অশোক মুখোপাধ্যায়
এনকাউন্টারের রাস্তায় না গেলে, “যে করেই হোক চোর চাই” রাস্তায় না গেলে, অপরাধীকে ধরতে এবং বিচার দিতে সময় লাগবে। তাতে এক মাস যথেষ্ট সময় হতে নাও পারে। দু-বছরও লাগতে পারে। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে জনস্রোতের আবেগকে আঁচলে পুরতে বিধানসভায় একটা “অপরাজিতা বিল” এনে এক মাসের মধ্যে বিচার এবং অবশেষে ফাঁসির ব্যবস্থার নিদান সাজিয়ে ফেলেছেন। আইনের ধারা দিয়ে যে ক্রিমিন্যালকে ধরা যায় না, তা যে ধরার পরে কাজে লাগে, এবং সেই সময়টা যে বিধায়কদের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যায় না— এই সহজ সত্যটা তাঁকে বোঝাবে এমন মাথা কার ঘাড়ে কটা আছে?
বিচার চাই। ন্যায়বিচার চাই। খুবই স্বাভাবিক ন্যায্য দাবি।
আরজিকরের পৈশাচিক ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও বিচার এবং দোষীদের কঠোর সাজা চাই। খুবই স্বাভাবিক ও ন্যায্য দাবি।
কিন্তু, এক মাসের মধ্যে বিচার চাই— কোনও যুক্তিসঙ্গত দাবি নয়।
“আর কবে?”— আবেগ হিসাবে ঠিক আছে। কিন্তু এও কোনও যুক্তিসম্মত আকাঙ্ক্ষা নয়।
রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নৃত্যনাট্য “শ্যামা” স্মরণ করুন। প্রথম গান।
চুরি হয়ে গেছে রাজকোষে।
চোর চাই।
যে করেই হোক চোর চাই।
আমার বা আপনার আকাঙ্ক্ষাটা যেন এরকম না হয়ে যায়।
এনকাউন্টারের রাস্তায় না গেলে, “যে করেই হোক চোর চাই” রাস্তায় না গেলে, অপরাধীকে ধরতে এবং বিচার দিতে সময় লাগবে। তাতে এক মাস যথেষ্ট সময় হতে নাও পারে। দু-বছরও লাগতে পারে। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ করে জনস্রোতের আবেগকে আঁচলে পুরতে বিধানসভায় একটা “অপরাজিতা বিল” এনে এক মাসের মধ্যে বিচার এবং অবশেষে ফাঁসির ব্যবস্থার নিদান সাজিয়ে ফেলেছেন। আইনের ধারা দিয়ে যে ক্রিমিন্যালকে ধরা যায় না, তা যে ধরার পরে কাজে লাগে, এবং সেই সময়টা যে বিধায়কদের মতামতের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা যায় না— এই সহজ সত্যটা তাঁকে বোঝাবে এমন মাথা কার ঘাড়ে কটা আছে?
আমাদের “আর কবে” আবেগ সবেগে ধাবিত হোক, ধর্ষণ নামক এই পাপাচার থেকে ভারতীয় তথা বঙ্গসমাজের উদ্ধার আর কবে হবে, সেই দিকে। আমরা “আর কবে” বলতে পারব, বসন্ত রোগের মতো ধর্ষণও সম্পূর্ণ অপনোদন হয়ে গেছে? শিল্পীর আবেগকে আমি ছোট করছি না। যাঁরা সেই আবেগে ভেসে যাচ্ছেন তাঁদেরও আমি আঘাত করতে চাই না। কিন্তু আমাদের আবেগকেও তো বুদ্ধিদীপ্ত হতে হবে। এমনকি চূড়ান্ত শোকের মুহূর্তেও।
এই অন্যায্য আবেগজনিত আকাঙ্ক্ষাই জনদাবি হয়ে হেতাল পারেখের হত্যার জন্য লিফটচালক ধনঞ্জয়ের ফাঁসি সম্ভব করেছিল। আজ সকলেই জানেন— এমনকি মীরাদেবীও— ধনঞ্জয় অপরাধী ছিল না। আসল অপরাধীরা— খুব সম্ভবত মেয়েটিরই খুব কাছের স্বজন— আজও অধরা রয়ে গেছে।
তিলোত্তমার ঘটনায় আদৌ কি বিচার হবে? অপরাধীরা শাস্তি পাবে? ধর্ষক-খুনিরা কি ধরা পড়বে? পুঁটির সঙ্গে বোয়ালরাও?
বলা মুশকিল। দুটো কারণে।
প্রথমত কার্ল মার্কসের এক বিখ্যাত মন্তব্য স্মরণ ও অনুকরণ করা যাক। উনি বলেছিলেন, The ideas of the ruling class in every epoch are the ruling ideas. আমি বলতে চাইছি, The elements of the ruling party are the ruling elements in every regime. এ হচ্ছে প্রথম বাধা। শুধু আরজিকর নয়, কোনও মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে, স্বাস্থ্য-দফতরে কোনও অপরাধচক্র বাসা বাঁধতে পারে না, যদি তা শাসকদলের আশ্রয় ও প্রশ্রয় না পায়। এই আশ্রয় আর প্রশ্রয়ের আমরা সরল লোকেরা যে সরলতর রূপ কল্পনা করে থাকি— দলের লোক, টাকা তোলে আর উপরে হিস্যা পাঠায়, পছন্দের লোককে সাহায্য করে আর যাদের অপছন্দ করে তাদের ডুবিয়ে দেয়, ইত্যাদি— অপরাধের ধরন, ব্যাপ্তি ও কু-ধন বণ্টনের তরিকা, এক কথায় সেই সবই বদলে গেছে। আজ নয়, অনেক দিন আগে থেকেই। এই জালচক্রে শাসকদল আছে, বিরোধী দল আছে, প্রশাসনের চাঁই আছে, খ্যাতিমান বিত্তবান লোক আছে, অত্যন্ত প্রভাবশালী লোক আছে, আবার এমনকি আমার-আপনার মতো সিধেসাদা লোকজনও আছে। কাজ এবং দায়িত্বের ভাগাভাগি আছে। সেই অনুযায়ী তথ্যজ্ঞান এবং পরিচিতিরও। কে কতটা জানবে এবং কে কাকে চিনবে।
এর মধ্যে শাসকদলের মুখটাই আমরা খানিক দেখতে পাই। বাস্তব কারণেই। আর শাসকদলের বুদ্ধির মাত্রানুসারে তার ব্যস্তানুপাতে দেখা যায়। ১৯৮২ সালে কোচবিহারের মহারাজা দীপ্তেন্দ্রনারায়ণ হাসপাতালের নার্স বর্ণালী দত্ত যখন নিজের কোয়ার্টারে দিনেদুপুরে আক্রান্ত হয়ে খুন হন, সেদিনও যারা অপরাধী তারা তদানীন্তন (বড়) শাসকদলের প্রশ্রয়েই কাজটা নির্ঝঞ্ঝাটে সারতে পেরেছিল। নব ব্যারাকপুরের যে নেতাকে তার আগে দল পাঠিয়েছিল সেই জেলার স্বাস্থ্য-দফতরের পার্টি সেলের কাজ দেখাশোনা করতে, তাকে রাতারাতি তুলে ফেরত নিয়ে আসে তার বাসভিটায়। সেবারেও অপরাধী ধরা পড়েনি। বর্তমান প্রজন্মের হয়তো সেই বর্ণালী দত্তের নাম আজ আর মনে পড়বে না। নামটি উচ্চারণ করায় বেয়াল্লিশ বছর বাদে পুলিশও সম্ভবত আমাকে বা এই প্ল্যাটফর্মকে আর নোটিস ধরাবে না।
তা, এবারেও একই কারণে (ruling elements in every regime are the elements of the ruling party থিসিস মোতাবেক) জাল কেটে খুনি ও ধর্ষকদের ধরার সম্ভাবনা খুবই কম। আর ধরলেই তো হবে না। তারাই যে খুনি ও ধর্ষক, তার ঠাসা বস্তুময় সাক্ষ্য প্রমাণ (solid material evidence) সংগ্রহ করতে হবে, যা আদালতকে খুশি করতে পারবে। তার সম্ভাবনা বেশ কম। আর নতুবা— হ্যাঁ আবার বলছি— দ্রুত একটা ধানঞ্জয়িক বিচার হয়ে বসবে।
দ্বিতীয়ত, এবারের আরজিকরের ঘটনায় অপরাধের জায়গাটা এমন যে প্রায় সাক্ষ্যপ্রমাণ না রেখেই খুন ও ধর্ষণের কাজটা অপরাধীরা সেরে ফেলতে পেরেছে। একজন ছাড়া আর কাউকে ধরার মতো এখন পর্যন্ত কোনও দৃশ্যমান সাক্ষ্য পাওয়া যায়নি। প্রমাণ লোপাটের কথা শোনা যাচ্ছে বটে। সে সম্ভাবনাও প্রচুর পরিমাণে আছে। এমনকি যেখানে লাশ পাওয়া গেছে, সেখানেই যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে, এমনটা নাও হয়ে থাকতে পারে। ঘর ভাঙার গল্পটা সেই ঘরের দিকেই নজর আটকে রাখার জন্যও হয়ে থাকতে পারে, যাতে অন্যত্র “প্রকৃত ঘটনাস্থল” খুঁজতে তদন্তকারী দল আগ্রহী না হয়। তাই আমার ধারণা, “প্রমাণ” লোপাটের চেষ্টা না হলেও খুব বেশি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ এই কেসে পাওয়ার অবস্থা প্রথম থেকেই ছিল না বা নেই। একমাত্র যদি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ গোপন তদন্তে নামে এবং সমস্ত প্রভাববৃত্তকে উপেক্ষা করে আড়ালে স্বাধীনভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে, তবে ছ-মাস বা এক বছরের মাথায় হয়তো কিছু কিনারা হলে হতেও পারে।
না হলে, একবার ভেবে দেখুন, যে বিশাল দীর্ঘকালীন র্যাকেটের সন্ধান আভাসে ইঙ্গিতে উঠে আসছে, সেগুলো সম্পর্কে আজকে যাঁরা মুখ খুলছেন, তাঁদের সংগঠনগুলো এতদিন চুপ করে বসেছিল কেন? চিকিৎসকদের একাধিক সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, ইত্যাদি? একজন একক ব্যক্তির পক্ষে একটা অবতল দুষ্কৃতি-গ্যাঙের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় ঝামেলা আছে, বিপদ আছে। কিন্তু সংগঠন? তারা কেন চুপ করে থাকবে? কেন ছিল?
একটাই কারণ। উচ্চতর প্রভাববৃত্তের পরিধি ভেঙে ঢুকতে কেউই সহসা চায় না। সোজা কথায় ঘাঁটাতে চায় না। সংগঠনও নয়। বিরোধী সংগঠনও নয়। এ হল আমাদের বাস্তব সমাজের কঠোর বাস্তব ছবি। ডাক্তাররা যে মেরুদণ্ড মেমেন্টো নিয়ে ঘুরছেন, সবাইকে দিতে চাইছেন, তাঁরাও জানেন, মনের গহনে স্বীকারও করেন, শুধু শাসকদলের ধামাধরারা নয়, শুধু গতকালের বা আজকের শাসকদের তাঁবেদাররা নয়, সমাজের এক বিরাট অংশের মধ্যেই মেরুদণ্ড এখন কার্টিলেজগঠন-ধন্য। স্পন্ডিলাইটিস না হলে এবং/অথবা এক্স-রে না করলে তার অস্তিত্ব তেমন করে ধরা পড়ে না!
না হলে ভাবুন না, গত পরশু (৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪) দিনের বেলায় উন্মুক্ত রাজপথের উপরে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে যখন ধর্ষণের ঘটনাটা ঘটছে, তখন চারপাশে অনেক লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে। এবং তারা চুপচাপ দর্শকের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে ভিডিও তুলছে মোবাইলের ক্যামেরায়। কেউ বাধা দিতে বা মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছে না! এটা কী করে সম্ভব হয়? কখন সম্ভব হয়? রাজ্য সরকার না হয় বিজেপি-র হতে পারে। কিন্তু সেই রাস্তার লোকগুলোও সবাই কি বিজেপি ছিল? ধর্ষকপূজারী গেরুয়া সেনা ছিল? না, তা নয়, স্রেফ মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ। হোমো টরপিডেন্স। শুধু ওরা নয়, ওখানেই নয়; আমরাও, এখানেও। দু-চারজন নয়, অনেক, অসংখ্য।
তাহলে এই যে এত আন্দোলন আমরা করছি, রাত জাগছি, রাত এবং রাস্তার দখল নিচ্ছি, এর কি কোনও মূল্য নেই? সবই ব্যর্থ হয়ে যাবে?
না। প্রশ্নই নেই। ইতিমধ্যেই অনেকগুলি ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। সেগুলি দেখতে হবে। চিনতে হবে।
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলিকে কেন্দ্র করে যে র্যাকেট আজকে উন্মোচিত হয়ে যেতে চলেছে, এটা এই আন্দোলনেরই ফসল। দশ-বিশটা লোকও যদি ধরা পড়ে, চক্রটা ভেঙে যাবে এবং সামনে অনেক দিন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। একজন তিলোত্তমাকে বাঁচানো যায়নি। তাঁর খুনি-ধর্ষকরাও সকলে যদি ধরা না পড়ে, অন্তত অনেক দিন আর কোনও তিলোত্তমাকে প্রাণ দিতে হবে না! এরকম একটা নিশ্চিতির বাতাবরণ তৈরি হয়েছে বর্তমান আন্দোলনের জোরে।
অনেক কাল পরে এবার মনে হচ্ছে সিবিআই খানিক বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করছে। তাড়াহুড়ো করছে না। ঢাকঢোল পেটাচ্ছে না। সঙ্গে চ্যানেল গুচ্ছের ওবি ভ্যান নিয়ে ঘুরছে না। প্রতিদিন প্রকাশ্যে মিডিয়ার কাছে ক্রাইমের বিরুদ্ধে ফাইট করার গরম গরম বাইট দিচ্ছে না। অভিযুক্ত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে গ্রেফতার না করে ষোলো দিন ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। চারদিকে সবাই অধৈর্য— এখনও তুলছে না কেন? সেটিং তত্ত্বের পসরা আরও একবার ঘুরপাক খেতে শুরু করল।
অথচ, ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই বিচারপ্রার্থীরা বুঝতে পারতেন, গ্রেফতার করলেই ঘোষ মুখ বন্ধ করে ফেলত। বলত, আমাকে আদালতে তুলুন, সেখানেই আমার সমস্ত বক্তব্য আমার উকিল বলবে। গ্রেফতার না করায়, জিজ্ঞাসাবাদে তাকে সাড়া দিতে হয়েছে। এই প্রশ্নোত্তরের ফাঁকে ফাঁকে নানারকম অসমঞ্জস কথা সিবিআই টুকে নিয়েছে। সেগুলো বাইরে পোস্টার করেনি। নানারকম ছবিটবি দেখে ঘোষের সাগরেদদের চিহ্নিত করেছে। রাজ্য প্রশাসনের সাহায্যেই তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করেছে।
সন্দীপ ঘোষকে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর আরজিকর থেকে পদত্যাগ করার পরে এদিক-ওদিকে পোস্টিং দেওয়াতেও অনেকেই প্রচুর অসন্তোষ ব্যক্ত করেছেন। এটাও যে (সম্ভবত রাজ্য পুলিশ ও সিবিআইয়ের মধ্যে কথাচালাচালির ভিত্তিতে) একটা দারুণ প্রশাসনিক চাল তাঁরা ধরতে পারেননি। সে বিভিন্ন ভাল পদে অধিষ্ঠিত থাকায় তার সঙ্গীসাথীরা খুবই নিশ্চিন্ত ছিল— আমাদের গায়ে হাত পড়ছে না। স্যার আছে, ঠিক দেখে রাখবে। ফলে তারা যে যার বাড়িতে ভালই ঘুমচ্ছিল। অপরাধের সাক্ষী কাগজপত্রও তাদের বাড়িতেই সু(?)রক্ষিত ছিল। তাই গত ৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ-সকালে যখন ইডি-র একাধিক টিম সাঁতরাগাছি, বৈদ্যবাটি, ক্যানিং, সুভাষগ্রাম, ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে গেল, তারা স্বভাবতই হতবাক।
আমার মনে হচ্ছে, এই যে নিয়মানুগ প্রচারবিমুখ আইনি কার্যকর তৎপরতা, এটাও গত এক মাসের গণআন্দোলনের একটা সুফল। এই সাফল্যকে আমাদের ধরে রাখতে হবে।
এই আন্দোলনের আরও একটা বিরাট সাফল্য এসেছে। গেরুয়া পার্টি অনেক চেষ্টা করেও এর মঞ্চ দখল নিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, একাধিক মঞ্চ থেকে তাড়া খেয়ে তাদের পালাতে হয়েছে। গেরুয়া প্রসাদপুষ্ট এমপি অভিজিৎ গাঙ্গুলিকেও “গো-ব্যাক” ধ্বনি শুনে মুখ গোমড়া করে চলে আসতে হয়েছে। যে দলটা মণিপুরকে এক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে ফাঁসিয়ে রেখেছে, হাজার খানেক মানুষ নিহত, শত শত ধর্ষণের শিকার মণিপুরের নারীরা, যে রাজ্যে প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত দেড় বছরে গিয়ে উঠতে পারেননি, যে রাজ্যের সমস্যার কথা সংসদে ওঠার দিনে প্রধানমন্ত্রী হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন, যে দলের খাতায় কাঠুয়া, উন্নাও, হাথরাসের মতো অসংখ্য নারীনির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা লেখা রয়েছে, যারা সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষকদের জেল থেকে ছুটি দিয়ে দেয়, গ্রেফতার হওয়া ধর্ষকদের জামিনের ব্যবস্থা করে, এরকম আরও অসংখ্য ক্রিমিন্যাল রেকর্ড যাদের নিত্যসঙ্গী, তাদের যে আরজিকরের ঘটনায় এসে কুমির কান্না প্রদর্শনের সুযোগ দেওয়া হয়নি হাজার হাজার প্রতিবাদ মঞ্চের একটিতেও— এটা অবশ্যই এই গণআন্দোলনের একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য। এই ধারাকেও আগামী দিনে রাতে বজায় রাখতে হবে এবং একইরকম সাবধান থাকতে হবে।
আগামী দিনে এই আন্দোলন হয়তো তার বাইরের চেহারা পালটে নেবে। কিন্তু ফরম্যাট যাই হোক, প্রতিবাদ জারি থাকবে। সেই সঙ্গে নতুন নতুন অত্যাচারের ঘটনাসমূহকেও আন্দোলনের দাবিতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে। হরিয়ানায় রাজস্থানে গোরক্ষকদের হিংস্র আক্রমণে যে ভিন্রাজ্যের নিরীহ মানুষের হত্যাকাণ্ড, তার বিরুদ্ধেও ধিক্কার এবং প্রতিবাদের আওয়াজ তুলতে হবে। উজ্জয়িনীর ধর্ষিতার নির্যাতকদের শাস্তির দাবিতেও আমাদের সোচ্চার হতে হবে।
আন্দোলন থেকে “উৎসবে ফিরবার” আলাদা কোনও প্রশ্ন নেই। মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতার উচ্চ মঞ্জিল থেকে দেখতে পাননি, আমরা উৎসবেই আছি। আমাদের মঞ্চে মঞ্চে গান আছে, নাচ আছে, নাটক আছে, কবিতাপাঠ আছে, আলোকসজ্জা আছে, অনেক, হরেকরকম। আমাদের শোক আছে, দুঃখ আছে, ব্যথা আছে, আনন্দ আছে, প্রতিজ্ঞা আছে, আগামী কাল আছে। সেই সব নিয়ে আন্দোলনটাই আমাদের উৎসব। বড় পার্বণ। এই উৎসবে আমরা মেতেই আছি, থাকবও। প্রায় একশো বছর আগে বাঙালির চিরপ্রোজ্জ্বল দ্রোহস্বর কাজী নজরুল ইসলাম দিন বেঁধে দিয়ে গেছেন, আমরা কবে শান্ত হয়ে ফিরব। তার ব্যত্যয় করি কী করে?
মেরুদণ্ড যখন খুঁজে পেয়েছি, তখন তার বত্রিশটি কশেরুকাকেই কাজে লাগাতে হবে। মস্তককেও হোমো স্যাপিয়েন্স-এর মতো করে খাড়া অবস্থায় সামনে-তাকানো মুদ্রায় ব্যবহার করে যেতে হবে।
____
*মতামত ব্যক্তিগত