শবের ওপর দাঁড়িয়ে উৎসবে ফিরব না

আত্রেয়ী ভৌমিক

 


সকল স্তরের মানুষ কখনও আন্দোলনে, কখনও মানববন্ধনের মধ্যে দিয়ে আওয়াজ পৌঁছে দিতে চায় শাসক অবধি। উৎসবকে প্রতিবাদে রূপান্তর করল মানুষ। ঢাকের আওয়াজ হোক বা শঙ্খধ্বনি, 'উই ডিমান্ড জাস্টিস' ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে আগলে, ছোট্ট মেয়ের হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে দিয়ে, রাজপথ সেজে উঠেছে উৎসবে। সারা রাস্তা জুড়ে অক্ষর শুয়ে আছে। আপনি যেদিকেই তাকাবেন আপনার চোখে আসবে আমাদের বিচার না-পাওয়ার সমস্ত নিশান

 

৯ আগস্ট, সকালে সকলের ব্যস্ততাকে স্তব্ধ করে খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্য জুড়ে। খুন করে ধর্ষণ করা হয়েছে আরজিকর হাসপাতালের তরুণী ছাত্রী চিকিৎসককে। বাবা পেশায় দর্জি। কাপড় জুড়ে জুড়ে স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। আর কয়েকমাস পরেই মেয়ে হবে ডাক্তার। মেধা, নম্রতায় আকাশছোঁয়া সেই মেয়েটা আতর্নাদ করে ঘুমিয়ে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। শেষ সময়ে জল নয়, মেয়েটির চোখে ছিল রক্ত। বয়ে গেল রাজনীতির জল একূল থেকে অকূল। একের পর এক ভুল তথ্য দিয়ে এই ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন সিপি। বিচারের দাবিতে শুরু হল রাজ্য জুড়ে আন্দোলন। সাধারণ মানুষের ডাকা আন্দোলনে পা মেলালেন শিল্পী, ডাক্তার, পরিচারিকা, রিকশাচালক, ডেলিভারিবয় থেকে শুরু করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, প্রতিবন্ধী মানুষরা। টনক নড়ে উঠল সরকারের। শুরু হল ১৪৪ ধারা। জমায়েতের স্থানে স্থানে বিক্ষোভ। আক্রান্ত হল সাধারণ মানুষ থেকে পুলিশ। মানুষের কাছে ভগবানের পরেই ডাক্তারের স্থান। এবার পথে নামলেন তাঁরা। শরীর সারানোর আগেও মেরুদণ্ড সারাতে হবে সেই সমস্ত নেতৃত্বের। যাদের শিরদাঁড়া থেকেও নেই। সিপির পদত্যাগের দাবিতে পথে বসলেন তাঁরা। দেখা নেই সিপি মহাশয়ের। ২২ ঘন্টা পথে আগামীর ডাক্তাররা। এগিয়ে এলেন তাঁদের সিনিয়ররা। এগিয়ে এলেন সাধারণ মানুষ। পাশের বাড়ি থেকে এল রাতের খাবার। অসংখ্য মানুষ এসে দিয়ে যাচ্ছেন জল। বৃষ্টি ভিজে ২২ ঘন্টা পথে থেকে অবশেষে দেখা পাওয়া গেল সিপির। হাতে তুলে দেওয়া হল সেই শিরদাঁড়া। ইতিহাসে এ-দৃশ্য আমরা কেউ দেখব না হয়তো আর। অপসারণের দাবি নিয়ে তাঁরা এগোলেন স্বাস্থ্যভবনের দিকে। শুরু হল আন্দোলন।

 

মানুষ থেকেই মানুষ আসে, বিরুদ্ধতায় ভিড় বাড়ায়

কবিতা হয়ে উঠল বাস্তব। একে একে সাড়ে সাত হাজার ডাক্তারের সঙ্গে যোগদান করলেন সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্যভবন হয়ে উঠল মানুষের নতুন ঠিকানা। শুধু মানুষ এলেই তো হবে না। যুদ্ধে অন্ন, জল সব লাগবে। একবার শুধু খবর রটল জল লাগবে। লিটার লিটার জল হাজির হল। কারা যে পাঠাচ্ছেন কেউ জানতেও পারল না। খাবার এল, খাবার বেশি হতে শুরু করল। সেই খাবার বিতরণ করে দেওয়া হল আশেপাশের মানুষের কাছে। শুরু হল বৃষ্টি। মানুষ এগিয়ে এল ত্রিপল হাতে। ‘আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি’— কবি এমন কোনও দিনের আশায় লিখেছেন বলেই আমার ধারণা। কেউ রেঁধে নিয়ে এলেন পায়েস। উদযাপন করলেন তাঁর সত্তরতম জন্মদিন। কেউ নিয়ে এলেন ঘরে বানানো রুটি। সন্তানরা পথে। বাবা-মায়ের শান্তিতে ঘুম যে হবে না এই তো স্বাভাবিক। এক দম্পতি রোজ সকালে চা নিয়ে আসতেন। রাতে এলেন দুই বন্ধু বারাসাত থেকে। মিষ্টি খাওয়ালেন সকলকে। এরই মধ্যে সরকার ঘোষণা করলেন ‘উৎসবে ফিরতে’। রাজ্যবাসী মেতে উঠল প্রতিবাদের উৎসবে। আন্দোলন বৃহত্তর আকার ধারণ করল। স্লোগানে স্লোগানে সারারাত মুখরিত রাজপথ। এইসবের মধ্যে হঠাৎ অসুস্থ হলেন এক পুলিশকর্মী। মাঝরাতে আন্দোলনরত ডাক্তারেরা সারিয়ে তুললেন তাকে।

 

আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এখনই ইতিহাস

এই সমস্ত রাত আমাদের কাছে গণজাগরণের সংজ্ঞা প্রস্তুত করে দিয়ে গেল। স্কুলফেরত শিশুরা মায়েদের হাত ধরে বসছে আন্দোলনে। চিৎকার করে বিচার চাইছে। এক মা সকল সন্তানদের মাথায় ছুঁয়ে দিচ্ছেন আশীর্বাদী ফুল, বেলপাতা। মঞ্চের এক কোনায় এক মহিলা গোপাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। দু-চোখ জুড়ে জল পড়ছে তাঁর। যে বয়স্ক মানুষদের রাত দশটায় ঘুমোনোর কথা, তাঁরা হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করছেন ছেলেমেয়েদের। হুইলচেয়ার নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন এক মহিলা। এই বাংলা প্রীতিলতা, মাতঙ্গিনীর। এই আগুন নিভে যাওয়া সহজ নয়।

এবার ঘটনায় এল অন্য টুইস্ট। আর্থিক দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর এবার সরাসরি আরজিকর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসি গ্রেফতার হলেন প্রমাণ লোপাট ও খুন-ধর্ষণে জড়িত থাকার কারণে। ডাক্তারদের আন্দোলনের কিঞ্চিৎ জয় বলা যেতে পারে একে। সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক প্রশ্নে জর্জরিত কপিল সিব্বল। দেখাতে পারেননি চালান। পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। ঠিক সেই সময় অভয়ার হয়ে লড়তে এলেন ইন্দিরা জয়সিং, করুণা নন্দী। সুপ্রিম কোর্টে বিচার চলাকালীন এই প্রথম সিনিয়র অ্যাডভোকেট কপিল সিব্বলকে চুপ হতে দেখা গেল, কখনও অপ্রস্তুত হলেন। নারীবাহিনির ঝড় কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে সকলকে। আগামীর দিকে তাকিয়ে আমরা। বিচারের বাণী যেন নীরবে নিভৃতে না কাঁদে।

সকল স্তরের মানুষ কখনও আন্দোলনে, কখনও মানববন্ধনের মধ্যে দিয়ে আওয়াজ পৌঁছে দিতে চায় শাসক অবধি। উৎসবকে প্রতিবাদে রূপান্তর করল মানুষ। ঢাকের আওয়াজ হোক বা শঙ্খধ্বনি, ‘উই ডিমান্ড জাস্টিস’ ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে আগলে, ছোট্ট মেয়ের হাতে প্ল্যাকার্ড তুলে দিয়ে, রাজপথ সেজে উঠেছে উৎসবে। সারা রাস্তা জুড়ে অক্ষর শুয়ে আছে। আপনি যেদিকেই তাকাবেন আপনার চোখে আসবে আমাদের বিচার না-পাওয়ার সমস্ত নিশান।

আমরা এখনও বিচার পাইনি। শবের উপরে দাঁড়িয়ে তাই ‘উৎসবে ফিরব না’।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4818 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...