মস্তকে ফণীর দংশন— আদানি-কাণ্ডে নিরপেক্ষ তদন্ত অসম্ভব

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


মে ২০২৩ থেকে আজ আগস্ট ২০২৪, এই সময়ে মাধবী বুচ টানা আদানি-তদন্তের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। অথচ সেই সময় কিনা তাঁরই টাকা খাটছে আদানিদের বেনামি কোম্পানির খাতায়। এমনকি একই সময়ের মধ্যে বারদুয়েক গৌতম আদানির সঙ্গেও মাধবীর বৈঠক হয়। এমন তদন্তেরও কি নিরপেক্ষতা বাস্তবে সম্ভব?

 

আবারও আদানি, আবারও হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। ভারতীয় রাজনীতির আকাশে আবারও দুর্নীতির কালো ছায়া। ভীষণ গতানুগতিক শোনাচ্ছে বোধহয়। আজ থেকে প্রায় ১৮ মাস আগে যখন আদানি-গোষ্ঠীর আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গ গোষ্ঠীর তরফে তাদের প্রথম তদন্তমূলক রিপোর্টটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়, তার পরবর্তীতে ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে অনেক জল বয়ে যেতে পেরেছে। দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আদানি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলি বিচার করতে নাম-কা-ওয়াস্তে তদন্তেরও ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলের মাধ্যমে মোদি-শাহের সরকার আবারও দিল্লির মসনদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও সংখ্যার নিরিখে তাদের শক্তি কমেছে। এতদসত্ত্বেও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তার কোনও লক্ষণই এখনও অবধি তেমন দেখা যাচ্ছে না। কেবল পূর্বতন দশ বছরের মতোই স্বাধীন প্রশাসনিক সংস্থাগুলির অন্তর্জলী যাত্রার উদযাপন একইরকমে চলেছে।

তারই মধ্যে, ভারত সরকারের তদন্তকারী সংস্থা সেবি-র তরফে যেমনই হিন্ডেনবার্গ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক অদ্ভুত শো-কজ নোটিস জারি করা হয়, তার কিছুদিনের ব্যবধানেই বিগত সপ্তাহে হিন্ডেনবার্গের তরফেও আরও একটি চাঞ্চল্যকর পালটা অভিযোগ সামনে নিয়ে আসা হয়। হিন্ডেনবার্গ সংস্থার বিরুদ্ধে সেবি-র তরফে অবশ্য যে নোটিস জারি করা হয়, আন্তর্জাতিক আইনের জটিলতায় সেই নোটিসের কার্যত কোনও ভিত্তি থাকেনি। পরিবর্তে হিন্ডেনবার্গের তরফে যে অভিযোগ সামনে এসেছে, সরকারিভাবে সেবি-র তরফে তার বিরুদ্ধে তেমন কোনও জোরালো বক্তব্য রাখাই সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় পাশাপাশি মূল অভিযোগ ও তৎপরবর্তী প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কিছু প্রতিক্রিয়ার দিকেই বরং চোখ ফেরানো যাক।

আদানি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যায় অফশোর শেল কোম্পানি তৈরি ও তার মাধ্যমে স্বদেশের শেয়ারবাজারকে অসাধু উপায়ে নিয়ন্ত্রণ, প্রাথমিকভাবে হিন্ডেনবার্গ গোষ্ঠীর তরফে এই অভিযোগ সামনে আসতেই দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ বিতণ্ডা-বিতর্কের পর অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকার, বিরোধী চাপের কাছে নতিস্বীকার করে সেবি-র মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্তের হুকুম দেয়। ২০২৩-এর মে মাসে সর্বোচ্চ আদালতের বিশেষজ্ঞ কমিটি রিপোর্ট দিয়ে জানায় সেবি-র প্রাথমিক তদন্ত অনুসারে সেই সময় আদানি-গোষ্ঠীর কার্যকলাপে অসাধু উপায়ে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ অথবা অন্য কোনও বিধি লঙ্ঘনের কোনও প্রমাণ মেলেনি। হিন্ডেনবার্গ গোষ্ঠীর তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, সেবি-র তদন্তের মাধ্যমে যে সদর্থক কোনও কিছু উঠে আসবে এমনটা তাদেরও প্রত্যাশা ছিল না। তারা তাদের নিজেদের রিপোর্টের সত্যতার উপরেই বিশ্বাসে অটুট থাকে। এরপর প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় কেটে যায়। বিগত সপ্তাহে হিন্ডেনবার্গের তরফে যে তথ্য সামনে এসেছে তা প্রমাণ করে কেনই বা হিন্ডেনবার্গের তরফে আগেই জানানো হয়েছিল, সেবি-র তরফে আদানির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়।

হিন্ডেনবার্গের এই নয়া রিপোর্ট অনুসারে দেখা যাচ্ছে সেবি-র কর্ণধার মাধবী বুচ ও তাঁর স্বামী ধবাল বুচ স্বয়ং আদানি-গোষ্ঠীর একাধিক অফশোর শেল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছেন। এমনকি হিন্ডেনবার্গের তথ্য অনুসারে এও দেখা যাচ্ছে— সেবি-র কর্ণধার হিসেবে মাধবী দায়িত্ব নেওয়ার সময়েই, ধবাল বুচের তরফে একটি কোম্পানিকে অনুরোধ করা হয় তাঁর স্ত্রী মাধবীর সেই কোম্পানিতে থাকা সমস্ত শেয়ারকে অবিলম্বে ধবালের নামে বদল করার জন্য। এছাড়াও, সেবি-র কর্ণধার হিসেবে আজ অবধি আদানি-গোষ্ঠীর এক দেশীয় বকলম সংস্থায় (অ্যাগোরা কনসাল্টিং) মাধবীর বিনিয়োগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, একই কোম্পানিতে মাধবীর স্বামী ধবাল স্বয়ং ডিরেক্টর পদে রয়েছেন। হিন্ডেনবার্গের তথ্য অনুসারে আরও অভিযোগ, এই কোম্পানিতে জড়িয়ে থাকার কারণে মাধবী-ধবালের যে অতিরিক্ত আয়, সেবি-র কর্ণধার হিসেবে মাধবী সেই আয়ের হিসেব, নিজের ব্যক্তিগত আয়ের তথ্য দাখিলের সময় উল্লেখ করেননি। জানা যাচ্ছে, সেই আয়ের পরিমাণও নাকি মাধবীর ব্যক্তিগত আয়ের চেয়ে প্রায় ৪.৪ গুণ পরিমাণে বেশি। কাজেই, এহেন পরিস্থিতিতে সেবি-র তরফে আদানি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কতখানি নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব তা আপনারাই বিচার করুন।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, অফশোর শেল কোম্পানি বলতে মূলত বোঝায় কর-বান্ধব ক্ষুদ্রতর দ্বীপরাষ্ট্রগুলিতে, কালো টাকা সাদা করার প্রয়োজনে সেই দেশগুলির দুর্বল আর্থিক নীতিকে ব্যবহার করে বেনামে একেকটি এমন কোম্পানি বা সংস্থা খুলে রাখা। এদের শেয়ারেরই নিয়ন্ত্রিত ওঠানামার মাধ্যমে বৃহত্তর দেশীয় শেয়ারবাজারকে অসাধু উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খোদ সেবি-কর্ণধারেরই যদি এমন কোনও সংস্থা বা কোম্পানিতে বিনিয়োগ থাকে, সে অবস্থায় সেবি-র তরফে যে কতখানি নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব তা নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সেবি-র তরফে কেবল জানানো হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে সেবি যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে আদানি-গোষ্ঠী বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক অনিয়মের যাবতীয় যে অভিযোগ, তার তদন্ত শেষ করতে চায়। সেবি-র তরফে এও জানানো হয় স্বার্থের সংঘাত থাকবে এমন কোনও তদন্ত-প্রক্রিয়ার সঙ্গে মাধবী আর যুক্ত থাকবেন না। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। মে ২০২৩ থেকে আজ আগস্ট ২০২৪, এই সময়ে মাধবী বুচ টানা আদানি-তদন্তের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। অথচ সেই সময় কিনা তাঁরই টাকা খাটছে আদানিদের বেনামি কোম্পানির খাতায়। এমনকি একই সময়ের মধ্যে বারদুয়েক গৌতম আদানির সঙ্গেও মাধবীর বৈঠক হয়। এমন তদন্তেরও কি নিরপেক্ষতা বাস্তবে সম্ভব? সদর্থক কোনও উত্তর মিলছে না।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বড় অদ্ভুতভাবে দেখা যায়, যে জেডিইউ সাংসদ বিগত লোকসভায় হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে আদানি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন, ও সেই পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য জোর গলায় সওয়াল করেছিলেন, আজ সেই একই সাংসদ হিন্ডেনবার্গেরই ‘ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে’ সরব। রাজনীতির নীতিহীনতায় ফুটপাথ বদল করতে আর মধ্যরাতের দরকার পড়ে না।

আদানি-মোদি যোগসাজশের অভিযোগ আজ নতুন নয়। ২০১৪ থেকে ২০২৪, বিগত ১০ বছরে রকেটের চেয়েও দ্রুততায় আদানির সম্পদ বেড়েছে। সামান্য কিছু তথ্যের মাধ্যমেই তা প্রমাণ করা চলে। ২০১৮ সালে প্রথম ১০ ধনী ভারতীয়ের মধ্যে ৮ নম্বরে ছিলেন আদানি। ২০১৩ সালে তেমন ধনী মানুষদের তালিকায় প্রথম ১০-এই নাম ছিল না তাঁর। অথচ ২০২৩, কোভিড-পরবর্তীতেও সম্পদের নিরিখে এক নম্বরে উঠে আসেন গৌতম আদানি। কীভাবে তাঁর এই অসাধ্যসাধন? মোদি-সরকারের বদান্যতায় লাফ দিয়ে দিয়ে সম্পদ বেড়েছে তাঁর। তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ সাল নাগাদ আদানি-গোষ্ঠীর মূল ৬টি কোম্পানির মোট বার্ষিক টার্নওভারের পরিমাণ ছিল ৩৪৫৫ কোটি টাকা। অথচ সেই সময় থেকে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের মধ্যেই স্রেফ বিবিধ প্রকল্প অথবা সংস্থা অধিগ্রহণের মাধ্যমে আদানির মোট সম্পদবৃদ্ধির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৭,২১৯ কোটি টাকা। কীভাবে এই সম্পদবৃদ্ধি?

অন্ধ্রপ্রদেশের গঙ্গাভরম বন্দর অধিগ্রহণেরই বরং উদাহরণ দেখা যাক। বিশেষজ্ঞদের মত অনুসারে ২০১৫ সালে সেই বন্দরের সমস্ত শেয়ারের বাজারমূল্য যেখানে হওয়া উচিত ছিল প্রায় ৭০০০ থেকে ১৩০০০ কোটি টাকা, ছয় বছর পর, ২০২১ সালেও আদানি গোষ্ঠী সেই বন্দর অধিগ্রহণ করতে খরচ করে মাত্র ৬২০০ কোটি টাকা। এমনকি অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে হওয়া চুক্তি অনুসারে দেখা যায়, ২০৩৯ সাল অবধি এই বন্দর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থ আদানি আয় করবে, তার মাত্র ২.৬ শতাংশ পরিমাণ অর্থ কর হিসেবে সরকারকে দিতে হবে তাদের। অর্থাৎ এই একটি বন্দর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আদানি গোষ্ঠী যদি ৮০০ কোটি টাকার কাছাকাছি আয় করে, সেই আয় থেকে সরকারের ভাঁড়ারে যাবে ৪০ কোটিরও কম। নিট লাভ দাঁড়াবে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা। কেবল একটি বন্দরের হিসেবেই অঙ্কের খতিয়ান এমন। এভাবে পরের পর সমুদ্রবন্দর ও বিমান পরিবহণের যে পরিকাঠামোগুলি আদানি-গোষ্ঠীর হাতে বন্ধুভাবাপন্ন সরকার তুলে দিয়ে এসেছে, ও তুলে দিয়ে চলেছে— গুণিতকের হিসেবে আদানির সম্পদ আহরণ ও লাভের পরিমাণ আগামী দিনে যে কেমন উল্কার গতিতেই বেড়ে চলতে থাকবে, তা বুঝতে বোধহয় আর গণিতজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না।

এমন ক্রোনি-ক্যাপিটালিজমের দোস্তিতেই দেশের স্বয়ংশাসিত সংস্থাগুলিকেও কার্যত ‘কিনে নেওয়ার’ স্পর্ধা দেখাতে পারেন আদানি-কর্ণধার। তদন্তকারী সংস্থার প্রধানেরাই সেখানে বিনিয়োগ করেন তাঁর বেনামি, বেআইনি সংস্থায়।  দেশের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ এভাবেই ক্রমশ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হয়ে পড়ছে, এবং বিশেষ এক ব্যক্তির অধীনেই সেই সম্পদের ক্রমাগত সঞ্চয় দেখা যাচ্ছে। নিরপেক্ষ তদন্ত তো দূরস্ত, অদূর ভবিষ্যতে যাঁদের চরম বেআইনি কার্যকলাপের কারণে দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ারও যে প্রবল সম্ভাবনা, সেই আদানি-গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আজ কোন পথে প্রতিরোধ সম্ভব, সেই নিয়েই সকল বিরোধীদের এক মঞ্চে, একত্রিত হওয়া উচিত।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...