তিলোত্তমা, ক্ষমা কোরো না

পৌলমী গুহ

 


আমরা যে সমাজের স্বপ্ন দেখি তার জন্য লড়াই নিজেদের করে নিতে হবে— এ-কথাও কি প্রমাণ করল না কালকের রাত? আমাদের মেয়েটি এক বিরাট অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা লড়তে গিয়ে খুন হয়েছেন। কাল গোটা শহর, গোটা রাজ্য তাঁর পাশে ছিল, আপাতত এইটুকু নিশ্চিন্ততা আমাদের হাজার হাজার মেয়েদের স্বপ্ন দেখাবে

 

একটা কথায় ফুলকি উড়ে শুকনো ঘাসে পড়বে কবে
সারা শহর উথালপাতাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে

আমরা এমন এক প্রজন্ম, নকশাল আন্দোলনের গল্প শুনে ট্রাফিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে ফিরেছি। আমাদের কাছে মিছিল মানে হুজুগ। মানে বিরক্তি। রাজনীতি থেকে আমরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে আঙুল টিপে উগরে দিই ক্ষোভ। আমাদের যুদ্ধ করা বা যুদ্ধ দেখাও হবে না। নবারুণের এই লাইন ক-টা সেই যুদ্ধের রোমান্টিসিজমের একটা আবছা ছবিমাত্র। অন্তত এতদিন তো তাইই ছিল।

১৪ আগস্ট, ২০২৪-এর পর তা আর থাকছে না। এই আগস্ট বড়ই বেয়াড়া। পড়শি দেশের বিরাট গণ-অভ্যুত্থানে বাংলা যখন সবেমাত্র টিটকিরি দেবে, নিজেদের আত্মগর্বে গোঁফে তা দিতে দিতে একটু সাম্প্রদায়িক আঁচে নিজেকে সেঁকে নেবে, সব হিসেব উল্টে দিল আরজিকর। এক তরুণীর রহস্যমৃত্যুকে ধামাচাপা দিতে সক্রিয় রাজ্য সরকারকে চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে ১৪ আগস্ট রাতে পশ্চিমবাংলার দিকে দিকে নারীরা নামলেন ‘রাত দখল’ করতে। এই ইতিহাস তৈরি হল, আমাদের চোখের সামনে। এর কথা বারে বারে আসবে।

রাত। নারীদের যাবতীয় অস্তিত্বে কালো আলকাতরার মতো সেঁটে থাকে রাত। রাত তো হিংস্র শ্বাপদের বিচরণভূমি। অরক্ষিত তুমি যেতে পারো না সেখানে। গেলেই হবে সাজা। শরীর খুবলে খেয়েছে? আগে দেখতে হবে কত রাতে, কোন পোশাকে তুমি স্পর্ধা দেখাতে গিয়েছিলে হে রমণী? তাই এই দু-হাজার চব্বিশে দাঁড়িয়েও শাসকদলের মদতপুষ্ট আরজিকরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বলতে পারেন যে উনি কেন অত রাতে একা সেমিনার হলে ঘুমোচ্ছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে সত্যিই তো এ-কথায় যৌক্তিকতা আছে! যে-সমাজে আমরা ছোট থেকে বেড়ে উঠি শুধুমাত্র পুরুষের দয়ার দানে, সেখানে মেধাবিনী হলেও, সমাজের সবচেয়ে সম্মানীয় পেশাটিতে থেকেও, এভাবে বিকৃত লালসার শিকার হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। স্বৈরাচারী শাসক এটুকুও জানে আমরা যতই চিৎকার চেঁচামেচি করি না কেন দিনের শেষে এই স্বাভাবিক ঘটনাকে আমরা মেনে নিতে বাধ্য হব। বা পরিষ্কার করা যাক, লিঙ্গনির্বিশেষে বাধ্য করা হবে। অন্তত এ-যাবৎকাল এমনটাই হয়ে এসেছে। আমরাও এ জানার কারণে বিশেষভাবে দায়ী। তবে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে শাসকের সিংহাসন নড়িয়ে দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

১৪ আগস্টের এই রাতদখল কর্মসূচির ডাক যখন অন্তর্জালে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল তখনও বোঝা যায়নি এর রেশ কত দূর অবধি পৌঁছতে পারে। তবে আশা করা যাচ্ছিল এই ডাকে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেবেন। এবং তরুণী মৃত্যুর বিষয়ে শাসকদলের অবস্থান যত দ্রুত স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল তাতে সাধারণ মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙা ছিল সময়ের অপেক্ষা। ১৪ আগস্ট এক নতুন স্বাধীনতার অংশ হতেই আমি উপস্থিত ছিলাম কলেজস্ট্রিটে। যখন জমায়েতে পৌঁছানোর জন্য বেলঘড়িয়া স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করছি তখন একটু চিন্তিত হয়েই বেরিয়েছিলাম। যদিও কথা ছিল এই রাতদখল অভিযান শুধু মেয়েদের অধিকার বুঝে নেওয়ার জন্য ও এই হত্যার সুষ্ঠু বিচারপ্রক্রিয়ার আবেদন করার জন্য এবং এতে পুরুষদের সামনে না এগোনোর অনুরোধ বা বলা ভাল পুরুষদের চিরাচরিত বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকায় নামতে না দেওয়ার জন্য— তবুও ভবি ভুলল না। পুরুষরা অনেক জায়গাতেই নাকি নিজেরা ঠেলেঠুলে ‘রক্ষক’ সেজে বহু কীর্তি স্থাপন করেছেন, সে-কথা এখানে নয় নাইই বা বললাম। এই ঐতিহাসিক প্রতিবাদে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ এবং প্রবীণ নাগরিকদের উপস্থিতিও ছিল আশাব্যঞ্জক। শাসকের রক্তচক্ষু, পুলিশি গুন্ডামি, শাসকদলের কর্মীদের হুমকি ও সন্ত্রাসের সামনেও নতিস্বীকার না করে মানুষ কোনও নির্দিষ্ট পতাকা ছাড়াই এভাবে রাস্তায় নেমেছিলেন— এ দৃশ্য এ জীবনে বারবার দেখার সৌভাগ্য আসবে না।

 

মিছিলের একটি অংশ আরজিকর-এর অভিমুখে এগিয়ে যেতেই প্রথম বাধা আসে। টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ এবং আরজিকর-এ প্রমাণ লোপাটের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় দুষ্কৃতিদের হামলা শুরু হয়ে যায়। এদিকে চিড়িয়ামোড় থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় তখন হাজার হাজার মানুষ রয়েছেন। একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে নিরীহ নাগরিকদের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জের ইতিহাস এই জনদরদি ‘মানুষের সরকার’-এর ইতিহাসে লেখা থাকবে। দ্বিতীয় মিছিলটি শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে পৌঁছোয় যখন তখনও পুলিশের গাড়ি মিছিলের মাঝে আনা হয়েছিল। তবে মানুষের সংখ্যা ও প্রবল প্রতিরোধের আশঙ্কাতেই তখন আর পুলিশের তরফে কিছু করা হয়নি। ততক্ষণে গোটা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে আরজিকর ও এনআরএস-এ ইচ্ছাকৃত হামলার খবর। কথামতো অনেকেই থেকে গেছিলেন অবস্থান বিক্ষোভে। নারীরা ছিলেন পুরোভাগে। তিলোত্তমা কাল আক্ষরিক অর্থেই নারীদের শহর হয়ে উঠেছিল রাতে। এবং কোনওভাবেই লিঙ্গের রাজনীতির ক্ষমতা হবে না এই ইতিহাসকে অস্বীকার করার।

বিতর্ক উঠেছে। উঠেছে সঙ্গত প্রশ্ন। এ লড়াই কি আদৌ এক আলাদা ইতিহাস তৈরি করল নাকি স্রেফ হুজুগ? সাধারণ মানুষের এ যোগদানে আদৌ কি বিচার পাবেন মৃত চিকিৎসক? যে নারকীয় ঘটনায় গোটা রাজ্য ফুঁসে উঠল সে কি এখানে শেষ করা সম্ভব? এসবের উত্তর দেবে সময়। আমরা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বহু ছেঁদো কথা নিয়ে ভাবব, এইই আমাদের ধর্ম। কিন্তু বিরাট অংশকে বাদ রেখে সমাজবদলের স্বপ্ন দেখা যে চলে না, সে-কথাই আরেকবার হয়তো আমরা বুঝে নিতে রাস্তায় নেমেছি।

আমরা যে সমাজের স্বপ্ন দেখি তার জন্য লড়াই নিজেদের করে নিতে হবে— এ-কথাও কি প্রমাণ করল না কালকের রাত? তিলোত্তমা এক বিরাট অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা লড়তে গিয়ে খুন হয়েছেন। কাল গোটা শহর, গোটা রাজ্য তাঁর পাশে ছিল, আপাতত এইটুকু নিশ্চিন্ততা হাজার হাজার তিলোত্তমাকে স্বপ্ন দেখাবে। এইটুকুই নয় থাক।

 


*মতামত ব্যক্তিগত। ভেতরের ছবি লেখকের তোলা

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4813 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...