বিলাল হোসেন
একটা সময় ছিল লেখকরা ছোটগল্প লিখতেন আবেগ আর মস্তিষ্ক দিয়ে। ধারণা করি, লিখতে লিখতে কাঁপতেন নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায়। লেখকের চোখের ভেতরে, করোটির ভেতরে ছোটগল্পের প্রদীপশিখা বিচিত্ররঙ নিয়ে জ্বলত। প্রদীপশিখার সলতেতলায় ভিন্নতর উপকরণ সজ্জিত থাকত। ফলে প্রদীপে প্রদীপে, শিখায় শিখায় ছিল নতুনত্ব-ভিন্নতা-বিচিত্রতা। গল্প লেখকদের সে হৃদয়দৃষ্টিকরোটি আজ আর নেই। নিরীক্ষার সলতে নিভে গেছে; নিভে যাচ্ছে; উড়ছে শেষ জামানার ধোঁয়া। এ আমার কথা নয় — এতটা সাহস আমার নেই। বলছেন, লেখকরাই। তারা প্রখ্যাত। তারা গল্পকার। ছোটগল্প লিখতে পারাটা একসময় কৃতির ছিল, গর্বের ছিল, চায়ের টেবিলে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। ছোটগল্প লেখকের হৃদয়ের মণি, আদরণীয় ছিল। তারা ছোটগল্প নিয়ে জেগে উঠত, ছোটগল্পকে বুকের মধ্যে বহন করতে করতে রাস্তায় রেস্তরাঁয় সময় কাটিয়ে ছোটগল্প নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ত।
ছোটগল্পের একটি সোনারঙা যুগ ছিল।
একথার অর্থ কি এই যে, এখন আর কেউ ছোটগল্প লিখছেন না? ছোটগল্পের বই ছাপা হচ্ছে না, লেখকরা, ছোটগল্প নিয়ে আর আলোচনায় মাতেন না? না, এসবই হচ্ছে, শুধু কিছু একটা ফাঁক রয়ে গেছে, যে ফাঁক জুড়ে জ্বলতে থাকত প্রক্ষিপ্ত চিরন্তন শিখা। থাকত নিত্যনতুন খোলসে নিজেকে জানানো, চেনানো। এখন নেই নতুন রূপের ঝঙ্কার। ছোটগল্প থেমে গেছে মূলত। সাহিত্যের অন্যতম শাখা উপন্যাসকে চ্যালেঞ্জ করে যার উৎপত্তি, কালক্রমে সেই উপন্যাসের কাছেই হয়েছে তার প্রবল পরাজয়। সাম্প্রতিককালের মুখ থুবড়ানো সাহিত্য শাখাটির নাম — ছোটগল্প। এই নুয়ে পড়া, ধ্বসে পড়া পরিচর্যাহীন রুগ্ন শাখাটির ওপর ফিনিক্স পাখির মতো সাহিত্যাকাশে ডানা মেলে দিয়েছে অণুগল্প। অণুগল্প উড়ছে। অণুগল্প ডাকছে। তার স্বর আলাদা। রঙ আলাদা। আকার আকৃতি চরিত্র আলাদা। স্বভাবে কি বদস্বভাবেও। সে সুর তুলছে, গান গাইছে, সে সবাইকে টানছে, দেখাচ্ছে। বলছে — এই আমি অণুগল্প। অণুগল্পই। আমি ছোটগল্প নই। দেখো, আমাকে দেখো।
এই দেখাটাই, জানাশোনাটাই হল আজকের আলোচনা। তবে স্বীকার করে নিতেই হচ্ছে অণুগল্প আর ছোটগল্পের পার্থক্য টানা কঠিন কাজ। এই দুই প্রকার গল্পের ফর্মাটের মধ্যে ছোটগল্প প্রতিষ্ঠিত। উনবিংশ শতাব্দী হতে এর আলোচনা হয়ে আসছে। এর সংজ্ঞা আছে। যদিও একেকজন লেখকদের সংজ্ঞা একেক ধরণের। যুগে যুগে এ সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে নতুন লেখকদের হাতে এসেছে নতুন সংজ্ঞা, পুরাতন সংজ্ঞা বাতিল হয়ে গেছে। বর্তমান নিবন্ধে আমার চেষ্টা থাকবে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত শাখা ছোটগল্প এবং নবীনতম শাখার অণুগল্পের পার্থক্য তুলে আনা, নিরালম্বভাবে। এ-পার্থক্যরেখা আমরা দু’ভাবে টানব। প্রথমত, এই দুজাতের সাহিত্যজাতকের উৎপত্তিসহ তাদের নিজস্ব সময়টাকে তুলে ধরা। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, এই দুই শাখার রূপগত পার্থক্য তুলে ধরা। অর্থাৎ এই দুয়ের কাঠামো শৈলীর মধ্যে সেই প্রাচীরটুকু দেখিয়ে দেওয়া, যেটি না-দেখা পর্যন্ত পাঠক আলোচক কেউই ঠিক ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না — তারা উভয়ই আলাদা, স্বতন্ত্র। আজকের আলোচনা প্রথম অংশের।
উনিশ শতক, একবিংশ শতক : ছোটগল্প, অণুগল্পের সৃষ্টিমুহূর্ত
ছোটগল্প তার ছোটকাল থেকেই, আরও সুনির্দিস্ট করে বললে — জন্মমুহূর্ত থেকেই অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক একটি আলাদা ধরণের নতুনতর একটি আইটেম হিসেবে সাহিত্যমোদীদের দৃষ্টি কাড়ে। এ-সংশ্লিস্ট ব্যক্তিরা ছোটগল্পকে একটি পোশাকি নামও সে সময় দিয়েছিলেন — Peculiar product। এই Peculiar productটি উনিশ শতকের সৃষ্টি, উনিশ শতকেই সূর্যের মুখ দেখে, রোদ গায়ে মাখে, ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠে এবং বড় হতেই থাকে। এজন্যেই বলা ভালো উনিশ শতক হল ছোটগল্পের। ভাবতে অবাক লাগে, উনিশ শতকের আগে ছোটগল্পের মতো কোনও বস্তু ছিল না। ‘এ নভেলাও নয়, রোমান্সও নয়। এ কবিতার মতো ঐকভাবাশ্রয়ী — অথচ কল্পনামুখ্য নয়, জীবননির্ভর। আবার সেই জীবনের সামগ্রিকতার প্রতিচ্ছবিও এতে নেই — এতে খণ্ডতার ব্যবহার। সুতরাং এ বস্তু স্পষ্টই ‘অভিনব’ — এ হল একটি Peculiar product। অন্যদিকে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রথমার্ধ থেকে অণুগল্পের যাত্রাসূচনা হয়েছে। অবশ্য এই ঐতিহাসিক যাত্রার কারণ হিসেবে কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা সামনে ছিল না। সাহিত্যমোদীদের কাছে অণুগল্প কোনও স্পষ্ট ছাপ রাখেনি, সাহিত্যপাঠক এর নতুনত্ব, অনন্য স্বাদ কিংবা এর আলাদা শৈলী কি অবকাঠামোর কোনও ধাক্কা অনুভব করেননি। পাঠক বুঝতেই পারেননি অণুগল্প এসে গেছে। তবে লেখকদের মধ্যে একধরণের অস্থিরতা নিশ্চয়ই ছিল। এ-অস্থিরতা ছিল অমোঘ, বিব্রতকর আর বৈপ্লবিক। সুতরাং, একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পাঠকের মধ্যে যত না সাড়া এসেছে, পরিবর্তন এসেছে তারচেয়ে বেশি লেখকদের মধ্যে। উচ্ছ্বাস আর দৃঢ়তা ছিল অণুগল্পকারদের মধ্যে। তাদের কাছে অণুগল্প একটি আলাদা জ্যোতিষ্ক, একটি আবিষ্কার।
উনিশ শতক বা একবিংশ শতক ছোটগল্প/অণুগল্পের জন্মলগ্ন হওয়ার কারণ
এটা বলা বাহুল্য যে, ছোটগল্পের জন্মলগ্নটিতে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে এমন এক অন্তর্লীন দীর্ঘশ্বাস প্রবল থেকে প্রবল হয়ে উঠেছিল যে পরিবার এবং ব্যক্তি সংকট যেন পৃথিবীর আকাশ বাতাস গ্রাস করে নিয়েছিল। এই যে বিরূপকাল, এর ভেতর থেকেই এক দুঃখকষ্টক্ষতের গভীরভাবে উচ্চারিত শব্দপুঞ্জ-ই হল — ছোটগল্প। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন — ছোটগল্প হল যন্ত্রণার ফসল। ‘হয় সামাজিক সংকট — নয় ব্যক্তিক সংকট — উনিশ শতকের ছোটগল্পে এই দ্বিবিধ যন্ত্রণা বিদ্যমান। ছোটগল্প যন্ত্রণার ফসল রূপেই এই সময় প্রথম অঙ্কুরিত হয়েছে।’ অন্যদিকে, কোনও সামাজিক পারিবারিক রাষ্ট্রিক বা একান্তই কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক দুর্বিষহ ক্ষত ও ক্ষতির বিষয় ছিল না — অণুগল্পের জন্মলগ্নে। মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা হতাশা ক্ষয়ক্ষতির লভ্যাংশ কিংবা সাহিত্যসহ যাবতীয় সামাজিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিস্তরঙ্গ ছিল। শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির একটি ওয়েবে সমাজ রাষ্ট্র এবং ব্যক্তি খড়কুটোর মতো ভাসছিল এর যথেচ্ছ ও যথেষ্ট ব্যবহারে। একবিংশ শতাব্দীর বিশেষত্ব এটুকুই। বাকিটা ফলাফল।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : ছোটগল্প, অণুগল্প
একথা বলা বাহুল্য যে, ছোটগল্পের যখন ব্যাপক আবির্ভাব ঘটেছিল সেই উনবিংশ শতকে — সাহিত্যের আকাশে নতুন তারা ছোটগল্পের উজ্জ্বল বিকিরণচ্ছটায় তারকাসম উপন্যাসের দীপ্তি নিভে নিভে আসছিল। পাঠকেরা ছোটগল্পকে লুফে নিয়েছিলেন। তারা ছোটগল্পের ছোট পরিসরের ভেতরে নিজেদের রাষ্ট্রের এমনকি গোটা পৃথিবীর ভাঙনের সংকটের বিচ্ছিন্নতার রক্তাক্ত হওয়ার একথোক তথ্য/কাহিনি/দর্শন পেয়ে যাচ্ছিলেন। ফলে উপন্যাস জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিরাজিত অবস্থানটি আর ধরে রাখতে পারছিল না। দীর্ঘদীর্ঘ কাহিনি পাঠের প্রতি জনমানস মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। সেই থেকে উপন্যাসের সংকোচনকাল শুরু হয়েছিল।
সাহিত্যের একটি মাধ্যম সৃষ্টি হওয়ার পর কতদিন টিকে থাকবে, কেন টিকবে অথবা টিকবে না, নতুন মাধ্যম আসার নিয়ামকগুলি কী কী, এ-ক্ষেত্রে পাঠকসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর কী ধরণের তাড়না থাকে — বিষয়গুলি খতিয়ে দেখার দরকার আছে। দেখবও।
উপন্যাসকে হটিয়ে প্রবলভাবে উত্থিত ছোটগল্পের প্রারম্ভকালের জননন্দিত আনন্দযাত্রা এবং শত বছরের নানান পথ বাহিত হয়ে একবিংশ শতকে এসে এই মাধ্যমটির উজ্জ্বলতা নিরীক্ষার সময় ঘনিয়েছে।
কেমন আছে ছোটগল্প?
এক কথায় ভাল নেই ছোটগল্প। এই যে ‘ভাল নেই’ বলছি — এটা আমি বলছি না। প্রশ্নটি অনেক আগেই উচ্চারিত হয়েছে। অনেক আগে থেকেই ‘বাঁচা-মরা’ ‘আছে-নেই’ প্রসঙ্গ নিয়ে মহলে মহলে আলোচনা হয়েছে। নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই এই আলোচনা সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে।
‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে’ বলে চিন্তার প্রথম গাছটি লাগিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। পরবর্তীতে এই চিন্তাবৃক্ষের শাখাপ্রশাখা বৃদ্ধি পেয়েছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই প্রশ্নটিকে একধরণের ‘উদ্ভাবন’ বলে মনে হয়েছে অনেকের কাছে। সে রকমই একজন হলেন কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন —
‘ইলিয়াস একবার এই প্রশ্ন উদ্ভব করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প থাকবে কি থাকবে না। আমি যেহেতু সাহিত্যের কোনও সংজ্ঞা পাই না, সেহেতু ছোটগল্প বাঁচবে কি মরবে বলতে পারব না। তোমাকে যদি বলা হয় ছোটগল্প কী? সেই প্রশ্নের জবাবই যদি না দিতে পারো, তাহলে সেটি টিকবে কি টিকবে না তুমি কেমন করে বলবে? আমি তো সেখানে এই প্রশ্নটি তুলেছি। আমাদের বনফুল যেগুলো লিখেছেন, দশ পনেরো লাইনে, সেটা কি ছোটগল্প? ‘ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’ সেটা কী? এইগুলি কি পাঠ্য হয়েছে বলে লোকে পড়ে? না উপন্যাস হয়েছে বলে বা ছোটগল্প হয়েছে বলে পড়ে, না হলে পড়ত না? তাহলে আমার দেখার দরকার কী? আমি ভেবেচিন্তে সবকিছু দেখেশুনে ডেফিনেশন ঠিক করে লিখতে বসব? আমি কি খাজাঞ্চিখানার হিসাবরক্ষক? সেজন্যে আমি বলি, প্রতিনিয়ত ছোটগল্প বদলে বদলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প এখন কি কেউ লিখবে? আমাদের যে তরুণরা, এখন যারা লেখে, তারা রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প লেখার কথা ভাবে? না।’
না, লিখছে না। ছোটগল্পের আগাপাশতলা বদলে গেছে। যে সংজ্ঞায় গত দুইশ বছর আলোড়িত হয়েছে ছোটগল্প, সেখান থেকে অনেক আগেই সরে এসেছেন ছোটগল্পকারগণ।
যে সামাজিক আর ব্যক্তিক টানাপোড়নের ফলস্বরূপ উনবিংশ শতাব্দীতে ছোটগল্পের আগমন ঘটেছিল, সেরূপ সামাজিক অস্থিরতা আর ব্যক্তিমানসের সংকট হয়ত নেই; — কিন্তু নেই বললেই তো ‘নেই’ হয়ে যায় না, এরূপ অস্থিরতা আর সংকট কোন্ কালেই বা ছিল না, মাত্রার পরিমাণ কমবেশি হতে পারে।
অণুগল্পের আবির্ভাবকাল এই একবিংশ শতকেও সংকট আছে — রাজনৈতিক ধর্মীয় সাংস্কৃতিক — অণুগল্পের বুকের ভেতরে সেইসব সংকটের কালোছাপ পাই; পাই বিষয়বস্তু হিসেবে।
কিন্তু সংকটের ঔরসজাত সন্তান হিসেবে উনবিংশ শতকের গর্ভে যে ছোটগল্প বেড়ে উঠেছিল, একবিংশ শতকের সংকটজাত সন্তান হিসেবে অণুগল্পের আবির্ভাব ঘটেনি — নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ছাপাখানা, ফেসবুক
বাংলা ছোটগল্প শুধু নয়, বিশ্বের ছোটগল্পের সাথে ছাপাখানার আবিষ্কার ও এর বিকাশ-প্রসার জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিকভাবে। ছাপাখানা আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষ আত্মপ্রচারণার তাগিদ অনুভব করে। এই তাগিদ থেকেই মূলত সাহিত্যের সৃষ্টি।
উপন্যাসের জন্ম হল।
বাংলা উপন্যাসের আগে উপন্যাসের পূর্বসূরি ছিল নভেলা। এইসব সাহিত্য আকারে বড়। ততদিনে চলে এসেছে চূর্ণক, আখ্যান, নক্সা। মানুষ স্বাদ পাল্টাতে চেয়েছিল। যেমন বিশ্বসাহিত্যে হয়েছে। সবদেশের সংবাদপত্র চেয়েছে লোকেরা ছোট ছোট গল্প পাঠ করুক। ছোটগল্পের জন্যে কম জায়গা লাগে। প্রতি সংখ্যাতেই নতুন নতুন গল্প প্রকাশ করা যায়। ফলে পত্রিকার গ্রাহক-পাঠককে ধরে রাখা সহজ হয়ে যায়। এইভাবে সংবাদপত্র পাঠক বৃদ্ধি-ধরে রাখা-সাহিত্যরুচি নির্মাণই শুধু না, ছোটগল্পকারও তৈরি করে। বিশদ আলোচনা পরে হবে। অন্যদিকে অণুগল্পের সাথে এই ধরণের কিছুই জড়িত নয়। সংবাদপত্র অণুগল্পের জন্যে কোনও অবদানই রাখেনি, রাখছে না। অণুগল্পের প্রচার ও প্রসারে কিছু কিছু অবদান এসময়ের ছোটকাগজ রেখেছে। তাদের তালিকা পরে দেওয়া হবে। যদি বলতেই হয়, বলব — অণুগল্পের উৎপত্তি, একই সাথে চর্চার প্রধান বাহন হিসেবে কাজ করছে ফেসবুক, ফেসবুককেন্দ্রিক গ্রুপ, বৃহৎ অর্থে ইন্টারনেট। ফেসবুকই হল অণুগল্পের মূল প্রেরণা।
সংবাদপত্রের আনুকূল্য
উপন্যাস ছাপাতে সম্পাদকদের বেশ বেগ পেতে হত জায়গার সঙ্কুলান নিয়ে — এটা তো ছিলই। পাশাপাশি দীর্ঘপাঠে পাঠকরাও বুঝি একটু ক্লান্ত হয়েছিল — সেই পাশ্চাত্যে। এই দুই প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলে হয়ত ছোটগল্পের জন্মই হত না। বিষয়টা ধরা পড়েছিল সম্পাদকের কাছে। অর্থাৎ পত্রিকার সম্পাদকদের ব্যবসায়িক বুদ্ধির তাড়না একই সাথে স্থান সঙ্কুলানের প্রশ্ন দেখা না দিলে হয়ত ছোটগল্পের আদৌ জন্ম হত কি না — অনেকেই সন্দেহ করেন। ‘উনিশ শতকের যুগ মানস ছোটগল্পের ভাব সত্যকে জন্ম দিল এবং সংবাদপত্র তার কায়ারূপ নির্মাণ করল।’
‘সাংবাদিকতার প্রয়োজনেই স্কেচধর্মী রম্যতার আবির্ভাব ঘটেছিল ইংল্যান্ডের ট্যাটলার-স্পেক্টেটর-রয়ামব্লারে। হথর্ন, পো, এবং হেনরি জেমস বিখ্যাত ম্যাগাজিনিস্ট, ফ্লোব্যার-বালজ্যাকের মুখ্য আশ্রয় পত্রিকা, মপাসাঁ তার তিনশোর ওপর গল্প পত্রিকার প্রয়োজনেই প্রধানত লিখেছেন; চেখভকে ডাক্তারি পড়বার খরচ চালাতে হাসির নক্সা দিয়ে পত্রিকার পাতায় হাত মকশো করতে হয়েছে — তারপর লিখতে হয়েছে গল্প।’
বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের শিল্পমান বৃদ্ধি এবং নির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রণয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি একটি আলোচনাসভার আয়োজন করে বিশিষ্ট লেখকদের ডাকলেন। ওই সভায়, ছোটগল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে যত না কথা হল, বাদানুবাদ আর ছোটগল্পের যুক্তি-দর্শন নিয়ে কথা হল বেশি। ফলে একথা প্রতীয়মান হল যে, বাংলা ছোটগল্পের যাবতীয় বিষয়টি আসলে পাশ্চাত্যের সৃষ্টি এবং বাংলা ছোটগল্প মূলত পাশ্চাত্যের ছোটগল্পকেই আত্মস্থ করবে, অনুকরণ করবে। সে আলোচনাচক্রে যারা উপস্থিত ছিলেন — প্রমথ চৌধুরী, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি; — এই মর্মে একমত হলেন প্রচুর পরিমাণে পাশ্চাত্য ছোটগল্পের অনুবাদ হতে হবে। সে দায়িত্ব নিয়েই আলোচনাচক্রটি শেষ হল।
এদিকে আধুনিক গল্পের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ ছোটগল্প লিখতে শুরু করেন সাপ্তাহিক ‘হিতবাদী’ পত্রিকার আমন্ত্রণে। রবীন্দ্রনাথ দুহাতে লিখতে শুরু করলেন ১৮৯২ সালে। লিখলেন — দেনাপাওনা, পোস্ট মাস্টার, গিন্নী, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান, তারাপ্রসন্নের কীর্তি।
বাংলা সাহিত্য পেল মৌলিক ছোটগল্প।
হিতবাদী কর্তৃপক্ষ আড়ালে আবডালে রবীন্দ্রনাথকেও পরিচালনা করতে লাগলেন। বললেন — রূপকভাব একটু কমিয়ে দিলে গল্পের মধ্যে যে আঠালো দুর্বোধ্যতা আছে — সেটি কমে যাবে। অলংকারে ব্যঞ্জনা না থাকলে গদ্য ঝরঝরে হয়ে যাবে, গদ্য বর্ণানাত্মক না হলে পাঠকপ্রিয়তা পাবে। রবীন্দ্রনাথ পরামর্শগুলি নিলেন এবং আরও ৬টি গল্প লিখলেন।
এইভাবে পত্রিকাগুলি ছোটগল্প ও গল্পকারদের জন্যে পথ কেটে দিচ্ছিলেন। ছোটগল্প পাচ্ছিল আনুকূল্য। অণুগল্পের ক্ষেত্রে এসবের কিছুই হল না। গুটিকয়েক লিটলম্যাগ, দু’চারটি অন্তর্জাল পত্রিকা অণুগল্পকে কাছে টেনে নেওয়া ছাড়া বাদবাকি সব অন্ধকার। আনুকূল্যহীন একবিংশীয় অন্ধকার।
তথ্যসূত্র :
বাঙলা সাহিত্যে গদ্য – সুকুমার সেন
প্রবন্ধ সমগ্র — হাসান আজিজুল হক
সাহিত্যে ছোটগল্প — নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়
রচনা সমগ্র-৩ — আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
অণুগল্পের অস্তিত্ব আছে — বিলাল হোসেন