রাতদখল আন্দোলন বৃহত্তর আঙিনায় চোখ রাখুক

অরিন্দম

 

 


এই আন্দোলনে এখনও শেষ কথা বলবার সময় আসেনি। তবে আন্দোলনে যেভাবে তথাকথিত লিঙ্গভিত্তিক আন্দোলন প্রাধান্য পাচ্ছে বা ‘রাখিবন্ধন’-এর কর্মসূচি নেহাতই জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তা আন্দোলনকে শাসকের হাতেই তুলে দেবে। যদিও এই আন্দোলনে বৃহত্তর সাধারণ বিষয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসার সুযোগ ছিল। আসলে পুঁজিবাদের সংস্কৃতি হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক, পেশি আস্ফালনের সংস্কৃতি। ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন আক্রমণের অন্যতম শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু, ব্রিজভূষণ থেকে আশারাম বাপু সেই সংস্কৃতিরই ফসল। ‘গেরস্থালির ধর্ষণ’কে রাষ্ট্র স্বীকার করে না। অসংগঠিত মহিলা, শিশুশ্রমিকরা অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণেই যৌন শোষণের শিকার। তাদের জন্য রাতের গাড়ির ব্যবস্থা বা শিশুর জন্য ক্রেস কে করবে? নারীকে রান্নাঘরের জোয়াল থেকে মুক্তি দেবে কে?

 

আরজিকর-কাণ্ডের পর আন্দোলনের মাঝে হঠাৎ করে একটি অভিনব কর্মসূচি উঠে আসে। সেটি হচ্ছে ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে রাত ১১.৫৫-তে জমায়েত। নাম দেওয়া হয় ‘রাতদখল’। এবং এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। মূলত মেয়েদের আহ্বান হলেও একটি মেয়ের এই নির্মম ধর্ষণ ও খুনের এবং রাজ্য সরকারের তদন্তের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে মানুষ এটিকে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। এবং রাজ্যের প্রায় ছোটবড় প্রতিটি শহরে হাজারে হাজারে মানুষ জমায়েত হয়। এই জমায়েতের বেশ কিছুটা সংগঠিত ও অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল।

এই কর্মসূচিটি জনগণের উপর যে প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে আলোচনা জরুরি। প্রথমেই বলে রাখা ভাল রাজ্যের শাসক দল হিসেবে তৃণমূল দলের চরম দুর্নীতি, নেতাকর্মীদের ঔদ্ধত্য ও দৌরাত্ম্যের কারণে শহরাঞ্চলের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষরা তৃণমূলের উপর ক্ষেপে আছে। গত নির্বাচনে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের হার দেখেই বোঝা গেছিল। সেখানে এই ডাক্তারি পড়ুয়া মেয়েটির নিজের কর্মস্থলে খাস কলকাতার নামী সরকারি হাসপাতালের মধ্যে নৃশংসভাবে ধর্ষিতা ও খুন হয়ে যাওয়া শুধু নয়, কলকাতা পুলিশের ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা আর মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দায় অস্বীকার করা, বিভ্রান্তিকর বক্তব্য রাখা ইত্যাদির ফলে মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তার প্রতিফলন দেখা যায় এই ‘রাতদখল’-এর প্রতিবাদী জমায়েতের মধ্যে দিয়ে। এই জমায়েতকে যতই অরাজনৈতিক দেখানোর চেষ্টা হোক না কেন এটি পরিষ্কার শাসকের বিরুদ্ধে অনাস্থার প্রকাশ। শাসক দল পুরোমাত্রায় এটি বুঝতে পেরেছে। ফলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ‘গাজর ও লাঠি’ নীতি নিয়েছেন। অর্থাৎ একদিকে প্রতিবাদীদের ভয় দেখানো গ্রেফতার, অন্যদিকে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবার মাধ্যমে। এবং শাসকদল আজ এতটাই জনবিচ্ছিন্ন প্রতিবাদী মানুষের উপর পুলিশি দমন বাড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

 

অরাজনীতির কতটা রাজনীতি

এই কর্মসূচির ঘোষণা প্রাথমিকভাবে কলকাতার প্রতিবাদী দু-একটি মেয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত বলে জানা যায়। সঙ্গে সঙ্গেই বামপন্থী দলগুলি যারা আন্দোলন করছিল কিন্ত সংগঠিতভাবে অত জমায়েত করতে পারছিল না, তারা এই কর্মসূচির সাফল্য আন্দাজ করে লুফে নেয়। সঙ্গে যোগ দেয় এনজিও ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি। পাশাপাশি উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত যারা ক্ষুব্ধ কিন্ত স্বার্থের কারণে রাজনৈতিক দলের সংস্রব এড়িয়ে চলতে চায় তারা যোগ দেয়। আর একদম শেষে বিচ্ছিন্নতার ভয়ে ও অরাজনীতির আড়ালে যোগ দেয় বিজেপি। এই অরাজনীতির সুযোগ শাসকদলও পায়। এই আন্দোলনে মুল স্লোগান হিসেবে ওঠে খালি এই নির্মম ঘটনার বিচারের দাবি। ফলে শাসকদলের ব্যর্থতা, দুর্নীতি, নৈরাজ্য সামনে আসে না। এবং এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখানো হয়। এমনকি ‘বিচারের দাবি’তে তৃণমূল দল ও রাস্তায় নেমে পড়েছে। যদিও এই আন্দোলন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন চেহারা নিচ্ছে। এটা নির্ভর করছে কোন অঞ্চলে কোন নেতৃত্ব কাজ করছে।

তবে এই আন্দোলনের মধ্যে ধীরে ধীরে সংগঠিত রূপ নেওয়ার একটি প্রয়াস লক্ষ করা যাচ্ছে। এবং এই নেতৃত্ব শুধু দলীয় রাজনীতি নয়, যে-কোনও রাজনৈতিক অবস্থানের বিরোধী। এদের নেতৃত্ব বিভিন্ন বাস্তবতাহীন কিন্তু চমকপ্রদ স্লোগান হাজির করছে অনেকটা এনজিও-দের মতন। এবং সারা পৃথিবী জুড়ে যে আত্মপরিচিতির আন্দোলন একধরনের জনপ্রিয়তা লাভ করছে তার একটি ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে। আত্মপরিচিতির আন্দোলন প্রাথমিকভাবে খুব প্রগতিশীল কথা বলে কিন্তু ধীরে ধীরে তা প্রতিক্রিয়ার বা শাসকের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কারণ শাসক জানে এই সাধারণ মানুষের সাধারণ দাবিগুলিকে বিচ্ছিন্ন করবে এবং সাধারণ মানুষকে বিভক্ত করবে। এই আন্দোলনেও সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে নারীস্বাধীনতা এবং ট্রান্সজেন্ডারদের রঙের পতাকা ছাড়া আর কোনও পতাকা নিয়ে আসা চলবে না। অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন করবার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং তা হচ্ছে অরাজনীতির নামে। যেমন এখানে দেখা যাচ্ছে সমাজের অন্য শোষণগুলিকে অগ্রাহ্য করে নারীধর্ষণকে একটি বিচ্ছিন্ন পুরুষ আধিপত্যবাদ হিসেবে দেখা বা দেখানো, এটি হল বুর্জোয়া দর্শনের আধিপত্যাধীন পেটিবুর্জোয়া আন্দোলনের মূল কথা। কিছু প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী-আন্দোলনের সুবিধাবাদী নেতৃত্ব তৈরি করাই লক্ষ্য। এর প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘নো মোর রেপ’ নামে কোনও বিশ্লেষণ ছাড়াই স্লোগান গড়বার মধ্যে দিয়ে।

হ্যাঁ, কোনও কোনও সময় পেটিবুর্জোয়া আন্দোলন তার থেকে এগিয়ে যায়, সমস্ত জনতার ক্ষোভ ব্যবহার করে, কিন্তু শেষ অবধি পেটিবুর্জোয়াদের দাস-মানসিকতা, বুর্জোয়া হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার আন্দোলনকে বুর্জোয়াদের হাতে তুলে দিয়ে সুরক্ষিত বোধ করে। এবং আবার বলছি এটি কোনও অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই। বরং অল্প-বিকশিত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এটি স্বাভাবিক ঘটনা। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, ইরান এই সমস্ত দেশগুলিতে যে অভ্যুত্থান আন্দোলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তাতে পেটিবুর্জোয়াদের অংশগ্রহণ, নেতৃত্বদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল দল-নির্বিচারে, রাজনীতি-নির্বিচারে সবার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রদর্শন করা এবং নিজেদের অরাজনৈতিক ঘোষণা করা।

আবার আমাদের এই আন্দোলনে ফিরে আসি। এই আন্দোলনের আরও একটি স্লোগান “উই ওয়ান্ট জাস্টিস” (লক্ষণীয় যে বেশিরভাগ স্লোগানই ইংরেজিতে, যা শ্রেণি নির্দিষ্ট করে দেয়)। ‘জাস্টিস’ বা ‘ন্যায়বিচার’-এর একটি বৃহত্তর মাত্রা রয়েছে। একটি বিশেষ আন্দোলনের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ ‘ন্যায়বিচার’-এর দাবিতে আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু যখন ‘নো মোর রেপ’ স্লোগান উঠে আসে তখন ‘ন্যায়বিচার’ও ভিন্নতর বৃহত্তর মাত্রা পায়। কিন্তু এই আন্দোলনের নেতৃত্ব একবারও বৃহত্তর ন্যায়বিচারের কথা না বলে পেটিবুর্জোয়া ক্ষোভকে ব্যবহারের জন্য চমকপ্রদ স্লোগান উদ্ভাবনে ব্যস্ত। এবং এটিকে আন্দোলনের সৃষ্টিশীল বিকাশ বলা হচ্ছে। আমরা যদি বাংলাদেশের আন্দোলনের দিকে তাকাই তখন দেখব তথাকথিত ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলনের নেতারা হাসিনার দেশ ছাড়ার পর যখন চরম অরাজকতা চলছে তখন সৃষ্টিশীল আন্দোলনের নামে ছোট দোকানদারদের দাম কমানোর হুমকি বা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা দেওয়াল অঙ্কনে ব্যস্ত এবং ছাত্রীরা প্রায় হারিয়ে গেছে। প্রকৃত বৈষম্য নিয়ে কোনও কথা নেই। এখানেও আমরা তার চিত্র দেখছি। মহারাষ্ট্রে এই ‘রাতদখল’ আন্দোলনে গ্যালেরিয়া মলের সামনে জমায়েত থেকে পাশেই উচ্ছেদ হওয়া দলিত বস্তি থেকে আশা মহিলাদের অবস্থান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও দেখতে পাচ্ছি বড় বড় নার্সিংহোমের মালিকরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে, কিন্তু ইটভাটা, বিড়িশ্রমিক, পাথর ভাঙা বা সাফাইকর্মী মহিলারা, মানে মেহনতি মহিলা বা তাদের সংগঠন এই আন্দোলনে নেই। নেই কারণ এই আন্দোলন তাদের যৌন বা আর্থিক শোষণকে স্বীকার করছে না।

সুতরাং এই অরাজনীতির পুরোটাই রাজনীতি এবং সেটা এখনও পর্যন্ত শাসকের দর্শনেই সীমাবদ্ধ।

 

আপাতত কথার শেষে

এই আন্দোলনে এখনও শেষ কথা বলবার সময় আসেনি। তবে আন্দোলনে যেভাবে তথাকথিত লিঙ্গভিত্তিক আন্দোলন প্রাধান্য পাচ্ছে বা ‘রাখিবন্ধন’-এর কর্মসূচি নেহাতই জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তা আন্দোলনকে শাসকের হাতেই তুলে দেবে। যদিও এই আন্দোলনে প্রকৃত অর্থেই আরও বৃহত্তর সাধারণ বিষয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসার সুযোগ ছিল। আসলে পুঁজিবাদ বা তার সংস্কৃতি হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক, পেশি আস্ফালনের সংস্কৃতি। ইজরায়েলের প্যালেস্তাইন আক্রমণের অন্যতম শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু, ব্রিজভূষণ থেকে আশারাম বাপু সেই সংস্কৃতির ফসল। ‘গেরস্থালির ধর্ষণ’কে রাষ্ট্র স্বীকার করে না। অসংগঠিত মহিলা, শিশুশ্রমিকরা অর্থনৈতিক বঞ্চনার কারণেই যৌন শোষণের শিকার। তাদের জন্য রাতের গাড়ির ব্যবস্থা বা শিশুর জন্য ক্রেস কে করবে? নারীকে রান্নাঘরের জোয়াল থেকে মুক্তি দেবে কে? তাই এখনও পর্যন্ত এই তথাকথিত চমকপ্রদ স্লোগান ‘রাতদখল’ মধ্যবিত্ত ক্ষোভ বহিঃপ্রকাশেরই একটি মাধ্যম। তবুও ওই মেয়েটির খুন ও ধর্ষণে অভিযুক্তরা যদি ধরা পড়ে তাহলেও সেটি বড় প্রাপ্তি হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4813 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...