কার্তিক কলিং কার্তিক

অনুরাধা কুন্ডা

 


এখন অগণিত মিছিল বেরিয়ে আসছে। ডাক্তারদের মিছিল, উকিলদের মিছিল, চলচ্চিত্রশিল্পীদের মিছিল, সঙ্গীতশিল্পীদের মিছিল, থিয়েটারকর্মীদের মিছিল, শিক্ষকদের মিছিল... কার্তিক কলিং কার্তিক। ভয় হচ্ছে মিছিলে মিছিলে না ডাক্তারের মৃত্যু ডুবে যায়। এক ডাক্তার কি মওত হয়ে শুধুমাত্র কি চলচ্চিত্রের পর্দায় ভেসে থাকবে এই মর্মান্তিক মৃত্যু এবং ধর্ষণ?

 

প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়লে অন্তত দুটি ধর্ষণ এবং দুটি খুনের কেস নজরে আসে। আরজিকরের ডাক্তারের মৃত্যুর খবরটি একটু আলাদা হয়ে এসেছিল ভার্চুয়াল মাধ্যমের দৌলতে। সবটাই খুব কনফিউজ করে দেওয়া খবর। প্রথম ধাপে যে খবর এসেছিল তাতে আমরা, সাধারণ মানুষরা জানতে পারি যে আরজিকরে মহিলা ডাক্তার মৃত। সেমিনার হলে তার মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। নিম্নাঙ্গে কোনও পোশাক ছিল না। ব্যস এইটুকু। যেহেতু মহিলা সেজন্য এই খবর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ধর্ষণের কথা অনিবার্যভাবে মনে আসে। এবং তারপর থেকেই নিউজফিডে এবং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসতে থাকে অত্যাচার এবং নির্যাতনের কথা। যে বিষয়গুলো সুপ্রিম কোর্ট এখন জানাচ্ছেন সেগুলো ১০ দিন আগে আমাদের মতো সাধারণ পাঠকদের জানা হয়ে গিয়েছে। যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রথমে সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য পাচ্ছিল যে নির্মমভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে ডাক্তারের কলার বোন এবং পেলভিক বোন, এখন যা ময়নাতদন্তে রিপোর্ট আসছে তাতে কিন্তু সে-কথা বলা হচ্ছে না। কী মারাত্মকভাবে কনফিউজিং! বাড়িতে খবর দেওয়া হল আত্মহত্যা। এখন প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষ সেটা বেমালুম অস্বীকার করে যাচ্ছেন অন্তত ভিডিওতে যা দেখলাম। এবং তিনি বলছেন যে কোথায় তিনি আত্মহত্যার কথা বলেছেন তার কোনও প্রমাণ নেই অর্থাৎ কোনও whatsapp বা কোনও মেসেজে তিনি এ-কথা বলেননি।

আমরা ছোটবেলা থেকে একটা প্রবাদ বাক্য জানি। এক-কান কাটা গ্রামের বাইরে দিয়ে যায়। দু-কান কাটা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যায়।

এই প্রবাদের প্রকৃষ্ট প্রয়োগ আমরা এখন দেখে যাচ্ছি দুবেলা। আমরা কার কাছে যাব কী বলব কিছু জানা নেই কারণ এ-দেশে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের লোকে ফুলের মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেয়।

৩৬ ঘন্টা টানা ডিউটি একটা অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। এটা কি ডাক্তারকে কোনও শাস্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল? এটা প্রথম প্রশ্ন। ২৪ ঘন্টা ডিউটি হতে পারে কিন্তু ৩৬ ঘণ্টা টানা? আমরা সবই ভার্চুয়াল মিডিয়ার মাধ্যমে বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পারছি। কাজেই কোনটা সঠিক তথ্য আমরা জানি না। ধরে নেওয়া যাক অত্যন্ত ক্লান্ত শরীরে তিনি ঘুমোতে গিয়েছিলেন এবং সেমিনার রুমে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং তারপরে খুন করা হয়েছে, বা খুন করে ধর্ষণ করা হয়েছে। এটা সিবিআই-এর বলে দেওয়ার অপেক্ষায রাখে না। নির্ভয়া কেস অন্তত অপরাধীদের অতি তৎপরতায় ধরে ফেলা হয়েছিল। বক্তব্য এই যে এখানে এখনও অপরাধীরা ধরা পড়ছে না কেন? যে ব্যক্তিকে অপরাধী বলে ধরা হয়েছে তার মুখ থেকে কোনও কথা বের করা যাচ্ছে না এবং এটা খুব পরিষ্কার যে সেই এক ব্যক্তির পক্ষে ওই ধরনের অত্যাচার করা সম্ভব নয়। সম্ভবত অনেকজন এই ভয়াবহ দুষ্কর্মের সঙ্গে লিপ্ত ছিলেন। কাজে অনিবার্যভাবে উঠে আসছে নানারকম র‍্যাকেট-এর কথা। সে হতে পারে ড্রাগ বা সেক্স র‍্যাকেট। প্রশাসনের কাছে বিচারের দাবি নিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কি বা উপায় থাকে? নির্দিষ্ট জবাবগুলি আসলে আমাদের মুখের ওপর এক তাল কাদা ছুড়ে দেয়। কোনও কিছু জানার অধিকার নেই। আমাদের কোনও নিরাপত্তা নেই। ইতিমধ্যেই ১৪ আগস্ট এক অভিনব উপায়ে মিছিল বেরিয়েছে। সমস্ত শ্রেণির মহিলারা রাস্তায় নেমে এসেছেন। বিচার চাই। বোঝা যাচ্ছে যে মানুষের আবেগ এখানে কাজ করছে। আবার এটাও বোঝা যাচ্ছে যে সম্পূর্ণ আবেগ দিয়ে এই রহস্য এবং এই মহা ষড়যন্ত্রের সমাধানও হবে না। এখানে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে কেউটে খুঁজতে অ্যানাকোন্ডা বেরিয়ে যাবে।

গল গল করে অনেক কথা উঠে আসছে। কিন্তু অসংলগ্ন হয়ে যাওয়ার ভয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। একজন ডাক্তারকে মেরে ফেলা অন্যান্য ডাক্তারদের পক্ষে খুব সহজ কারণ তাঁরা যেমন জানেন কীভাবে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হয় ঠিক ততটাই ভালভাবে জানেন কীভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটাতে হয়। তৎসত্ত্বেও এত বীভৎস মৃত্যু কেন? কলার বোন বা পেলভিক বোন কি তাহলে ভাঙেনি? আগে তো এই হাড়গুলো ভাঙার কথা বিস্তৃতভাবে বলা হচ্ছিল। সেই কাজটা কখনওই এক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। এমনকি এখন যে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলার কথা বলা হচ্ছে সেটাও একজন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়।

এখন অগণিত মিছিল বেরিয়ে আসছে। ডাক্তারদের মিছিল, উকিলদের মিছিল, চলচ্চিত্রশিল্পীদের মিছিল, সঙ্গীতশিল্পীদের মিছিল, থিয়েটারকর্মীদের মিছিল, শিক্ষকদের মিছিল… কার্তিক কলিং কার্তিক। ভয় হচ্ছে মিছিলে মিছিলে না ডাক্তারের মৃত্যু ডুবে যায়। এক ডাক্তার কি মওত হয়ে শুধুমাত্র কি চলচ্চিত্রের পর্দায় ভেসে থাকবে এই মর্মান্তিক মৃত্যু এবং ধর্ষণ?

এই প্রথম বোধহয় এত বড় জনজোয়ার লক্ষ করা গেছে সারা দেশ জুড়ে এবং এই জনজোয়ারের পিছনে কোনও রাজনৈতিক অঙ্গুলিহেলন না থাকাই বাঞ্ছনীয়। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। একমাত্র দাবি অপরাধীর বিচার চাই। কিন্তু অপরাধীরা এখনও কেন গ্রেফতার হল না? সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পলিগ্রাফ টেস্ট পার হয়ে যাওয়ার মতন বুদ্ধি একজন ডাক্তারের কাছে থাকে। হয়তো অভিযুক্ত ব্যক্তিটিরও আছে। পলিগ্রাফ টেস্টের ওপর ভরসা করে এই ঘটনার সত্যতা বিচার করা খুব সঙ্গত হবে বলে মনে হয় না। সত্যিই কি ইচ্ছে করলে খুব দ্রুত অপরাধীদের গ্রেফতার করা যায় না? আটকাচ্ছে কোথায় সেটা আমরা আপনারা সবাই জানি। কী লিখেছিল মেয়েটি তার ডায়েরিতে? সেই ডায়েরি নাকি সিবিআই-এর হেফাজতে। ভাবী জীবনসঙ্গী কাউকে কি কিছু বলেনি মেয়েটি? খবরে বলছে ইদানিং সে নাইট শিফট সম্পর্কে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিল না।

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আবর্জনায় ভরা একটা সিস্টেম।

আরজিকরের অধ্যক্ষ সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য দিনের পর দিন বেরিয়ে আসছে তাতে প্রশ্ন তুলতেই হয় যে এতদিন কি কেউ এসব জানতেন না? মৃত ডাক্তার একাই জানতে পেরেছিলেন? এটা ঠিক যে সিবিআই তদন্তে ঠিক কী কী হচ্ছে সেটা এখনই পাবলিক করা সমীচীন হবে না। তার ওপরে আরও জানা গেল যে একটি তদন্ত যখন হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং তারপরে সিবিআই-এর হাতে যায় তখন পুরনো সাক্ষ্যপ্রমাণ তথ্য ইত্যাদি সেগুলো আবার করে সংগ্রহ করা হয়। আর এই ক্ষেত্রে তো সাক্ষ্যপ্রমাণ আগেই লুটপাট হয়ে গেছে। যেটুকু প্রমাণ আছে তাও যে ট্যাম্পার করা হয়নি তা কে বলবে? একটা হিন্দি ছবির ক্রাইম প্লটও এর চেয়ে ভাল হয়। একটার পর একটা কনফিউজিং ঘটনা। অপরাধীরা ধরা পড়ল না। জুনিয়র ডাক্তারদের রীতিমতো মিছিল বেরোচ্ছে অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য। অথচ ফতোয়া জারি হয়ে গেল যে মেয়েদের নাইট শিফটে যথাসম্ভব কম কাজে দিতে হবে। আমরা আবার মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছি? দিনের বেলা কি মহিলাদের সম্ভ্রমহানি হয় না? চোখের উপর দিনেদুপুরে মেয়েরা লাঞ্ছিত হন। তারপর কি মেয়েদের দিনের বেলা চলাফেরাও নিষিদ্ধ হবে? তাহলে বিজেপিশাসিত জায়গাগুলো থেকে কি তফাৎ রইল পশ্চিমবঙ্গের? চোর ধরা পড়ল না অথচ গৃহস্থের শাস্তি হয়ে গেল।

আপাতত যদি খুব পরিষ্কারভাবে এই ঘটনা অ্যানালিসিস করা যায় তাহলে তার একটি সামাজিক দিক আছে, আরেকটি রাজনৈতিক দিক। সামাজিক দিক থেকে মেয়েরা চিরকাল এইভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে আসছে। প্রসঙ্গত উঠে আসছে হাথরাস, উন্নাও, আসিফা এবং আরও হাজার হাজার মেয়ের কথা যাদের ধর্ষণের বৃত্তান্ত আমরা খবরের কাগজে পড়েছি এবং ভুলে গেছি। একটি মেয়েকে শাস্তি দেওয়ার সবচেয়ে বড় উপায় হচ্ছে তাকে ধর্ষণ করা। এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিদান। ধর্ষণে একটি ব্যক্তির আত্মার মৃত্যু হয়, অতএব মেয়েটিকে ভাঙো, ভেঙে গুড়িয়ে দাও। যদি মৃতদেহের উপর বলাৎকার করা হয়ে থাকে তবে তা পৈশাচিক এবং এর অধিকতর পৈশাচিক আর কিছু নেই। শোনা গেছে মেয়েটির গাড়িটি ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সবদিক থেকে এ মেয়েটিকে পর্যুদস্ত করার একটা প্রচেষ্টা চলছিল। কারা ভাঙল গাড়ি? সেমিনারের সিসিটিভি অচল ছিল— সারা হাসপাতালেরই কি সিসিটিভি অচল ছিল? এই নিয়ে কিছু সঙ্গত প্রশ্ন কি সাধারণ মানুষ সরকারের কাছে রাখতে পারে না?

একের পর এক প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছে আমাদের আর চোখের উপরে ভাসছে মৃত ডাক্তারের ভাইরাল হয়ে যাওয়া ছবি। অপরাধীরা এত প্রোটেকশন পাচ্ছে কেন? এটা একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন।

সুরূপা গুহর মৃত্যুর কথা খানিকটা টেনে আনা যায়। কলকাতার সব তাবড় তাবড় এলিটরা এই মৃত্যুর ঘটনা সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সম্ভবত সুরূপাও কিছু গোপন তথ্যের হদিস পেয়েছিলেন যার জন্য তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারের বধূ, সেইজন্য তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু ধর্ষণ করা হয়নি। এইক্ষেত্রে মৃতা ডাক্তার বীভৎসভাবে ধর্ষিতা এবং এই হাড়ভাঙার রিপোর্ট! আগে বলা হয়েছিল হাড়ভাঙা আছে এবং এখন বলা হচ্ছে নেই। এটাও একটা রহস্যজনক ইন্টারপ্রিটেশন। প্রশ্ন জাগে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যেটা পাবলিকে চলে আসছে সেটা কি সঠিক? এরকম মৃত্যুর তদন্তে যে পোস্ট হয় তাকে এত সহজে ভাইরাল করা সম্ভব? আমাদের জানা তথ্যগুলোই সিবিআই বলে যাচ্ছে। আর এই ঘটনাটি নাইনথ আগস্ট ঘটার সঙ্গে সঙ্গে যে ক্ষোভ সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে সেই জনরোষ এখনও কিছু আদায় করে উঠতে পারেনি প্রশাসনের কাছ থেকে। সত্যিই এই পৃথিবীতে কি তার কোনও বন্ধু ছিল না যে তার কিছু ব্যক্তিগত কথা জানে? অন্তত তার খুনিরা হয়তো তার সঙ্গে আগে বচসার মধ্যে গেছে। কী এমন বচসা যেটা এইরকম মর্মান্তিক খুনে পরিণত হতে পারে? সে অভিভাবকদের তার চিন্তার কথা কিছু বলত না। দায়িত্ববান ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে চিন্তাভারাক্রান্ত করতে চায় না। কিন্তু তার বন্ধু বা সহকর্মীরা তো কিছু জানবে। জানি না পলিগ্রাফ টেস্ট বা নারকো করে ঘুঘু অপরাধীদের কাছ থেকে কিছু কথা বের করা যায় কিনা। আশা করব যায়।

প্রশাসনের একগুঁয়ে কথাবার্তা এখন বড় বিরক্তিকর লাগছে। সন্তান অপরাধ করলে তাকে শাস্তি দিতে হয়। ভুবন আর মাসির গল্পটা বোধ করি সবাই পড়েছেন। কিন্তু মনে রাখেননি।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4810 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...