‘এলেম নতুন দেশে’

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কাউকে জিজ্ঞাসা না করলে উপায় নেই। এপার-ওপার ঝকঝকে রাস্তার দুপাশে সুবিশাল হর্ম্যসারি, প্রশস্ত রাস্তার পাশে বিধবার সিঁথির মতো শূন্য সার্ভিস রোড, মাথার ওপর নীল আকাশ। সব মিলিয়ে একটা ব্যাপার। অথচ সাবেক কলকাতায় রাস্তার হদিশ খুঁজে বেড়ানোর যে চিরাচরিত এগারো নম্বর পদ্ধতি অর্থাৎ কিনা স্রেফ পায়ে হেঁটে আর নানা জায়গায় একে ওকে তাকে জিজ্ঞাসা করে করে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া— এখানে সেই রীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। ঠিক যেমন বস্তুর পরমাণু কণার অন্দরে থমকে যায় নিউটনের গতিবিদ্যার চালু সূত্রগুলি। কারণ, এই জনপদে জনমানুষের অস্তিত্বের কোনও প্রত্যক্ষ সঙ্কেত নেই, যা আছে তা সুউচ্চ আবাসনের অভ্রংলেহী দর্প, প্রায় শূন্য রাজপথে দারুচিনি দ্বীপের মতো একেকটি বাসস্টপ, মূলত নিরালা, আর কিছুদূর অন্তর রাস্তার দিকনির্দেশ— তাদের ইশারা ধরা থাকে এভিনিউয়ের নম্বরে, ক্রসিংয়ের ইঙ্গিতে। আর দূরে স্কাইলাইনে সব বাড়ি ছাড়িয়ে ওঠা জেসিবি-র চুড়ো, কংক্রিট মিক্সার, ক্র্যাশার আর রাস্তার মাঝে মাঝে সুসজ্জিত কাজের ঘর বা ওয়ার্কস্টেশন— এগুলি তৈরি হয়েছিল কোভিডকালে ওয়ার্ক-ফ্রম-হোমের জমানায়। আজ সেগুলোর তেমন প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এই সব মিলিয়েমিশিয়ে আমাদের রাজারহাট, আমাদের নিউটাউন— আমাদের এঁদো কলকাতার পাশে ডানা-মেলা একটুকরো এল ডোরাডো। যেখানে হুস করে গাড়ি চলে যায়, যেখানে ট্রাফিক সিগনালে জমাট বাঁধা একমুঠো গাড়ি নিয়ত অধৈর্য হয়ে ইতরভাবে হর্ন বাজায় না, যেখানে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা এলাকার পাবলিক রুটের বাসের থেকে ঢের বেশি, যেখানে সম্ভবত এখনও বাতাসে অক্সিজেনের জোগান অফুরান বলেই প্রচার আর তার অনুপাতেই নাকি জমি বা আবাসনের দাম নির্ধারিত হয় সেখানে।

কিন্তু সেখানে কোনও ছকু খানসামা লেন নেই, নেই ছাতাওয়ালা গলি, নেই ভ্যান্সিটার্ট রো। সমস্ত শহরেরই একটা ইতিকথা থাকে যা মোটেই প্রাণহীন নয়। সমস্ত শহরের পেটের ভিতরেই লুকিয়ে থাকে একটা গ্রাম্য জনপদ, সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার সেইটাই রীতি। হরপ্পা মহেঞ্জোদড়োর আমলে শহরের নকশায় সেই গ্রাম্যতার কীরকম আভাস ছিল তা আমাদের জানা নেই, জানা নেই মেসোপটেমিয়ার নাগরিক জীবনের অন্দরমহল। কিন্তু এই হালে, মাত্রই শ-তিনেক বছর আগে তৈরি হওয়া আমাদের কলকাতা শহরের গড়ে ওঠার একটা ধাঁচ ছিল। যদিও এই শহরের প্রত্যক্ষ নাগরিক আদলের পেছনে ছিল উপনিবেশের ধূর্ত বুদ্ধি ও অভিপ্রায়— কিন্তু সেটা বোধহয় অর্থনৈতিক দিক। বাণিজ্যের স্বার্থ থাকলেও একটা জনপদের সব মানুষকে অস্বীকার করে তাদের সামাজিক বিন্যাসকে ধ্বস্ত করে নগর গড়ে উঠতে পারে না, অন্তত কলকাতার ক্ষেত্রে তেমন আমরা খেয়াল করি না। গ্রামীন কলকাতা মূলত যে তিনটে গ্রামের সমষ্টি ছিল, তার কৌমজীবনকে হয়তো ধীরে ধীরে বিদেশি বণিকরা আর্থিকভাবে নিকেশ করেছে কিন্তু তার সামাজিক সত্তাকে জোর করে দুরমুশ করার কথা ভাবেনি অথবা ভাবলেও তা পেরে ওঠেনি। মূলত ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের আশেপাশে কোম্পানির রাজপুরুষদের যে এলাকা তার পুরো পত্তনই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিনায়কত্বে— মূলত ওই এলাকা ছিল জঙ্গল আর স্বল্প কিছু মানুষের আবাস। এইসব সরিয়ে সেখানে যখন সাহেবপাড়া গড়ে উঠল, তখন সেখানে ‘ব্ল্যাক নেটিভ’দের প্রবেশ ও চলাচল অবাধ ছিল না ঠিকই, কিন্তু আদি সুতানুটি জুড়ে যে পুরনো ‘কলকাতা’ সেখানকার আদি বাসিন্দারা কিন্তু হঠাৎ গড়ে ওঠা এই নগরের প্রান্তে চলে যাননি। তাই আড়াইশো বছর আগে পত্তন হওয়া সাহেবপাড়া তো একদিক দিয়ে ‘রাজা’র হাট এবং ‘নিউটাউন’-ই ছিল— সেখানকার সরণি ও সৌধের ছত্রে ছত্রে ধরা দিচ্ছিল নতুন শাসকের নাম ও ধামের ফিরিস্তি। ডালহৌসি স্কোয়ার, অকল্যান্ড স্কোয়ার, হেস্টিংস প্লেস, হ্যারিংটন স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট, রাসেল স্ট্রিট— এইসবই নতুন শাসকের দেওয়া নাম। ক্ষমতা ও মতাদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাস্তা বা সৌধের নাম বদলে দেওয়ার একটা প্রবণতা আমরা গত সাড়ে সাত দশক ধরে প্রবলভাবে খেয়াল করেছি। এমনকি আজকাল মসনদে থাকা জ্যান্ত প্রধানমন্ত্রীর নামেও ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নাম রাখা হচ্ছে অনায়াসে, রাস্তাঘাট বা রেলস্টেশনের নাম না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু ব্রিটিশ উপনিবেশের হাজারো আগ্রাসন স্বীকার করলেও এটা লক্ষ করার বিষয় যে চালু নাম বাতিল করে তাঁরা নিজেদের প্রতিনিধির নাম চাপিয়ে দেননি। যদি দিতেন, তাহলে সাবেক কলকাতায় ওই ছকু খানসামা লেন বা মসজিদবাড়ি স্ট্রিট কিংবা পটুয়াটোলা বা কুমোরটুলির মতো এলাকাগুলি আজও সেই আদি নামেই আমাদের কাছে পরিচিত হতে পারত না।

এই জায়গাটাতেই আসলে একটা ইউনিকনেস। কলকাতা শহর গত দু-আড়াই দশক ধরে আড়ে-বহরে বেড়েছে কিন্তু তারই একটা বড় অংশের মধ্যে যে প্রাচীন গ্রামজীবনের ইশারা ছিল তা কিন্তু অবিকৃত— গ্রাম নেই, পাড়া নেই, পেশাভিত্তিক জাতিভেদ নেই— তবু এই শহরের মধ্যে আছে বেনিয়াটোলা লেন, আছে সোনাগাজি, আছে বৈঠকখানা লেনের মতো রাস্তা। আছে মলঙ্গার গলি, হাড়কাটা গলি (আসলে হিরাকাটা গলি), চালতাবাগান, চোরবাগান, জোড়াবাগান বা বাগমারির মতো এলাকা, আছে কবেকার কোন পাড়ার পুকুরের নামে বেনিয়াপুকুর, মুরারিপুকুর বা চুনাপুকুর; বহুবাজার, রাধাবাজার বা মল্লিকবাজার কিংবা শোভাবাজারের মতো আদি কোনও বাণিজ্যসত্রের নাম আজও মুখে মুখে ফিরছে মানুষের, তালতলা বা বটতলার মতো গ্রামীণ পরিচয় আজও এই শহরের অঙ্গ। সুদীর্ঘকাল ধরে যে-শহর দেশের রাজধানী, যে-শহরের বুকে নতুন আলোর অরুণোদয়, যে-শহর দেশকে শৃঙ্খলমুক্তির হাতেখড়ি দিয়েছে একদিন সেই শহরে আজও আছে কলুটোলা নামের রাস্তা, খালাসিটোলার মতো চেনা মহল, নগরের কিছু উল্লেখযোগ্য থানার নাম মুচিপাড়া বা তালতলা কিংবা বটতলা। এগুলোকে আজও কেউ গিলে খেতে পারেনি কারণ কলকাতা নামের এক মেট্রোপলিসে সবাই থাকতে পারেন আজও— অজস্র খানাখন্দ আর ঘেটো জীবনের পাঁক সত্ত্বেও। আর এই অভিন্নতার জন্যই বোধহয় কলকাতার রাস্তায় ঠিকানা খুঁজে পেতে আমাদের পাশেপাশে কথা বলে ওঠে অনেকরকম স্বর, খাড়া হয়ে যায় সমবেত তর্জনী— সবাই মিলে চিনিয়ে দেন, ওই তো ওই তো! এরপর পায়ে পায়ে পথে নামা— কবির কথায়, হেঁটে দেখতে শিখুন! হ্যাঁ, এইভাবেই আমরা শিখেছি— পথে পথে পায়ে পায়ে পাড়ায় পাড়ায়। তাই ওই নতুন উপনিবেশের অ্যাসফল্ট পথে মসৃণ শকটযাত্রায় যখন অকস্মাৎ আটকে যেতে হয় কোনও ঠিকানার সন্ধানে তখন গাড়ির জানলা দিয়ে ফ্যালফ্যাল চেয়ে থাকা— বিবিক্ত জনপদে কাকে প্রশ্ন করে জেনে নেব আমাদের গন্তব্য? কারা এসে ঘিরে ধরে বলবে, কত নম্বর বাড়ি খুঁজছেন বলুন তো?

 

দুই.

এটা ঠিক, গ্রাম থেকে শহরের দিকেই সভ্যতার অভিমুখ। কলকাতা যখন ছোট্ট জনপদ থেকে মেট্রোপলিসের দিকে যাত্রা করেছে তখনও কলকাতার চারিদিকে ছড়ানো গ্রাম। অষ্টাদশ শতকের একটা প্রতিবেদনে লেখা হচ্ছে, ‘…তিনটি গ্রাম মিলে যে শহর গড়ে উঠছিল তার চারপাশে ছিল ধানক্ষেত, কলাবাগান, সবজিক্ষেত, বাঁশবন, তামাক ও তুলোর চাষও হত। পাড়ায় পাড়ায় জঙ্গল, পুকুর, এঁদো ডোবা, হোগলা বন। অধিকাংশই কাঁচা বাড়ি, কাঁচা রাস্তা, উপচে পড়া নর্দমা, যত্রতত্র আবর্জনার স্তূপ।’ অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, শহর আর গ্রাম একেবারে মাখামাখি হয়ে আছে এই নতুন উপনিবেশে।

এই শহরকে খুব পরিকল্পনা করে প্রথম বাড়ানোর কথা এল লবণহ্রদের মাধ্যমে। শহরের উপকন্ঠে বিস্তীর্ণ নোনা ভেড়ি আর স্বল্প কিছু বাসিন্দা, মূলত মৎস্যজীবী। এর অনেকটা জমিই ছিল হাটখোলার দত্ত পরিবারের, যেটাকে আজও বলা হয় দত্তাবাদ— ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে। অন্যদিকে মহিষবাথান। বিশাল সরকারি উদ্যোগ, বিরাট তার কর্মকাণ্ড। জলাভূমি বুজিয়ে গড়ে উঠল নতুন উপনিবেশ। সেখানকার আদি বাসিন্দারা কোথায় চলে গেলেন, কোথায় তাঁদের সরিয়ে ফেলা হল আমরা কেউ জানি না। হয়তো ভুল তুলনা, তবে মার্কিন দেশের ‘সল্টলেক’ নামের এক বসতিতেই একদিন ব্রাশ ফায়ারে নিকেশ করা হয়েছিল শ্রমিকনেতা জো হিল-কে— সেও তো এক প্রান্তীয় মানুষেরই হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ধীরে ধীরে যখন গড়ে উঠছিল উপনগর— একটা-দুটো বাসরুট, অল্প বাসিন্দা, নৈমিত্তিক দিনযাপনের আয়োজন অপ্রতুল— ঠিক তখনই ওই এলাকার ঠিকানার চিহ্ন হিসেবে জেগে উঠল মাত্রই কয়েকটা জলের ট্যাঙ্ক। ব্লক নম্বর বা সেক্টর নম্বর দিয়ে যেহেতু বিস্তারিত হদিশ মেলে না তাই বাস কন্ডাক্টারের চেঁচানিতে শোনা যেতে লাগল বারো নম্বর ট্যাঙ্ক বা আট নম্বর ট্যাঙ্কের সঙ্কেত। ওই শুনেই যাত্রীরা পথ চেনেন, জনবিরল উপনিবেশে খুঁজে ফেরেন নিজেদের গন্তব্য। আদি লবণহ্রদ এলাকায় যে গ্রাম, যে গ্রামীণ অনুষঙ্গ নতুন শহর কেমনভাবে তাকে যেন গিলে নেয়— নইলে কি আর সেইসব গাঁয়ে একটাও শিরিষতলা বা বটতলা বা পাকুড়তলা ছিল না? ছিল না ফণিমনসার ঝোপ বা অন্তত দু-চারটে মজা পুকুর? কিন্তু শহরের দিকচিহ্নে আর তাদের ঠাই হল না। আধুনিক নগরের এটাই দস্তুর। আজকের জনবসতিতে উপচে-পড়া সল্টলেকে রাজ্য প্রশাসনের সমস্ত দফতরেরই প্রায় সদর অফিস, নানান নামের ভবন গড়ে উঠেছে এখানে-ওখানে— প্রায় কলকাতার গোটা অফিসপাড়াটাই উঠে এসেছে এখানে। সেই সঙ্গে নানা অফিস, হাসপাতাল, মাল্টিপ্লেক্স, মেট্রো স্টেশন তৈরি করে দিয়েছে আরও চওড়া সব অভিজ্ঞান। এমনকি এই অফিসযাত্রীদের সৌজন্যে দেদার বিস্তার হয়েছে ফুটপাথের হকার, দুপুরে টিফিন খাওয়ার হরেক আয়োজন। সল্টলেকের পথে পথে গুমটি ঝুপড়ি আজ আর খুব আশ্চর্য বিষয় নয়। যদিও আমরা জানি না, যাঁরা একদিন এই বসতি ছেড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলেন ঠিক তাঁরাই আবার ফিরে এসেছেন কিনা নিতান্তই সামান্য রুটি-রুজির ধান্ধায়। কারা গেলেন আর কারা ফিরলেন, এ নিয়ে উপনগরীর তেমন কিছু এসে যায় না। কারণ অধুনা বিধাননগরের পথনির্দেশে এঁদের আর কোনও ভূমিকা নেই— যেমনটা আজও আছে কলকাতার ছিদাম মুদি বা গুলু ওস্তাগরের নামাঙ্কিত রাস্তায়।

খাপে খাপে মিলবে এমন নয়, কিন্তু দুর্গাপুর শিল্পনগরীর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একই জিনিস। হয়তো সব আধুনিক শিল্পনগরীর জন্যই তা সত্যি। একটা সময় কেন, এখনও দুর্গাপুরের এলাকার শ্রেণিবিন্যাসে মূল নির্ণায়ক হল জোন— বাসের গায়ে লেখা থাকে এ জোন, বি জোন আর তার থেকেই চিনে নিতে হয় গন্তব্য। তবে দুর্গাপুরে বাড়তি একটা রোমাঞ্চ হল তৈরি করা উপনগরীতে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস থেকে নেহেরু-গান্ধি হয়ে নিউটন বা এডিসন-এর নামাঙ্কিত রাস্তা। তবে এটাও বলা দরকার দুর্গাপুরের পত্তন নেহাতই এক বৃহৎ শিল্পের স্বার্থে, তাই কার্যত সেখানকার কোনও আদি বাসিন্দা নেই, সবাই সেখানে ইস্পাতশিল্পের কর্মী আধিকারিক। শহর তৈরির সময়েই ওই এলাকার জঙ্গলের আদি বাসিন্দা জনজাতি গোষ্ঠীদের সরকারিভাবে বিদেয় করে দেওয়া হয়, তাঁরা আর ফিরে এসে নিজেদের দাবিদাওয়া তোলার সুযোগ পাননি।

কিন্তু রাজারহাট বা নিউটাউন যে অঞ্চলের বুকের ওপর গড়ে উঠল তার সবটাই ছিল চাষের জমি এবং তার লাগোয়া গ্রাম। হয়তো বা সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর কলকাতার মতোই সেখানে ছিল বাঁশবন, এঁদো ডোবা বা ভরা পুকুর, আর তারই ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক গ্রামীণ জীবন, অকিঞ্চিৎকর সব মানুষের শরিকানি লেগে থাকে যার প্রান্তসীমায়। কী এক আশ্চর্য উপায়ে এই বিপুল সংখ্যক কৃষিজীবী মানুষগুলিকে নীরবে সরিয়ে দেওয়া হল তা আমরা প্রায় জানতেই পারিনি। যখন জানলাম তখন সে যেন এক নতুন জেগে ওঠা চর, সমস্ত অতীত ডুবে গিয়ে যেখানে শুধুই বর্তমান। সেই ঘটমান বর্তমানের ভিতর প্রকাণ্ড হর্ম্যরাজি, বিপুল চওড়া সব পথঘাট, রাস্তার পাশে পাশে সদ্যোরোপিত তরুরাজি, প্রতিটি চৌমাথায় উজ্জ্বল বিলবোর্ডে শোভা পায় পথের হদিশ— তার স্থানাঙ্ক শুধু কত নম্বর ক্রসিং ও কত নম্বর লেন। আর কিছু নয়। যেন-বা সুদূর অতীত বলে সেখানে আসলে কিছুই ছিল না, যেন-বা সূর্য থেকে ছিটকে আসা এক প্রস্তরখণ্ড শীতল হয়ে জমাট বেঁধে আছে এই নব্য শহরে। সেখানে খাঁ খাঁ দুপুরে হয়তো ঘুঘুপাখির ডাক, হয়তো হাল্কা গাছের ডালে দোলখাওয়া ফিঙে, জোরালো হ্যালোজেন আলোর বাইরেও এবড়োখেবড়ো অন্ধকারে একটা-দুটো জোনাকির ওড়াউড়ি— হয়তো আরও আরও কিছু যা দিয়ে কেবল সাজানো যায় এক গ্রামের অনুষঙ্গ, গ্রাম নয়— এমনকি নয় তার মানুষগুলোকেও।

উপনিবেশের কলকাতাও এতটা বেপরোয়া হতে পারেনি। তাই সে নিজের বাড়তি শরীরে বারবার ধারণ করে নিয়েছে সেখানকার আদি ও তুচ্ছ প্রান্তীয় মানুষগুলির অস্তিত্ব— এত বছর পরেও তাই ছিদাম মুদি বা অখিল মিস্ত্রি লেনের নাম আমাদের রোমাঞ্চ জাগায়। এমন এক মেট্রোপলিসের আখ্যানে এইসব ব্রাত্য-দের তো নাম থাকার কথা ছিল না। এটাও স্মরণ করা দরকার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়োজিত কলকাতার জমিদার হলেও হলওয়েল সাহেব কিন্তু কলকাতার রাস্তা বা এলাকার নামকরণ করার ক্ষেত্রে (১৭৮৪) আঞ্চলিক বৃত্তিজীবীদের পরিচয়কে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন— কার্যত সেই ভাবনা থেকেই কলুটোলা, আহিরীটোলা, দর্জিপাড়া, যোগীপাড়া বা কুমোরটুলি এলাকার সরকারি স্বীকৃতি এসেছিল। সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিরা যা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুন, কলকাতার পথে ঘাটে এলাকায় এঁদের উপস্থিতি আজও মুছে দেওয়া গেল না। আর আমরা ‘জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ’ করে যে আজব শহর বানিয়ে প্রচ্ছদ পালটে ফেলতে চাই রাজধানীর সেই বিস্তীর্ণ জনপদে এমন কোনও বৃত্তিজীবী বা ‘অখ্যাত’ মুদি মিস্ত্রি কলু জোলা এক-আধজনও ছিলেন না? পুরনো গ্রামীণ এলাকায় তাঁদের অবস্থান দিয়ে গন্তব্য চিহ্নিত হত না কোথাও? বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়েও এ-কথা স্বীকার করা মুশকিল!

সুতরাং সুতীব্র বেগে ছুটে যাওয়া গাড়ি। সুতরাং জেসিবি-লাঞ্ছিত স্কাইলাইন, কংক্রিট মিক্সার, ক্র্যাশার আর রাস্তার মাঝেমাঝে সুসজ্জিত কাজের ঘর বা ওয়ার্কস্টেশন। সুতরাং ধু ধু পথের বিরলতার পাশে পাশে বহুতলের অবিনীত স্পর্ধা। কারা থাকেন এখানে? আমরা কি তাদের চিনি? সবকিছু বড় সাজানোগোছানো ছিমছাম, স্পন্দিত রাজপথ থেকে নিরালা ধূসরতা। বড় বেশি ছমছমে, বড় বেমানান। কত বিঘে কত একর জানা নেই। সেই কবে বাদল সরকার তাঁর ‘ভোমা’ নাটকে লিখেছিলেন— ‘ভোমা মানে জঙ্গল। ভোমা মানে আবাদ। ভোমা মানে গ্রাম।’ ভোমা, ভোমারা আর এখানে নেই। তাই গাড়ির বাইরে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলে কেউ ভিড় করে আসে না। অগত্যা গুগল। এলেম নতুন দেশে।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...