রাতের রূপকথা

মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

 


বিশাল গণজোয়ারে সাত রঙের মানুষ আসবেন, সকলের দাবি এক নয়, অধিকারও সমান নয়। তাই তাঁদের নিয়ে চলতে গেলে নেতৃত্বকে, সংগঠকদের হতে হবে যুক্তিনিষ্ঠ, রাজনীতিসচেতন এবং অবশ্যই উদারমনষ্ক। শুধু কেতাবি কথা নয়, কখনও কখনও সাধারণ মানুষ বলে যাঁদের দেগে দিচ্ছি তাঁদের থেকেও জরুরিভিত্তিতে শিক্ষা নিতে হয়। অবশ্য কালকে কলকাতা ও রাজ্যের অন্য শহরগুলো প্রমাণ করল শহুরে বিদ্বজ্জন বিনাও মানুষ রাস্তায় নামতে পারেন, চলতে পারেন। তাঁদের আর বিদ্বজ্জন নামের যষ্টির প্রয়োজন নেই। এ কী কম পাওনা!

 

আশ্চর্য এক রাত

কাল রাতে রাস্তায় ছিলাম। রাস্তায় ছিলাম বটে, তবে একসময়ে আর এগোতেও পারিনি, পিছোতেও পারিনি।

পাড়ায় পাড়ায় যে ব্রিগেডের জনসমাবেশ।

প্রবল জনস্রোত— জনকল্লোলে সমুদ্রের উচ্ছ্বাস। শহর কলকাতার রাস্তায় চলেছেন মধ্যবিত্ত মা, মেয়ে, বৌ, বন্ধু— সঙ্গে আছেন প্রিয়জন। নারীর পাশে পুরুষও থাকেন। লড়াই চলবে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে— ব্যক্তিপুরুষের বিরুদ্ধে নয়।

আমাদের প্রকৃতি ভিন্ন, তবু আমরা সমান। ধন্যবাদ সেই সব মানুষকে, যারা আমাদের হাত ধরেছেন।

রাতের দখল আমরাও নেব।

 

তিলোত্তমা… মা আমার

৮ আগস্ট সরকারি হাসপাতালে ডিউটিরত অবস্থায় তিলোত্তমা ডাক্তার কন্যা আমাদের নির্মমভাবে ধর্ষিত হয়ে খুন হয়ে গেলেন। এরকম ঘটনা কেউ আগে জানেননি, শোনেননি, হয়তো কল্পনাও করেনি। তাই লন্ডনের পত্রিকা ‘গার্ডিয়ান’ ও ‘বিবিসি’ দিনের পর দিন তা নিয়ে বিরাট করে খবর করে। তাই প্রদেশ ও দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের শহরেও আছড়ে পড়েছে এই সংহতি, পারস্পরিক নির্ভরতা, আন্দোলনের ঝাপটা।

তিলোত্তমার বাবা জানিয়েছেন, তাঁকে পরদিন সাড়ে দশটা নাগাদ হসপিটালের আধিকারিক ফোন করে জানান মেয়ে তাঁর আত্মহত্যা করেছেন। তিন-তিন ঘন্টা হাসপাতালে বসিয়ে রেখে দেওয়া হয় তাঁদের। তারপরে মা-বাবাকে মেয়ের ক্ষতবিক্ষত, অর্ধনগ্ন দেহ দেখতে দেওয়া হল। মুখ, চোখ, যোনিদ্বার ছিন্নভিন্ন— অটোপ্সি রিপোর্ট বলেছে “genital torture”। তারপরেও হাসপাতাল থেকে বাবাকে জানানো হয়েছিল তাঁদের কন্যা আত্মহত্যা করেছেন। তারপরেও হাসপাতালের অধ্যক্ষ বলেছেন, রাতে (নারী) ডাক্তার একা থাকে কেন? কেন, কেন?

পুলিশ শোকাকুল বাবাকে টাকা দিতে চেয়েছিল। পুলিশ কমিশনার কিছুতেই সংবাদমাধ্যমের বারেবারে প্রশ্ন সত্ত্বেও অভিযুক্তের পেশা জানালেন না। মানুষ তাই পুলিশে ভরসা হারায়। সেই অভিশপ্ত সেমিনার রুমের উল্টোদিকের ঘরগুলো জরুরিভিত্তিতে ভাঙা হল। অজস্র বেনিয়মের ‘খ্যাতি’তে কণ্টকিত অধ্যক্ষ সকালে পদত্যাগ করে দুপুর না গড়াতেই সরকারি চাকরির এই দুর্দিনের বাজারে আরও বড় হাসপাতালে নতুন করে চাকরি পেলেন।

আমাদের মনে আছে কামদুনির ঘটনার ফাস্ট ট্র্যাক বিচার করবেন রাজ্যের প্রধানা আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেই ঘটনার অধিকাংশ অপরাধী এখন কামদুনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কেন?

এতগুলো কেনর উত্তর পেতে, বিচার চাইতে পাড়ায় পাড়ায়, শহরে গ্রামে মানুষ পথে নেমেছেন।

অনেকেই ছিলেন, যাঁরা কোনওদিন ভাবেনওনি যে, রাস্তায় হাঁটবেন; তবুও হেঁটেছেন— সেই ডাক্তারকন্যার জন্য, নিজের জন্য এবং স্বজনের জন্যও বটে। সকলে বিচার চেয়ে উদ্বেগে আকুল হয়ে হেঁটেছেন।

আশ্চর্য রাত— বাতাসে বারুদের গন্ধ। তাতে লেগেছে আগুনের ফুলকি। তবে তা তারাবাতির মতো দুরন্ত উচ্ছ্বাসে নিঃশেষিত হবে নাকি ছড়িয়ে পড়বে শহরে, গ্রামে, গঞ্জে তা বলবে ভবিষ্যৎ।

সামনে মুক্তি, না এখানেই ছেদ? ফস্ করে জ্বলে ওঠা, না
দপ্ করে নিভে যাওয়া?
আগুনের চুম্বন, না হাওয়ার ফুত্কার?

এখানেই কি শেষ? আগামীকাল আমরা নিরাপদ তো? আমার বাড়ির মেয়ে, বোন, সহকারিনী— নিরাপদ তো?

আর আমি, রাতে রাস্তায়, কর্মক্ষেত্রে— নিরাপদ তো?

 

আন্দোলনের নেতৃত্ব 

কাল যাঁরা পথে হেঁটেছেন তাঁদের অনেকেই হয়তো কোনও নির্দিষ্ট দলের সমর্থক নন। দলহীন তবে তাঁদের রাজনীতিবোধহীন বলা যায় না।

এই সময়কে যদি ক্রান্তিকালীন করতে হয়, তবে উদারমনস্কদের হাতে আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকতে হবে।

কে শঙ্খধ্বনি তুলবেন, কে বাঁশি বাজাবেন বা কে শিস দেবেন তাকে শাসন করার সময় এই নয়। শঙ্খধ্বনি এই অঞ্চলের সংস্কৃতিরও অংশ। কাল পথে নেমেছেন ভীত, ক্রুদ্ধ মানুষ। গ্রামেগঞ্জেও নারীবাহিনি রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন।

এঁরা সকলেই হুইসল ব্লোয়ার।

যাঁরা নামেননি, তাঁরা হয়তো পরেরবার নামবেন। অথবা নামবেন না। কে নামলেন না, সেই হিসেব করে কী হবে?

সেন ইত্যাদিদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। তাঁরা তাদের মতো সলিডারিটি জানিয়েছেন, অথবা জানাননি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি আমার ভাল না লাগতেই পারে। আগের জমানাতেও এমন অনেক বিদ্বজ্জন, কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা ছিলেন যাঁদের ভূমিকা বহু মানুষের পছন্দ হয়নি। সকলকে সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তিক্ততা সরিয়ে রেখে আন্দোলনে যোগ দিতে হবে, আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে।

বিশাল গণজোয়ারে সাত রঙের মানুষ আসবেন, সকলের দাবি এক নয়, অধিকারও সমান নয়। তাই তাঁদের নিয়ে চলতে গেলে নেতৃত্বকে, সংগঠকদের হতে হবে যুক্তিনিষ্ঠ, রাজনীতিসচেতন এবং অবশ্যই উদারমনষ্ক। শুধু কেতাবি কথা নয়, কখনও কখনও সাধারণ মানুষ বলে যাঁদের দেগে দিচ্ছি তাঁদের থেকেও জরুরিভিত্তিতে শিক্ষা নিতে হয়।

অবশ্য কালকে কলকাতা ও রাজ্যের অন্য শহরগুলো প্রমাণ করল শহুরে বিদ্বজ্জন বিনাও মানুষ রাস্তায় নামতে পারেন, চলতে পারেন। তাঁদের আর বিদ্বজ্জন নামের যষ্টির প্রয়োজন নেই।

মানসিকতার কত বড় উত্তরণ!

এ কী কম পাওনা!

 

অতঃকিম

সূচনার উত্তাল রাত শেষ হল। তবে এই রাতই প্রতিবাদের শেষ রাত নয়। এ সবে শুরু। কাজ পরে রয়েছে প্রচুর।

আমাদের দাবিগুলোকে সূচিবদ্ধ করতে হবে। আমাদের আশু দাবি তিলোত্তমার ভয়াবহ হত্যার সঠিক বিচার। আমাদের দাবি রাতের শহরে নারীর পথে চলবার অধিকার সুনিশ্চিত করা। দুর্নীতি ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বলতে হবে। আশু দাবি আদায়ের পথরেখা তৈরি করতে হবে। সকলকে নিয়ে সেই দাবি আদায়ের লড়াই করতে হবে। সেই দাবি আদায় করতে গিয়ে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনা যেন তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

তারপর?

কে জানে কোথায় শেষ হবে এই আন্দোলন?

কত সহজে আমাদের মুখ বন্ধ করা চলে, তা তো জানি— শুধু ধমকে দিলেই হয়তো একেবারে দমে যাব!

যাব কি?


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...