অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
গোড়া থেকেই এই আন্দোলনের এক প্রকট প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র সামনে উঠে এসেছে। কেবল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাই নয়, একই সঙ্গে তা প্রশাসন-বিরোধী ও রাজ্যের বর্তমান শাসক-বিরোধী এক সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। আবারও বলছি এই রাজনৈতিক চরিত্রকে সরাসরি দলীয় রাজনৈতিক চরিত্র বলে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বরং এক বৃহত্তর নাগরিক-রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবেই একে ভেবে নেওয়া উচিত
জনতার রাগ ক্রমশ বাড়ছে, এবং তা বেড়েই চলেছে। আরজিকর হাসপাতালের যে-ঘটনা ও তার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা যে-স্বতঃস্ফূর্ত নাগরিক-রাজনৈতিক আন্দোলন, তার বিকাশ যত হচ্ছে, ততই নতুনতর তথ্য/বিবৃতি সামনে আসছে। এক বিকৃত ঘৃণায় আমরা দুমড়ে যাচ্ছি। বিব্রত বোধ করছি ও ক্রমাগত বিরক্ত হয়ে উঠছি। এই আন্দোলনকে নাগরিক-রাজনৈতিক শব্দবন্ধে কেন ব্যাখ্যা করব, তার বিশ্লেষণ আগের এক নিবন্ধে করেছি। পুনরুক্তি ছাড়াই বলব, প্রত্যেক নাগরিক আন্দোলনেরই সুপ্ত অথবা প্রকট এক রাজনৈতিক চরিত্র থাকে। প্রথমদিকে আরজিকর আন্দোলনকে ‘অরাজনৈতিক’ ভেবে নিয়ে তার উপর বিবিধ দলীয় রাজনীতির প্রোপাগান্ডিস্টরা নিজেদের ‘বোধ’ চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত তা থেকে অনেকটাই বেরিয়ে আসা গিয়েছে। জুনিয়র ডাক্তারদের সংগঠন ও রাতদখলের কলাকুশলীরা মোটের উপর এই আন্দোলনের এক নিজস্ব পরিচিতি তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। তবুও, কিঞ্চিৎ সমন্বয়ের ঘাটতি অথবা দূরদর্শিতার অভাব যে চোখে পড়ছে না এমন নয়। তৎসত্ত্বেও বলব, স্বতঃস্ফূর্ত এই বিরাট আন্দোলন ক্রমশই পরিণত বুদ্ধির পথে এগিয়েছে। তাই সাধারণ পর্যবেক্ষক হিসেবে এই নিবন্ধে দুটি নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতি আন্দোলনকারী ও সাধারণ জনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
প্রথম বক্তব্যটি তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে। ৪ সেপ্টেম্বর, রাতদখলের দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলনে প্রথমবার ‘তিলোত্তমা’র পরিবারের সদস্যেরা সরাসরি সেই প্রতিবাদে সামিল হন। তাঁদের বক্তব্যে সেদিন প্রথমবারের জন্য একগুচ্ছ ভয়াবহ অভিযোগ সামনে উঠে আসে। অভিযোগগুলিতে বিস্তারিত না গিয়ে মূল তিনটি মারাত্মক অভিযোগের দিকেই ইঙ্গিত করব, সেগুলি হল—
- পুলিশ ও আরজিকর হাসপাতালের একাধিক বরিষ্ঠ চিকিৎসকের তরফে সেদিন নাকি সাদা কাগজে সই করে দেওয়ার জন্য তিলোত্তমার পরিবারের সদস্যদের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
- কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ আধিকারিক তিলোত্তমার পরিবারকে নাকি টাকা দিতে চেয়েছিলেন।
- পরিবারের অভিযোগ, তাঁরা দেহ সংরক্ষণ করতে চাইলেও পুলিশ ও প্রশাসনের তরফে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়, যার কারণে তাঁরা সৎকারে সম্মতি দিতে কার্যত বাধ্য হন। প্রশাসনিক তদারকিতেই তড়িঘড়ি তিলোত্তমার দাহ-কাজ সম্পন্ন হয়।
প্রথম দুটি অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে নিরপেক্ষ তদন্তের পর তার ফলাফলের ভিত্তিতে অবিলম্বে সেই সব পুলিশ আধিকারিক ও বরিষ্ঠ চিকিৎসকদের সকলের বিরুদ্ধে কঠোরতম আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে আমাদের সবচেয়ে আগে সোচ্চার হওয়া উচিত। অনেকদিন যাবৎ সাধারণ দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এই ঘটনায় বরিষ্ঠ চিকিৎসকদের লঘু ধারায় বের করে আনার ও একই সঙ্গে নাগরিক আন্দোলনের অভিমুখটিকে অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা হয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গে, পুলিশ, প্রশাসন ও প্রত্যেক বরিষ্ঠ চিকিৎসক, যারা এই খুন ও ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে অথবা তার পরবর্তীতে প্রমাণ লোপাটের পরিকল্পনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের সকলের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট এই অভিযোগগুলির ভিত্তিতে সরাসরি আঙুল তোলার সময় এসেছে। সন্দীপ ঘোষের দুর্নীতির তদন্ত কখনওই এই আন্দোলনের মূল দাবি বা উদ্দেশ্য ছিল না। এ-কথা স্পষ্ট করেই সকলের বুঝে নেওয়া উচিত।
তৃতীয় যে অভিযোগ, অর্থাৎ কিনা দেহ সংরক্ষণের পরিবর্তে জোর করে তা পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ, এই ঘটনা কেবল যে হাথরাসের বীভৎসতাকেই মনে পড়ায় তাই নয়— তিলোত্তমা আন্দোলনের শুরুর সময়ে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনাকেই এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা উচিত।
মনে রাখতে হবে, ঘটনার পরেপরেই বিশেষ এক রাজনৈতিক দল ঘটনার বীভৎসতাকে কার্যত পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, নিজেদের রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা বাড়ানোর প্রয়োজনে একাধিক বিকৃত তথ্যকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্টেরও একাধিক ভুয়ো প্রতিলিপি সুকৌশলে সমাজমাধ্যমে ছড়ানো হতে থাকে। অবশেষে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার গেলে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির এজলাসে সিবিআইয়ের তরফে ময়নাতদন্ত-সম্পর্কিত যে-সকল তথ্য পেশ করা হয়, তাতে তিলোত্তমার শারীরিক আঘাত সম্পর্কে একাধিক ভুয়ো তথ্যই যে বিকৃতভাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছিল, সেই তথ্যই সামনে উঠে আসে। একাধিক জাতীয় সংবাদমাধ্যমের তরফে এই খবর প্রকাশ করা হয়।[1][2][3][4]
অথচ ৪ সেপ্টেম্বর ঘটনার প্রায় একমাস পর, তিলোত্তমার পরিবারের তরফে দেহ লোপাট ও জোর করে সৎকার— এই যে দুটি মারাত্মক অভিযোগ তোলা হয়েছে, তারপর সঙ্গত কারণেই জনমানসে কৃত-ময়নাতদন্তের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে আসবে। এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করতে হয়, ময়নাতদন্তে অংশ নেওয়া এক বরিষ্ঠ চিকিৎসক অবধি সিবিআই জেরার মুখোমুখি হওয়ার পরেপরেই আকস্মিক অসুস্থতায়, এই লেখা পাঠানোর সময় অবধিও সঙ্কটজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এই ক্ষেত্রে তাই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ময়নাতদন্তের যে ভিডিওগ্রাফি হয়েছিল বলে সংবাদে প্রকাশ, তার ফুটেজটিকে যথাযথ নিরাপত্তায় সংরক্ষণ করা। সেই তথ্য অনুসারে জানা যাচ্ছে ঘটনার দিন বিকেল ৪টে ২০ মিনিটে বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে তিলোত্তমার ময়নাতদন্ত হয়, সেই তথ্য ভিডিও-বন্দি করা হয়, এবং তাঁর মা সেই ময়নাতদন্তের রিপোর্টে সই করেন। আশা করা যায় সেই রিপোর্ট ও ভিডিওগ্রাফির সমস্ত তথ্য ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ আদালতের হেফাজতে পেশ করা হয়েছে। সেই রিপোর্ট ও ফুটেজ সংরক্ষণের বিষয়টিই এখন সংশ্লিষ্ট সকল তদন্তকারী সংস্থা ও আন্দোলনকারী ছাত্রদের তরফে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত।
এরপর আসা যাক আমার দ্বিতীয় বক্তব্যের প্রসঙ্গে। যার মাধ্যমে আমি খুঁজে দেখতে চেষ্টা করেছি এই নাগরিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সার্বিক ভবিষ্যৎ।
সঙ্গত কারণে গোড়া থেকেই এই আন্দোলনের এক প্রকট প্রতিষ্ঠানবিরোধী চরিত্র সামনে উঠে এসেছে। কেবল প্রতিষ্ঠানবিরোধিতাই নয়, একই সঙ্গে তা প্রশাসন-বিরোধী ও রাজ্যের বর্তমান শাসক-বিরোধী এক সুস্পষ্ট রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করেছে। আবারও বলছি এই রাজনৈতিক চরিত্রকে সরাসরি দলীয় রাজনৈতিক চরিত্র বলে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। বরং এক বৃহত্তর নাগরিক-রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবেই একে ভেবে নেওয়া উচিত। এই চরিত্র গড়ে ওঠার পিছনেও সম্পূর্ণ দায় সরাসরি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ও বর্তমানে একচ্ছত্র রাজনৈতিক শাসক হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের উপরেই বর্তায় বলে মনে করি।
প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে এই জঘন্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঞ্জয় রাইকে গ্রেফতার-ভিন্ন নাগরিক আবেগকে মর্যাদা দিতে আর একটিও সদর্থক, সম্পর্কযুক্ত পদক্ষেপ ৩ সেপ্টেম্বর তারিখ অবধিও না নেওয়া (ওইদিন সিবিআই গ্রেফতারির পরবর্তীতে আরজিকর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড করা হয়), উলটে একাধিক ক্ষেত্রে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য, একদা ‘জননেত্রী’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জনতার আবেগের এই কাঠগড়ায় আজ এনে দাঁড় করিয়েছে। তারই সঙ্গে যোগ হয়েছে তাঁর দলের বিরুদ্ধে ওঠা একাধিক ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতির অজস্র অতীত অভিযোগ, ও তদুপরি নেত্রীর পথ ধরেই একাধিক বরিষ্ঠ তৃণমূল নেতা ও জনপ্রতিনিধির তরফে চূড়ান্ত কুরুচিকর বক্তব্য প্রচার। ৪ সেপ্টেম্বর রাতে কোচবিহারের মাথাভাঙায় শাসকদলের গুণ্ডাদের তরফে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের উপর নির্লজ্জ আক্রমণ, নৈহাটিতে অনুরূপ আক্রমণ, অথবা সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার, বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিক, মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, পৌরপ্রতিনিধি তারক সিংহ প্রমুখের তরফে প্রকাশ্যে অথবা সামাজিক মাধ্যমে একাধিক দাম্ভিক ও অশ্রাব্য বয়ান— ক্রমশই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে দিয়েছে। এমতাবস্থাতেও রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের তরফে যে হিরণ্ময় মৌনতা, তার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আমি আরও একটি রাজনৈতিক কূট-চালের ব্যবহার আশঙ্কা করছি।
বিবিধ রাজনৈতিক দলের তরফেও যেমনভাবে এই আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক লাভ তোলার চেষ্টা হয়েছে, তেমনই বৃহত্তর ক্ষেত্রে জনমানসে বর্তমান শাসকের প্রতি দীর্ঘসময় ধরে যে একটি সুপ্ত ক্ষোভ এতকাল একচ্ছত্র আনুগত্যের পর ক্রমশই বিস্ফোরণের আকারে সামনে চলে এসেছে তা আর অস্বীকার করা চলে না। কাজেই দলীয় রাজনীতির বাইরেও, সাধারণ নাগরিকদের আলোচনায় এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ফলশ্রুতি হিসেবে রাজনৈতিক পট-পরিবর্তন সম্ভব কিনা, অথবা শাসক-পরিবর্তনের বিষয়টি এখন কতখানি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই বিষয়ক আলোচনা শোনা যাচ্ছে। স্বভাবতই উঠে আসছে ২০০৬-১১-র রাজনৈতিক পরিবর্তনের আখ্যান। অনেকেই এই আন্দোলনকে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম সময়ের পরিবর্তনের আন্দোলনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাইছেন। সেই তুলনার সপক্ষে ও বিপক্ষেও মত উঠে আসছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেই আন্দোলনের সঙ্গে বর্তমান আন্দোলনের যে অনেকগুলি অমিল রয়েছে তার মধ্যে প্রধান হল,
- সেই আন্দোলনে তৎকালীন শাসকের রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে সরাসরি তৃণমূল কংগ্রেস নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল, এবং
- সেই নাগরিক-রাজনৈতিক আন্দোলন কিন্তু গড়ে উঠেছিল গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষকে সরাসরি আঘাত করেছে এমন এক ইস্যুর ভিত্তিতেই।
মনে রাখতে হবে, সত্তর বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে দুবার মাত্র পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটেছে দুবারই কিন্তু সেই আন্দোলন গ্রামবাংলার পটভূমিতেই গড়ে উঠেছিল। শহর কলকাতা রাজনৈতিক ক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদি ভরকেন্দ্র হলেও পট পরিবর্তনের অঙ্কুরোদ্গমের প্রয়োজনে শহুরে তাত্ত্বিক বুদ্ধিজীবীদেরও কিন্তু গ্রামবাংলারই মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়েছিল।
বর্তমান এই আন্দোলনের সময়, শাসক তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী যে দল, বিজেপি— তারা কিন্তু কোনওভাবেই এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে না। ‘পাবে না’ এ-কথা না বলে, ‘পেতে পারে না’ বলছি কারণ, গণতন্ত্রে আমাদের মতো তথাকথিত তাত্ত্বিক নয়— সাধারণ মানুষই আদিঅনন্তকাল-যাবৎ শেষ কথা বলে এসেছে। কাজেই ভবিষ্যৎ কী হবে নিশ্চিত করে আমাদের পক্ষে তা বলা অসম্ভব।
অথচ অন্যদিকে বিকল্প বাম অথবা কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল জোট, অন্তত শেষতম নির্বাচনেরও ফলাফল অনুযায়ী সাংগঠনিকভাবে চূড়ান্ত অবিন্যস্ত ও পর্যুদস্ত অবস্থায় রয়েছে। সাধারণ গণতন্ত্রে সদর্থক বিরোধী-পরিসর এভাবে সঙ্কুচিত হয়ে আসার পিছনে সরকারের যেমন, তেমনই আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও যথেষ্ট দায় রয়েছে। যদিও সে-প্রসঙ্গ এখানে অবান্তর। এখন, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই গড়ে ওঠা এই বিরাট ক্ষোভ, খুব সহজাত কারণেই গণতন্ত্রের জটিল অঙ্কে বিজেপির দিকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অথবা, শেষ অবধি আবারও বিরোধী ভোট ভাগাভাগি হয়ে গিয়ে ‘লেসার ইভিল’ তত্ত্বে ভর করেই মাননীয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট বৈতরণী পার হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু ২০২৬-এর আগে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাজ্যে কোনও বড় নির্বাচন নেই, সেক্ষেত্রে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির দিকেই পাল্লা ঝুঁকে রয়েছে। ততদিন অবধি নাগরিক নেতৃত্বে এই আন্দোলন রাজনৈতিক আঙ্গিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। এই প্রেক্ষিতে মাননীয়া বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘লেসার ইভিল’ তত্ত্বের ধারণাতেই আরেকটি কূট চাল চালতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে মনে হয়।
এ-কথা সত্যি নারীনির্যাতন বা লিঙ্গভিত্তিক এই জঘন্য অপরাধের তীব্রতা সারা বাংলাকে ছুঁয়ে যেতে পেরেছে। কিন্তু কলকাতা বা মফস্বলের বড় শহরগুলিতে এই আন্দোলনের যত না প্রভাব দেখা গিয়েছে, প্রান্তিক গ্রামের মানুষকে কিন্তু এই আন্দোলন ততখানিও ছুঁতে পেরেছে কিনা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। যে কারণেই, শাসক-ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমে এই প্রশ্নও উঠতে দেখা যায়— গ্রামবাংলার প্রতিটি ধর্ষণের ক্ষেত্রেই তিলোত্তমার আন্দোলনকারীরা এভাবে সরব হবেন তো? নাকি এই বিচারের দাবি কেবল তিলোত্তমার প্রয়োজনেই?
দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রাতদখলের কাণ্ডারীরা এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলে এসেছেন, তাঁদের দাবি ও আন্দোলনপদ্ধতি থেকেই একথা স্পষ্ট, নারীর উপর প্রত্যেক অত্যাচার, প্রত্যেক অন্যায়কে রুখে দিতেই তাঁদের এই সংগ্রাম-আন্দোলন। জেলা-মফস্বল-গ্রাম— একাধিক পরিসরে রাতদখলের স্থানীয় নেতৃত্বের তরফে অসংগঠিত, প্রান্তিক মহিলাদের এই সার্বিক আন্দোলনে সংগঠিত করার কাজ চলেছে। কিন্তু যত শীঘ্র সম্ভব তার প্রত্যক্ষ প্রভাব সামনে তুলে আনতে না পারলে এই আন্দোলনকে কিন্তু শহর-বনাম-গ্রাম, এই দ্বণ্যুক সম্পর্কে ফেলে দেওয়ার সরকারি চক্রান্ত গতিলাভ করবে।
কাজেই দীর্ঘমেয়াদি লড়াইতে সার্বিক পরিকল্পনাভিত্তিক, কুশলী আন্দোলন তৈরি হোক। রাতদখলের ভবিষ্যতের লড়াই স্বতঃস্ফূর্ত থেকে সার্বিক হয়ে, বৃহত্তর সমষ্টির প্রতিনিধিস্বরূপ— আরও পরিণত হয়ে উঠুক। কোনও চক্রান্তই যেন তাকে বিদ্ধ করতে না পারে। আজকের এই অন্ধকার সময়ে কেবল এইটুকু আলোরই প্রত্যাশী হয়ে থাকব।
সব অন্যায়েরই সার্বিক বিচারের দাবিকে আজ, যেন কোনওদিন কোনওভাবেই, কোনও স্বার্থান্বেষীর দল শ্রেণির পরিসরে টুকরো করতে না পারে— এই বিশ্বাস আমাদের মনে অক্ষয় থাকুক। এই লক্ষ্যেই যেন আমাদের পথ হেঁটে যাওয়া জারি থাকে, আজ থেকে অনন্তকাল।
[1] Chaudhuri, Monalisa. RG Kar rape and murder case: A week on, what we know and what we don’t. The Telegraph. Aug 17, 2024.
[2] Mehrotra, Khushi. Misleading claims about post-mortem report in the RG Kar case go viral. The Quint. Aug 28, 2024.
[3] Mukul, Sushim. Kolkata rape-murder case: How facts stand out from spectacular fiction. India Today. Aug 22, 2024.
[4] Bhattacharya, Oishani & Sinha, Pratik. Pelvic girdle, hyoid bone broken? RG Kar victim’s post-mortem report says no fracture found. Alt News. Aug 21, 2024.
*মতামত ব্যক্তিগত