ধামা-চাপা কভার-আপ, চাপ বাড়াও বাড়াও চাপ

আইরিন শবনম

 


এই আন্দোলন যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে নিশ্চয়ই তা কেবলমাত্র আরজিকর-এ আটকে থাকবে না। দেশের প্রতিটি কোণে প্রতিদিন কেন এত ধর্ষণ হয়, খুন হয়, অত্যাচার-অবিচার হয় মেয়েদের উপর— তা নিয়ে প্রশ্ন জাগবেই, এবং তখন নিশ্চয়ই এ সত্য বেরিয়ে আসবে যে— পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী এই সমাজকাঠামোই আসলে ধর্ষণ-সহ সমস্তরকম নারীনির্যাতনের আধার। সুতরাং তাকে অটুট রেখে নারী-সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। কিন্তু তার জন্য হাঁটতে হবে দীর্ঘ পথ

 

‘প্রতিবাদের আরেক নাম মৃত্যু— আরজিকর’— হ্যাঁ, ঠিক এই পোস্টারই পড়েছে হুগলির মাঝদিয়ার সেই স্কুলটিতে। যারা রবি ঠাকুরের গান গেয়ে, পোস্টার নিয়ে আরজিকরের ঘটনার প্রতিবাদ করেছিল। অবশ্য তার আগেই ‘আরজিকর করে দেব’— এই হুমকি এসে গেছে। কারা লাগাল এই পোস্টার, কেন এই হুমকি? প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ২৪ দিন। দোষী ধরা পড়ুক আর না পড়ুক একটা কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে এটি শুধুমাত্র একটি ধর্ষণের ঘটনা নয়, একটি পরিকল্পিত খুন এবং ধর্ষণের ঘটনা— যার পেছনে আছে একটা মাফিয়ারাজ। তার হাত কতদূর লম্বা তা এখনও স্পষ্ট না হলেও কিছুটা আন্দাজ করা যায়। কারণ দেশময় প্রতিবাদ, রাজ্য-রাজনীতি উত্তাল, অথচ শাসক যেন ‘বধির ও অন্ধ’ হয়ে গেছে।

আমাদের পোড়া দেশে ধর্ষণের ঘটনার তো কোনও অভাব নেই, কিন্তু এই প্রথম বোধহয় নারীরা এভাবে পথে নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। কলকাতা-সহ জেলায় জেলায় ১৪ আগস্ট রাতে যে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে তা নজিরবিহীন। এই মিছিলে কেবল যে সচেতন নারীরাই বেরিয়ে এসেছিলেন, তা নয়; সাধারণ গৃহবধূ, মা-কাকিমা, যাঁরা কোনওদিন কোনও মিছিলে হাঁটেননি— তাঁরাও সেদিন বেরিয়ে এসেছিলেন, চিৎকার করেছিলেন, কেঁদেছিলেন, বক্তব্য রেখেছিলেন। অনেক অনেকদিনের জমা বারুদে যেন এই ঘটনা আগুন ছুঁইয়ে দিয়েছে, বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে চারদিক, আর সেই সুযোগে দুর্বৃত্তরা প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় ভাঙচুর চালিয়ে গেছে আরজিকরে, পুলিশের চোখের সামনে। তারপরেও কিন্তু মানুষ থামেনি, মেয়েরা থামেনি। প্রতিদিন প্রতিবাদমিছিল বেরোচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে, বিভিন্ন পেশা থেকে। প্রত্যেকের প্রতিবাদের ধরন হয়তো এক নয়, কিন্তু চাওয়াটা এক— We Want Justice. জানি না শেষ পর্যন্ত সত্যিটা বেরিয়ে আসবে কি-না, ঘটনার সুবিচার হবে কি না!

কিন্তু এই ঘটনা সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের জীবনে একটা নড়চড় ঘটিয়ে দিয়েছে। এতদিন পর্যন্ত এই ধরনের ঘটনায় কিছু রাজনৈতিক দল (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে) এবং কিছু নারীবাদী গোষ্ঠী ছাড়া আর কাউকে তেমন প্রতিবাদ করতে দেখা যেত না, চাকুরীজীবী মেয়েদের (অধিকাংশ) তো নয়ই। তারা স্বামী-সন্তান ও আর্থিক স্বাচ্ছন্দের সুরক্ষিত বলয় ভেদ করে এসব ‘আজেবাজে’ ব্যাপারে কখনও জড়াত না। বলতে দ্বিধা নেই, যে সমাজ থেকে তারা উঠে এসেছে, সেই সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের জন্যও তাদের (অধিকাংশের) কোনও সহানুভূতি বা সহমর্মিতা লক্ষ করা যায় না। পাশে দাঁড়ানো, লড়াই করা, এসব তো ছেড়েই দিলাম। এক কথায় অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক জীবন তারা যাপন করে। সেই নারীদের সুরক্ষিত বলয় কিন্তু এবার কেঁপে উঠেছে। তারা ভীত হয়েছে, সন্ত্রস্ত হয়েছে, জোটবাঁধার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। ভরসা রাখতে পারছে না শাসক বা প্রশাসনের উপর, বেরিয়ে এসেছে প্রতিবাদ করতে। হয়তো প্রতিবেশী দেশের আন্দোলন সাহস জুগিয়েছে কিছুটা। ‘কী হবে এসব করে? কিছুই তো বদলাবে না’— এই জাতীয় হতাশা থেকে তারা বেরিয়ে এসেছে, সাময়িকভাবে হলেও। কিংবা এটাও হতে পারে যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এর বাইরে আর কোনও পথ ছিল না। যাইহোক, সম্মিলিত প্রতিবাদের, আন্দোলনের যে একটা ক্ষমতা আছে তা মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

অন্যদিকে এই আন্দোলনকে প্রথম থেকেই বাঁকাচোখে দেখছেন একদল মানুষ— না, তাঁরা রক্ষণশীল মানুষ নন, বরং লড়াই-আন্দোলন করা মানুষ এবং কিছু অতিবোদ্ধা। যাঁরা যে-কোনও আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই তার ভূত-ভবিষ্যৎ, তার ধর্মীয় বা লিঙ্গপরিচয় এবং শেষপর্যন্ত অশ্বডিম্ব প্রসব করার অবধারিত নিয়তি বলে দিতে পারেন। দেখে নিই এরকম কিছু মন্তব্য— “মেয়েরা রাত দখল করো, এইসব অতি আবেগপ্রবণ এবং ভাসমান স্লোগান আসলে ১৪ আগস্টের রাত্রি কাটানোর উৎসব। রাত্রি ১১.৫৫ এই সময় দখল করে কি ধর্ষণ আটকানো যাবে? আসলে এই ধরনের ভাবনা জেন্ডার বিভাজন বৃদ্ধি করবে।” রাতদখলের ভাবনা কী করে জেন্ডার বিভাজন বৃদ্ধি করবে তা আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ঢোকেনি। কারণ এ-মিছিলে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ এমন ফতোয়া জারি করা হয়নি, বরং সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। তাহলে আপত্তি কোথায়? মেয়েদের রাতদখলে? এসব স্লোগান বা কার্যক্রম যে প্রতীকী তা-ও বলে দিতে হয়?!! আসলে এই ধরনের উক্তির ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে থাকে ‘জেন্ডার বিভাজন’। যেহেতু এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে মেয়েরা সুতরাং তা-তো অতি আবেগপ্রবণ এবং ভাসমান হবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ মেয়েরা তো এরকমই। তারা সিরিয়াস কিছু করতে পারে নাকি! আসলে এটা হৈ-হুল্লোড় (উৎসব) করে রাত কাটানোর একটা অছিলা। এরকমভাবে যারা মেয়েদের স্ট্যাম্প মেরে দেয়, অপমান করে, তারা আবার জেন্ডার বিভাজনের দায় চাপায় মেয়েদের উপর! তাছাড়া এই মিছিলে একবারও বলা হয়নি যে, ছেলেরা যোগ দিতে পারবে না। সকলকে স্বাগত জানানো হয়েছিল, শুধু মিছিলের ডাক দিয়েছিল মেয়েরা। এতেই এত আপত্তি! তবে এই ধরনের মন্তব্য কেবল যে ছেলেরাই করেছে তা কিন্তু নয়, অনেক মেয়েও সমাজমাধ্যমে এই রাতের মিছিল নিয়ে এই ধরনের অপমানকর মন্তব্য করেছে, যার মোদ্দাকথা এই মিছিল শেষপর্যন্ত একটা সাজ-পোশাক দেখানোর এবং সেলফি তোলার উৎসবে পরিণত হবে। আমরা কিন্তু এই সমস্ত মন্তব্যে একটুও বিচলিত হইনি, কারণ যে পিতৃতান্ত্রিক মতাদর্শ ওই পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে, এই মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গিও সে-ই তৈরি করেছে, কোনও তফাত নেই। যদিও প্রায় প্রতিটি পেশায় মেয়েরা নিজেদের যোগতা প্রমাণ করে চলেছে, তবু আমাদের সমাজে আজও মেয়েদের এই চোখেই দেখা হয়। পূর্ণ মানুষের মর্যাদা আজও তারা অর্জন করতে পারেনি। আসলে মানুষের ভাবনাকাঠামোর পরিবর্তন খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাই নারীরা আজও প্রথমত এক জৈবিক সত্তা।

কিন্তু এত কিছুর পরেও যখন ১৪ আগস্ট রাতে যখন সারা বাংলা গর্জে উঠল ‘We want justice’ বলে, যখন হাজার হাজার নারী বেরিয়ে এল তাদের নিরাপত্তা বলয় ছেড়ে, আওয়াজ তুলল পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক বলে, তখন কিন্তু এই মন্তব্যকারীরা একটু হোঁচট খেল। বিশেষ করে এই ধরনের মিছিল যখন চলতেই লাগল— আজ এখানে কাল সেখানে। যখন তারা বুঝতে পারল এ কেবল প্রতিবাদের ফ্যাশন নয়, আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে, হয়তো তারা সহজে হাল ছেড়ে দেবে না, তখন বলা হতে লাগল— এই আন্দোলনকে অরাজনৈতিক রাখার ডাক দিয়ে আসলে এরা এক ধরনের রাজনীতি করছে। এটা নেহাতই একটা পেতিবুর্জোয়া আন্দোলন। সমাজের অন্যান্য সমস্ত শোষণকে অগ্রাহ্য করে কেবলমাত্র ধর্ষণকে একটি বিচ্ছিন্ন পুরুষ আধিপত্যবাদ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এই নেতৃত্ব কখনওই বৃহত্তর ন্যায়বিচারের কথা বলে না। সমাজের নিম্নশ্রেণির যোগদান এই আন্দোলনে নেই, কারণ এই আন্দোলন তাঁদের আর্থিক বা যৌন শোষণকে স্বীকার করে না। হ্যাঁ, একথা সত্যি যে, এই আন্দোলনে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের, বিশেষ করে সর্বস্তরের নারীদের যোগদান সেভাবে নেই, থাকলে ভাল হত। বিশেষ করে যাঁরা বিভিন্ন অনুদান পান, তাঁদের। কিন্তু সেজন্য তাঁদের সংগঠিত করা দরকার, সে দায় এরা নেন না কেন? সব দায় অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে শুধু আন্দোলনের খামতি খুঁজে বেড়ান!

এই অতিবিপ্লবীরা কী চান? প্রথমত, তাঁরা অতি আবেগে ভাসমান এই অরাজনৈতিক আন্দোলনকে নাকচ করতে চান। যখন দেখা যাচ্ছে তা সম্ভব নয়, তখন তাকে দিয়ে এক্ষুণি বিপ্লব করাতে চান। তাঁরা সমাজের নিপীড়িত শ্রেণির সার্বিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই চান। সর্বস্তরের মানুষের যোগদান চান। হ্যাঁ, সেসব করা গেলে তো ভালই হত, কিন্তু এই আন্দোলনের কাছে কি আমরা তা চাইতে পারি? অন্ততপক্ষে এখন? এটা একটা ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন। তার একটা নির্দিষ্ট ফোকাস আছে। সেই ফোকাস থেকে সরে যাওয়া কি এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

সকলেই জানেন এই আন্দোলন কোনও সুসংগঠিত আন্দোলন নয়। যাঁরা খবর দেখেন, সমাজমাধ্যম দেখে প্রতিক্রিয়া জানান, তারই একটি বর্ধিত রূপ। পার্থক্য এই যে তাঁরা সমাজমাধ্যমে আটকে না থেকে পথে নেমে এসেছেন। আসছেন। এবং এটা সকলের কাছে পরিষ্কার যে খুনি ও ধর্ষকদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে। এই আন্দোলন তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে চায়। নইলে তাঁরা স্লোগান দিতেন না— “শাসক তোমার কীসের ভয়/ধর্ষক তোমার কে হয়?”, “উন্নাহ থেকে আরজিকর/ সব শাসকের একই স্বর”, কিংবা ‘পিতৃতন্ত্র নিপাত যাক’, ‘বিচার যত দেরি হবে/গর্জন তত তীব্র হবে, ‘ধামা চাপা কভার আপ/চাপ বাড়াও, বাড়াও চাপ’, ‘ছিঁড়বে ধ্বজা ভাঙবে রথ/চূর্ণ শাসক, হোক শপথ’। এই সমস্ত স্লোগান কি কিছুই বলে না? যে ক্ষোভ, যে ভয় তাঁদের ঘর থেকে বের করে এনেছে, তা কি শাসকের বিরুদ্ধে নয়? এখন এই আন্দোলন থেকে যদি সমাজবদলের ডাকের প্রত্যাশা করা যায় তবে তা হবে নেহাতই বালখিল্যতা।

তবে এ-কথা ঠিক এই আন্দোলন যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তবে নিশ্চয়ই তা কেবলমাত্র আরজিকর-এ আটকে থাকবে না। দেশের প্রতিটি কোণে প্রতিদিন কেন এত ধর্ষণ হয়, খুন হয়, অত্যাচার-অবিচার হয় মেয়েদের উপর— তা নিয়ে প্রশ্ন জাগবেই, এবং তখন নিশ্চয়ই এ সত্য বেরিয়ে আসবে যে— পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী এই সমাজকাঠামোই আসলে ধর্ষণ-সহ সমস্তরকম নারীনির্যাতনের আধার। সুতরাং তাকে অটুট রেখে নারী-সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। কিন্তু তার জন্য হাঁটতে হবে দীর্ঘ পথ। আমরা সেই নতুন ভোরের দিকে তাকিয়ে আছি।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4810 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...