জয়ন্ত ভট্টাচার্য
১৪ আগস্ট মধ্যরাতে নারীরা কোনওরকম রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া যেভাবে রাজপথ অধিকার করার আন্দোলনে হাজারে হাজারে সামিল হলেন, এ ঘটনা অভূতপূর্ব এবং ঐতিহাসিক। হারিয়ে যাওয়া একটি পরিসর উন্মোচিত হল ঐতিহাসিকভাবে— রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে অতিক্রম করে “তৃতীয় পরিসর”। এ সম্ভাবনাকে পরম যত্নে, মমতায়, পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের। একে যেন আমরা ধ্বস্ত না করি
চেতাবনি ছিল ঠিক, তুমি-আমি লক্ষ্যই করিনি
কার ছিল কতখানি দায়
আমরা সময় বুঝে ঝোপে ঝোপে সরে গেছি শৃগালের মতো
আত্মপতনের বীজ লক্ষ্যই করিনি…
লোকে ভুলে যতে চায়, সহজেই ভোলে।—“আরুণি উদ্দালক”, শঙ্খ ঘোষ
৯ আগস্ট সকালের আলো ফোটার অপেক্ষায়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে জীবন একইরকম হয় না। ৩১ বছর বয়সি এক ডাক্তারি পড়ুয়া তরুণীরও হয়নি। ও সারাদিনের ডিউটির শেষে রাতের খাবার খেয়ে চেস্ট ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমে বিশ্রামের জন্য একাই শুয়েছিল। সম্ভবত ৩ থেকে ৪ জন পশু (৫ জনও হতে পারে, এমনকি যে দলে আরেকজন নারী চিকিৎসকও থাকতে পারে) ওকে গণধর্ষণ করে তারপরে বর্ণনাতীত হিংস্রতায় হত্যা করে। যেরকম নৃশংসভাবে ২য় বর্ষের পোস্টগ্র্যাজুয়েট এই তরুণীকে হাসপাতালের মধ্যে শেষ রাতে গণধর্ষণ করে চরমতম বীভৎসতার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে সে ঘটনা সম্ভবত এক অর্থে “নির্ভয়া” বা “হাথরাস”-এর ঘটনাকেও ছাপিয়ে গেছে। কলকাতা শহরের বুকে একটি প্রথম সারির হাসপাতালের মধ্যে এ-ঘটনা যে ঘটতে পারে, সম্ভবত ভারতের ইতিহাসেও বিরল— অন্তত আমার জানা নেই। কারণ? মোটিভ কী? ও কি কলেজের এমন কিছু নারকীয় কার্যকলাপ জেনে ফেলেছিল যে জন্য এই পরিণতি?
অনুসন্ধান চলছে। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে ডিভিশন বেঞ্চ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পরে তদন্তভার সিবিআই-এর হাতে দিয়েছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে— কলকাতা পুলিশের তরফে তদন্ত চলাকালীন— কী কী প্রমাণ মুছে গেছে তার হদিশ পাওয়া মুশকিল। তবে আজ (১৬.০৮.২০২৪) ঘটনার দিন আরজিকর-এর যিনি প্রিন্সিপাল ছিলেন সেই সন্দীপ ঘোষকে (যেসব মারাত্মক, ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের অন্যতম চক্রী হিসেবে জড়িত এই ব্যক্তির নামের আগে ডঃ শব্দটি ইচ্ছে করেই লিখলাম না, পাছে স্বয়ং হিপোক্রেটিস বমি করে ফেলেন!) সল্টলেকের রাস্তা থেকে সিবিআই-এর তদন্তকারী অফিসারেরা ঘাড় ধরে তাঁদের ফেফাজতে নিয়ে গেছেন।
বড় পাপী হে আমরা!
নিহত মেয়েটি হয়তো আমাদের বলছে— “বড় পাপী হে আমরা!” বিভিন্ন সূত্র থেকে যতটুকু জানা যাচ্ছে, হাসপাতালের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মৌরসিপাট্টা গেড়ে বসা ওষুধ-মাদক-সেক্স র্যাকেট-পয়সার বিনিময়ে পাশ করানো বা ইন্টার্নশিপ শেষের সার্টিফিকেট দেওয়ার যে মধুচক্র গড়ে উঠেছিল (যাতে আশঙ্কা করা যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্রছাত্রীদের একটি অতি ক্ষুদ্রাংশ যুক্ত ছিল) এই তরুণী চিকিৎসক সেটা জানতে পারে এবং হয়তো-বা প্রতিবাদও করেছিল। এর পুরস্কার হিসেবে সে পেয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত নিজের গাড়ি, গণধর্ষণ এবং মানুষের জীবনের সর্বাধিক-কাঙ্খিত বেঁচে থাকার অধিকার হারানো।
নির্ভয়া, কাশ্মিরের বাচ্চা মেয়ে আসিফা, হাথরাস, তারও আগে ২০০৪ সালে মণিপুরের মনোরমা— ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে খুন হওয়ার মিছিল চলছে। এখন অব্দি সর্বশেষ সংযোজন আরজিকরের ডাক্তার মেয়েটি। আমাদের বিবশ হয়ে যাওয়া সামাজিক বোধকে এই মৃতদের অনুক্ত প্রশ্ন কি একবারও বিদ্ধ করছে না—
কেন নারী হওয়ার জন্য আমাকে অতিরিক্ত সুরক্ষা দিতে হবে? কিসের সুরক্ষা? আমার দেহের এবং জীবনের সুরক্ষা?
কেন এই “পবিত্র” পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত সমাজ আমার সুরক্ষা সুরক্ষিত করতে ব্যর্থ হবে বারংবার?
উত্তর দিতে হবে, কেন আমাদের বেলাতেই কেবল সুরক্ষার প্রসঙ্গ আসবে?
কেন আমাদের সামাজিক মানসিকতা আমাকে নিজের চারিত্র্যলক্ষ্মণ নিয়ে বাঁচা একজন “মানুষ” হিসেবে গ্রহণ করবে না? কেন?
আর কত ধর্ষণ, হত্যা, রক্তাক্ত শরীর আর ছিন্নভিন্ন দেহ দেখতে চায় “সমাজ”? ঠিক কতটা দেখলে তৃপ্তি হবে সমাজের চোখের, মনের, ধর্ষকামিতার?
আপনারা “ফাঁসি” কিংবা “এনকাউন্টার” কিংবা “রাজনৈতিক যোগ” নিয়ে কথা বলুন, বলতে থাকুন। কিন্তু এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন না? এই “ইতরের দেশ” কি সভ্য হবে? উত্তর কি কেবল বাতাসেই ভেসে বেড়াবে?
আমরা যে বুকভরে বাতাসও নিতে পারি না মরে যাওয়ার সময়ে? আমাদের কথা ৩৬৫ দিনে একবার ভাবুন— কারও ফুটফুটে মেয়ে, সক্ষম যুবতী কিংবা গৃহবধূ, কামদুনির পড়ুয়া মেয়েটি কিংবা পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের যুবতী।
অন্য কারও পরিচয়ে আমাদের চিনবেন না। আমাদের পরিচয়ে আমাদের চিনতে হবে। চিনতেই হবে।
পরের ঘটনাপ্রবাহ
ঘটনা এখানে শেষ হয়নি। এর প্রতিবাদে “ইতরের দেশে” বাস করা আরজিকর-এর জুনিয়র ডাক্তারেরা পবিত্র ক্রোধ থেকে তীব্র আন্দোলন শুরু করে পরদিন সকাল থেকেই। এতে যুক্ত হয়েছে ডাক্তারদের সংগঠন ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম, ডাক্তারদের জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম, কলকাতা শহরের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলার মেডিক্যাল কলেজ, ভারতের নামী ডাক্তারি প্রতিষ্ঠানগুলো— দিল্লির এইমস, চণ্ডীগড়ের পিজিআই, বিএইচইউ, তামিলনাড়ুর একাধিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, গুজরাত রাজস্থান মহারাষ্ট্র দিল্লি পাটনা-সহ ভারতের প্রায় সব প্রান্তের ডাক্তারদের সংগঠন। এমনকি সর্বভারতীয় সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনও অংশগ্রহণ করেছে।
এ তো গেল আন্দোলনের ব্যাপ্তি ও তীব্রতার এক দিক। অন্যদিকে রয়েছে আইনি অংশ যেখানে কলকাতা হাইকোর্টের নজরদারিতে তদন্ত চলার নির্দেশে মৃত্যুরহস্য সমাধানের দায়িত্বভার চলে গেছে কলকাতা পুলিশ থেকে সিবিআই-এর হাতে। এসব কথা এখন সবাই জানে— এমনকি গার্ডিয়ান বা বিবিসি-র মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও এ-সমস্ত খবর প্রকাশ করেছে। ফলে আমি নতুন কথা এখনও অব্দি কিছু বলিনি— শুধু ইতিহাসকে আরেকবার স্মরণ করানো ছাড়া। তবে গতকালের (১৫.০৮.২০২৪) নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতো প্রভাবশালী সংবাদপত্রের খবরটি নজরে আসার মতো— “Medic’s Killing Fuels Protests and Walkouts in India”। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—
Outrage among doctors has also continued to build, with many government hospitals suspending all but emergency treatment as medical workers protest to demand better protection from such violence.
হ্যাঁ, এটাই ঘটছে।
নেকড়ে-ওজর মৃত্যু এল
মৃত্যুরই গান গা—
মায়ের চোখে বাপের চোখে দু-তিনটে গঙ্গা।
দূর্বাতে তার রক্ত লেগে
সহস্র সঙ্গী
জাগে ধক্ ধক্, যজ্ঞে ঢালে
সহস্র মণ ঘি…
নিভন্ত এই চুল্লিতে বোন আগুন ফলেছে!—“যমুনাবতী”, শঙ্খ ঘোষ
আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন—
রোগীদের কাছে আমরা ক্ষমাপ্রার্থী। ১৭ আগস্ট অব্দি আমাদের কর্মবিরতি, এমনকি প্রাইভেট ক্লিনিকও একদিন বন্ধ থাকবে। আপনাদের আমরা কষ্ট বা যন্ত্রণা দিতে চাই না। কিন্তু আপনাদের বাড়ির মেয়েটির দিকে তাকান। আমাদের অসহায় অবস্থা এবং আমাদের ওপরে লাগাতার নির্যাতনের কথা ভাবুন। আমরা আবার ফিরে আসছি— খুব শীগগিরই।
মধ্যরাতে রাতের রাজপথ নারীদের দখলে— “তৃতীয় পরিসর”-এর উন্মোচন
কিন্তু এরপরে আরেকটি ঘটনা ১৪ আগস্ট মধ্যরাত্রে ঘটেছে— কলকাতা-সহ ভারতের সব জেলায় এবং অঞ্চলে নারীরা, হ্যাঁ কেবলমাত্র নারীরা, রাজপথের দখল নিয়েছে। Reclaim the Night! আমি অন্ত্যেবাসী, প্রান্তিক অঞ্চলের একজন ডাক্তার। কিন্তু এই রায়গঞ্জেও এ মহাযজ্ঞ হয়েছে। কয়েক হাজার নারী দখল নিয়েছেন রাজপথের। তবে পুরুষেরাও পাশে বা পেছনে ছিল। তারা ছিল নিজেদের তাগিদে। এ নারীদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল— দয়া করে কোনও রাজনৈতিক দল এসে আমাদের এ প্রয়াসকে কলুষিত করবেন না, কোনও রাজনৈতিক ব্যানার বা স্লোগানও থাকবে না। এ আন্দোলন আমাদের নিজের, আমাদেরকে করতে দিন। প্রসঙ্গত বলা দরকার রায়গঞ্জ মেডিক্যাল কলেজের জুনিয়র ডাক্তারেরাও নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
১৪ আগস্ট মধ্যরাতে নারীরা কোনওরকম রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া যেভাবে রাজপথ অধিকার করার আন্দোলনে হাজারে হাজারে সামিল হলেন, এ ঘটনা অভূতপূর্ব এবং ঐতিহাসিক। হারিয়ে যাওয়া একটি পরিসর উন্মোচিত হল ঐতিহাসিকভাবে— রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে অতিক্রম করে “তৃতীয় পরিসর”। এ সম্ভাবনাকে পরম যত্নে, মমতায়, পুষ্টি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নাগরিক সমাজের। একে যেন আমরা ধ্বস্ত না করি।
অগ্নিবর্ণ সংগ্রামের পথে প্রতীক্ষায়
এক দ্বিতীয় বসন্ত। আর
গলিতনখ পৃথিবীতে আমরা রেখে যাব সংক্রামক স্বাস্থ্যের উল্লাস।
ততদিন আত্মরক্ষার প্রাচীর হোক
প্রত্যেক শরীরের ভগ্নাংশ।—”নির্বাচনিক”, সুভাষ মুখোপাধ্যায়
*মতামত ব্যক্তিগত
খুব সুন্দর পোস্ট
সত্যিই এই “রাত দখল” অভূতপূর্ব। অগনিত মানুষের মত আমারও রাজনৈতিক পক্ষপতিত্বের উর্ধ্বে উঠে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, সমাজের সবক্ষেত্রে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করার দাবি করছি ।
আর জি কর কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষ , হয়ত বা মুদ্রণ প্রমাদে সন্দীপ দত্ত হয়েছে। লেখার মধ্যে সময়, শাসক এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার সংগত ও য্থায্থ। পাশাপাশি চলমান সময়ে বহু প্রতিবাদী ডাক্তারবাবুদের কথা দৃশ্যমাধমে চোখে পড়ে , এই অনাচার কি তাদের চোখে পড়ে নি? দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই অব্যবস্থা , স্বজন পোষণ ( অন্তত পশ্চিমবঙ্গে বহু ব্যবহারে জীর্ন এক বাকি বন্ধ ) নিয়ে জুনিয়র ডাক্তারও কেন কোন প্রতিবাদ করে নি ? সমস্যা ত আজকের নয়। তবুও ঘটনা ঘটার পর মানুষের হুঁশ ফেরে , আবার তারা মানুষ হয়। তোমার লেখা নিয়ে ত বলার কিছু নেই , বেশ ভালো লেখা।