সায়ন্তী দাস
আমরা মেয়েরা হাতে হাত দিয়ে সবাই প্রবল রুখে দাঁড়িয়ে শাসনযন্ত্রকে ভয় পাওয়াতে পারব যে, দাবিগুলো মেনে নিতেই হবে। আমাদের পথকে সুরক্ষিত হতে হবে, আমাদের কর্মস্থল সুরক্ষিত হতে হবে। সমাজে, জীবনে সে নারী বলেই নেমে আসা দৈহিক নির্যাতনগুলোকে নারীরাই প্রাধান্য দেয় না বহু সময়। লিঙ্গ-রাজনীতি পেরিয়ে যেদিন এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার মানসিক স্তরে উন্নীত হতে পারব আমরা, সেদিন হয়তো আজকের এই আন্দোলন অবিস্মরণীয় হয়ে উঠবে। আশা রাখি, ১৪ আগস্ট ২০২৪ মধ্যরাত, হয়ে উঠবে তারই সূচনাকাল। হাজার হাজার মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়েছে এই রাতজাগা ভোর
আগুন শ্রাবণ পুড়ছে বুক
তোমার আমার রক্তমুখ
জেগেই থাকছে জেগেই থাকে…—পায়েল সেনগুপ্ত
১৪ আগস্ট ২০২৪ মধ্যরাত, যে জনজোয়ার সারা রাজ্য দেখেছিল, তা অভূতপূর্ব। সারা বাংলার মেয়েরা সে-রাতে বদলে দিয়েছিল পথের চিত্র। সল্টলেক করুণাময়ীর জমায়েত পেরিয়ে যখন রাত এগারোটা চল্লিশ নাগাদ পৌঁছলাম অ্যাকাডেমি চত্বরে, তখন তা জনসমুদ্র। সেই মুহূর্তে ‘আমরা’ থেকে ‘অনেক’ শব্দবন্ধে পৌঁছলাম। তারপর ভোর পাঁচটা অবধি মেয়েদের দখলে ছিল সে-পথ। সারা রাজ্য জুড়ে শত-শত স্থানে মধ্যরাতে মেয়েদের ঢল নেমে এসেছিল রাস্তায়, নিজেদের অধিকার সুরক্ষার দাবিতে, তা ভাষায় কতই বা বলা যায়— যদিও একদল সমাজবিরোধী আরজিকর আক্রমণ করে কালিমালিপ্ত করে সে-রাত।
১৫ আগস্ট, ২০২৪ এক অবিস্মরণীয় ভোর— যা দেখেছে গোটা রাজ্য, আর এ-রাজ্যের মেয়েদের দেখেছে গোটা দেশ, গোটা পৃথিবী। ইতিহাস তৈরি করল বাংলার মেয়েরা।
‘রিক্লেম দ্য নাইট’, আমরা যার বঙ্গীকরণ করেছি— ‘মেয়েরা রাত দখল করো’, এই আন্দোলনের সূচনা ১৯৭৫ সালের ফিলাডেলফিয়া শহরে। এক ছাত্রীর নৃশংস হত্যার ঘটনাতে এই আন্দোলন শুরু হয়। তারপর ১৯৭৬-৭৭-এর লন্ডনে আরেক নারীধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে এ-আন্দোলন হয়, যা পরে লন্ডন থেকে জার্মানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই ২০২৪ সালের পশ্চিমবঙ্গে, আমাদের মেয়েদের আবার রাত দখল করতে হল, কারণ এখানে যিনি ধর্ষিত ও খুন হলেন তিনি চিকিৎসাবিদ্যার স্নাতকোত্তর স্তরের ছাত্রী, ছত্রিশ ঘণ্টা টানা কর্মরত অবস্থায় তিনি তার কর্মক্ষেত্রে ধর্ষিত হলেন, যা তাঁর জন্য তাঁর বাসস্থলের পরবর্তী দ্বিতীয় ‘নিরাপদ স্থান’ হওয়ার কথা ছিল।
এখানেই প্রশ্ন, যখনই এই ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তখনই বলা হয় ‘মেয়েটির নিশ্চয়ই কোনও দোষ ছিল, সে নিশ্চয়ই পুরুষকে/পুরুষদেরকে প্রলুব্ধ করেছিল।’ কিন্তু ধর্ষণ বা যৌন হেনস্থা কোনও আনন্দময় ঘটনা নয় যে, কোনও মেয়ে তা ডেকে নিজের সঙ্গে ঘটাবে। এই সহজ সত্যের সামনে সকলকেই আগে দাঁড়াতে হবে। বহুক্ষেত্রেই শুনেছি, এই আলোচনায় অন্য মেয়েরা এমনকী তাঁর সহকর্মী মেয়েরাও অংশ নিয়ে ফেলে। ধর্ষণ তো চূড়ান্ত অপরাধ, কোনও ধরনের যৌন হেনস্থা বা মেয়েটির প্রতি কোনও অবমাননাকর আচরণ-এর ক্ষেত্রেই তা দেখা যায়। এভাবেই অপরাধী আড়াল হয় এবং মেয়েটি কার্যত শাস্তি পায় ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’-এর মাধ্যমে। যা বন্ধ হওয়া আশু প্রয়োজন। ‘না’ মানে ‘না’, এই শব্দটি পুরুষ বা নারী সবাইকেই শিখতে হবে। কেন যৌন নির্যাতন থেকে বাঁচতে মেয়েটিকেই পকেটে ছুরি বা লঙ্কার গুঁড়ো রাখতে হবে? কিংবা ছোট থেকে ক্যারাটে শিখতে হবে? যা পুরুষের সহবত শিক্ষা হওয়া উচিত, তা এখন আলোচনায় মেয়েদের নিজেদের আত্মরক্ষা কীভাবে করা যায়, তাতে পর্যবসিত হয়েছে। সুরক্ষার দায় কার?
এ-বিষয়ে ১৭ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকা-তে অনিতা অগ্নিহোত্রীর ‘সোনার তরোয়ালের খেলা’ শিরোনামে লেখার একটি অংশ উল্লেখ করছি—
১৯৯৭-এ বিশাখা রায়ের আগে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের কোনও স্বীকৃত মৌলিক অধিকার ছিল না। … ২০১৩-য় এসেছে যৌন হেনস্থা নিবারণী আইন, কিন্তু কেবল আইন থাকলেই হয় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বদলির শাস্তি পায় মেয়েটি। অসংগঠিত ক্ষেত্রে তো সুরক্ষা সমাধানের প্রশ্ন নেই। অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোথাও অন্তর্বর্তী অভিযোগ কমিটি নেই, কোথাও তা অদৃশ্য, কর্তাদের দ্বারা অলংকৃত হয়ে বসে আছে।
এই যদি প্রকৃত চিত্র হয়, তা হলে কর্মস্থলে মেয়েরা ঠিক কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে? বহুক্ষেত্রেই তো চাপা পড়ে যায় অন্তঃসলিলা সমস্যাগুলি। হয়তো এরকম একটা মৃত্যু সামনে এসে আবার মূল প্রশ্নগুলি জাগিয়ে তোলে। নিহত মেয়েটির বিচারের চাহিদার সঙ্গে আমরা নিজেদের জীবনের সঙ্গে ঘটে চলা অন্যায়গুলোর প্রতিবাদ করে ফেলি, প্রতিকার চাই।
এক সাক্ষাৎকারে সিমন দ্য বোভোয়া জানিয়েছিলেন—
দ্য সেকেন্ড সেক্স লিখতে-লিখতেই আমি প্রথম টের পাই যে আমি নিজেও এক ভুল জীবন কাটাচ্ছি, … ঘটনা হচ্ছে আমি পুরুষের মূল্যবোধ গ্রহণ করে ফেলেছি এবং সেই অনুযায়ী জীবন কাটিয়েছি…
—মেয়েদের হার, মেয়েদের জিৎ, পৃ.৮
এই ভ্রমে বাঁচা জীবনকে তিনি নিজে চিনেছিলেন, এবং ধীরে ধীরে তা থেকে সরে ছিলেন। অধিকাংশ মেয়ে যেদিন এই লিঙ্গ-রাজনীতির নিহিত ভ্রম কাটিয়ে নিজেদের আলোয় নিজেদের দেখবে, সেই দিন আমরা প্রকৃত সকাল দেখব। জানি, মেয়েরা এ লড়াই অবশ্যই জিতবে।
সেদিন আমরা মেয়েরা হাতে হাত দিয়ে সবাই প্রবল রুখে দাঁড়িয়ে শাসনযন্ত্রকে ভয় পাওয়াতে পারব যে, দাবিগুলো মেনে নিতেই হবে। আমাদের পথকে সুরক্ষিত হতে হবে, আমাদের কর্মস্থল সুরক্ষিত হতে হবে। সমাজে, জীবনে সে নারী বলেই নেমে আসা দৈহিক নির্যাতনগুলোকে, নারীরাই প্রাধান্য দেয় না বহু সময়। লিঙ্গ-রাজনীতি পেরিয়ে যেদিন এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার মানসিক স্তরে উন্নীত হতে পারব আমরা, সেদিন হয়তো আজকের এই আন্দোলন অবিস্মরণীয় হয়ে উঠবে। আশা রাখি, ১৪ আগস্ট ২০২৪ মধ্যরাত, হয়ে উঠবে তারই সূচনাকাল।
হাজার হাজার মেয়েকে স্বপ্ন দেখিয়েছে এই রাতজাগা ভোর। তাঁরা মিছিলের মুখ হয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। এই দ্রোহকালে, বলতে ইচ্ছে করে—
…চিতার আগুন অমর হোক
আমরা এবার স্বয়ং ত্রাস
শ্রাবণ এখন আগুন মাস
মৃত্যু লেখা খাতার পাতাভস্ম করার নাম স্বাধীনতা॥
—পায়েল সেনগুপ্ত
*মতামত ব্যক্তিগত। ভেতরের ছবিটি লেখকের তোলা