বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ঘুঘুডাঙা
তিন.
—বিয়ের আগে তুমি আমাকে দেখতে চাওনি কেন?
ফুলশয্যার রাত। মশারির মতো উপর থেকে ঝুলছে ফুলের চাঁদোয়া। অসংখ্য রজনীগন্ধার শিকলি দিয়ে বানানো ঘেরাটোপ। মাঝে মাঝে লাল গোলাপ রং ভরে দিয়েছে। সারা বিছানায় রজনীগন্ধার কলি ছেটানো। তার মাঝখানে আলতা রাঙানো পায়ের পাতা ছড়িয়ে বসে আছে মঞ্জিনি। পরনে সবুজ আর লালের বেনারসি। ঘোমটায় কপালের অনেকটা ঢাকা। মেহেন্দি লাগানো আঙুলগুলো খাটের উপর আঁকিবুঁকি কাটছিল। প্রশ্নটা করার সময়ে তারা থেমে গেল। আঙুলগুলো যেন কানখাড়া করে অপেক্ষা করছে উত্তরের।
হীরক দেওয়াল ঘেঁষে রাখা চেয়ারে। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। ধুতি ছেড়ে একটা চোস্তা পড়ে নিয়েছে খানিক আগেই। পাঞ্জাবির উপরে এতক্ষণ একটা জওহর কোট ছিল। বন্ধ ঘরে গুমোট লাগায় ঢুকেই ঝুলিয়ে দিয়েছে চেয়ারের পিছন দিয়ে। তারপর চেয়ারে বসে কী বলে কথা শুরু করবে সেটাই ভাবছিল। মেয়েটা নিজেই কথা শুরু করে স্তব্ধতা ভেঙে দিয়েছে। সেজন্য হীরক কৃতজ্ঞতাবোধ করল। একদম অচেনা একটা মেয়ের সঙ্গে কীভাবে কথা শুরু করা যায়, তাও আবার একটা বন্ধ ঘরে বসে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না হীরক। উত্তর দেওয়াটা বরং অনেক সহজ। তিন সপ্তাহের জন্য এসেছি। তখন এসে দেখে পছন্দ করে বিয়ে ঠিক করা যায়?
এরকম ছেঁদো কথায় মানার মেয়ে মঞ্জিনি নয়। এই প্রশ্নটা বাড়িতেও বারবার করেছে। কেউ ঠিকভাবে উত্তর দেয়নি। সবার মধ্যে একটা ভাব যেন আমেরিকায় থাকা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে ধন্য হয়ে যেতে হবে মঞ্জিনিকে। তা কেন, সেই বা কম কীসে? চাইলে অনেক ছেলের লাইন লেগে যেতে পারত। বাপি অনেক বুঝিয়েছে। দ্যাখ আমেরিকায় থাকাটা বড় কথা নয়। পড়াশোনাটা দ্যাখ। আজকালকার কটা ছেলে বাবা-মাকে মানে বল তো। এটার থেকেও বোঝা যায় শিক্ষাসহবত কত ভাল। কীসের ভাল সেটা মঞ্জিনি বুঝতে পারেনি। এ কি বাড়ির কাজের লোক নিয়ে যাচ্ছে যে একবার কথা বলারও প্রয়োজন মনে করেনি? এই কথাটার ঠিকঠাক উত্তর কেউ দিতে পারেনি। নানাভাবে এড়িয়ে গেছে। মা তো বলেই দিয়েছে তোর এই টাস টাস করে কথা বলার অভ্যাসটা ছাড়তে হবে বাপু। আমাকে পেয়ে এতদিন ছড়ি ঘুরিয়েছ, বেশ। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে অমনভাবে কথা বলে আমাদের মুখে চুনকালি দিও না। মায়ের অমনি কথা, মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে তার মনে কি প্রশ্ন থাকতে নেই? যেটা তার জানার দরকার সে প্রশ্ন করবেই। কারও ভাল লাগুক চাই না লাগুক। মনের খচখচি নিয়ে নতুন একটা জীবন শুরু করতে চায় না মঞ্জিনি। তাই উল্টো জেরা করতে ছাড়ল না। দেখতে কিংবা কথা বলতে তো কোনও অসুবিধা ছিল না।
—তখন যদি তোমার আমাকে পছন্দ না হত?
এই কথাটা মঞ্জিনির খুব মনে ধরল। খিলখিল করে হেসে উঠেই আবার চট করে ডানহাত তুলে মুখের সামনে ধরল। হাতে অনেক চুড়ি, বালা। সব রিনরিন করে উঠল। চাপাস্বরে বলল, দরজার বাইরে কেউ নিশ্চয় দাঁড়িয়ে আছে। শুনে ফেলবে।
এই চুড়ির আওয়াজ, ঘোমটার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া গাঢ় করে আঁকা চোখের চাউনি, লাল রঙে রাঙানো ঠোঁটের দরজা পেরিয়ে বেরোনো দাঁতের সারি বন্ধ দরজার আড়ালে একটা নেশার আবহ তৈরি করে। ধীরে ধীরে তাতে আচ্ছন্ন হচ্ছিল হীরক।
—এখন যদি আমার তোমাকে পছন্দ না হয় তাহলে কী হবে? আওয়াজ না করে ফিক করে হাসল মঞ্জিনি।
—এখনও সময় আছে। আমি এই দূরে চেয়ারে বসে আছি, তুমি খাটে। আমরা এখনও এই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বলতে পারি, হে জনগণ, হিতৈষী বন্ধুবান্ধব সবাই শোনো। আমরা খুব দুঃখিত। কিন্তু মেয়ের ছেলে পছন্দ হয়নি, বিয়ে বাতিল।
—যাহ্, তুমি খুব চালাক কিন্তু। বেশ আমার উপর দিয়ে চালিয়ে দেবে।
—যা সত্যি সেটাই বলব। আমার তো অপছন্দ হয়নি। হয়েছে তোমার। বেশ মজা লাগছিল হীরকের এমন চাপানউতোড় খেলতে।
—এ বাবা, আমি কখন বললাম আমার পছন্দ হয়নি? ওটা তো এমনি বলেছি।
হো হো করে হেসে উঠল হীরক। ব্যস তাহলে তো চুকে গেল। আমারও তোমাকে পছন্দ, তোমারও আমাকে পছন্দ। মামালা খতম।
—এই চুপ চুপ আস্তে। বাসরঘরে এত জোরে কেউ হাসে, বাইরে থেকে সবাই শুনে ফেলবে না?
—হাসি কি অন্যায়? শুনুক না।
—তোমার বাড়ি, তুমি বুঝবে। কিন্তু আমাকে এটা বলো, আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি তো আমাকে দেখোনি এখনও।
—এই যে দেখছি। সামনে জলজ্যান্ত বসে আছ, না দেখে যাব কোথায়? তাছাড়া আমাদের বাঙালি বিয়েতে দেখলাম সবরকমের ছোঁয়াছুঁয়ি করিয়ে নেয়। এই যে এক ঘণ্টা ঘটের উপর দুজনের হাত ধানদুর্বো দিয়ে বেঁধে রেখে দিল, আবার হাতের উপর বেলপাতা চাপাল মন শান্ত রাখার জন্য— জানো তো লেকের ধার দিয়ে হাত ধরে হাঁটতে গেলেও এমন নিরুপদ্রবে হাতে হাত রাখার উপায় নেই।
—তুমি কলেজে পড়তে এমন হেঁটেছ বুঝি অনেক?
মেয়েটার চোখে হাসি ঝিকঝিক করে উঠল। সেটা হীরকের চোখ এড়ায়নি। ভালও লাগছিল। এই একদম অচেনা একটা মেয়ে কেমন নেশার মতো ধীরে ধীরে তাকে টেনে নিচ্ছে। মানুষের মন কি এতই চঞ্চল, এত সহজে ভালবাসার একজনকে ভুলে গিয়ে আরেকজনের মধ্যে ডুবে যাওয়া যায়? না কি সে-ই এরকম যার সত্যিকারের কোনও ভালবাসা নেই, মনের কোনও দৃঢ়তা নেই। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল হীরকের। এত সহজে সে রেখাকে ভুলে যাচ্ছে?
কিন্তু কথা বলতে বলতে তো আর এমনি থেমে যাওয়া যায় না। সেটা আরও বেশি অস্বস্তির কারণ হবে। হীরক কথার পিঠে কথা বসাল। না, সে সুযোগ হলে কি এখন এখানে বসে থাকি?
—খুব আফশোস হচ্ছে, তাই না?
হাসলে মেয়েটার চোখে বিদ্যুৎ খেলে। সেটা চোখ এড়াল না হীরকের। কথার খেলাটা বন্ধ করতেও ইচ্ছা হল না। তা একটু হচ্ছে। মুচকি হাসল হীরক। কিন্তু এই যেমন বিয়ের ঘটে ফুলপাতা ঢালার নাম করে আমি তোমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে হাতে হাতে কোষা বানিয়ে এতক্ষণ ধরে তোমাকে জাপটে ধরে দাঁড়ালাম সেটা কি লেকের ধারে গেলেও পারতাম?
—আমার খুব ভয় হচ্ছিল তখন। মঞ্জিনির কথার সঙ্গে শরীরটাও একটু শিউরে উঠল বুঝি। হাতের চুড়িগুলো রিনরিন করে বেজে জানান দিল।
—কেন?
—তুমি যদি অসভ্যতা করো।
—মানে?
—আমার এক বন্ধুর বিয়ে হল, ওইভাবে দাঁড়ানোর সময় সে নাকি বাসে লোকে যেমন অসভ্যতা করে সেরকম করছিল। ছিঃ। মঞ্জিনি হাতের আঙুল দিয়ে বিছানার চাদরে ছিঃ লিখল, স্পষ্ট মনে হল হীরকের।
—অন্য লোকে করলে অসভ্যতা, কিন্তু বর করলে আর আসভ্যতা কোথায়।
—তাহলে তুমি কেন করোনি?
হীরককে কায়দায় পেয়ে গেছে সেই খুশিতে মঞ্জিনি আবার ফিক করে নিঃশব্দে হাসল, মুখের সামনে হাতের আড়াল এনে। হীরকের মনে হল হাতটা সামনে না এলে বুঝি ভাল হত। ওই হাসিটা বারবার দেখবার জন্য মন ছটফট করছিল তার। এই আকর্ষণ থেকে মন সরাতেই তেড়েফুঁড়ে বলল, তুমি কি ল পড়ছিলে?
আবার আওয়াজ না করে হাসি। দেখেছ আমার বিষয়ে তুমি কোনও খোঁজ পর্যন্ত নাওনি। আমি কোন সাবজেক্টে গ্র্যাজুয়েট হলাম সেটাও জানতে না তুমি। আসলে কলেজে তোমার কোনও প্রেমিকা ছিল। সে তোমাকে লেঙ্গি মেরেছে, তখন রাগ করে আমাকে বিয়ে করেছ।
—আচ্ছা তুমি কী পড়েছ সেটা জেনে আমি কী করতাম বলো তো?
—কেন তুমি কী পড়েছ সেটা তো আমি জানি, তার কোনও মূল্য নেই? উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিল মঞ্জিনি। ওর ঘোমটা এখন অনেকটা সরে গেছে। যেভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ক্লিপ দিয়ে আটকানো না থাকলে ঘোমটা আর মাথায় থাকতে হত না।
হীরক যেন অনিকেত কিংবা বুদ্ধর সঙ্গে কোনও বিষয়ে গভীর আলোচনা করছে সেই ভাবটা বজায় রেখেই বলল, আমি যা পড়েছি, তার কতটা বাঁচতে কাজে লাগে আমি জানি না। তুমি কী পড়েছ সেটা তাই অতটা ইম্পরট্যান্ট নয়। কিছু যে পড়েছি আমরা দুজনেই, সেটাই যথেষ্ট। অশিক্ষিত গাঁওয়ার নই, একজন আরেকজনের কথা বুঝতে পারব। আর কী চাই?
মঞ্জিনি চুপ করে একটু ভাবল। তোমার কথাগুলো একটু অন্যরকম। কিন্তু আমার ভাল লাগছে। আর ভয় করছে না। একজোড়া নিশ্চিন্ত চোখ হীরকের মুখে ফেলে বলল মঞ্জিনি। এই বিশ্বাসটা হীরককে তৃপ্তি দিল। তবু জিজ্ঞেস করল, ভয়? কিসের ভয়?
—তুমি আমাকে একবারও দেখতে চাইলে না, কথা বলতে চাইলে না। আমার মনে হচ্ছিল তোমার মনের মধ্যে হয়তো অন্য কোনও ইচ্ছা আছে, হয়তো আমাদের বিয়েটা একটা জবরদস্তির বিয়ে। খুব ভয় লাগছিল আমার। রোজ রাতে শুতে গিয়ে এই ভাবনাই মনের মধ্যে ভিড় করত। এমন তো নয় যে তোমাকে কেউ জোর করে বিয়ে করাচ্ছে। বাড়ির চাপে বাধ্য হয়ে তুমি না দেখে, না কথা বলে একজনকে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছ। তারপরে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে আমাকে মেইড সারভেন্টের মতো ট্রিট করবে। এরকম হয় আমি শুনেছি। ভেবেছি আর ভয়ে হাত পা আমার সিঁটিয়ে গেছে।
হীরকের হঠাৎ খুব লজ্জা হল। মেয়েটা তার চেয়ে ছোট। বয়সে হয়তো বছর পাঁচেকের, কিন্তু অভিজ্ঞতায় আরও অনেক কম। বাড়িতে শেল্টারড লাইফ কাটিয়েছে। তার মতো বাইরের পৃথিবীর অভিজ্ঞতা হয়নি। মনে মনে কত শঙ্কা নিয়ে কাটাচ্ছে, হয়তো প্রাণ খুলে নিজের বিয়েটাও উপভোগ করতে পারেনি। ওর কী দোষ? কেন মিথ্যা এই মেয়েটাকে এমন কষ্ট দিচ্ছে হীরক। ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল হীরক। মঞ্জিনির একদম সামনে এসে দাঁড়াল। ক্লিপ খুলে আলতো হাতে ওর ঘোমটা টেনে দিল মাথার পিছনে। সারা মুখে চন্দনের ফোঁটা, তার সঙ্গে এই শীতের রাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ তুলে তাকাল মঞ্জিনি। বড় বড় চোখের পাতায় দু-এক বিন্দু জলও টলমল করছে। হীরকের মনে হল এই বাচ্চা মেয়েটাকে কাঁদানোর কোনও অধিকার তার নেই। আজ থেকে এই জীবনের দায়িত্ব তার। সেটাকে অবহেলা করতে পারে না হীরক। নিজের ব্যথাকে মনের চোরকুঠুরিতে বন্দি করে রাখতে হবে। তার মনের রেখা চিরদিন তার হয়ে থাকবে। কিন্তু মঞ্জিনির জন্যেও তাকে জায়গা বানাতে হবে। আরেকটা মেয়েকে ঘরে এনে কষ্ট দিতে পারে না সে।
—তোমাকে বাড়িতে কী বলে ডাকে মঞ্জিনি?
—কেন আমার এই নামটা তোমার পছন্দ নয়?
—খুব পছন্দ। কিন্তু দিনে অনেকবার করে ডাকতে হবে তো, দাঁত ঝিনঝিন করতে পারে।
হাসতে হাসতে হাতের দুই পাতায় ওর মুখটা তুলে ধরেছিল হীরক। মঞ্জিনির চোখে আবার হাসির ঝলক। ও মা, খুব অসভ্য তো তুমি? আমার নামটা নিয়ে ঠুকে দিলে।
—আমেরিকায় গিয়ে তোমাকে ল পড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে, বেশ উকিলি বুদ্ধি তোমার। বাড়িতে কেউ জজ ব্যারিস্টার আছে না কি?
—ধ্যাত! আমাকে মা ডাকে মনু বলে। কিন্তু বাবা ডাকে জিনি। আমি সামনে দাঁড়ালেই না কি বাবার সব প্রবলেম মিটে যায়, তাই আমার নাম জিনি।
—বাহ, এটাই বেশ নাম। জিনি। আমার জীবনেও অনেক প্রবলেম জিনি। অনেক সমস্যা। তুমি সব মিটিয়ে দেবে তো, জিনি?
[আবার আগামী সংখ্যায়]