অলিম্পিক ২০২৪— প্রশ্ন অনেক, উত্তর জানা নেই

অরিন্দম মুখোপাধ্যায়

 


১১৭ জন প্রতিযোগীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে, মাত্র ছটি পদকের সঙ্গে পদক তালিকাতে একাত্তরতম স্থানে শেষ করল ভার‍ত। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে সুনীল ছেত্রীর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের কথা। কেন আমরা পারছি না পদকসংখ্যা বাড়াতে? কেন একশো ত্রিশ কোটির দেশ হয়েও সেই কয়েকটি গোনাগুনতি ইভেন্টের বাইরে আমাদের কোনও প্রতিযোগী নেই? কেন খেলাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার সংস্কার এখনও গড়ে ওঠেনি আমাদের দেশে?

 

অলিম্পিক শেষ হয়েছে দু-সপ্তাহ হতে চলল। এরই মধ্যে আমাদের দেশ, আমাদের রাজ্যে পরিস্থিতির যে তুমুল পরিবর্তন ঘটেছে তা কারও অজানা নয়। গত চার বছর ধরেও যে বিভিন্ন ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী থেকেছি আমরা, তাও এখন অতীত। অথচ বদলায়নি বলতে শুধু ভারতের অলিম্পিকে পদকসংখ্যা। টু ডিজিটে প্রবেশ করার অসংখ্য প্রত্যাশা জাগিয়েও শেষমেশ আমরা দাঁড়িয়ে থেকেছি খালি হাতে। যদিও আমাদের উৎসাহিত হওয়ার কারণ নেই এমনটা একেবারেই নয়। তবে উৎসাহের আলোর থেকে চিন্তার মেঘের পরিমাণ এবারে বেশ খানিকটা বেশি।

প্যারিস অলিম্পিক, ২০২৪-এ শেষ পর্যন্ত ৬টি পদক পেয়েছি আমরা। একটি রুপো এবং পাঁচটি ব্রোঞ্জ নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অধরা থেকে গেছে সোনার স্পর্শ। অথচ আমরা যে কাছাকাছি পৌঁছাইনি এমনটাও নয়। বৃহত্তর আঙ্গিকে দেখতে গেলে এবারের অলিম্পিক ভারতের খেলার জগতে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছে। অভিনব বিন্দ্রার বারো বছর পর অলিম্পিকে শুটিং-এ পদক এনেছেন মানু ভাকর। তাও আবার একটি নয়, দুটি। সামান্যর জন্য অধরা থেকে গেছে তৃতীয় পদক। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল এবং সর্বজিৎ সিংয়ের সঙ্গে ১০ মিটার এয়ার পিস্তল মিক্সড জিতে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন মানু। টোকিও অলিম্পিকে পিস্তল ম্যালফাংশানিং-এর জন্য নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী পারফর্ম করতে না পারার যে যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণার আগুনের গুলিতে এবারে ঝাঁঝরা হয়েছে প্রতিটি প্রতিপক্ষ। তিনি হয়ে উঠেছেন স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগের একই অলিম্পিকে একের বেশি পদক জেতা প্রথম ভারতীয়।

মানু ভাকের

একদিকে যেমন ইতিহাস লিখলেন মানু। অন্যদিকে স্বর্ণালী রূপকথা লেখার থেকে সাড়ে তিন মিটার দূরত্বে রয়ে গেলেন নীরজ। হেরে গেলেন তারই শ্রেষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের আরশাদ নাদিমের কাছে। ৯২.৯৭ মিটার ছুড়ে নতুন অলিম্পিক রেকর্ড স্পর্শ করলেন আরশাদ। পাকিস্তান পেল অলিম্পিকের ইন্ডিভিজুয়াল ইভেন্টে তার প্রথম স্বর্ণপদক। ৮৯.৪৫ মিটার ছুড়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়ে গেলেন নীরজ। তবুও এইসব পেরিয়ে দুই দেশের দুই মা, তাঁদের দুই সন্তানকে ভালবাসা আর আশীর্বাদে ভরিয়ে দিলেন। হিংসা, রেষারেষির আবহ থেকে সরে এসে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল ভালবাসার মিষ্টি সুবাস এবং অ্যাথলেটিকসে ইউরোপ ও আমেরিকার চূড়ান্ত প্রতিপত্তির রাজত্বে থাবা বসাল উপমহাদেশের সর্বকালের দুই শ্রেষ্ঠ অ্যাথলিট। এ-দৃশ্যও কম আনন্দের নয়।

নীরজ এবং আরশাদ

নীরজের সোনা হারানোর ব্যথা যতটা আঘাত দিয়েছিল আমাদের তার দ্বিগুণ আঘাত নিয়ে বর্শার মতো এসে বিঁধল লক্ষ্যের হার। গোটা অলিম্পিকে অসামান্য লেভেলের ব্যান্ডমিন্টন খেলার পর যখন ডিফেন্ডিং অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান ভিক্টর অ্যাক্সেলসেনের সামনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না লক্ষ্য, গোটা দেশ আশা করেছিল অন্তত ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করবেন তিনি। ঠিক সেইসময় প্রথম গেম ২১-১৩ জেতার পরেও মালয়েশিয়ার লিজি জিয়ার কাছে হার স্বীকার করলেন। যেভাবে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় গেমে ৭-০ এগিয়ে থেকেও অপারগ হয়েছিলেন অ্যাক্সেলসেনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। এবারে লক্ষ্যের কোচের ভূমিকায় ছিলেন প্রাক্তন বিশ্বসেরা ও সম্ভবত ভারতের শ্রেষ্ঠ শাটলার প্রকাশ পাড়ুকোন, যিনি লক্ষ্যের হারের পর ভারতের সমস্ত অ্যাথলিটদের মানসিকতার সমালোচনা করায় অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছেন। একদিকে নোভাক জোকোভিচ আটত্রিশ বছর বয়সে কার্লোস আলকারাজকে হারিয়ে জীবনের প্রথম স্বর্ণপদক জেতার পর মানসিক জোরের কথা উল্লেখ করছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে তখন প্রকাশ পাড়ুকোন সেই একই প্রশ্ন তোলায় দেশের খেলোয়াড়দের এক অংশের থেকে তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে কটাক্ষ, যা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের ভবিষ্যতের জন্য শুভ ইঙ্গিত নয় বলেই মনে হয়।

লক্ষ্য সেন

যদিও এ-কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে বক্সিং এবং কুস্তিতে ভারতীয় খেলোয়াড়দের এবারের অলিম্পিকে বারবার পক্ষপাতিত্বের শিকার হতে হয়েছে। লাভলিনা, নিখাত জারিন, অমিত পোঙ্গলের প্রত্যেকের হারের মধ্যেই এক ধরনের ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। অলিম্পিক পদকজয়ী ভারতীয় বক্সার বিজেন্দ্র সিংও যে ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। যদিও তাতে অবাক হওয়ার কিছুই ছিল না। অন্যদিকে বিশ্বসেরা কুস্তিগির, বিগত দশ বছর ধরে অপরাজিত কিউবার গুজমানকে ৫-০ হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর ১০০ গ্রাম ওজন বেশি হওয়ায় মূল ইভেন্ট থেকে সরাসরি বাদ পড়লেন ভিনেশ ফোগত। চূড়ান্ত লড়াই এবং লক্ষ্যের একদম নিকটে এসেও সোনা হাতছাড়া হল। উকিলের মাধ্যমে রুপোর জন্য আবেদন করেও আশানুরূপ ফল পাওয়া গেল না। তাঁর সম্মানের লড়াইয়ের মতোই এখানেও খালি হাতে ফিরতে হল তাঁকে, কিন্তু আমরা সাক্ষী রইলাম এক বীরাঙ্গনার অকান্ত পরিশ্রম ও অটুট সাহসের। সেই সাহসকে ভরসা করেই ভারতের জন্য কুস্তিতে শেষ পর্যন্ত পদক আনলেন অমন শেরাওয়াত।

ভিনেশ ফোগত, অমন শেরাওয়াত

বক্সিং এবং ব্যাডমিন্টনের হতাশার মেঘের মধ্যে আলো হয়ে জ্বলে উঠলেন ভারতীয় হকি দল ও স্বপ্নিল কাসুলে। জার্মানির বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তের গোলে সেমিফাইনালে হারের পরেও স্পেনের বিরুদ্ধে নিজেদের নিংড়ে দিলেন হরমনপ্রীতরা। স্পেনকে ২-১ হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্জন করলেন পরপর দুটি অলিম্পিকে পদক আনার কৃত্বিত্ব। গোলের সামনে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ভারতীয় হকির অন্যতম শ্রেষ্ঠ আইকন পিআর শ্রীজেশ। অন্যদিকে ধোনিভক্ত, ও তাঁরই মতো রেলকর্মচারী স্বপ্নিল ভারতকে এনে দিলেন ৫০ মিটার রাইফেল শুটিংয়ের জন্য ব্রোঞ্জ পদক। অথচ প্রতিবারের মতো প্রচুর আশার কথা বলেও এবারেও একটিও পদক আনতে ব্যর্থ হল ভারতীয় তিরন্দাজ দল। সবরকম প্রচারের আলো থেকে দূরে থেকেও নিজেদের উজাড় করে দিলেন অবিনাশ সাবলে এবং বলরাজ পানওয়ার। আট মিনিট চোদ্দ সেকেন্ডে শেষ করে ৩০০০ মিটার স্টিপলচেজে গোটা বিশ্বে এগারোতম স্থান আনলেন অবিনাশ সাবলে। অন্যদিকে ইতিহাস গড়লেন বলরাজ। মাত্র সাত মিনিট দু-সেকেন্ডে অতিক্রম করে ইন্ডিভিজুয়াল রোয়িং ইভেন্ট, স্কালসে পঞ্চম স্থান অধিকার করলেন তিনি।

 

১১৭ জন প্রতিযোগীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে, মাত্র ছটি পদকের সঙ্গে পদক তালিকাতে একাত্তরতম স্থানে শেষ করল ভার‍ত। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে সুনীল ছেত্রীর দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের কথা। কেন আমরা পারছি না পদকসংখ্যা বাড়াতে? কেন একশো ত্রিশ কোটির দেশ হয়েও সেই কয়েকটি গোনাগুনতি ইভেন্টের বাইরে আমাদের কোনও প্রতিযোগী নেই? কেন খেলাকে পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার সংস্কার এখনও গড়ে ওঠেনি আমাদের দেশে? উত্তরে সুনীল বলছেন, আন্দামান বা মিজোরামের যে ছেলেটি দুর্দান্ত জাম্প করতে পারে, কিংবা হিমাচলের প্রত্যন্ত কোনও গ্রামের যে মেয়েটি নির্দ্বিধায় মাঠে না জেনেই জিমন্যাস্টিক করে বেড়ায় তারা জানেই না তাদের এই অসম্ভব প্রতিভাকে পেশা করাও সম্ভব। যৌবনে প্রবেশ করতে না করতেই তারা নিজের অঞ্চল ছেড়ে শহরে চলে আসে চাকরির খোঁজে। পেটের দায় তাদের খেলোয়াড়ের বদলে কোনও বিশালাকার কারখানার শ্রমিক কিংবা ড্রাইভার বানিয়ে দেয়। এই অ্যাওয়ারনেস ছড়ানোর দায়িত্ব কার? দ্বিতীয়ত এত যে প্রতিভা গোটা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের শনাক্ত করবে কে? ভারতবর্ষে কবে গড়ে উঠবে ট্যালেন্ট স্কাউটিং ডিপার্টমেন্ট? প্রশ্ন অনেক। কবে পৌঁছাতে পারব আমরা দু-ঘরের অঙ্কে অথবা কবে স্থান পাব পদকতালিকায় প্রথম দশের ভিতর? আমরা জানি না। উত্তর কবে পাব তারও কোনওরকম নিশ্চয়তা নেই। তবে শুধু জানি, এই প্রশ্ন আমাদের করে যেতে হবে। কারণ উত্তরের কাছাকাছি পৌঁছানোর এ-ছাড়া আর কোনও দ্বিতীয় রাস্তা নেই।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4810 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...