এবারের নির্বাচনী ফলাফলে রাজনৈতিক-অর্থনীতির ভূমিকা

নন্দন রায়

 


আমাদের মতো দেশে যেখানে নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনও টিকে রয়েছে, এবং যে-দেশে নয়া-উদারবাদী আগ্রাসন অপ্রতিহত গতিতে চালাতে গেলে নয়া-ফ্যাসিবাদের ঠেকনা প্রয়োজন হয়, সেখানে নয়া-ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নয়া-উদারবাদী অর্থ-ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে যাওয়া— যেখানে ভদ্রস্থ জীবনযাপনের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলে, উপযুক্ত মানসম্পন্ন অবৈতনিক শিক্ষা সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ হয়, যেখানে সকলের জন্য উপযুক্ত মানের অবৈতনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে, ইত্যাদি

 

এবারের নির্বাচনের ফলাফলে ইন্ডিয়া ব্লকের দলগুলির ফলাফলে গোটা বিজেপি-বিরোধী শিবির যারপরনাই উল্লসিত। উল্লসিত এই কারণে নয় যে বিজেপি তথা এনডিএ জোটের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোট জয়লাভ করে সরকার গঠনের পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছেছে। বরং এই উল্লাস এই কারণে যে দীর্ঘ দশ বছর পরে বিরোধীদের দুরমুশ করে চলা বিজেপির অপ্রতিহত বিজয়রথের গতি হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছে। এসব কথা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বহু ভোটবিশেষজ্ঞ বহুভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, যার অধিকাংশই যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতি ভোটের এহেন ফলাফলে বিশেষ কোনও ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছে কিনা, সেইরকম নিবন্ধ বিশেষ নিজরে পড়েনি। আমরা এখানে সেইদিকে নজর দেওয়ার চেষ্টা করব। সন্দেহ নেই এতে কিছু তাত্ত্বিক প্রসঙ্গের অবতারণা করার দরকার হতে পারে।

 

এক.

পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা হচ্ছে ক্ষুদ্র উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে গিলে ফেলা। এর মধ্যে পড়ে কৃষক-চালিত কৃষি এবং ক্ষুদ্র উৎপাদনব্যবস্থা। বৃহৎ কৃষিবাণিজ্যের কর্পোরেট সংস্থা কৃষক-পরিচালিত কৃষিব্যবস্থাকে নিজের তাঁবে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, বড় বড় বাণিজ্যিক মলগুলি (Mall) ছোট দোকানদারদের ব্যবসা থেকে হঠিয়ে দেয়, amazon পাড়ার ছোট মুদিখানাকে ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য করে, পণ্য উৎপাদনের দৈত্যাকার কারখানা ক্ষুদ্র কারিগরের রুজি কেড়ে নেয়। এসবের মিলিত ফল হল ক্ষুদ্র উৎপাদকদের আরও বেশি বেশি দারিদ্র্য। তাদের এই দারিদ্র্য এমন এক দেশের অর্থনীতির মধ্যে আবদ্ধ যে-দেশের মোট সম্পদের অর্ধেক উৎপন্ন করে যে ‘অসংগঠিত ক্ষেত্রের’ উৎপাদকেরা, তারাই দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৫ শতাংশ। প্রাপ্তবয়য়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে যে-দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, সেই দেশে পুঁজিবাদের এইরূপ স্বভাবগত প্রবণতা বেশিদিন চলতে পারে না।

এই কারণেই ভারতে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে, তাকে বলা যেতে পারে ‘নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ’, যেখানে পুঁজিবাদী জবরদখলদারির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র উৎপাদকদের রক্ষা করেছে— দেশীয় ও বিদেশি কর্পোরেশনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ দিয়েছে, কৃষিক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করেছে সার ও কীটনাশকের দামের ওপর ভর্তুকি দিয়ে, স্বল্পমূল্যে সেচের জল জুগিয়ে, এবং ফসলের মূল্যে সহায়তা প্রদান করে যাতে তারা ফসল বিক্রি করে কিছুটা লাভের মুখ দেখে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কৃষিপণ্যের দামের ওঠানামা থেকে তাদের রক্ষা করে। বস্ত্র উৎপাদনের মোট পরিমাণের একটা অংশ যাতে হস্তচালিত তাঁতশিল্প থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কেনা হয় তার ব্যবস্থা করে। বেনারসি সিল্ক শাড়িপ্রস্তুতকারী শিল্পীদের দেয় কর মকুব করে দেওয়া হয়। এর ফলে স্বতন্ত্র পার্টির মতো অপ্রতিহত পুঁজিবাদীর পৃষ্ঠপোষকেরা নির্বাচনে কখনও বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারেনি।

ব্রিটেনের মতো আমাদের দেশে কোনও রক্ষণশীল পার্টি (Conservative Party) গড়ে ওঠেনি, গড়ে ওঠেনি ওই মহাদেশের বিভিন্ন দেশে খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মতো কোনও রাজনৈতিক দল যারা খোলাখুলিভাবে পুজিবাদপন্থী এবং নির্বাচনী আঙিনায় যাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এরকমটা ঘটার কারণ হচ্ছে ইওরোপীয় দেশগুলিতে যখন অপ্রতিহত পুঁজিবাদী বিকাশের তাণ্ডব চলছে, তখন নিজেদের অর্থনৈতিক স্থিতি থেকে উৎখাত হওয়া ইওরোপের কৃষক, ক্ষুদ্র উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত মানুষজন এবং ক্ষুদ্র দোকানদার ইত্যাদি মানুষ অভিবাসী হয়ে কাজের খোঁজে নতুন বসতি স্থাপনের দেশগুলিতে, যেমন আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ইত্যাদি দেশে পাড়ি জমায়। এছাড়া যারা নিজেদের দেশে রয়ে যায়, তারা নেহাতই প্রান্তিক জনতা। পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলি থেকে ১৮১৫ সাল থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ৫০ মিলিয়ন (পাঁচ কোটি) মানুষ এইভাবে পরিযান করে। নতুন বসতিতে পৌঁছে এরা, সংখ্যায় যারা ১৮১৫ সালের পশ্চিম ইওরোপের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, নতুন বসতির দেশগুলির আদি অধিবাসীদের উৎখাত করে তাদের জমিজমা কেড়ে নেয়, তাদের সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করে, তাদের হত্যা করে এবং তাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে নিমজ্জিত করে কিছু কিছু সংরক্ষিত অঞ্চলে প্রায় বন্দি করে রাখে। এক ঐতিহাসিক পর্বে এমন একটি ঘটনা ঘটে গিয়েছে যে পথ ভারত-সহ আজকের উন্নয়নশীল দেশগুলির কাছে খোলা নেই। যদিও এই পর্বটি সকল অর্থেই ঘৃণ্য এবং পরিত্যাজ্য। এ হল পুঁজিবাদের বিকাশের পাপ যা মনুষ্যজাতিকে বহন করে চলতে হচ্ছে।

 

দুই.

কিন্তু অন্ধ বিকাশের যে অন্তর্নিহিত প্রবণতা পুঁজিবাদের চালিকাশক্তি, সে কোনও বাধাই মানতে চায় না। নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ আসলে অকার্যকর হয়ে পড়ে। ফলে পুঁজিবাদের যে আধুনিক রূপ আজ আমরা প্রত্যক্ষ করছি, সেই নয়া-উদারবাদী কর্মসূচি অপ্রতিহতভাবে পুঁজিবাদের চলার পথের সব বাধা অপসারিত করতে চায়। এর ফলে একটা সমস্যার উদ্ভব হয় আজকের দিনে। কীভাবে এমন একটি রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব সম্ভব হতে পারে যারা অপ্রতিহতভাবে পুঁজিবাদের পক্ষে ওকালতি করতে পারে এবং এই ওকালতি করেও একইভাবে তারা ভোটে জেতার আশা করবে? পুঁজিবাদের যথেচ্ছাচার মানে অবাধ শোষণ ও নিপীড়ন। মানুষ কীভাবে নিজের সর্বনশের পক্ষে রায় দেবে? এবং একইসঙ্গে পর পর নির্বাচনে জিতে আসবে?

অনেকে ভাবেন যে মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বে ২০০৪ সালে যে ইউপিএ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই সরকারই সেই ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন যারা অপ্রতিহত পুঁজিবাদী যথেচ্ছাচারকে মদত দিয়েছিল। এমনটা ভাবার কারণ হচ্ছে যে এই মনমোহন সিং অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালে পুঁজির অবাধ চলাচলের জন্য দেশের অর্থনীতির দুয়ার আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির সামনে খুলে দিয়েছিলেন এবং নয়া-উদারনীতি কর্মসূচিকে দেশের আর্থিক ব্যবস্থার নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই বক্তব্যের দ্বিতীয়াংশ তথ্য হিসেবে সত্যি হলেও প্রথমাংশ সত্যি নয়। ২০০৯ সালে এই সরকারের দ্বিতীয়বার আরও বেশি ভোটে জিতে আসার মধ্যে দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে তার সরকারের পুনর্নির্বাবাচনের মধ্যে দিয়ে অপ্রতিহত পুঁজিবাদের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেননি বরং বামপন্থীদের এবং অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তির চাপের মুখে নয়া-উদারবাদের কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য আন্তর্জাতিক পুঁজির ইচ্ছেমতো তিনি পুঁজিকে যথেচ্ছাচার করার সুযোগ দেননি। বরং তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে আইনত বিচারযোগ্য ১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি প্রদত্ত আইন প্রণয়ন করেছিলেন এবং কৃষিঋণের বকেয়া শোধ করার জন্য ব্যাঙ্কের দেনা সরকারি কোষাগার থেকে মিটিয়েছিলেন। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে বামপন্থীরা আমেরিকার সঙ্গে অসামরিক নিউক্লিয়ার চুক্তি করা চলবে না বলে যে হুমকি দিয়েছিল এবং অবশেষে সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, তা সত্ত্বেও সরকারের পতন ঘটেনি, বং সরকার আরও বহুমত নিয়ে নির্বাচনে জিতে এসেছিল এবং সেই নির্বাচনে বামপন্থীরা পর্যুদস্ত হয়েছিল। মানুষ কী চায় এই সম্পর্কে বামপন্থীদের কোনও ধারণাই ছিল না। বহুদিন থেকে পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সজীব সম্পর্ক রক্ষা করার থেকে তাঁরা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এটা তারই ইঙ্গিতবাহী। এর পর থেকেই বামপন্থীদের নির্বাচনী পরাজয় শুরু হয়।

যদিও এটা সম্ভব যে পুঁজিবাদী স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত প্রাণ কোনও রাজনৈতিক সংগঠন উচ্চহারে বিকাশের ক্রমশ নিচের দিকে চুইয়ে পড়ার গল্প শুনিয়ে দুই-একবার ভোটে জিতে যেতে পারে, তবে অচিরেই জনতা চুইয়ে পড়া প্রবোধবাক্যের অসারতা বুঝতে পারেন এবং ক্রমশ প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বিশেষত পুঁজিবাদ যখন অমোচনীয় সঙ্কটের মধ্যে পতিত হয় (যেমনটা ২০০৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে) সেই সময়ে বামপন্থীরা সঠিক রণকৌশল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অসারতা আরও প্রকটভাবে দেখা দিত। দুর্ভাগ্য, বামপন্থীরা সেই জরুরি কাজটা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

 

তিন.

যে-কোনও ব্যবস্থাকে টিকে থাকতে গেলে গরিষ্ঠ মানুষের একটা সামাজিক সম্মতি লাগে। এ-কথা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সত্য। গরিষ্ঠসংখ্যক জনগণের সম্মতিব্যতীত বিজেপির শাসন সমস্ত বিরোধীদের জেলে পুরে যেমন টিকত না, পশ্চিমবঙ্গেও তেমনি একশো শতাংশ ছাপ্পা ভোটও তৃণমূলি শাসনকে টিকিয়ে রাখতে পারত না। একই যুক্তিতে সঙ্কটে দীর্ণ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গরিব মানুষের কল্যাণের জন্য রাষ্ট্র যেসব জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি প্রবর্তন করে, সেসব প্রত্যাহার করার জন্য সরকারকে চাপ দেয় এবং বদলে পুঁজির মুনাফাবৃদ্ধির পক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। ফলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, আজকে যা নয়া-উদারবাদী পন্থা অবলম্বন করেছে, তার সামাজিক ভিত্তিটাই নড়বড়ে হয়ে পরে। সঙ্কটে নিমজ্জিত পুঁজিবাদের দরকার পড়ে নয়া ফ্যসিবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের সহায়তা, যারা মানুষের দিনযাপনের অভাব ও বঞ্চনার জ্বলন্ত ইস্যুগুলিকে আড়াল করার জন্য মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেয় অন্যদিকে— হতভাগ্য সংখ্যালঘুদের নিশানা করে তাদেরকেই যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশার মূল বলে দাগিয়ে দেয়, তাদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু মানুষের মনে ঘৃণার বীজ বপন করে এবং তাদের সম্ভাব্য বিরুদ্ধ শক্তিসমূহ যাতে একযোগে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারে, তার জন্য বিরুদ্ধ শক্তিগুলির মধ্যে বিভেদের সৃষ্টি করে নানা উপায়ে। যে কর্পোরেট-হিন্দুত্ব আঁতাত আজকের ভারতকে শাসন করছে, এটাই তাদের চরিত্র। এই আঁতাত অবশ্যই শ্রমজীবী জনতার জীবনযাত্রার কোনও সমস্যারই সমাধান করতে পারে না। একদিকে এরা যেমন ধনীদের ওপর বাড়তি কর চাপিয়ে সংগৃহীত অর্থ কাজে লাগিয়ে সরকারি ব্যয় বাড়িয়ে সঙ্কটমোচন করতে পারে না কারণ বিশ্বায়িত পুঁজি এমন উপায় অনুমোদন করে না, অন্যদিকে তেমনি বিশ্বায়িত পুঁজিকে চটিয়ে অপ্রতহত পুঁজিবাদ তার অন্ধ প্রবণতা অনুসারে ক্ষুদ্র উৎপাদকদের ওপরে যে আগ্রাসন নামিয়ে আনছে প্রতিদিন, তাকে বন্ধ করার সাধ্যও তাদের নেই।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে এমনকি নয়া-ফ্যাসিবাদের পক্ষেও নয়া-উদারবাদকে দীর্ঘকাল ধরে যাবৎ ভরণপোষণ করার ক্ষমতা নেই, বিশেষত নয়া-ফ্যসিবাদকেও যতদিন নির্বাচনী গণতন্ত্রের ঘেরাটোপের মধ্যে শাসন চালাতে হয়।

ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে নয়া-ফ্যসিবাদের একটি বড় মাপের তফাৎ হচ্ছে এই যে ১৯৩০-এর দশকের জার্মান ফ্যাসিবাদ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার উদ্দেশ্যে বিপুল ঋণ নিয়ে সমরাস্ত্র ও যুদ্ধে যেসব জিনিস প্রয়োজন হয় সেইসব উপকরণ বিপুল পরিমাণে উৎপাদন করার জন্য বহু কারখানা স্থাপন ও শ্রমিক নিয়োগের মাধ্যমে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করেছিল। জাপান একই পন্থা নিয়েছিল। এইভাবে এই ফ্যাসিস্ট দেশগুলি ১৯৩০-এর মহামন্দার বিভীষিকা থেকে বেরিয়ে এসেছিল জনগণের সমর্থনকে পুঁজি করেই। আজকের দিনের নয়া-ফ্যসিবাদের ভবিতব্য— বেকারত্বের হার সে কমাতে পারে না, বরং বাড়িয়েই চলে, কারণ আন্তর্জাতিক পুঁজি সেই পন্থা অনুমোদন করে না এবং তার মর্জির বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা মোদির মতো নয়া-ফ্যসিবাদী একনায়কের নেই। মনে রাখতে হবে, হিটলারের আমলে পুঁজি দেশের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল। পুঁজির বিশ্বায়ন ঘটে ১৯৭০ সাল নাগাদ যখন প্রথম জ্বালানি তেলের সঙ্কট দুনিয়ার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

 

চার.

আবার সেই পুরনো কোথায় ফিরে আসি।

একদিকে চরম বেকারত্ব আর অন্যদিকে ক্ষুদ্র উৎপাদক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র কারিগরদের ওপর যথেচ্ছাচারী পুঁজিবাদের বেলাগাম আগ্রাসন তাদের জীবিকার অস্তিত্বকেই সঙ্কটপূর্ণ করে তুলছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই নয়া উদারবাদ-নয়া ফ্যাসিবাদের আঁতাতের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী ও মধ্যবর্গের জনতা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে যার উদাহরণ আমরা দেখেছি ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন, শ্রমিকদের, আশা কর্মীদের এবং অঙ্গনওয়ারি কর্মীদের বিশাল বিশাল আন্দোলন ও সমাবেশ-বিক্ষোভের মধ্যে।

নির্বাচনের সময়ে গরিব জনতার এই বিদ্রোহ পুনরায় প্রকাশ্যে এসেছে।

এবারের নির্বাচনে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে, সন্দেহ নেই বহুবিধ কারণ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল ক্ষুদ্র উৎপাদক এবং শ্রমজীবী জনতার এই বিদ্রোহ, বিশেষত কৃষকদের উষ্মা। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে কৃষকদের এই বিজেপি-বিরুদ্ধতা বেশ ভালভাবেই নির্বাচনী ফলাফলে অনুভূত হয়েছে। সংসদে আইন করে ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্যের গ্যারান্টি প্রদানের বিষয়টিতে মোদি কিছুতেই অনুমোদন দিচ্ছেন না। এর ফলে কৃষকরা মোদির পতন দেখতে চান। মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজের দামের অস্বাভাবিক পতনে বহু পেঁয়াজচাষি নিঃস্ব হয়েছেন, আত্মহত্যার মিছিল বেড়েই চলেছে। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের ক্ষুদ্র কারিগরদের জীবিকা লোপাট হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে। এরা সবাই মোদির পতন চেয়েছেন। এমনকি ঘটা করে উদ্বোধন করা অযোধ্যার রামমন্দির, যাকে বিজেপি ভেবেছিল ‘চারশো পার’ করিয়ে দেবে, সেখানেই বিজেপি মুখ থুবড়ে পড়েছে। মোদি বারাণসী কেন্দ্রে পরাজয়ের মুখ থেকে ফিরে এসেছেন। এসবের পেছনে কারণ হল রামমন্দির গড়তে এবং বিশ্বনাথ মন্দির থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট পর্যন্ত বিরাট করিডোর তৈরি করতে যেসব দোকান ভেঙে জীবিকানির্বাহের উপায়কেই গায়ের জোরে হরণ করা হয়েছে তার কোনও মূল্য কি বিজেপিকে চোকাতে হবে না? আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে বহুজাতিক পর্যটন ব্যবস্থার এই অশুভ মেলবন্ধনের ফল বিজেপির কাছে দুঃস্বপ্নের মতো দেখা দিয়েছে। পেশিশক্তি প্রদর্শনের যে রাজনীতি উদারবাদী অর্থনীতির আগ্রাসনের সেবায় সদা-তৎপর, সেই পরিস্থিতিতে স্বভাবত ধর্মভীরু ভারতীয়রাও শেষ বিচারে অর্থনৈতিক আত্মরক্ষাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।

এই অবস্থার গভীর তাৎপর্য রয়েছে। আমাদের মতো দেশে যেখানে নির্বাচনী গণতন্ত্র এখনও টিকে রয়েছে, এবং যে-দেশে নয়া-উদারবাদী আগ্রাসন অপ্রতিহত গতিতে চালাতে গেলে নয়া-ফ্যাসিবাদের ঠেকনা (prop) প্রয়োজন হয়, সেখানে নয়া-ফ্যাসিবাদের কবল থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় নয়া-উদারবাদী অর্থ-ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে যাওয়া— যেখানে ভদ্রস্থ জীবনযাপনের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ মেলে, উপযুক্ত মানসম্পন্ন অবৈতনিক শিক্ষা সর্বজনীনভাবে উপলব্ধ হয়, যেখানে সকলের জন্য উপযুক্ত মানের অবৈতনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার সুযোগ রয়েছে, ইত্যাদি।

এসব অধিকার সমস্ত নাগরিকের মৌলিক অর্থনৈতিক অধিকার। সবার আগে চাই এইসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সব বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত অঙ্গীকার। যে দৃঢ়পণ ঐক্যের উদাহরণ দেখিয়ে তারা এই সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন যে বিজেপি অজেয় নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ উপরে বলা অঙ্গীকারের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থাকা। আগামীদিনের ভারতের এটাই রাজনৈতিক অর্থনীতি।

তা যদি না হয়, আরও হিংস্রতার সঙ্গে বিজেপির ফিরে আসা কেউ রোধ করতে পারবে না।

 

ঋণস্বীকার:

  • Patnaik, Prabhat. Break the cycle. The Telegraph. July 10, 2024.

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...