তিলোত্তমা বাঁচতে চেয়েছিল

শ্রাবন্তী মিত্র

 


এবার কী হল? ক্ষোভের আগুনেও রাজনৈতিক প্রহসন আর দৈনন্দিন খোরাকি ধামাচাপা দেওয়া গেল না, নাকি পথের দাবি ভয় পাওয়াল একটু হলেও রাজতন্ত্রকে? যদি এ-ভয় সত্যি হয়, তাহলে জানবেন জয় আমাদেরই হবে। কিন্তু এ-ভয় যদি আরও বড় কোনও ধমকানিকে উস্কে দেয়, যদি প্রতিবাদের পরিণতিতে অন্ধকার ঘনায় আন্দোলনকারীদের ব্যক্তিগত যাপন জুড়ে, তাহলে তারা প্রত্যেকে আরও বিরাট আক্রোশ নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে দলে দলে, দিকে দিকে। তখন সে চাপ সামলাতে পারবে তো শাসকদল?

 

যে কোনও কিছুই ট্রেন্ডে চলে বাজারে। মিছিলও সেই ট্রেন্ডের বাইরে নয়। কিন্তু সেই মিছিল যদি নাগাড়ে জনপথের মধ্যিখানে অহরহ চলতেই থাকে? যদি সে মিছিলে প্রকাশ্যে শাসকদলের অকর্মণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়? যদি সেই মিছিল ক্রমাগত ধিক্কার জানায় মানব-সুরক্ষাকে? লুটিয়ে পড়ে পথের প্রান্তে কেবল সুবিচারের প্রার্থনায়? তবে কি সেই মিছিল আর ট্রেন্ড হয়ে পড়ে থাকে? নাকি সমগ্র মানবজাতির নিবিষ্ট হুঙ্কার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব কটি অন্ধগলিতে, যেখানে হয়তো এতদিন একটা প্রদীপও জ্বলে উঠত না।

এতদিন তিলোত্তমা বলতে আমরা জানতাম হলুদ ট্যাক্সি, ভিক্টোরিয়ার পরী আর দুর্গাপুজো। আজ তিলোত্তমা হয়ে উঠল জ্বলন্ত আগুনের অপর নাম। কিন্তু এ আগুন যে দাবানল হয়ে উঠতে পারে কজনে তা জানত? সবাই জানে, সব দেশে সব কালে আপস করে নিলেই সব মিটে যাবে। দুদিন মিডিয়া মাতামাতি করবে, তারপর তিনদিনের দিন সরকারি কয়েক লাখ টাকা খেসারত ঢুকে যাবে ঘরে ঘরে। আর বিচার? সে তো টাকা ফেললেই কিনতে পাওয়া যায়! কী হবে এসব ভেবে!

আমরা কখনও ভাবিনি আমাদের চাপা ক্ষোভই একদিন আমাদের পথে নামাবে, সারারাত, সারাদিন। আট থেকে আশি সকলকে নিয়ে। না, কেবল মহিলার সুরক্ষার কথা বলব না। রাজনৈতিক জাঁতাকলে আর ধারাবাহিকভাবে দেখতে থাকা সামাজিক অবক্ষয়ে, পুরুষ-নারী কেউই আজ সুরক্ষিত নয়। গত বছর যাদবপুরে স্বপ্নদ্বীপের মৃত্যুকাণ্ডে দেখেছি, কীভাবে একটি জ্বলজ্যান্ত ছেলেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়, এ বছর ঠিক ওই একই দিনে দেখলাম চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে। হয়তো দুটি ঘটনাই ভীষণভাবে সুপরিকল্পিত, হয়তো দুটি ঘটনার পিছনেই বিরাট দল ও বড় বড় মাথারা কাজ করছে— কিন্তু এই দুটি ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল কোথায় জানেন? দুটোই দেখিয়ে দিল দু-বছর পর পর যে— ১) পুরুষনারী-নির্বিশেষে গোটা সমাজ কতটা অসুরক্ষিত, ২) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এই গুরুত্বপুর্ণ দুই পিলারের পরিকাঠামো আজ কতটা নড়বড়ে। ঠিক সে কারণেই কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে এলে আমরা আর কেউ আশ্চর্য হই না।

একটা ধর্ষণ-হত্যা আজ আমাদের জানিয়ে দিল সরকারি হাসপাতাল ঠিক কতখানি দুর্নীতির আঁতুরঘর হয়ে উঠেছিল। জানিয়ে দিল, সাধারণ মানুষের মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসার জাল ঠিক কতদূর সুবিস্তৃত হয়েছে, জানিয়ে দিল দোষ ঢাকতে ঠিক কী কী উপায়ে তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে হয়, সর্বশেষ এও জানাল যে মৃত ব্যক্তি যদি মহিলা হয় তাহলে সবার আগে তাকেই দোষারোপ করা বর্তায়।

কিন্তু এত সব জানার পরেও সাধারণ মানুষের লড়াই থামেনি। তবে সাধারণ মানুষ বলতে ঠিক কারা? তারাও তো বাইরে বেরোয়, রাত করে বাড়ি ফেরে। ভোট দেয়, সরকারকে ঘরে ডেকে আনে, রাজনৈতিক মন্তব্যে মুখ লুকিয়ে রাখে, আবার প্রয়োজনে সরকার-বিরোধী প্রতিবাদেও থাকে। হয়তো এরা প্রত্যেকেই জানে এদেশে সুবিচার পাওয়া যায় না, তবুও মেরুদণ্ড সোজা রেখে দিনের পর দিন হাঁটার অদম্য জেদের এই চিত্র, শেষ বহু দশক এ-সমাজ দেখেছে কি?

আমরা তো রাজনৈতিক ঝান্ডার ভেদাভেদ আর বাকবিতণ্ডার স্রোতে গা ভাসিয়ে কমিক রিলিফ নিই প্রায় প্রতিদিন সন্ধেবেলা সোশাল মিডিয়ায়। রাজনীতিবিদরাও সেই কমেডির মান উন্নত করতে প্রতিদিনই চমকপ্রদ সব ঘটনায় ভরিয়ে রাখতে তৎপর হয় আমাদের। মাঝখান থেকে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে… এই তো চিরন্তনী সমাজব্যবস্থা! যাকে পাল্টাতে নয়, বরং বার দুয়েক ফিসফিস করে মানিয়ে নেওয়ার আবদারই জেনে এসেছে এতগুলো প্রজন্ম।

তাহলে এ বার কী হল? ক্ষোভের আগুনেও রাজনৈতিক প্রহসন আর দৈনন্দিন খোরাকি ধামাচাপা দেওয়া গেল না, নাকি পথের দাবি ভয় পাওয়াল একটু হলেও রাজতন্ত্রকে? যদি এ-ভয় সত্যি হয়, তাহলে জানবেন জয় আমাদেরই হবে। কিন্তু এ-ভয় যদি আরও বড় কোনও ধমকানিকে উস্কে দেয়, যদি প্রতিবাদের পরিণতিতে অন্ধকার ঘনায় আন্দোলনকারীদের ব্যক্তিগত যাপন জুড়ে, তাহলে তারা প্রত্যেকে আরও বিরাট আক্রোশ নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে দলে দলে, দিকে দিকে। তখন সে চাপ সামলাতে পারবে তো শাসকদল?

ভাবতে অদ্ভুত লাগে, যে মধ্যবিত্তশ্রেণির জনসাধারণকে প্রতিটি দিনে কর্মজগতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে অনবরত ঘামরক্তের ক্ষয় করে যেতে হয়, যে শ্রেণিকে সংসার চালাতে আজও পান থেকে চুনের হিসেব রাখতে হয়, যারা দু-দিন আগেও বাড়ি বসে উইকেন্ডে কী ওয়েবসিরিজ দেখবে, আর পুজোয় কবে কার সঙ্গে বেরোবে, তার প্ল্যানিং নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল— আজ কেমন তারা দৈনন্দিন যাপনের অনেকটাই সরিয়ে রেখে খোলা ময়দানে নেমে পড়ছে, প্রায় রোজ। প্রকাশ্যে আঙুল তুলছে পুলিশকে, নেতাকে, স্বাস্থ্যকর্মীকে, সিবিআইকে, মনুষ্যত্বকে, বিবেকবোধকে…

একদিকে যখন এ শহরে বাঁশ বাঁধা হচ্ছে বড় বড় মাঠ জুড়ে অনুদানের পঁচাশি হাজার দিয়ে, অন্যদিকে তখন আরেক দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টারে চোখে পড়ছে, “আমরা পুজো চাই না, বিচার চাই”। অসুরদলনীর এই বঙ্গভূমিতে এমন অভিমানী শরৎকাল এর আগে কক্ষনও দেখিনি আমরা। দেখতেও চাই না। চাই, প্রকৃত খুনিরা শাস্তি পাক। চাই, পথের কলরবে বিস্ফোরণ হোক রোজ, যাতে রাজনৈতিক ডালপালারা হাঁসফাঁস করতে পারে… অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও। যে তিলোত্তমা মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার জন্য ডানা ঝাপটেছিল, তার আত্মাকে এত সহজে বিলীন হতে দেবেন না।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4813 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...