তানিয়া চক্রবর্তী
ভবিষ্যতে কী হবে জানি না তবে এই ঘটনা মানুষ ভুলবে না, কোনওদিনও ভুলবে না! আমাদের মাথার ওপরের ছাতা ছাপিয়ে পড়া বৃষ্টির বিন্দুরাও বুঝে গেছিল এই মেয়েরা ছাড়বে না আজ পথ। তরুণ কবি অদিতি রাতের আন্দোলনে সামিল হতে ছোট্ট মেয়েকে বললেন আজ তুমি একাই থেকো বাবুই। বাবুই তার মাকে ছাড়বে না, তার মা তাকে বলেন যাতে প্রতিটা রাত তোমার হয় তাই আজ আমায় যেতেই হবে বাবুই। এই ছোট্ট একটি লাইন সময়কে নিরাপত্তার মুখে টেনে দাঁড় করায়। বন্যা কর বললেন লিঙ্গ নয় “মুখ্য বিষয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা”। বন্যা, কস্তুরী, অবন্তিকা, ঐত্রেয়ী, আত্রেয়ী, ঋজা, শতাব্দী, অলোকপর্ণার মতো অজস্র অজস্র বয়স ও আওয়াজ যারা কাল জলে ভিজে কলমের ওপরে আওয়াজ রেখে বৃষ্টিতে ভিজে বিচার চাই বলেছে সেই আমাদের আগামী দৃঢ় হোক, মজবুত হোক। রাত মানেই দুশ্চিন্তা যেন না হয়, রাত মানেই বাবা-মার আশঙ্কা যেন না বাড়ে এই ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হোক
নিজেদের কথা নিজেরা লিখছি, নিজেদের কথা নিজেরাই বলব, বেশ করব।
গতকাল সমস্ত শক্তি পথে নেমেছিল, রাজপথ সাক্ষী রইল শক্তির গর্জনের। ১৪ আগস্টের শুরু ১৫ আগস্টের গা জাপটে ধরল। মেয়েদের সবটুকু অর্জনে কেবলই লড়াইয়ের গল্প, ইতিহাস তাই বলে। লিপস্টিকের রংটুকুও কেড়ে নিতে চেয়েছিল হিটলার, সেই লিপস্টিকটুকুও মেয়েরা লড়াই করে জিতেছে। প্রতিটা সম্মান শুধু লড়াই করে পেয়েছে মেয়েরা। আজ সেই লাল রং ঠোঁট থেকে নেমে এসেছে দেহে। রক্তাক্ত চোখের মেয়ে তোমার শেষ শ্বাসটুকু অবধি আমাদেরই লজ্জা আর কান্না বন্ধক পড়ে আছে। গতকাল সেই লড়াইয়ের সাক্ষী রইল গ্রাম, মফস্বল, শহরের রাজপথ, শিশু থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিমঝিম সিনহার বারবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ডাক এবার সারা বাংলার ডাক হয়ে গেল। গলায় গলা মিলে গেল সকলের, সত্যিই তো লড়াইটুকুই তো জোর— জেতা হারা তো অনেক পরে। কিন্তু লড়াইয়ে সামিল হওয়াই তো বিস্ফোরণ। গণতন্ত্র যদি না কথা বলে, না পথে নামে, তা কী গণতন্ত্র থাকে? হ্যাঁ অনেকে বলেছেন অরাজনৈতিক এই ডাক, শুধু অন্যায়ের বিরুদ্ধে ডাক। ভুল তো কিছু নেই বার্তায়। আমার গা থেকে রক্ত পড়ছে কিছু হামলায়, আমার দুপাশে দুটি দলের হাসপাতাল— এই দুটি দলের হাসপাতাল আমার প্রত্যক্ষ বিষয় নয়, পাকেচক্রে তা হতে পারে, কিন্তু মুখ্য বিষয় হল আমার গা থেকে বেরোনো রক্ত ও যন্ত্রণা, আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া অন্যায় ও তার নিবারণ— যখন মানুষ সঠিক বিচারের জন্য বিস্ফারিত হয়ে ওঠে তখন তাঁর একমাত্র অস্থিরতা সুবিচার— কে কী দল করে তাতে তার কিছু এসে যায় না, এটুকু বুঝতে হবে। যেখানে ন্যায় নেই সেটাই অন্যায়; অন্যায়কারী তা সে যে কেউ হোক— সে নিপাত যাক। গতকাল দেখেছি একটি ঝড়ের ঝাপটায় অজস্র বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে কান্না, আওয়াজ— নিরাপত্তার এই আলো না জ্বললে এই শক্তি যে দিগ্বিদিক আলোড়িত করতে পারে গতকালের রাত তার জ্যান্ত সাক্ষী রইল। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না তবে এই ঘটনা মানুষ ভুলবে না, কোনওদিনও ভুলবে না! আমাদের মাথার ওপরের ছাতা ছাপিয়ে পড়া বৃষ্টির বিন্দুরাও বুঝে গেছিল এই মেয়েরা ছাড়বে না আজ পথ। তরুণ কবি অদিতি রাতের আন্দোলনে সামিল হতে ছোট্ট মেয়েকে বললেন আজ তুমি একাই থেকো বাবুই। বাবুই তার মাকে ছাড়বে না, তার মা তাকে বলেন যাতে প্রতিটা রাত তোমার হয় তাই আজ আমায় যেতেই হবে বাবুই। এই ছোট্ট একটি লাইন সময়কে নিরাপত্তার মুখে টেনে দাঁড় করায়। বন্যা কর বললেন লিঙ্গ নয় “মুখ্য বিষয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা”। বন্যা, কস্তুরী, অবন্তিকা, ঐত্রেয়ী, আত্রেয়ী, ঋজা, শতাব্দী, অলোকপর্ণার মতো অজস্র অজস্র বয়স ও আওয়াজ যারা কাল জলে ভিজে কলমের ওপরে আওয়াজ রেখে বৃষ্টিতে ভিজে বিচার চাই বলেছে সেই আমাদের আগামী দৃঢ় হোক, মজবুত হোক। হ্যাঁ রাত মানেই দুশ্চিন্তা যেন না হয়, রাত মানেই বাবা-মার আশঙ্কা যেন না বাড়ে এই ব্যবস্থা সুনিশ্চিত হোক। আমরা তাকিয়ে ছিলাম আরজিকরের দিকে— এই তুমুল অন্যায় আমাদের ভেতর খেয়ে নিয়েছে রাগে, কষ্টে। যেটুকু সময় বিদেশে থেকেছি দেখেছি মেয়েরা একা হচ্ছে, পিঠে বাচ্চা নিয়ে একা মা ঘর্মাক্ত হয়ে তার শখের পাহাড় দেখছে কারণ সম্মানের স্বাধীনতা। এই বছর শাড়ি নামে একটি সঙ্কলন সম্পাদনা করেছিলাম কারণ মেয়েদের পোশাক নিয়ে কথা উঠেছিল, পোশাকই নাকি অনেক কিছুর জন্য দায়ী! আজ ভাবি, এই ঘটনায় পোশাক দায়ী বলতে পারবেন তো তারা? সম্মান ও নিরাপত্তার স্বাধীনতা মেয়েরা নিয়ে ছাড়বে এটাই আগামী। আগামী যাতে বিপন্ন না হয় সমঝে চলুন পুরুষ, সমঝে চলুন মানুষ।
আমাদের নিরাপত্তা যে কতখানি ভঙ্গুর তা ভাবলে চমকে যেতে হয়। যখন আরজিকরের ঘটনায় সকলে বিপন্ন ও সরব হয়ে বিচারের আশায় বসে আছি তখনও চারিদিকে অভব্য ও অন্যায় আচরণ ক্রমাগত হয়েই চলেছে। সেগুলি আমি তুলে দিচ্ছি এখানে কারণ যখন চারিদিক থমথমে হয়ে যাওয়ার কথা, যখন চারিদিক অপরাধবোধে তলিয়ে যাওয়ার কথা, সেই সময়েও এদিকে-ওদিকে নির্যাতন হয়েই চলেছে। গত কয়েকদিনে যখন আরজিকরের মেয়েটির ঘটনায় আমরা ক্লিষ্ট ও ভয়ার্ত হয়ে উঠেছি তখনও একের পর এক অশ্লীল আচরণের খবর পেয়েই যাচ্ছি— এই আমাদের নিরাপত্তা, এই আমাদের সময়! তবু আশার আলো ১৪ আগস্টের “আমাদের রাত”…
২০১৫ সালে ৭১ বছরের সন্ন্যাসিনী ধর্ষিতা হন, সেই সময়ে একদিন সংবাদপত্রে এই কবিতাগুচ্ছটি লিখেছিলাম। আজও তা প্রাসঙ্গিক রয়ে গেল, তাই এখানে রাখলাম।
আত্মপ্রবঞ্চক শরীর
১.
বাইরে থেকে যা শরীরের ভেতরে ঢোকে
তা শরীরকে অপবিত্র করে না
শরীর থেকে যা বাইরে যায় তা—
যীশু বলেছিলেন
হ্যাঁ এখানে মেয়েরা বিছানা জড়িয়ে
ভিন্ন মর্মে কেঁদে উঠলে
সবাই বলে ন্যাকামো!
এখানে মেয়েদের বেশ্যা বানিয়েছে যারা
সে সমাজ আগন্তুকের মতো নামকরণে
মুক্তির দরজা চেপে বসে আছে!
এখানে যোনিমুখের পাহারাদার
পৃথিবীকে মা বলে ডাকে না কখনও
শুধু বলে বেশ্যা, বেশ্যা, বেশ্যা—
দুধে, গঙ্গাজলে ত্বকীয় সংস্কার হয়
এখানে কাপড়ের তলা থেকে স্তন দেখা গেলে
ছানাবড়া চোখ বিসদৃশ বেশি বড় হয়
এ পৃথিবী সক্রেটিসের কখনও হবে না
একক সদগুণ বলে এখানে কিছু নেই—
ছ-মাস থেকে সত্তরে হবে গণধর্ষণ
পুরুষও লিখবে দ্রোহের কবিতা
পুরুষও করবে ধর্ষণ
আমরা পেয়ালা-পিরিচ নিয়ে
ধর্ষণ বিস্কুট খাব রোজ সকালে
২.
হ্যাঁ, আমি রোজ ঈশ্বরীয় কিছুকে
আবেদন করে বলি ধর্ষণ বন্ধ করো!
মানুষ যে অনবদ্য মিথ্যে বলে বাঁচার তাগিদে
সে তাগিদ লুপ্ত করো
জন্মছিদ্রকে গলে পচে মরার আগে
কিছু ধরন বদলে দাও—
৩.
পিঠোপিঠি আমরা বসব
তা-ধিন, ধিন-তা নাচব
তোমাকে দেখলেই গা ঘিনঘিন করবে
তুমি মানুষ বলে, মানুষ সর্বভুক বলে
আমরা আধুনিক হতে গিয়ে বিকৃত হয়ে গেছি
মনে এত পক্ষাঘাত
নিবারণের আগে বিস্ফোরণ প্রয়োজন
৪.
ভাবো, তুমি পুরুষ
তোমার হাত নারীর মুখ থেকে
এক নিমেষে চলে গেছে যোনিতে
তুমি ভাবছ,
এখানে গমনপদ্ধতি
এখানে বীর্য-সেচ
এখানে খাদকতৃপ্তি
এখানে আধিপত্য
এখানে উন্মত্ত বিনাশ
এবারে ভাবো,
এখানে পৃথিবী ফুলেল প্রহেলিকা
এখানে জন্মরা জন্মের দান
এখানে এসেছ বলে তোমাকে ইতর বলে না কেউ
এখানে এসেছ বলে তুমিও এক সৃষ্টিকর্তা
এভাবে যদি ভাবো, ভাঙন যদি বা আসে
প্রেমিকার ডাকনাম মা হয়
কখনও বেশ্যা নয়
৫.
যদি ধরি, সতীত্ব বলে কিছু থাকে
তবে তা ভয়ঙ্কর অমূলক
মূলকেই আবদ্ধ তো নয় গঠন!
প্রতি মাসে ডিম্বাণু রক্তবিছানা বাঁধে
ধারা চলে অবিরত নিয়ামক নির্গমনে
প্রতি শরীরে অজস্র রজঃস্রাব
তবে নিয়ত পবিত্র করে দেহ,
মুক্তির কাকলি গাছে গাছে ঘোরে
নারী কখনও সতীত্ব হারায় না
যদি প্রশ্ন তোলো তবে,
প্রতি মাসে নারী আজন্ম কুমারী হয়—
*মতামত ব্যক্তিগত
বাস্তব। সুন্দর। খুব সুন্দর