নিহিত কোমলগান্ধার : সিনেমা সঙ্গীত ও ঋত্বিক ঘটক

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

ইগর স্ত্রাভিন্সকি একবার বলেছিলেন, “সিনেমা সঙ্গীত ও সিনেমার মধ্যে সম্পর্ক ততটাই, ঠিক যতটা একই সময়ে অবসরে বই পড়া ও নেপথ্যে বেজে চলা পিয়ানো।” ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ও সিনেমায় ব্যবহৃত সঙ্গীত সম্পর্কে বলতে গিয়ে এই কথাটাই সবার আগে মনে পড়ল। বলতে দ্বিধা নেই, আজ এত বছর পরেও তার সিনেমায় সাঙ্গীতিক প্রয়োগ, সুর নিয়ে ভাবনাচিন্তা, লোকায়ত দৃষ্টিকোণ ও মার্ক্সিয় দর্শনের এমন অপার্থিব মেলবন্ধন, একরোখা, বেপড়োয়া এই কিংবদন্তি মানুষটিকে নিয়ে নতুন করে চিন্তা করা শেখায়। ঋত্বিকের সিনেমা নিয়ে কিছু বলব এমন স্পর্ধা না দেখানোই ভাল। কিন্তু তার ‘মিউজিকাল সেন্স’, ‘ট্রিটমেন্ট’ ও ‘এক্সপেরিমেন্টস’ আজও ঘুমোতে দেয় না। অগত্যা জেগে উঠে বসে কাগজ-কলম টেনে নিই। ‘নিহিত কোমলগান্ধার’ লেখার সূত্রপাত এখান থেকেই।

২০০৮ সাল। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি। বছর দুই হল সরকারী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এসেছি। ক্যাম্পাসে একটি বহুজাতিক বই’র দোকানের তত্ত্বাবধান ও ফাঁকেফাঁকে চলছে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে উঁকিঝুঁকি। আলাপ হয় সঞ্জয়দা, মানে অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ঋত্বিক গবেষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সাথে। মুলতঃ তার ঠেলাঠেলিতেই এই কাজে হাত দেয়া। কাজ হাতে নিয়ে দেখি, এ তো সাক্ষাত ‘এল ডোরাডো’। এতদিন কেন কেউ খেয়াল করেনি সেটাই আশ্চর্য! বাংলায় সত্যজিৎ রায়ের ‘চোখধাঁধানো আলোকছটা’ই এই ‘অন্ধত্বে’র কারণ? এই বিতর্কে না গিয়ে সোজাসুজি বলে রাখা ভালো, সত্যজিৎকে নিয়ে যতটা কাজ বা গবেষণা হয়েছে, ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে ততটা হয়েছে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। বিশেষ করে তার সিনেমা সঙ্গীত নিয়ে। ঋত্বিক সরাসরি কখনও সক্রিয় সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন, এমনটি শোনা যায়নি। কিন্তু তার মার্গসঙ্গীত, লোকগীতি, গাথা, চর্যা বা গণসঙ্গীতের প্রতি দুর্বলতা ও মুনশিয়ানা অনস্বীকার্য। এবং অবশ্যই অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রনাথ। ঋত্বিক নিজে বাঁশি ও সরোদ বাজাতে জানতেন। মাইহার ঘরানার প্রবাদপ্রতিম নক্ষত্র ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেবের কাছে বেশ কয়েকবছর সরোদের তালিম নিয়েছিলেন বলেও শোনা যায়। পরে, ঋত্বিক ঘরানার সাথে ওতপ্রোত জড়িয়েছেন বাহাদুর খাঁ। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তার একাধিক ছবিতে। পরে সেই তালিকায় সংযুক্ত হয়েছেন ওস্তাদ আলী আকবর, সলিল চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত ও হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও হরিপ্রসন্ন দাশের মতো দিকপালেরা। সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক অসামান্য সুরজগত। আর তাতে অলক্ষ্যে, জলছাপের মতো রয়ে গেছেন ঋত্বিক। অথচ তার আমরা কতটুকুই বা জানি। ‘নিহিত কোমলগান্ধার’ তারই একটি নগণ্য, অপ্রতিমেয় ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র। দেখার বিষয়, ঋত্বিকের যাবতীয় সৃষ্টির মধ্যে তার এই অজানা, সাঙ্গীতিক দিকটি মানুষটির সম্বন্ধে আমাদের কাছে নতুন করে কোন দিকগুলি খুলে দেয়। “বিস্ময়ে তাই জাগে…”

নাগরিক (১৯৫২)

‘নাগরিক’ ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য-র ছায়াছবি। নানান বিশেষজ্ঞের মতে এটিই বাংলা সিনেমার ইতিহাসে প্রথম তথাকথিত ‘আর্ট ফিল্ম’। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই ছবিটি নানান কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বাক্সবন্দি থাকার, ২৫ বছর পর, এবং ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর ২০শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে কলকাতার ‘নিউ এম্পায়ার’ থিয়েটারে মুক্তি লাভ করে। ছায়াছবির প্রযোজনার দায়িত্বে ছিলেন প্রমোদ সেনগুপ্ত, ভূপতি নন্দী, এবং স্বয়ং ঋত্বিক। সিনেমাটোগ্রাফি — রামানন্দ সেনগুপ্ত, এডিটিং — রমেশ যোশী, শব্দগ্রহণ — সত্যেন চ্যাটার্জী এবং শিল্পনির্দেশনায় শ্রী ভূপেন মজুমদার।

ঋত্বিকের এই প্রথম ছবিটির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সুরকার শ্রী হরিপ্রসন্ন দাশ, যিনি ‘নাগরিক’-এর আগেই ‘অপরাধ’ (১৯৪২), ‘কাদম্বরী’ (১৯৪৪), এবং ‘সতী তরাল’ (১৯৪৭) ইত্যাদি ছবিতে সুরারোপ করে এসেছেন। এই ছায়াছবিতে তাঁর সহকারী রূপে অংশগ্রহণ করেন নির্মল গুহঠাকুরতা, আবহে ওস্তাদ বাহাদুর খান এবং গীত রচনায় গোবিন্দ মুনিশ।

ছবির শুরুতে ‘টাইটেল কার্ড’ ওঠার আগেই দেখা যায় কামার লোহা ঠুকছে। লোহা ঠোকার দৃপ্ত ভঙ্গি ও শব্দ এখানে বিশেষ মাত্রা আনে। লোহা ঠোকার আওয়াজ বদলে গিয়ে সেখানে উঠে আসছে ঘণ্টার ধ্বনি। এই ঘণ্টার ধ্বনি সুরকার খুব যত্নসহকারে ব্যবহার করেছেন যেখানে কামারের লোহা ঠোকার আওয়াজের সাথে ‘সময়’-এর পরিবর্তন এবং লড়াইয়ের মানসিকতাকে ব্যাখা করে। এই ঘণ্টার ধ্বনির পথ ধরে শুরু হয় ঋত্বিকের ছায়াছবির সঙ্গীত ও তার সাঙ্গীতিক চর্চার ‘অশ্রুত’ ইতিহাস।

সিনেমার শুরুতেই ক্যামেরায় একে একে ধরা পড়ছে প্রাকৃতিক দৃশ্য (Natural Scenes)। উঠে আসছে রাস্তা, গাছপালা, নদী, নৌকো। নদীর পাড়ে কাপড় উড়ছে। সাথে শহর সম্পর্কিত কবিতার Voice over. এইভাবে অনবদ্যভাবে উঠে এসেছে সেতার ও সরোদের যুগলবন্দী। মূলতঃ সেতারের ঝালা অংশটি মিলিয়ে যেতে যেতে উঠে আসে হাওড়া ব্রিজ। ব্যস্ত রাস্তা। ট্রামলাইন। অফিস পাড়া। সেতারের সুর মেলাতে মেলাতে আমরা দেখতে পাই ব্যস্ত মানুষের ভিড় থেকে বেরিয়ে আসা একটি স্বতন্ত্র চরিত্র। কাহিনির Protagonist — রামু। সে রাস্তা পার হবার চেষ্টা করছে। সহসা পেছন থেকে এক বৃদ্ধার ডাক। তাকে রাস্তা পার করিয়ে দেবার আর্জি। রামু বৃদ্ধাকে রাস্তা পার করায়। নেপথ্যে ক্ল্যারিওনেট বাজে। পাড়াতে ঢুকতেই আরও একবার বেজে ওঠে সঙ্গীত। এখানে অসামান্যতার সাথে ব্যবহৃত হয়েছে বেহালা (Violin)। ছোট ভাই-এর সাথে পাড়ার মোড়ে গল্প করতে করতে হঠাৎই রামুর কানে আসে বেহালার এক করুণ সুর। রামু খুঁজে পায় রাস্তার ধারে বসে থাকা এক অজ্ঞাত বেহালাবাদককে। তার করুণ সুর যেন শহুরে জগদ্দল দামামা-র মাঝে খুঁজে পাওয়া এক টুকরো নিঃসঙ্গতা। রামু বেহালাবাদককে অনুরোধ করে, ‘অদ্ভুত সুর… আর একবার বাজাও তো!’ বেহালা থেমে যায়। রামুর সামনে উঠে আসে হাত। ভিক্ষার হাত। রামু লজ্জা পায়। অজ্ঞাত বেহালাবাদক মুচকি হেসে চলে যায়।

ঋত্বিকের এই সিনেমার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে ‘বেহালা’। ঋত্বিকের বেহালা ও সরোদপ্রিয়তার কথা তাঁকে নিয়ে আলোচিত নানান প্রবন্ধ ও নিবন্ধে উল্লিখিত। পরবর্তী দৃশ্যে বেহালার continuation-ও চোখে পড়ার মতন। রামু ঘরে ফিরে এসে বোন সীতার মুখোমুখি হয়। সীতা তার দাদার কাছে দুঃখ করে। পাত্রপক্ষের নানা দাবি মেটাতে মেটাতে সে ক্লান্ত। অবসাদগ্রস্ত। রামু অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে বোনের দিকে। নেপথ্যে আবার বেজে ওঠে বেহালা। করুণ সুরে। এর পরের দৃশ্যে রামু নিজের ঘরে জামাকাপড় পরে বাইরে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত হয়। হঠাৎই চোখ পড়ে দেওয়ালে আটকানো একটি পুরোন ক্যালেন্ডারের দিকে। তাতে একটি গ্রাম্য জীবনের ছবি। Pastoral outlet। গাছ, নদী, এবং একটি বাড়ি। রামু ক্ষণিকের জন্য আনমনা হয়ে পড়ে। নেপথ্যে আবার সেই বেহালা। সেই অজ্ঞাত বেহালাবাদকের সুর ভেসে ওঠে। রামু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। দৃশ্যের পর দৃশ্য এগিয়ে চলে। একটি দৃশ্যে মুখোমুখি হয় রামু ও তার প্রেমিক উমা। তারা তাদের জীবনের কথা আদানপ্রদান করে। আদানপ্রদান হয় সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন। আবহে বেজে ওঠে বেহালা। তার সুরে যেন দিনবদলের ইঙ্গিত।

এই সিনেমাটিতে অনিবার্যভাবে ঋত্বিক ব্যবহার করেছেন কিছু আবশ্যক গানও। বেহালার পাশাপাশি এই গানগুলিও বেশ স্বতন্ত্র ও দৃপ্ত। যেমন একটি দৃশ্যে সীতা তার ছোটভাইকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে। ‘খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল, বর্গী এল দেশে’। সীতা মৃদুস্বরে গান গেয়ে চললেও তার মুখ বিষাদে ভারাক্রান্ত। ছেলেভুলানো এই ঘুমপাড়ানি গানটির মধ্যে দিয়ে কোথাও যেন সে তার হারিয়ে যাওয়া শৈশবকে দেখতে পায়। এরকম হারিয়ে যাওয়া শৈশবের মুহূর্ত কমবেশি আমাদের সবার মধ্যেই থাকে। ঋত্বিক এই দৃশ্যে তাকে যথার্থ রূপদান করেন।

এই গানের সাথে সাথেই ঋত্বিক আবার ফিরে যান তাঁর বেহালা মাদকতায়। পরবর্তী দৃশ্যে উঠে আসে সীতার মায়ের মুখ। উদ্বিগ্ন। সীতার মা শুতে যাবার আগে হঠাৎই পাশের ঘরের জানালার পর্দায় সীতার ছায়া দেখতে পান। ছায়াটি ক্লান্ত, শ্রান্তভাবে নড়াচড়া করছে। ঘরের আলো নিভে যায় এবং সাথে সাথে নিচের রাস্তায় ঘুরে যায় ক্যামেরার মুখ। বেজে ওঠে সেই বেহালা। সেই হারানো সুর। বেহালাবাদক একা একা রাস্তা দিয়ে বেহালা বাজাতে বাজাতে চলে যায়। রাতের কলকাতার অন্ধকারে যেন গুমরে গুমরে সেই বেহালার সুর ঘোরে-ফেরে। ক্যামেরা ঘুরে Close Up করে রামুর মুখে। সে শুয়ে শুয়ে দিনবদলের কথা ভাবে। বেহালার সুর আস্তে আস্তে রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

এই ছায়াছবিতে গানের ব্যবহার নিয়ে আগেও বলা হয়েছে যথাসম্ভব। পরের দৃশ্যে দেখা যায় এক ভিখারি ও ভিখারিনীকে ভিক্ষা করতে। তারা একটি সমসাময়িক হিন্দি সিনেমার গান গাইছে —

‘মাঝি ইয়ে তো মাঝধার হ্যায়/ কিনারা নেহী হ্যায়

তুফান ইয়া কিসি তিনকে কা/ সাহারা নেহী হ্যায়’

সেই যুগে (১৯৫২) একটি বাংলা সিনেমায় এরকম অনবদ্য হিন্দি গানের প্রয়োগ খুবই কম চোখে পড়ে।

হিন্দি গান, ঘুমপাড়ানি গানের পাশাপাশি এবার উঠে আসে রাগাশ্রয়ী। এর পরবর্তী দৃশ্যে রামু একটি চায়ের ঠেকে আড্ডা মারতে যায়। কয়েকজন সতীর্থের সাথে চাকরির বাজারদর নিয়ে আলোচনা হয়। চায়ের দোকানেই এক সতীর্থকে দিয়ে ঋত্বিক সেরে ফেলেছিলেন ‘ভৈরবী’-র আলাপ। আমরা দেখতে পাই রামুর সতীর্থটি কোনওদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে নিজ মনে ভৈরবীর আলাপ সেধে চলে।

সিনেমার আরেকটি দৃশ্যে আবার ফিরে আসে ‘সেতার’। নাগরিকের প্রথম পর্বে সেতারের অনবদ্য প্রয়োগের পর কোথাও যেন তা বেহালার করুণ রসধারায় হারিয়ে গেছিল। হরিপ্রসন্নবাবু আবার অসাধারণ মুনশিয়ানায় তাকে আবার ফিরিয়ে আনেন। সেই দৃশ্যে রামু অন্যান্য দিনের মতন আবার শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকে। দিনবদলের স্বপ্ন। তার চাকরির স্বপ্ন। সংসারের হাল ফেরার স্বপ্ন। এমন সময় সীতা চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। আবহে বেজে ওঠে সেতার।

হরিপ্রসন্নবাবু ও ঋত্বিক ঘটকের যৌথ ভূমিকায় এ ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে আরও একটি পাশ্চাত্য তারের যন্ত্র — চেলো (cello)। এই ছায়াছবিরই একটি দৃশ্যে রামু তার প্রেমিকা উমাকে সেই স্মৃতিবিজড়িত ক্যালেন্ডারটি দেখায়। সিনেমার নানান দৃশ্যে এই বিশেষ ক্যালেন্ডারটি বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু ফেলে আসা, কিছু কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের মতো এই ক্যালেন্ডারটিও বারবার সিনেমার গতিকে বা নাগরিক জীবনের তীব্রতাকে অন্য মাত্রায় পর্যবসিত করেছে। এই প্রত্যাবর্তনের গতির মাঝেই অনির্বচনীয় রূপে উঠে এসেছে — চেলো। চেলোর গভীর ও করুণ স্বর এই দৃশ্যকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করে।

১৯৫২ সালের দেশভাগ ও তার যন্ত্রণার সুচারু প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় এই সিনেমাটিতে। কলকাতা জুড়ে তখন দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে বেকারত্ব, দারিদ্র, ও ক্ষুৎতাড়নার মহাসংগ্রাম। ‘নাগরিক’-এর এমনই একটি বিশেষ দৃশ্যে উঠে এসেছে গণসঙ্গীত। ছায়াছবির সেই দৃশ্যে দেখা যায় কলকাতার রাস্তা জুড়ে বেকার যুবকদের মিছিল। নেপথ্যে প্রতিবাদ ও অধিকার বুঝে নেবার তীব্র সংক্ষোভ, হরিপ্রসন্নবাবুর হাত ধরে উঠে আসে প্রতিবাদের সোচ্চার ভাষা — গণসঙ্গীতের রূপে। সময় ও সঙ্গীতের এক অতুলনীয় মিশ্রণ আমরা দেখতে পাই।

এরপর আবার ফিরে আসে রাগসঙ্গীত। ‘নাগরিক’-এর একটি দৃশ্যে দেখা যায় উমা অন্ধকার খোলা ছাদে একা একা গান গাইছে —

‘এসো শ্যাম সখী কঠোর/ কাহে গাও ভাদর ঘোর’

‘নটমল্লার’-এ রচিত এই গানটি সিনেমার একটি বড় সম্পদ। এই গানটির করুণ অথচ গম্ভীর চলনে সহজেই দর্শকের মন বিগলিত হয়। সুরকার হরিপ্রসন্নবাবু ঢিমা লয়ের এই গানটির সংযোজনায় দৃশ্যটিকে এক অন্য মার্গে নিয়ে যান।

পূর্বেই বলা হয়েছে, এই সিনেমাটির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে বেহালা। সিনেমাটিতে বারবার ঘুরেফিরে বেহালা উঠে আসে। ‘নাগরিক’-এর শেষের দিকে একটি দৃশ্যে দেখা যায় রামুর এক বন্ধু রামুর বকেয়া টাকা দিয়ে চলে যায়। সেখানেও নেপথ্যে সেই বেহালার করুণ সুর ও বেহালাবাদক ফিরে আসে।

দৃশ্যটি শেষ হতে না হতে আছড়ে পড়ে সেতার। যখন রামু উমাকে টাকা দিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয় এবং বাড়ি ছেড়ে ধীর গতিতে বেরিয়ে আসে তখন অনির্বচনীয় ভঙ্গিতে বেজে ওঠে সেতার। বাগেশ্রীর বিলম্বিত আলাপে সহজেই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে পরিবেশ এবং দর্শকমনন।

অবশেষে সিনেমার শেষাংশে রামু ও বেহালাবাদক মুখোমুখি হয়। এবার রামুকে আর সে প্রত্যাখ্যান করেনি। মৃদু হেসে বেহালার তারে ছড় দিয়ে দেয় টান। অসম্ভব করুণ সে সুরে এ পৃথিবীর যা কিছু জাগতিক সব ঢাকা পড়ে যায়।

এ ছবিতে অনবদ্যভাবে ব্যবহৃত হয়েছে — ঢাক। রামু মরিয়া হয়ে শহরের বুক চিরে চাকরি খুঁজতে বেরোয়। নেপথ্যে বেজে চলা ঢাক যেন একই সাথে তার লড়াইয়ের প্রতীক এবং হেরে যাওয়ার গ্লানিকে তুলে ধরে। সারাদিন চাকরির বৃথা চেষ্টা করে সন্ধেবেলায় দিশেহারা, উদভ্রান্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরে রামু। একে একে রাস্তার বাতি নেভে। নেপথ্যে বেজে ওঠে ঢাক, পিয়ানো এবং হিন্দি গানের কলি। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত শব্দকল্পদ্রুম।

ঋত্বিক ঘটক তাঁর এই ছবিতে মৃত্যুকেও অসাধারণভাবে ফুটিয়েছেন এবং তার যথার্থ রূপদান করেছেন কোনও সঙ্গীত দিয়ে নয়, রোড রোলারের কর্কশ আওয়াজে।

রামুর অসুস্থ বাবা তাকে জানালা খুলতে বলেন। বহুদিন রোগাক্রান্ত তিনি বাইরের পৃথিবী দেখেননি। রামু জানালা খুলতেই কর্কশ শব্দে হেঁকে ওঠে রোড রোলার। একই সঙ্গে ঘটে বাবার মৃত্যু। ‘মৃত্যু’-র এই অসামান্য উপস্থাপনায় যেন পরিচালক যেন এক ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করান আমাদের। বিশ্বায়নের হাতে সবুজায়নের ধ্বংসসাধন।

শব্দ ও সঙ্গীতের এই অসামান্য মেলবন্ধন আশ্লেষে এক অসামান্য নান্দনিকতায় (Aesthetics) উত্তীর্ণ হয় এই সিনেমার শেষ দৃশ্যে। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় গোটা পরিবার তাদের বাস্তুভিটা ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে ওঠে। রামু ক্লান্ত মনে দেওয়ালের ক্যালেন্ডার খুলে নেয়। আরও একবার লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয় মনে মনে। গাড়ি ছেড়ে দেয়। নেপথ্যে আবার সেই বেহালাবাদক ফিরে আসে। করুণ সুরে বেজে ওঠে বেহালা। হঠাৎই সশব্দে বেহালার তার ছিঁড়ে যায় এবং অসাধারণ মুনশিয়ানার সাথে তার ছেঁড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে ওঠে গণসঙ্গীত। সঙ্গীতের এই অসাধারণ Conjunction আরও একবার আমাদের মথিত করে। আমাদের ভাবতে শেখায় যে শেষ বলে কিছু নেই। যেমন নেই শুরু। আছে শুধু চলাচলের মাঝখানে জ্যোতিষ্কের মতন ভেসে ওঠা ‘নাগরিক’ জীবনদর্শন। মধ্যবিত্ত আটপৌরতা। আমাদের বেঁচে থাকা।

আবার আগামী সংখ্যায়

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...