নরকগামী

সহদেব হালদার

 


লেখক পেশায় একটি সরকারি অফিসে কন্ট্রাকচুয়াল সুইপার। নাটক, গান, ছড়া লেখেন। নাটক করেন, যাত্রা করেন

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

দ্বিতীয় দৃশ্য

[আলো জ্বলতেই দেখা গেল লীলাবাইয়ের নাচঘরে সারেঙ্গির সুরে উস্তাদজি তবলা বাজাচ্ছেন আর তালে তালে লীলাবাই নাচছে। হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ হয়]

লীলাবাই: এই অসময়ে আবার কে এল? উস্তাদজি দেখিয়ে তো কোন বাবু এসেছে…

উস্তাদজি: দেখতা হু। (গিয়ে দরজা খুলে) বাবু না আছে বেটিয়া। এ তো কোই আনজান লেড়কি অউর এক নান্নিমুন্নি পেয়ারি বাচ্চা আছে…

লীলাবাই: কই দেখি, দেখি… (দৌড়ে যায় দরজার দিকে) আরিব্বাস! একদম খাসা চিজ আছে উস্তাদজি! শুধু একটু তালিম দিলেই সারে মার্কেট হামাদের হয়ে যাবে…

উস্তাদজি: সাচ বলিয়েছ বেটিয়া। (দরজার দিকে তাকিয়ে) আও বেটি আও…

[ঘরে প্রমীলা ও কমলার প্রবেশ]

প্রমীলা (হাত জোড় করে): দয়া করে আমাদের দুই মা-মেয়েকে আপনাদের বাড়ির এক কোণে একটু আশ্রয় দিন। আমরা যে আশ্রয়হীন…

লীলাবাই: তুকে দেখে তো মনে হচ্ছে কোনও আমির আদমির বিবি আছিস…

প্রমীলা: আপনি ঠিকই বলেছেন…

লীলাবাই: অ্যায়সি হালত তোর কেন হল?

প্রমীলা: স্বামীর দুর্ব্যবহারের কথা বলতে খারাপ লাগে দিদি…

লীলাবাই: দিদি! যা, তু যখন হামাকে দিদি বোলিয়েছিস তখন তুকে তো আর তাড়াতে পারি না। (কমলাকে) আ বিটিয়া, হামার কাছে আ… (কমলাকে কোলে তুলে নিয়ে উস্তদজির দিকে ফিরে) উস্তাদজি…

উস্তাদজি: হ্যাঁ বেটি…

লীলাবাই: এনাদের উপর মে লিয়ে যান। (কমলকে কোল থেকে নামিয়ে) যাও…

উস্তাদজি: ঠিক হ্যায়… চলো বেটিয়া, উপর চলো… (প্রস্থানে উদ্যত)

লীলাবাই (পেছন থেকে ডাকে): উস্তাদজি…

উস্তাদজি: কুছু বলবে বেটি?

লীলাবাই: ইয়ে লোগ এখন হামার আপনা আছে। ইনকে লিয়ে উপর মে একটা আচ্ছা ঘর দেখিয়ে দিন। (প্রমীলাকে) আজ থেকে তু হামার বহেন বনিয়ে গেলি। (কমলার চিবুক ধরে) অউর তেরা ছোটিসি নান্নিমুন্নি হামাদের সকলের বেটিয়া বনে গেল। (আবার প্রমীলাকে) তু চিন্তা মাত কর বহেন। হামাদের লেড়কিকে এমন বানাব, সারে দুনিয়া একদিন ইসকো নাম সে পুকারেগা। (আবার কমলাকে) তেরে লিয়ে একদিন সারা দুনিয়া পাগল হয়ে যাবে মুন্নি। যে তোদের লাথ মেরে মন্দির সে নিকাল করিয়ে দিয়েছে একদিন উস হারামি কো তোদের পায়ের নিচে গিরতে হবে। (উস্তাদজিকে) উস্তাদজি, ইনকো লে যাইয়ে…

প্রমীলা: আমরা যে তোমার গলগ্রহ হয়ে গেলাম দিদি…

লীলাবাই: কেয়া বোল রাহা হ্যায়? তু হামার গলগ্রহ! তোর মুখে এ বাত এল কী করে? হিন্দি মে এক কাহাবত আছে। জিসে হাম আপনা বানায়া/ও মুঝে করদি পরায়া/জিসে হাম দিল মে বসায়া/ও মেরে দিল মে চাক্কু চাপায়া…

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই: একদিন তোর মতো হালাত হামার ভি হয়েছে। তোর মতো হামি ভি ইস কোঠি মে এসেছি। তফাত সির্ফ এহি আছে, তোর মরদ তোকে ইনকার করেছে, তাই তু এখানে এসেছিস। আর হামাকে এখানে পাঠিয়েছে হামার সবচেয়ে কাছের মানুষ— হামার জনমদাতা।

প্রমীলা: কী বলছ দিদি!

লীলাবাই: সাচ বলছি। তখন হামার উমর পনরো সাল হবে। সির্ফ পচাস রুপেয়ার জন্য যমুনাবাইয়ের কাছে হামাকে বিক্রি করিয়ে দিল। হামার নাম ছিল লীলাবতী। হামি বনে গেলাম লীলাবাই।

প্রমীলা: আমাকে তুমি ক্ষমা করো দিদি… (পা ধরতে যায়)

লীলাবাই (তাড়াতাড়ি প্রমীলাকে তুলে ধরে): তু কেন মাফি মাংবি? তোর কাছে মাফি মাংবে ও কুত্তা কি আওলাদ। যে তোকে অউর তোর লেড়কিকে ঘর সে নিকাল করিয়ে দিয়েছে। দোনোকে জিন্দেগি বরবাদ করিয়ে দিয়েছে।

উস্তাদজি: তুম সাচ বলিয়েছ। (কমলাকে) আও বেটিয়া, হামার সাথে আও…

কমলা: আমরা কোথায় যাব?

লীলাবাই: আপনা ঘর মে যাবে বেটি। এ ঘর, এ সারে মহল, শুধু তোর আছে…

প্রমীলা: না দিদি, এত বড় ভুল তুমি কোরো না…

লীলাবাই: হা হা হা… না না, ভুল আমি করছি না…

প্রমীলা: আমার মেয়ে বলে বলছি না… এ যুগের মানুষকে কোনওদিন বিশ্বাস কোরো না দিদি। এরা তোমার বিশ্বাসকে একদিন পায়ের তলায় ফেলে পিষে দেবে। তখন বুকফাটা কান্না ছাড়া আর কিছুই থাকবে না…

লীলাবাই: নেহি রহেগা তো কেয়া হোগা? আরে সারে জিন্দেগি হামার তো কুছ মেলেনি। না পতি, না ঘর, না বাচ্চা, না কোই পেয়ার… কুছ নেহি। লেকিন হা… এক চিজ জরুর মিলা, ও হ্যায় বদনাম… হা হা হা…

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই: তু চিন্তা করিস না। তোর লেড়কি কো হামি এমনভাবে বানাব, সারা দুনিয়ার আদমিরা মুখে মুখে ওর নাম জপ করবে, কিন্তু বদনাম হবে না। হামি ওকে সবসে বড়া নাচনেওয়ালি বানাব…

প্রমীলা: আমি তোমার পায়ে পড়ি দিদি… আমার মেয়েকে তুমি ওই সর্বনাশের পথে ঠেলে দিও না। ওর জীবনটাকে তুমি নষ্ট করে দিও না…

লীলাবাই: তু কী ভাবছিস, তোর লেড়কির জিন্দেগি বরবাদ হয়ে যাবে? বদনাম হয়ে যাবে? আরে হামাদের মতো বিনোদিনী ভি ছিল। এই দুনিয়ার ঝুটা আদমিরা বিনোদিনীকে বদনাম করতে চেয়েছিল। আখির কেয়া হুয়া? কিছুই হল না। লেকিন বদনাম কি বদলে সুনাম মিলেছিল। কারণ প্রভু রামকিষান এবং গিরীশচন্দ্রের মতো ভগবান মিলেছিল।

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই: আমাদের মতো নটী নাচনেওয়ালি ইস দুনিয়া মে না থাকলে তো এই দুনিয়ার শরিফ লেড়কিদের ইজ্জত আর জান হারাতে হবে ওই রাস্তার কুত্তাগুলোর হাতে…

উস্তাদজি: লীলা বেটিয়া সাচ বোলিয়েছে বেটি। তু দেখনা একদিন তেরে ইয়ে লেড়কি কা নাম রওশন হয়ে যাবে। চল বেটিয়া…

[উস্তাদজি কমলার হাত ধরে বেরিয়ে যান]

প্রমীলা: ওস্তাদজি… ওস্তাদজি… (লীলাবাইয়ের দিকে ফিরে) আচ্ছা দিদি, এই কাজ ছাড়া আর অন্য কোনও উপায়ে আমার মেয়েকে নামজাদা করা যায় না? পারি না আমরা ওকে লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চশিক্ষিত করে তুলতে?

লীলাবাই: তেরা দিমাক খারাপ আছে? বাইজির কোঠায় এসে লেখাপড়া করলে উসকা কোই নাম হবে না, বদলে মে ইয়ে দুনিয়াবালে উসকা বদনাম করিয়ে দেবে। কভি বড়ি বনতে দেবে না। সমঝা তু? (বেরিয়ে যায়)

প্রমীলা: হে ঠাকুর সারাজীবন শুধু তোমাকে ডেকে এসেছি চোখের সামনে এই দেখব বলে…. হা হা হা (কান্নায় ভেঙে পড়ে)

[আলো নিভে যায়]

 

তৃতীয় দৃশ্য

[আলো জ্বলতে দেখা যায় উস্তাদজি তবলা বাজাচ্ছে। লীলাবাই তালি দিয়ে তাল, ছন্দ মেলাচ্ছে। কমলা ঘুঙুর পায়ে নাচছে]

লীলাবাই: ধা ধিন ধিন ধা, ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না, তেটে ধিন ধিন ধা…

[এই পর্যন্ত সাউন্ড চলার পর বাকিটা মূকাভিনয় চলতে থাকবে। স্টেজের অন্যদিকে চেয়ার-টেবিলে বসে দ্বিজেন তার দুই বন্ধুর সঙে মদ্যপানে মত্ত। টেবিলে সাজানো মদের বোতল, গ্লাস। তিন বন্ধু গ্লাস নিয়ে চিয়ার্স করে]

দ্বিজেন: তাড়িয়ে দিয়েছি শালীকে। একেবারে চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি…

প্রথম বন্ধু: কাকে তাড়িয়ে দিয়েছিস ভাই?

দ্বিজেন: আরে আমার বৌকে, আবার কাকে! শালী আমাকে কিনা জ্ঞান দেয়! এই দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়িকে জ্ঞান দেবে ওই ছোটলোকের মেয়েটা, আর সেটা আমি মেনে নেব ভাবল কী করে হারামজাদি!

দ্বিতীয় বন্ধু: কারেক্ট। একেবারে খাঁটি কথা বলেছিস তুই। শালা কোথাকার কে চিনি না জানি না বিয়ে করে ঘরে এনে সোহাগ করছি, আদরযত্ন করছি। কোথায় আমার কথামতো চলবি তা নয়, উলটে অবাধ্য হবি! দেব শালীর তলপেটে বারো ইঞ্চি ঢুকিয়ে।

[এবার এপাশে সাউন্ড বন্ধ হবে। মূকাভিনয় চলতে থাকবে। ফোকাস হবে স্টেজের অন্য প্রান্তে]

লীলাবাই: তাক তেরে কেটে ধিন, তাক তেরে কেটে ধিন, ধাগে ধিন ধা, ধাগে ধিন ধা, নাগে ধিন ধা, নাগে ধিন ধা, তেরে কেটে ধিন, তেরে কেটে ধিন…

[আবার মূকাভিনয়, ফোকাস ঘুরে যায় স্টেজের অপর প্রান্তে]

নেপথ্য কণ্ঠ: মার মার… আরে নিজেকে কী ভেবেছে… দাদা হয়ে গেছে? দাদা?

নেপথ্য থেকে অনেকের গলা: শেষ করে দেব। কোনও চাঁদু তোকে বাঁচাতে পারবে না। এই দ্বিজেন্দ্র লাহিড়ি… ঘর থেকে বেরিয়ে আয় শালা…

দ্বিজেন: কার এত বড় হিম্মৎ… শালা আমাকে নাম ধরে ডাকছে! (পকেট থেকে রিভলভার বের করে) কুত্তার বাচ্চাগুলোর গলার আওয়াজ বেড়েছে। ওই আওয়াজ যদি বন্ধ করতে না পেরেছি, তবে আমার নাম দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ি নয়… (চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়)

প্রথম বন্ধু (দ্বিজেনকে আটকায়): দ্বিজেন, মাথা গরম করিস না। ওরা সংখ্যায় অনেকজন আছে। এই সময়ে বের হলে বিপদ অনিবার্য।

দ্বিতীয় বন্ধু: ওরা পূর্ণ রণসাজে সেজে এসেছে। এখন মাথা ঠান্ডা রাখাই আমাদের বুদ্ধিমানের কাজ…

দ্বিজেন: ওরা ঝোপ বুঝে কোপটা মারতে চাইছে। ওরা দ্বিজেন্দ্রলালের ওপরের রূপটা দেখেছে, ভেতরের রূপটা দেখেনি। রাজনীতি আমিও জানি। আমি এমন রাজনীতির চালে মারব, জীবনে কেউ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

[আবার মূকাভিনয়, ফোকাস অন্য প্রান্তে]

লীলাবাই: ধা ধিন ধিন ধা, ধা ধিন ধিন ধা, না তিন তিন না, তেরে কেটে ধিন ধা। কী উস্তাদজি, কেমন দেখছেন?

উস্তাদজি: বহত খুব, বহত খুব। ইয়ে লড়কি নেহি, চান্দ কা টুকরা আছে। তু চিন্তা করিস না বেটিয়া। একদিন ইসকি বজয় সে ইয়ে আন্ধেরা মহল রোশনাই সে ভর জায়েগা। ঝুম উঠেগি ইস মহল…

লীলাবাই: ভাবতে আমার কী ভাল লাগছে! আনন্দে আমি পাগল হয়ে যাব। উস্তাদজি, হাম পুরা দেখ পা রহে হ্যায়, ও দিন আনেওয়ালা… (কমলাকে জড়িয়ে ধরে) তুকে আমি কী বলে ডাকব বল তো? তুকে আমি জান কহকে পুকারুঙ্গা। আজ সে তু হামার জান বনে গেলি… (চুমু খায়)

কমলা: আমার মা কোথায় মাসি?

লীলাবাই: তুর মা ঘর মে আছে বেটিয়া। চল তোকে তোর মা কে পাস রেখে আসি। আইয়ে উস্তাদজি…

উস্তাদজি: চল…

[কমলাকে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে যায়। ফোকাস অন্যদিকে]

দ্বিজেন: বাইরে কোনও সাড়াশব্দ নেই… কী ব্যাপার?

প্রথম বন্ধু: আমি দেখছি… (উঠে গিয়ে জানালা খুলে এদিকওদিক তাকিয়ে) না… বোধহয় আর কেউ নেই…

দ্বিজেন: নেশাটা একটু চড়ে গেছে তাই শুয়োরের বাচ্চারা এ-যাত্রায় বেঁচে গেল। তা না হলে এখানে আজ রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিতাম। এই দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ি কোনওদিন কাউকে ভয় পায় না। যে আমার সঙ্গে টক্কর নেবে তার মৃত্যু অবধারিত।

দ্বিতীয় বন্ধু: এবার তাহলে ওঠা যাক…

[তিনজনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাইরে থেকে বোমা-গুলির আওয়াজ আসে]

অনেক নেপথ্য কণ্ঠ: মার মার মার…

[আস্তে আস্তে আলো নিভে যায়]

 

চতুর্থ দৃশ্য

[আলো জ্বলতে দেখা যায় খাটের ওপর আধশোয়া অবস্থায় প্রমীলা অঝোরে চোখের জল ফেলছে আর আঁচল দিয়ে মাঝেমাঝে চোখের জল মুছছে। ঘরে ঢোকে কমলা]

কমলা: মা… মা… (দৌড়ে গিয়ে প্রমীলার পাশে বসে প্রমীলাকে জড়িয়ে ধরে) জানো মা, মাসি বলেছে আমি নাকি মাসির মেয়ে। আচ্ছা মা তুমি বলো, আমি তোমার মেয়ে হয়ে মাসির মেয়ে হলাম কী করে? জানো মা, আমি না খুব ভাল নাচ শিখেছি। ওস্তাদজি বলেছে, আমি বড় হলে খুব বড় নাচনেওয়ালি হব। আমার নাকি খুব খুব নামডাক হবে…

[প্রমীলা কমলাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে]

কমলা: মা তুমি কাঁদছ কেন?

প্রমীলা: কই আমি কাঁদছি না তো…

কমলা: তবে যে তোমার চোখে জল?

প্রমীলা (চোখ মুছে): ও কিছু না…

কমলা: আচ্ছা মা, বাবা আমাদের ভালবাসে না কেন?

প্রমীলা: জানি না আমি… কিছুই জানি না… হা হা হা… (আবার কেঁদে ওঠে)

কমলা: তুমি কাঁদলে যে আমার একটুও ভাল লাগে না মা! আমি জানি তুমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদো। বাবা আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর তুমি রোজ রাতে গুমরে গুমরে কাঁদো যাতে আমি জেগে না যাই। তুমি জানো না মা, রোজ রাতে আমিও ঘুমাই না। তোমার ফোঁপানো শুনে সারা রাত আমার চোখে জল ঝরে…

প্রমীলা: আমি যে আর পারছি না ভগবান! একদিকে স্বামী-সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে অন্যের আশ্রয়ে আশ্রিতা, অন্যদিকে নিজের মেয়ে দিনের পর দিন নরকগামী হচ্ছে আর আমি মা হয়ে প্রস্তরস্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে দেখছি আর অশ্রু ঝরাচ্ছি। একবার চিৎকার করে কেন বলতে পারছি না— দিও না… আমার কমলাকে তোমরা নরকে ঠেলে দিও না… হা হা হা… (কান্না)

কমলা: মা… ও মা… তুমি অমন করে কথা বলছ কেন? আমার যে বড় ভয় করছে…

প্রমীলা (দ্বিজেনের ছবি হাতে নিয়ে): তুমি এত নিষ্ঠুর হলে কেন গো? কেন আমাদের এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ঠেলে দিলে? আমাদের জন্য তোমার হৃদয় কি এতটুকু কেঁদে উঠল না? আমি না হয় তোমার চোখের বালি, কিন্তু তোমার মেয়ে তো তোমার বড় আদরের! তাকেও তুমি… হা হা হা… (কান্না)

কমলা (প্রমীলার হাত ধরে): মা, ও মা… চলো না… বাবার কাছে ফিরে চলো না… বাবাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। কতদিন হয়ে গেল বাবাকে দেখিনি। কতদিন বাবার হাতের মাখনভাত খাইনি। কাজ থেকে ফিরে বাবা নিজের হাতে করে আমাকে খাইয়ে দিত। তারপর বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম…

প্রমীলা: পারছি না… আমি আর পারছি না… হা হা হা… (কান্না)

কমলা: আমি আর কোনওদিন তোমার কাছে বাবার কথা বলব না মা…

[লীলাবাইয়ের প্রবেশ]

লীলাবাই: কই আমার রাজকুমারী কমলা কই?

কমলা: মাসি, তুমি এসেছ… খুব ভাল হয়েছে। জানো মাসি, মা তো রোজ বাবার কথা ভাববে, আর রোজ কাঁদবে। আচ্ছা মাসি, মা যদি রোজ কাঁদে আমার কি ভাল লাগে তুমি বলো…

লীলাবাই (কমলাকে কোলে তুলে নিয়ে): বিলকুল নেহি। একদম ভাল লাগবে না। প্রমীলা তু কেন করছিস এমন? হামি শাদি নেহি কিয়া, মগর পতি হারানোর দর্দ হামি বুঝি। তাই বলে এতটুকু বাচ্চার সামনে তু রোজ রোজ অ্যায়সি হরকত করবি, ওর কি ভাল লাগবে? দেখ বহেন, ইসকি জিন্দেগি তু বরবাদ করিয়ে দিস না…

প্রমীলা: ওর জীবন তো বরবাদ হতে চলেছে দিদি… নতুন করে আমি আর কী বরবাদ করব?

লীলাবাই (কমলাকে কোল থেকে নামিয়ে): কেয়া বোলা তু? হামি তোর লেড়কির জিন্দেগি বরবাদ করিয়ে দিচ্ছি? গলত সমঝতে হ্যায় তু, গলত! আরে তোর পতিদেবতা তোকে ঘরসে নিকাল করিয়ে দিল। পড়ে থাকতিস বিচ সড়ক পর। অউর রাস্তার কুত্তাগুলো তোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত…

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই: তু দুনিয়া দেখেছিস? দেখিসনি। হামি দেখেছি কিতনা খতরা। এমন তো হতে পারত, তু হামার ঘরে আশ্রয় না মেঙ্গে দুসরা ঘর মে যাকে আশ্রয় মাংতিস। সাহারা মিলত… কিন্তু ও লোক তোর ওই কমলাকে বাহার মে চালান করিয়ে দিত, অউর তেরা ইজ্জত নিয়ে খেলত…

প্রমীলা: না…

লীলাবাই: শুনেই তোর এত ডর এসে গেল? আগর অ্যায়সা হোতা তো তু কী করতিস? শুন তু সাফ বোলে দে… কমলাকে এ লীলা জ্যায়সা নাচনেওয়ালি বানাবি কি না?

প্রমীলা: হা হা হা… (কান্না)

লীলাবাই: আগর না বানাবি তো তুম মা-বেটিকো হামি ইখানে রাখব না। হামার বাড়ি থেকে তোদের চলে যেতে হবে…

প্রমীলা: আমাদের তুমি তাড়িয়ে দিও না দিদি… আমরা মা-মেয়ে কোথায় যাব?

কমলা: মাসি, বাবা আমাদের ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, এবার তুমি আমাদের তাড়িয়ে দেবে?

লীলাবাই (কমলাকে কোলে তুলে নিয়ে): আরে নেহি রে নেহি… হামি তোদের তাড়িয়ে দেব না। লেকিন তোর মা এমন কেন করছে বল তো?

কমলা: আমি কোথাও যাব না। আমি এখানে থাকব। তোমার থেকে নাচ শিখব। আমার অনেক নাম হবে।

প্রমীলা: কমলা…

কমলা: তুমি ভাবছ আমি ছোট বলে কিছু বুঝি না? আমি সব বুঝি মা…

প্রমীলা: কমলা…

কমলা: বাবা তোমাকে আর আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল শুধুমাত্র তার নিজের স্বার্থের জন্য। আমি বড় হয়ে বাবাকে এবং এই সমাজের মানুষকে বুঝিয়ে দিতে চাই আমরাও মানুষ। আমাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে।

লীলাবাই: সাব্বাস বেটিয়া সাব্বাস! দেখ প্রমীলা প্রতিবাদ কাকে বলে! এতটুক বাচ্চার থেকে শিখ লে প্রতিবাদ কী করে করতে হয়…

কমলা (হাতজোড় করে): এই বাড়ি থেকে তুমি আমাদের তাড়িয়ে দিও না মাসি! আর যে আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই…

লীলাবাই (হাঁটু মুড়ে বসে কমলাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায়): তোকে আমি তাড়িয়ে দেব তু সোচা ভি কীভাবে? তু তো মেরা জান আছিস। (দাঁড়িয়ে) আজ সে এ মহল তেরা নাম সে চলবে। আজ সে এ মহলকা নাম হ্যায় কমলা মহল।

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই: তু কুছ নেহি বোলেগি। হাম যো বোলি ওহি হোগা। তেরি পতিদেবতা তেরে কো কেয়া দিয়া? কুছ নেহি দিয়া। বদলে মে সব কুছ ছিন লিয়া।

প্রমীলা: সেটা যে আমার চরম দুর্ভাগ্য…

লীলাবাই: তোর ওই সুর্ভাগ্যের রাস্তা পার করে সৌভাগ্যের রাস্তায় পৌঁছে দেবে এই মহলকা রানি কমলা…

কমলা: আমি রানি হব?

লীলাবাই: আলবাত হোবে। আজ সে ইস মহলকা নাম কমলা মহল। হামারি জান, মেরি পেয়ারি কমলারানি ইস মহল মে রাজ করবে। এক দিন সারে দুনিয়ে ইসকো নাম সে পুকারেগি। বুড়া মাত মাননা বহিন। ইস দুনিয়াবালে লড়কিয়োকো ইজ্জত করে না, সম্মান করে না। মওকা পেলে মরদরা অওরত জাতিকো ইজ্জত নিয়ে খেলা করে। তারপর শালপাতার মতো ফেক দেতা হ্যায় বিচ সড়ক পর। আর তখন তাদের তিন রাস্তা পসন্দ করে নিতে হয়। এক, হামাদের মতো নাচনেওয়ালি; দুই, পতিতা; আর তিন— আখরি রাস্তা— খুদকুশি।

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই: ভগবান না করে… হামারি কমলা বেটিয়ার উপর অ্যায়সি গন্দি হরকত কোই না করে…

প্রমীলা: ওকে নিয়ে আমার বড় ভয় করে। কালে কালে যা দেখছি যা শুনছি তা যেন বিশ্বাসের অযোগ্য। জানোয়ারগুলো তিন বছরের শিশুকেও বাদ দেয় না…

লীলাবাই: হামলোগ সব জানি, সব বুঝি, লেকিন মু মে তালা লাগিয়ে রাখি। জাদা জান-পেহেচানা ঠিক না আছে। জাদা জান-পেহেচানা হবে তো খতম করিয়ে দেবে। তার চেয়ে হামলোগ যো কাম করি ও হি আচ্ছা। বড়া বড়া আমলা মন্ত্রী হামাদের পায়ের নিচে শির ঝুকাকে রুপিয়া উড়িয়ে বাহবা শাবাশি দেয়। অউর হাম গাতে হ্যায়… কমলা, একটা গান ধর তো…

[কমলা গান শুরু করতেই প্রমীলা সহ্য করতে না পেরে মাথা ঘুরে ধপাস করে পড়ে যায়]

কমলা: মা… (চিৎকার করে ওঠে)

লীলাবাই: কেয়া হুয়া বেটিয়া?

কমলা (প্রমীলাকে দেখিয়ে): মাসি… মা…

লীলাবাই: প্রমীলা বহেন… কেয়া হুয়া তুঝে?

প্রমীলা: কেন জানি, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গেল। কিন্তু আমি চোখে ঝাপসা দেখছি কেন?

লীলাবাই: নেহি নেহি… ইয়ে বাত তো ঠিক নেহি হ্যায়… উস্তাদজি… উস্তাদজি…

[উস্তাদজির প্রবেশ]

উস্তাদজি: কেয়া হুয়া বেটিয়া? আরে প্রমীলা বেটিয়া কো কেয়া হুয়া?

লীলাবাই: আভি ইসকো ডক্টরকে পাস লিয়ে যেতে হবে…

প্রমীলা: তুমি ব্যস্ত হোয়ো না দিদি… আমি ঠিক আছি…

কমলা: তোমার কী হয়েছে মা?

প্রমীলা: আমার কিচ্ছু হয়নি সোনা…

লীলাবাই: হামি সব কুছ জানি…

প্রমীলা: দিদি…

লীলাবাই (প্রমীলার গায়ে হাত রেখে): হামি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তোর যেন কুছ না হোয়ে যায়… (ঘর থেকে বেরিয়ে যায়)

উস্তাদজি: ভুল যা বেটিয়া… অতীত কো ভুল যা। ভবিষ্য কে বারে মে সোচ কে তুঝে চলনা হোগা। তুঝে ইয়াদ রাখনা হোগা, তু সাচ্চা ইমানদান ইনসান। ইস দুনিয়া মে তুঝে বাঁচনে কা হক হ্যায়। ছিন লেনা হোগা বাঁচনে কা হক… (উস্তাদজিরও প্রস্থান)

প্রমীলা: বাঁচতে তো আমি চাই, কিন্তু এভাবে বেঁচে কী লাভ! আমি তো চেয়েছিলাম মাথা উঁচু করে বাঁচতে। কিন্তু তুমি আমাকে শেষ করে দিলে দ্বিজেন। তোমার জন্য সকলের চোখে আজ আমি ঘৃণিতা। একদিকে বিবেক আমাকে দংশন করে— আমি লোভী। নিজেকে বাঁচাতে নিজের মেয়েকে ঠেলে দিয়েছি নরকে। অন্যদিকে সমাজ আমার দিকে আঙুল তুলে পতিত বলে…

নেপথ্য: ওহে ঘৃণ্যা নারী… তুমি মানো তুমি ডাইন…

প্রমীলা: না…

নেপথ্য: তুমি কুলটা…

প্রমীলা: না…

নেপথ্য: তুমি কলঙ্কিনী…

প্রমীলা: না না না… হা হা হা… (কান্নায় ভেঙে পড়ে)

কমলা: মা… (প্রমীলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে)

[আলো নিভে যায়]

 

পঞ্চম দৃশ্য

[হাতে দামী মদের গ্লাস, মুখে কাঁচাপাকা চাপদাড়ি, পরনে পরিষ্কার প্যান্টশার্ট, দ্বিজেন ঘরে ঢোকে টলতে টলতে গান গাইতে গাইতে]

দ্বিজেন: লোকে আমায় মাতাল বলে, আমি কী তা জানি না, যে যা বলে বলুক লোকে, মানি না ভাই মানি না।… শালা দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ি… তুই মাইরি মানুষ হলি না। সরকারি চাকরি ছেড়ে একেবারে পাড় মাতাল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস… (গলায় মদ ঢালে) শ…শ…চুপ। শালা এটাই তো জীবন রে! মদ খাব আর বেশ্যা… থুড়ি থুড়ি… পতিতালয়ে যাব, সারারাত তাদের সঙ্গে ফূর্তি-আমোদ করব। আর সেসব না করে বাড়িতে বৌয়ের আঁচলের তলায় লুকোচুরি খেলবে সেরকম মানুষ এই দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ি নয় বুঝলি। শালা দশ বছর আগে যদি বৌটাকে বাড়ি থেকে না তাড়াতাম তাহলে কি এই স্বর্গসুখ ভোগ করতে পারতাম! (বাইরে গাড়ির হর্ন বাজে, দ্বিজেন জানালা দিয়ে দেখে)… আরে এক সুন্দরী রমণী যেন গাড়ি থেকে নামল। ভগবান… তুমি তো জানো মাইরি! নিত্যনতুন নারীসঙ্গ না পেলে এই দ্বিজেন্দ্রলাল লাহিড়ির মাথার ঠিক থাকে না। কথায় বলে না, যে খায় চিনি, তাকে জোগায় চিন্তামণি… হা হা হা…

[সুন্দর পোশাকে যুবতী কমলার প্রবেশ]

কমলা: শুনছেন?

দ্বিজেন: শুনব পরে… আগে তুমি আমার সঙ্গে এসো… (কমলার হাত ধরে টানে)

কমলা: এটা কী করছেন আপনি?

দ্বিজেন: আমি যা রোজ করি…

কমলা: দোহাই আপনার… আমাকে ছেড়ে দিন…

দ্বিজেন: আমি এত সহজে কাউকে ছেড়ে দিই না। আমার যেটা পছন্দ সেটা আগে আমি ব্যবহার করি, তারপর ডেটফেল ওষুধপত্রের মতো ছুড়ে ফেলে দিই। আগে তো তোমাকে ব্যবহার করি, তারপর স্বাদ বুঝে ছেড়ে দেব… কেমন? এসো… (হাত ধরে বুকে টেনে নেয়)

কমলা: না… (চিৎকার করে ওঠে। আলো নিভে যায়)

[আলো জ্বলতে দেখা যায় এলোমেলো কাপড়ে কমলা মুখ চাপা দিয়ে কাঁদছে। দ্বিজেন জামাকাপড় ঠিক করতে করতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়]

দ্বিজেন: আ… কী সুখ… আমার জীবনে স্বর্গসুখ মানেই নারীসঙ্গ… হা হা হা… (টলতে টলতে বেরিয়ে যায়)

কমলা: আঃ… (যন্ত্রণায় কাতরে উঠতে গিয়েও বসে পড়ে, তারপর অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ায়) আমি আর পারছি না… মাগো… তুমি আমার থেকে যা আশা করেছিলে, যা চেয়েছিলে, তার এক কণাও আমি তোমায় দিতে পারলাম না। তুমি মেয়ের সুখ দেখতে চেয়েছিলে, কিন্তু আমার চেয়ে দুখী বোধহয় আর কেউ নেই। (কঠিন গলায়) তবে তুমি শুনে রাখো মা, যার দ্বারা আমি নরকগামী হয়েছি, যার জন্য তুমি সব কিছু হারিয়ে আজ নিঃস্ব, যার অহঙ্কারে তুমি আজ চোখের দৃষ্টি হারিয়ে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছ, তার তাজা রক্ত দিয়ে ধুয়ে দেব তোমার আর আমার সমস্ত কলঙ্ক। আর সেদিন আমি প্রাণ খুলে হাসব… হা হা হা… (হাসতে হাসতে কেঁদে ওঠে)

[লীলাবাইয়ের প্রবেশ, পরনে সাধারণ পোশাক]

লীলাবাই: আরে কমলা বেটিয়া, তু এখানে? এ কী… তু কাঁদছিস? মত তো বেটিয়া… আঁশু মুছ লে। তেরে আঁখ সে আঁশু মেরে কো বহত দর্দ দিলাতা হ্যায়…

কমলা: আমার চোখের জল বোধহয় আর কোনওদিন শুকাবে না মাসি…

লীলাবাই: এ তু কী বলছিস বেটিয়া!

কমলা: ঠিক বলছি মাসি। জীবনে আমি অনেক কিছু পেয়েছি। আবার তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু হারিয়েছি। আর এই হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে এসেছে আমার জীবনের কলঙ্ক…

লীলাবাই: ভুল যা ও বেইমান কো। যে তোর অউর তোর মাকে নরক মে ফিক দিয়েছে ও তেরা পিতা নেহি, শয়তান আছে… শয়তান। যব মেরে কো বেচ ডালা তব হামি কসম খেয়েছিলাম, বড় হয়ে ওই শয়তানকে নিজের হাতে খতম করব। লেকিন উপরওয়ালা ও হারামজাদাকে মেরে দিয়েছে। বহত আফশোস হ্যায় শালা কুত্তার বাচ্চাটাকে মেরে বদলা নিতে পারিনি…

কমলা: পারবে না মাসি! শত চেষ্টা করলেও তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না! কারণ সত্য আজ অন্ধকারে মুখ লুকিয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাবে… খতম হয়ে যাবে সব…

লীলাবাই: আজ তেরে কো কেয়া হুয়া বেটিয়া? কেন এ বাত করছিস?

কমলা: আ… আমি যে শেষ হয়ে গেছি মাসি… তোমার কমলা আজ ধর্ষিতা… হা হা হা… (লীলাবাইকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে)

লীলাবাই: নেহি…! নাম বাতা কমলা বেটিয়া… ও কুত্তা কি আওলাদ কা নাম বাতা… ও জানে না কার গায়ে হাত লাগিয়েছে। লীলাবাইয়ের লেড়কির ওপর হাত লাগিয়েছে মতলব ও খতম হয়ে গিয়েছে। তু চিন্তা মত কর বেটিয়া… ও হারামজাদার সিনার খুন দিয়ে হামি তোর কলঙ্ক ধুয়ে দেব…

কমলা: মাসি দোহাই তোমার, মাকে তুমি এ-কথা বোলো না… মা যদি জানতে পারে, তাহলে মাকে বাঁচাতে পারব না…

লীলাবাই: প্রমীলা বেহেন কুছ জানতে পারবে না… আমি কথা দিলাম…

কমলা: মাসি…

লীলাবাই: হাম জানতে হ্যায় তেরে কো কুছ হয়ে গেলে প্রমীলা বেহেন মরে যাবে। কিন্তু হামি সেটা হতে দেব না। তু যেমন হামার বেটিয়ামাফিক আছিস, প্রমীলা ভি হামার বেহেনমাফিক আছে…

কমলা: আমি শুধু তোমার মেয়ের মতো, মেয়ে নই… তাই তো?

লীলাবাই: হামি আনপড় গাঁওয়ার আছি… তাই লিখনা পড়না কুছু জানি না। তাই এ ভি জানি না কোনসা মাফিক আর কোনসা আপনা। লেকিন হামি জানে তু হামার আপনা আছিস…

কমলা: মাসি… (লীলাবাইকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে)

লীলাবাই: রো মত বেটিয়া রো মত… উপরওয়ালা হ্যায়… ও সব কুছ জরুর দেখ রহা হ্যায়… ও যেমন শরিফ অউর ইসসান আদমিকে ভালবাসে, তেমনি শয়তান আদমিকে খতম করতে পারে। যো তেরে কো ইতনা বড়া নুকসান করেছে, ওকে খুদ মরতে হবে… তু দেখে লিবি…

কমলা: তাই যেন হয় মাসি…

লীলাবাই: চল বেটিয়া… ধর চল…

[দুজনে বেরিয়ে যায়। আলো নিভে যায়। দুজনে এবার মঞ্চের অন্য পাশ দিয়ে ঢোকে। লীলাবাই সুইচ টিপে আলো জ্বালায়। আলো জ্বলতে দেখা যায় ঘরে নাচের সাজসরঞ্জাম, দেওয়ালে টাঙানো নানা বাইজিদের ছবি। কমলা ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে…]

লীলাবাই: কেয়া দেখতে হ্যায় বেটিয়া?

কমলা: ছবিগুলো দেখছি। আচ্ছা মাসি, দেওয়ালে যে ছবিগুলো দেখছি এনারা কি সবাই…

লীলাবাই: যে তসবিরগুলো হামলোগ দেখছি এদের নাম… (একটা করে ছবি দেখায় আর নাম বলতে থাকে) এটা যমুনা, এটা কান্তা, শকুন্তলা, লক্ষ্মী…। এরা সবাই আমাদের মতো ছিল…

কমলা: আর এই ছবিটা?

লীলাবাই: এ তসবির মীরাবাই কা। এ যো মহল দেখতি হ্যায়, ইস ইতনা বড়া মহলের মালকিন ছিল মীরাবাই। উনহি তো এই মহল বানিয়েছিল।… এবার চল… ওরা সবাই নাচঘরে অপেক্ষা করছে…

কমলা: আজ যে আমার ভাল লাগছে না মাসি… আজ আমার নাচতে ইচ্ছা করছে না…

লীলাবাই: লেকিন ও লোগ তো আমাকে বহত রুপেয়া দিয়েছে তোর নাচ দেখার জন্য… আচ্ছা, ঠিক হ্যায়… তোর যখন ভাল লাগছে না, তাহলে আমি ওদের চলে যেতে বলি… (ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যায়)

কমলা: না মাসি, যেতে বোলো না… (একটু থেমে) ওদের বসতে বলো, আমি যাচ্ছি…

লীলাবাই: লেকিন তোর এই অবস্থায়…

কমলা: কিছু হবে না মাসি…

লীলাবাই: হাম জানতে হ্যায় হামার বেটিয়া হামার অবাধ্য হবে না… জলদি জলদি চলে আয় কেমন… (বেরিয়ে যায়)

কমলা: অদৃষ্টের কী লিখন! এই কমলা কী হতে চেয়েছিল, আর কী হয়ে গেল! চেয়েছি বন্দুক হাতে নিয়ে এই ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে শত্রুনিধন যজ্ঞ করব। নিরীহ আর অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সাহস আর শক্তি জোগাব। অসহায়া নারীদের পাশে দাঁড়িয়ে লোলুপ পুরুষদের দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার হাত থেকে তাদের বাঁচাব। আর এই কমলা নিজেই আজ ধর্ষিতা। বন্দুকের বদলে হাতে রয়ে গেল মদের গ্লাস। শুধুমাত্র নারীলোলুপ পুরুষদের বশ করে তাদের থেকে অর্থ উপার্জন করার জন্য… হা হা হা… (হাসতে হাসতে কান্নায় ভেঙে পড়ে। আলো নিভে যায়)

[আলো জ্বলতে দেখা যায় দ্বিজেন নাচঘরে বালিশে হেলান দিয়ে বসে। পরনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক, সামনে মদের বোতল-গ্লাস। লীলাবাই একধারে বসে পান খাচ্ছে। আরেক ধারে ডুগি-তবলা বসানো, মিউজিক চলছে]

দ্বিজেন (গ্লাসে চুমুক দিয়ে): আরে লীলাবাই, তোমার মেয়ে এত দেরি করছে কেন? নেশাটা যে চটে যাচ্ছে…

লীলাবাই: এত জলদি কেন করছেন হুজুর? নয়া চিজ পেতে গেলে থোড়া ইন্তেজার তো করতে হবে। আরাম সে বইঠকে শরাব পিয়ে যান। আপনার স্বপ্নো কা পরী আভি এসে যাবে হুজুর…

[উস্তাদজির প্রবেশ]

উস্তাদজি (কপালে হাত ঠেকিয়ে): আদাব… আদাব… (তবলার কাছে গিয়ে বসে)

লীলাবাই (পান চিবোতে চিবোতে): কমলা বেটিয়া কাঁহা হ্যায় উস্তাদজি?

উস্তাদজি: আভি আ জায়েগা বেটিয়া…

[নর্তকীর বেশে কমলার প্রবেশ]

কমলা (হাতজোড় করে): নমস্কার… (দ্বিজেনের দিকে তাকিয়ে ভয় আর বিচলিত ভাব প্রকাশ করে)

দ্বিজেন (কমলাকে দেখে প্রথমে একটু হকচকিয়ে যায়, তারপর সামলে নেয়): বাঃ অপূর্ব… অপূর্ব তোমার রূপ…

লীলাবাই: কি হুজুর… কেমন লাগছে আমার মেয়েকে?

দ্বিজেন: আমি ভাবতে পারছি না লীলাবাই, তোমার মেয়ে এত রূপবতী…

লীলাবাই: আভি তো সির্ফ হামার বেটিয়ার রূপ দেখলেন… এবার নাচ ভি দেখ লিজিয়ে… উস্তাদজি…

উস্তাদজি: হা বেটিয়া…

[মিউজিক চালু হয়। উস্তাদজি তালে তালে তবলার সঙ্গত করতে থাকে। ফুটেছে একটি গোলাপ— এই গানটি শুরু হয়। কমলা নাচ শুরু করে। কিছুক্ষণ গান-নাচ চলে]

দ্বিজেন (নিজের হাতের আংটি খুলে): তোমার নাচ দেখে আমি মুগ্ধ… এই নাও আমার এই প্রিয় আংটিটা তোমায় দিলাম… (উঠে এসে কমলার আঙুলে আংটি পরিয়ে দেয়)

[অন্ধ প্রমীলা কমলাকে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢোকে। পরনে পরিষ্কার শাড়ি। শাঁখা-সিঁদুর…]

প্রমীলা (হাতড়াতে হাতড়াতে): কমলা… কমলা… কমলা কোথায় গেলি? আমার ওষুধটা বোধহয় ফুরিয়ে গেছে রে মা। তোর তো আজ ওষুধটা আনতে যাওয়ার কথা। তুই তো গাড়ি নিয়ে বেরও হলি। ওষুধটা আনতে নিশ্চয়ই ভুলে গিয়েছিস?

কমলা: মা তুমি এখানে এলে কেন?

দ্বিজেন (অবাক হয়ে): এ… এই… কে… কে তুমি? উত্তর দাও… কে তুমি?

প্রমীলা: কে… কে আপনি? আপনার গলার আওয়াজ যেন খুব চেনা লাগছে! কমলা… কে উনি?

কমলা: ওনাকে আমি চিনি না মা…

লীলাবাই: এ কি বেহেন… তুই ইধার কেন এসেছিস?

দ্বিজেন: একটা সত্যি কথা আমাকে বলবে লীলাবাই… এই মেয়েটা কে?

লীলাবাই: কমলা মেরা বেটি আছে হুজুর…

দ্বিজেন: মিথ্যা কথা! কমলা তোমার মেয়ে নয়। ও… (হঠাৎ ছুরি বের করে নিজের পেটে ঢুকিয়ে দেয়) আঃ…. প্রমীলা…

প্রমীলা (বিচলিতভাবে): কে? কে আমার নাম ধরে ডাকল? কে?

কমলা: মা…

লীলাবাই: এ আপ কেয়া কর দিয়া হুজুর…

দ্বিজেন: প্রমীলা… আঃ…

প্রমীলা (হাতড়ে হাতড়ে): কে আপনি? আপনার কণ্ঠস্বর আমার এত চেনা লাগছে কেন?

দ্বিজেন: আমাকে চিনতে পারছ না প্রমীলা? আ… আমি তো… তোমার দ্বিজেন…

প্রমীলা (প্রচণ্ড রেগে): দ্বিজেন কে? আমি তো দ্বিজেন বলে কাউকে চিনি না…

লীলাবাই: প্রমীলা বেহেন…

প্রমীলা: দিদি তুমি এই লোকটাকে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে বলো… তা না হলে ওর প্রচণ্ড বিষাক্ত নিঃশ্বাসে সারা বাড়ির বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাবে… ওর কু-দৃষ্টিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সব কিছু…

কমলা: মা… তুমি শান্ত হও… তোমার যে শরীর খারাপ…

লীলাবাই: হা বেহেন… থোড়া শান্ত হোয়ে যা…

প্রমীলা (চরম উত্তেজিত হয়ে পাগলের মতো): না… আমি শান্ত হতে পারছি না… কিছুতেই শান্ত হতে পারছি না…। এই লোকটা আমাকে আর আমার মেয়েকে নরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সমস্ত বিবাহিত নারীজাতি ভগবানের কাছে স্বামীল মঙ্গল কামনা করে। কিন্তু আজ আমি চোখে দেখতে না পেলেও এই অন্ধ প্রমীলা তোমার কাছে প্রার্থনা করছে ভগবান… এই লোকটার মুখ যেন আমার মেয়ে কোনওদিন দেখতে না পায়… এই মুহূর্তেই ওর যেন মৃত্যু হয়… আঃ…

[বুকের বাঁদিক চেপে ধরে প্রমীলা পড়ে যায়। তার মৃত্যু হয়]

কমলা (প্রমীলার গায়ে হাত দিয়ে ডাকে): মা… মা মা… মাসি, মা কথা বলছে না কেন?

লীলাবাই (প্রমীলার মাথাতা কোলের ওপর তুলে): প্রমীলা বেহেন… প্রমীলা বেহেন…

কমলা: মার কী হল মাসি? মা কথা বলছে না কেন?

লীলাবাই: প্রমীলা বেহেন ভগবানের পেয়ারি হয়ে গিয়েছে বেটিয়া…

কমলা (আর্তনাদ করে): না….. মা…. হা হা হা…. (কান্নায় ভেঙে পড়ে)

দ্বিজেন: তুমি ঠি… ঠিক বলেছ প্র… প্রমীলা… আ… আমার মতো পা… পাপীদের কোনও ক্ষ… ক্ষমা নেই। কি… কিন্তু তুমি কেন চ… চলে গেলে… (বুক ঘষে ঘষে প্রমীলার পায়ের ধারে এসে) তু… তুমি তো কোনও পা… পাপ করোনি…। আ… আমাকে তোমরা ক্ষমা ক… করবে না জা… জানি… কি… কিন্তু একটু তা… তাচ্ছিল্য তো করতে পারো… যা দেখে আ… আমি অন্তত শা… শান্তিতে মরতে পারি… (পেটে ঢোকানো ছুরিটা আর একবার ভাল করে ঢুকিয়ে দেয়) আ… আ… (মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে)

[লীলাবাই আর কমলা প্রমীলাকে ধরে কাঁদতে থাকে। আলো নিভে যায়]

সমাপ্ত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...