি মতাদর্শ বদলাইনি। কিন্তু একজনকেই আমি একজন বাঙালি লেখক হিসেবে ওইরকম খোলা চিঠি লিখতে পারতাম, কারণ তাঁর সংবেদনের উপর আমার দাবি ছিল। অধিকার ছিল তাঁকে সমালোচনা করার, কারণ তাঁর কাছেই আমার, আমার মতো অনেকের রাজ্য নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শেখা। এখন হতাশ্বাস জীবনে কেবল একের পর এক লেখা, যার কিছুই ব্যক্তিগত নয়; যা লিখে মনে হয় আমার স্বর কোথাও পৌঁছল না।

দল ও মতের বাইরে বহু মানুষের ভালবাসা নিয়ে তাঁর এই চলে যাওয়া যদি আমরা মনে রাখি; অশ্রু আর আবেগ যদি একদিন রাজনৈতিক সমর্থনের চেহারা নেয়, তাহলে বাংলা নিয়ে স্বপ্ন দেখার মহড়া হয়তো আবার আরম্ভ হতে পারে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4810 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...