আনিসুজ জামান
—বাড়ি কোথায় আপনার? লোকটার পাশে বসে আচমকা প্রশ্নটা ছুটে আসতে দেখে একটুও চমকাইনি।
এর পেছন পেছন আসবে কোত্থেকে এসেছেন, কী করেন, বিবাহিত কিনা, স্প্যানিশ কোত্থেকে শিখলেন… এরকম হাজার প্রশ্ন। কিন্তু এক-কথা দু-কথার মাঝে ২০২৪ সালে বসে কেউ সনটাকে ১৯৬৮-র সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে মনে হবে শালা গাঁজা খেয়েছে! তবে পাঁড় মাতাল যে তাতে কোনও সন্দেহ নাই, গা থেকে ভুরভুর করে তেকিলার গন্ধ বেরুচ্ছে। প্লাজার সরকারি বেঞ্চটা থেকে ওঠার চেষ্টা করলে আমার হাত চেপে আবার বসিয়ে দেয়। অথচ একটু আগেই বলছিল নিজের সঙ্গে কথা বলার জন্য, একটু একা হওয়ার জন্য হাজার মাইল পেরিয়ে সবচেয়ে নির্জন কোণটাকে বেছে নিয়েছে। অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়ার গুঞ্জনের সঙ্গে নিঃসঙ্গ শীতের সোয়ালোর আলাপ, বাকি সবই নাকি অন্যকালের ফিসফিসানি।
আমি অন্ধকার খুঁজি, অন্ধকার হাতড়ে নিজের আদলটা বুঝে নিতে চাই— বলছিল। মাঝে মাঝে থেমে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল আবার বেরিয়ে আসছিল টুকরো টুকরো শব্দ। টুকরোগুলো হারিয়ে যাচ্ছিল নিমিষেই, অনেক কষ্ট করে পার্কের বিভিন্ন কোণায় গাছের তলে পাতার উচ্ছলতা থেকে খুঁজে বের করে জোড়া লাগানো চাট্টি খানিক কথা নয়।
—কাউয়া উজ্জ্বলতার মধ্যে থাকতে থাকতে আঁধারের কথা ভুলে যায়, অন্ধকারকে চিনতে না পেরে ভাবে এও উজ্জ্বলতা। মিথ্যা বলতে বলতে ভুলে যায় সত্যের চেহারা, গুলিয়ে ফেলে সত্য-মিথ্যা। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে লড়তে গিয়ে হারিয়ে ফেলে অস্তিত্বের সংজ্ঞা, আমি অন্ধকার ভালবাসি, এর মাঝ থেকেই উঠে আসে নিখাদ সত্য, ওরা, চার বছরের উঁকি দেওয়া মুখটা থেকে বেরিয়ে আসবে আলোর দ্যুতি, রাস্তায় কচ্ছপের দৌড়, পঙ্গপাল ধান খাবে, খাবে মুণ্ডু, পদ্মার শান্ত পানির নিচে চলছে প্রচণ্ড তাণ্ডব, বেরিয়ে আসতে কত দিন, মাস, বছর লাগবে! কবে মহাথির আসবে? ত্লাতেলোলকো-র দোসরা অক্টোবর প্রতি দু-বছরে একবার আসে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন জায়গায়। সব সিংহাসন দখল করে আছে দিয়াস অরদাস, ওরা তো শান্তিপূর্ণ মিছিল করতে জমা হয়েছিল, কেন আমাকে গুলি করতে হল, এই দেখো, আমার হাতের তালুর রক্ত মোছে না…
এমনিতর বকবক করতে করতে দু-হাত ঘষতে থাকে। কেবল শুকিয়ে আসতে থাকা ক্ষত জ্যান্ত হয়ে লাল রক্ত ঝরতে থাকে, টুপ্ টু্প্, অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যায় নিচের জমিন লাল হয়ে উঠছে।
ওর মুখ থেকে পদ্মা, মহাথির শুনে চমকে উঠেছিলাম। চমকে গিয়েছিলাম যখন ব্ল্যাক স্পাইডার, ব্ল্যাক স্পাইডার বলে চিৎকার করছিল। অনেকদিন পরে বুঝতে পারব লোকটার নেশা শুধু ড্রাগসেই নয়, বইপত্রেও। যেখানে যা পায় গিলে খায়: সংবাদপত্র, ইন্টারনেট, মানুষজন…।
নাহ্, এবার উঠতেই হবে। পাগলামি একটা ছোঁয়াচে রোগ। এই পাগলের সঙ্গে থাকলে আমিও পাগল হয়ে যাব। প্লাজার কোনে একটি বার; এল পোর্টাল। আলেক্সের সঙ্গে ওখানেই দেখা করার কথা। বারের সামনে পোর্টালের নিচে অনেকগুলো টেবিল সাজানো, খদ্দের বসেছে মাত্র একটিতে। কেবল সন্ধ্যা, জমতে আরও সময় লাগবে। একটি টেবিলে সাজানো চারটি একিপালের একটিতে বসলে পাছায় তিনশত বছর আগের কারিগরের হাতের ছোঁয়া লাগে। এখন চামড়া খুব দামি হওয়ায় এ-ধরনের চেয়ার প্রায় কেউই বানায় না। বারের মালিক রনের পূর্বপুরুষ এসেছিল প্রায় পাঁচশত বছর আগে। একিপালগুলো, কাররিসোর টেবিলগুলো তারই প্রমাণ বহন করে। বসতে বসতে একটি ছেলে খোসা ফেলা বাদামভাজা, এক গ্লাস পানি ও একটি ছোট গামলায় বরফের টুকরোর ওপরে চিমটে নিয়ে হাজির। বলে:
—এক্ষুণি আলেক্স এসে পড়বে। এর মাঝে কিছু অর্ডার দেবেন?
—হ্যাঁ, এক কাবায়্যিতো ১৮০০ ক্রিস্টালিনো দিয়ে যাও, সঙ্গে একটি সাংগ্রিতা দিতে ভুলো না যেন, লেবুর টুকরো ও সঙ্গে লবণ তো লাগবেই।
—জি, সিঞোর।
দাদার হাত ধরে হোরহে গিয়েছিল লাস কান্ঞাদাস্, স্বর্ণখনিতে। খনির সামনে সেদিন প্রচুর লোক। কাজ না করে জটলা করছে। ঘোড়া থেকে নেমে দন্ সালভাদর গোমেজ পেরেজের আপিস পর্যন্ত যেতে পিস্তল হাতে নিতে হয়। হোরহে যে ওর সঙ্গে আছে তা সে বুঝতেও পারে না। ওর অপেক্ষায় বসে ছিল ইউনিয়নের তিন মাথা আর খনির মালিকদের একজন ও তার কিছু সাঙ্গপাঙ্গ। দীর্ঘক্ষণ বৈঠক চলে। পাশে বসা হোরহে তার কিছুই বুঝতে পারে না। শুধুই দুইপক্ষের উত্তেজনা আস্ফালন টের পায়। বুঝতে পারে কিছু কিছু শব্দ; মিলিটারি, ক্রিস্তেরো, শ্রমিকদের বেতন যথেষ্ট নয়, ওদের চিকিৎসাব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। ছয় ছয় ঘণ্টা কথাচালাচালির পরও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয় ওরা। আবার ঘোড়ায় ফিরতি পথ ধরে দাদা। জোছনা রাত হলেও একাকী পাহাড়ের কোল বেয়ে নামার সময় ভয় কাটাতে গান ধরে; হেমা।
পরের দিনগুলো কেটে যায় সপ্তাহ হয়ে উত্তেজনার ভেতর দিয়ে। দাদা লুকিয়ে খবরের কাগজ পড়ে যাতে প্রায়ই ছবি থাকে মিছিলের, স্লোগান থাকে লেখা: “ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে হবে।” অন্যদিকে “যিশুখ্রিস্টের জয় হোক”। এক কাকভোরে জেগে দাদি জেগে ওঠে দাদার ছোটবেলার বন্ধু হোসেকে পায় উঠানে।
—পেদ্রো, কানোকে ওরা ইস্টিশানের হিগান্তের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে, উত্তেজিত হোসে প্রায় চিৎকার করছে।
—কী… এক মিনিট— দাদার পোশাক বদলাতে দু-মিনিটের বেশি লাগে না। লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়ার আগে পিস্তলটা কোমরের খাপে গুঁজতে ভোলে না।
দাদি খুব ভাল করেই জানেন ছোড়া গুলি ফেরত আনা যায় না। পেছন পেছন চিৎকার করেন:
—ভেবেচিন্তে ব্যবহার কোরো, মাথা গরম কোরো না। যিশু, ঈশ্বর, ওকে ভালয়-ভালয় ফিরিয়ে এনো।
দেওয়ালে লাগানো একটি ইশতেহারে লেখা: ‘এই বাড়িতে বাস করেছেন বিখ্যাত… Don Salvador Gomez Perez…’। কিছুদিন আগে ইশতেহারটা দেখিয়ে বন্ধু হোরহে জুনিয়র গর্ব করে ওর পরদাদার এই গল্পটা বলেছিল।
দেখতে না দেখতেই ছোট্ট আলেক্স এসে হাজির। কেবল স্নান করিয়ে দেওয়া হয়েছে, হাল্কা সোনালী রোমান চুলগুলো এখনও ভেজা। হাতে লেগো কিউব দিয়ে তৈরি দুটো বিড়াল, একটি লাল অপরটি নীল।
—অলা, আলেক্সিতো, কেমন আছ?
—ভাল, তুমি, কাকা?
—তোমার বয়স কত?— প্রতিবার দেখা হলেই ওকে প্রশ্নটা করি। ওর চার আঙুল তুলে দুই বলাটা আমার ভীষণ পছন্দ।
—দুই, তলো ফাইত কলি, নীল বিড়ালটা আমার হাতে দিয়ে মুখ দিয়ে অদ্ভুত বিড়ালের ঝগড়ার শব্দ করতে করতে আমারটার মুখে কামড় বসায়।
বাধ্য হয়ে আমাকেও আওয়াজ তুলতে হয়, তবে সেটা বিড়ালের আওয়াজের থেকেও বেশি কুকুরের গলার মতো লাগছিল।
—আমি জিতেছি! আমারটাকে ঠেলে পিছু হটিয়ে উল্লাসে চিৎকার করতে করতে বলে।
—এ দুটোর নাম কী?
—চে আর দিয়াস।
নাম শুনে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়েছিলাম। একি শুধুই কাকতালীয়! সম্বিত ফিরে আলেক্সের ডাকে। হাতের তেকিলা ও সাংগ্রিতা টেবিলে রেখে পাশে বসে। ওয়েটারের হাতে না দিয়ে নিজে নিয়ে এসেছে।
—আপনাকে খুব বুঝি জ্বালাচ্ছে? ও এরকমই, আপনি চলে গেলে কাঁদে, জানি না কী পায়। এরিকা, ছেলেটাকে নিয়ে যাও, হাঁক ছাড়ে।
—ন্ন্ নাহ্ আমি দাবো না, চিৎকার শুরু করে ছোট।
পার্কের লোকটা সম্বন্ধে আলেক্সকে প্রশ্ন করলে শুধু জানতে পারি ১৯৬৮-র দোসরা অক্টোবরের পর মিলিটারি ত্যাগ করার পর পাগল হয়ে গিয়েছে।
৫০১ বছর বয়সের গির্জায় ঘণ্টা বেজে ওঠে, দূরে পাগলের চিৎকার শোনা যায়— মিগে…ল…, বারান্দা মুসাইদ।
লোকজনে বার প্রায় ভরে গিয়েছে। আলেক্সকে হাত লাগাতে যেতে হয় ওদের সঙ্গে। পাশেই সিঁড়ির একটি ধাপে বসে গানের মহড়া দিচ্ছে অ্যাকর্ডিয়ন হাতে এক বয়স্ক লোক, সঙ্গে কর্ড বাজাচ্ছে কমবয়সি এক ছেলে। ‘সেঞোরা তেন্তাসিওন গানটা জানেন’, প্রশ্ন ছুড়ে দিই ওদের দিকে।
—হ্যাঁ, লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
ছেলেটা দৌড় দেয় সঙ্গের ভিওলিনচেলো বাদক ও গায়ককে ডাকতে।
Debo a la luna… ওরা শুরু করে, সঙ্গে গলা মেলাই।
Aquí no hay novedad… দ্বিতীয় গান শুরু হয়, সঙ্গে গলা মেলায় পাগল।
শত শত বছর ধরে ওরা গাচ্ছে এ-রকমের গান। কিছুক্ষণ আগে আলেক্স বলছিল, ‘মার্কিন দেশে কোনও সংস্কৃতি নেই; একটা সংস্কৃতি তৈরি হতেই শত শত বছর পার হয়ে যায়। কিন্তু খোয়া যেতে লাগে মাত্র এক প্রজন্ম। ওদের যা ছিল বা হতে পারত তার সবই খোয়া গিয়েছে, আর আমরা সযতনে বুকে ধারণ করি আমাদের পূর্বপুরুষদের, ওই যে দেখুন প্লাজার কোণায় হাতে বানানো ক্যান্ডি ও মিষ্টিবিক্রেতা মেয়েটা, আপনি ওর বাবাকে তো চিনতেন, বাবার চাচাকে কি পেয়েছিলেন?’, উত্তর দিয়েছিলাম হ্যাঁ, ‘প্রায় তিনশত বছরের আগের রেসিপি, আজও চলছে, একইভাবে’, বলে চলে আলেক্স ‘আচ্ছা, তোর দেশ তো নতুন, কিন্তু সংস্কৃতি তো অনেক দিনের। তাই না?’, প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আমাকে। কী উত্তর দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এক প্রজন্মের আয়ু হিসেব করছিলাম লুকিয়ে কড় গুনে।
ঠিক ওই সময়ে পাগলটা এসে পাশে বসে। কারও অনুমতির অপেক্ষা না করে বোতল ধরে গলায় ঢালতে শুরু করে। আলেক্স বাধা দিতে চেষ্টা করলে আমি ইশারা করি যেন কিছু না বলে। আধ বোতল শেষ করে কিছুটা ধাতস্থ হয়। ‘ছেলেটা দাঁ ভিঞ্চির ভিট্রুবিয়ান ম্যানের মতো দু-হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, ভেবেছিল আমরা গুলি করব না। অর্ডার আসে, ‘ফায়ার’, তর্জনি টেনে ট্রিগার থেকে সরাতে পারিনি, দেখ আমার তর্জনী নেই…’ বলে ডান হাত আমার সামনে মেলে ধরে। সত্যি, তর্জনী গোঁড়া থেকে নাই হয়ে গিয়েছে।
—আমার শ্বশুরের মুখে শুনেছি ও মেক্সিকো সিটি থেকে পরের দিনই বাড়ি ফিরে মাচেতে দিয়ে এক কোপে আঙুল নামিয়ে দিয়েছিল। ভুগেছিল অনেক দিন।
—সব দোষ এই খানকির পোলার, বলে অদৃশ্য আঙুলটাকে ধরে মোচড়াতে থাকে। ছেলেটা ‘মা’ বলে চিৎকার করেছিল। সমস্ত সোকালো মা চিৎকারে ভরে গিয়েছিল… মা, মা, মা, ঠা ঠা ঠা, হা, হা, হা ওরা কয় ১০০ আমি কই হাজারের কম না, শালার খানকির পোলা হইয়া জন্মাইছি, খানকির পোলা হইয়াই মরণ লাগব।
তারপর হাহা করে হেসে উঠে আমার তেকিলার গ্লাসটা সম্পূর্ণ ওর গলায় ঢেলে চিৎকার করে:
—আসছে, তৈরি হ, এরপর তোদের পালা, দিয়াস আসছে, আসছে তলাতেলোলকো।
আমি আর এক গ্লাস তেকিলা ঢেলে মুখ লুকাই।