প্রসেনজিৎ বসু
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক চরিত্রটিকে রক্ষা করতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গভীরভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন। এমনকী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে অসুস্থ শরীরেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনের ফুটন্ত কড়াই থেকে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ঝাঁপ না দিতে আবেদন করেছিলেন। তবে যে পার্টিকে বুদ্ধদা ২০১১ সাল অবধি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই পার্টির পুনরুজ্জীবন বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতীক্ষিতই রয়ে গেছে। সেই পুনরুত্থানে তিনিই সবচেয়ে তৃপ্ত হতেন
দলমতনির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণে গভীর শোকাচ্ছন্ন। এক দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তার আগে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে চারবারের ক্যাবিনেট মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উজ্জ্বল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আজকের শাসকদের মধ্যে অতি দুর্লভ। সাধারণ মানুষের কাছে উনি ছিলেন সততা, সৌজন্য ও দৃঢ়তার মূর্ত রূপ।
ওঁর প্রজন্মের অনেকেরই কাছের মানুষ ‘বুদ্ধদা’ কমিউনিস্ট আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ১৯৬০-৭০ দশকের ছাত্র-যুব আন্দোলনে শামিল হন। মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই সিপিআই(এম)-এর যুবফ্রন্টের নেতা ও বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট প্রমোদ দাশগুপ্তের শিষ্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ১৯৭৭ সালে প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের তথ্য ও জনসংযোগ বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। বস্তুত, উনি সেই মুষ্টিমেয় নেতাদের একজন যিনি প্রথম বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে ২০১১ সাল অবধি মন্ত্রিত্ব সামলেছেন। মাঝে ১৯৮২ সালে একবার মাত্র স্বল্প ব্যবধানে বিধানসভা নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন।
মন্ত্রী থাকাকালীন এই দীর্ঘ সময়ে বুদ্ধদা সবসময়ই সততা ও শালীনতার জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। এমনকি ১৯৯৩ সালে বাম সরকারের অনৈতিক কার্যকলাপকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রতিবাদে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগও করেছিলেন। পরে জ্যোতি বসু তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আবার ফিরিয়ে আনেন। সেই দুঃসময়-কে নিয়ে লেখা একটি নাটকে বুদ্ধদেব বাম আন্দোলনের দ্বারা সঞ্চারিত মূল্যবোধের অবক্ষয়ের দিকটি ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের সমকালীন কমিউনিস্ট নেতাদের মধ্যে তিনিই সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির জগতের সঙ্গে সর্বাধিক জড়িত ছিলেন। শুধু তাই নয়, ১৯৮০-র দশকের শেষদিকে পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে প্রত্যক্ষ করে মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট নানা গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অনেক প্রশ্নও তুলেছিলেন।
২০০০ সাল থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গোঁড়ামিমুক্ত পথ অবলম্বন করা এবং ব্যক্তিগত স্তরে সত্যনিষ্ঠা ছিল তাঁর সম্বল। পশ্চিমবঙ্গের বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁর বিশেষ প্রয়াস ছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতাকে ঠেকাতে রাজ্যে শিল্পায়নের উদ্যোগ প্রাথমিকভাবে জনসমর্থন পায়, যার ফলস্বরূপ তাঁর নেতৃত্বে ২০০৬-এর নির্বাচনে বামফ্রন্ট বিপুল জয়লাভ করে।
কিন্তু সেখান থেকেই ইতিহাস অন্যদিকে বাঁক নেয়। চিনের মডেলকে অনুসরণ করে শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিষয়টি প্রভূত বিতর্কের জন্ম দেয়। ৩৪ বছরের বাম শাসনের বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের সঙ্গে মিলে সেই জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত আন্দোলন ২০১১ সালে বাম জমানার অবসান ঘটায়। নম্র চিত্তে পরাজয়কে মেনে নিতে কুণ্ঠিত হননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এরপর থেকে ক্রমে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়েও নেন।
বামফ্রন্ট সরকারের ঠিক-ভুল নিয়ে কাটাছেঁড়া আজও চলছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন এবং রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের জন্য উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি নিয়ে বুদ্ধদার স্বপ্নগুলি এখনও প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। এটাও মনে রাখতে হবে, যে তাঁর আমলেই সাচার কমিটির প্রতিবেদন এবং রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশকে কার্যকর করে পশ্চিমবঙ্গে অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) জন্য সংরক্ষণের কোটা বাড়িয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানদের সেই সংরক্ষণের আওতায় আনার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। এই প্রগতিশীল নীতি তৃণমূল সরকারের আমলে আইনে পরিণত হয়েছিল, কিন্তু সম্প্রতি মহামান্য হাইকোর্টের আদেশে তা বাতিল হয়েছে।
বস্তুত, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক চরিত্রটিকে রক্ষা করতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গভীরভাবে দায়বদ্ধ ছিলেন। এমনকী, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে অসুস্থ শরীরেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনের ফুটন্ত কড়াই থেকে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার আগুনে ঝাঁপ না দিতে আবেদন করেছিলেন। বাংলার বহুলাংশের মানুষ ২০১৯-এও সে ভুল করেনি, ২০২১ বা ২০২৪-এও না। তবে যে পার্টিকে বুদ্ধদা ২০১১ সাল অবধি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই পার্টির পুনরুজ্জীবন বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে প্রতীক্ষিতই রয়ে গেছে। সেই পুনরুত্থানে তিনিই সবচেয়ে তৃপ্ত হতেন।
*মতামত ব্যক্তিগত