চালা নদী লা জানুয়া

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

ভগীরথ ও পুরাণকথা

এ-গল্পের শুরু পুরাণের আখ্যানে। আখ্যানের কেন্দ্রীয় চরিত্র ভগীরথ, যার আহ্বানে সাড়া দিয়েই নাকি প্রাণদ জলধারা হয়ে দেবী গঙ্গার মর্ত্যে আগমন। ভগীরথের এই কাহিনি নিশ্চয়ই সকলে জানেন, তবুও নিবন্ধের শুরুতে ধরতাই হিসেবে সেই বহুলকথিত, বহুলশ্রুত কাহিনিটিকেই সংক্ষেপে নিবেদন করব, এ-কালের এক ভগীরথের কথা আলোচনা প্রসঙ্গে।

 

ভগীরথ ছিলেন সূর্যবংশীয় রাজা। একদা ভগীরথের পূর্বপুরুষ সগররাজা অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। এই উদ্দেশ্যে একটি সর্বসুলক্ষণযুক্ত অশ্বকে নির্বাচিত করে কপালে জয়তিলক এঁকে ছেড়ে দেওয়া হল। আসলে রাজা সগরের ইন্দ্রত্ব লাভের বাসনা ছিল। তাই এমন ব্যয়বহুল যজ্ঞের আয়োজন।

সগররাজা এমন যজ্ঞ করছেন শুনে দেবরাজ ইন্দ্র মনে মনে প্রমাদ গুনলেন— সগর সফলকাম হলে তাঁর যে চাঁটি বাটি চৌপাট হয়ে যাবে! তাহলে উপায়? ফন্দি এঁটে পণ্ড করো যজ্ঞ। যজ্ঞাশ্বটিকে অপহরণ করে পাতালে কপিলমুনির আশ্রমে তাকে বেঁধে রেখে আসা হল। ঘোড়া হারিয়ে গেছে শুনে খোঁজাখুঁজির জন্য মাঠে নেমে পড়ল সগররাজার ষাট হাজার এক-জন পুত্র।

আতিপাতি করে সন্ধানের পর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল মহাতপা কপিলমুনির আশ্রমে। সগরপুত্রদের হাতে বিস্তর হেনস্থা হওয়ার কারণে মুনিবর ক্রুদ্ধ হয়ে সগরপুত্রদের ভস্ম করলেন। শেষে খানিকটা শান্ত হয়ে এক শর্ত আরোপ করলেন— “তোমার প্রপৌত্রদের মধ্যে কেউ যদি স্বর্গ থেকে দেবী গঙ্গাকে তপোবলে মর্ত্যের মাটিতে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলেই আমার অভিশাপে ভস্মীভূত তোমার পুত্রেরা রক্ষা পাবে।”

আর কী করা যাবে? ইন্দ্রের দেওয়া শঙ্খ বাজিয়ে সগরের নাতি ভগীরথ পথে নামলেন। অনেক অনেক বাধা পার হয়ে তিনিই দেবী গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে এলেন। রক্ষা পেল সকলে।

এই পৌরাণিক কাহিনির সারকথা হল এই যে, নদীর জলের স্পর্শে জীবন জেগে ওঠে। নদী আছে বলেই না সভ্যতা টিকে আছে। যুগ যুগ ধরে এমন বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছি আমরা, বেঁচে আছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ, বহমান রয়েছে বর্ণিল প্রাণধারা। তাই নদী বিপন্ন হলে বিপন্নতার শিকার হয় প্রাণীকুল। এই পৌরাণিক কাহিনি পড়ে যদি আপনাদের মনে হয় যে ভাগ্যিস ভগীরথ ছিলেন, নাহলে সমগ্র আর্যাবর্ত জুড়ে এমন ঐতিহ্যবাহী পরম্পরার বিকাশ হত কীভাবে! তাহলে আজ আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব একটা শুকিয়ে যাওয়া বিপন্ন নদীকে পুনরুদ্ধার করা এক প্রবীণ মানুষের সঙ্গে, যার নাম বৈজিনাথ জগন্নাথ ঘোঙ্গাডে। মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার বাসিন্দা এই মানুষটি।

 

এক নদী, এক মানুষ, এক স্বপ্ন

মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বভাগে অবস্থিত সোলাপুর জেলা আসলে ষোলোটি পুর বা গ্রাম নিয়ে তৈরি। জলবায়ু রীতিমতো শুষ্ক প্রকৃতির। এখানেই সাঙ্গোলা তালুকের ওয়াদেগাঁও গ্রামের বাসিন্দা হলেন বৈজিনাথ। কর্মসূত্রে তিনি যুক্ত ছিলেন মহারাষ্ট্রের কৃষিবিভাগের সঙ্গে। অবসর গ্রহণের পর আর পাঁচজনের যেভাবে কাটে, সেভাবেই একরকম অলসভাবে কেটে যাচ্ছিল তাঁর দিনগুলো। একদিন কী মনে হল, গুটিগুটি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন ওয়াদেগাঁও গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মানগঙ্গা নদীর ধারে। ওমা! একী? নদী কোথায়? এ যে শুকনো ডাঙা! ওখানে দাঁড়িয়ে কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়েন বৈজিনাথ। এই মানগঙ্গা নদীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত কত স্মৃতি! অবসরের পরে কেন খোঁজ নিতে আসেননি তাঁর ছেলেবেলার সাথী তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে বয়ে চলা সেই ছোট্ট নদীটির? নদীর প্রতি গভীর দুঃখের সঙ্গে তাঁর মনে জাগে গ্লানি, আত্মগ্লানি। লজ্জিত কণ্ঠে নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন— আচ্ছা, সরকারি কৃষি দফতরের প্রাক্তন কর্মচারী হিসেবে তো প্রতি মাসে আমি সরকার নির্ধারিত পেনশন পাই, মাস ফুরোতে না ফুরোতেই সরকারি ট্রেজারি থেকে নির্দিষ্ট অর্থ চলে আসে আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে, অথচ তার বিনিময়ে আমি তো কিছুই করছি না, কোনও পরিষেবা ফিরিয়ে দিচ্ছি না আমার সমাজের কল্যাণে? এই সমাজের কাছে আমার যে ঋণ, তার কিছুটা হলেও মেটাব কেমন করে? বৈজিনাথের মনের ভেতরে তীব্র অন্তর্দাহ ঘূর্ণিঝড়ের মতো পাক খেতে থাকে। কীভাবে আমি আমার ঋণ শোধ করতে পারি? প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে চলল এমন টানাপোড়েন। কী করব? কী করব? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বৈজিনাথ যেন আলো দেখতে পেলেন। আচ্ছা! গাঁয়ের এই মানগঙ্গা নদীর জীর্ণ শীর্ণ দশাটাকে যদি কাটানো যায়, তাহলেই তো আমার সামাজিক ঋণের কিছুটা হলেও পরিশোধ করা যাবে! এই নদী আগের মতো প্রবাহী হয়ে উঠলে নদীপাড়ের মানুষজনের কত না উপকার হবে! এই নদীকে ঘিরেই তো বিকশিত হয়েছে সাঙ্গলি জনপদ, কত স্মৃতিবিজড়িত এই নদী! একে বাঁচিয়ে তুলতেই হবে।

 

এ-কালের ভগীরথ

সমাজের কাছে জমে থাকা ঋণ শোধ করার জন্য মাঠে নেমে পড়লেন বৈজিনাথ। সাঙ্গলি থেকে সোলাপুর— দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। নদীর এই অংশটুকুকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়ি ছেড়ে পথযাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন বৈজিনাথ। উদ্দেশ্য এই পঁচাত্তর কিলোমিটার নদীপথের হালহকিকত সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করা যাতে কর্মপরিকল্পনার সঠিক ও কার্যকর রূপায়ণের কাজ সহজ হয়। বৈজিনাথ তাঁর এই পদযাত্রার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিকভাবে নদীবাস্তুতন্ত্রকে বুঝে নিতে চাইছিলেন। সরকারি দফতরে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁকে এভাবেই ভাবতে শিখিয়েছে।

বৈজিনাথ বুঝেছিলেন যে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এত বড় একটা কাজ কখনওই সঠিকভাবে রূপায়ণ করা যাবে না। তাই তিনি নদীসংলগ্ন এলাকার গ্রামীণ মানুষজনকে একটু একটু করে সংগঠিত করলেন। ২০১৬ সালে বৈজিনাথ জগন্নাথ ঘোঙ্গাডে সাহেবের নেতৃত্বে ক্ষীয়মান মানগঙ্গা নদীকে নবজীবন দানের কাজ শুরু হল।

 

নদীর নাম মানগঙ্গা

নদীর নাম মানগঙ্গা। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর নাম মানবগঙ্গা। মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার পূর্বসীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় থেকে উৎসারিত এই নদী পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে সোলাপুর জেলার পাঁচটি খরাপ্রবণ তালুক যথাক্রমে— দহিওয়াডি, আটপদী, সাঙ্গোলা, মঙ্গলবেদা এবং পান্ধারপুর-এর মধ্যে দিয়ে। টানা এভাবে বয়ে গিয়ে সারকোলির কাছে ভীমা নদীতে গিয়ে মিশেছে। সর্বাংশে বৃষ্টির জলে পরিপুষ্ট এই নদীর উজানের শুকিয়ে যাওয়া ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথের সংস্কারের জন্যই বৈজিনাথজির সমবেত কর্মপ্রয়াস, নদী বাঁচাও প্রকল্প।

মহারাষ্ট্রের এই অঞ্চলে বর্ষা আসে ক্ষণিকের অতিথি হয়ে। সোলাপুরে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৫৮৪ থেকে ৭৬২ মিলিমিটার। মজার ব্যাপার হল এত অল্প বৃষ্টিপাত সত্ত্বেও এখানে মাঝেমাঝে বন্যার ঢল নামে। ২০১৯ সালের আগস্টে এবং ২০২১ সালের অক্টোবরে বানভাসি হয়েছিল গোটা এলাকা। এও এক বৈপরীত্যকে সঙ্গী করে বেঁচে থাকা।

আসলে মানগঙ্গার উজানি নদীখাতের ৭৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত অংশ পলি জমে জমে অগভীর হয়ে পড়েছে অনেককাল। এর ফলে নদীর বাকি অংশের থেকে বিলকুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে হঠাৎ করে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে জল আর ভাটির অংশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, ফলে উপচে পড়ে বন্যার সৃষ্টি করে। ঘোঙ্গাডে সাহেব সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে এই সমস্যার কথা জানতে পারেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে জল না থাকায়, নদীখাতের দখল নিয়েছে ঢোলকলমির দঙ্গল। মাটির সামান্য আর্দ্রতাকে কাজে লাগিয়েই এই সহিষ্ণু গাছেরা দল বেঁধে এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে।

 

ছেলেবেলা থেকে যে নদীকে জড়িয়েই একটু একটু করে বড় হয়েছেন বৈজিনাথ ঘোঙ্গাডে সাহেব, সেই নদী পলি পড়ে মজে গিয়েছে দেখে তিনি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। নদীর পাড় জুড়ে যথেচ্ছভাবে গজিয়ে ওঠা ঢোলকলমি-সহ অন্যান্য আগ্রাসী লতাগুল্মর দাপট তাঁকে উদাস করে তুলেছিল। তিনি সমস্যার আসল চেহারাটা দেখে হয়তো মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলেন ওই দীর্ঘ ৭৫ কিলোমিটার পথকে মুক্ত করে ভাটির অংশের সঙ্গে যুক্ত করতে।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোঙ্গাডে সাহেব সমমনস্ক আরও ১১ জন কৃতবিদ্য মানুষের সহায়তায় এক বিশেষ গোষ্ঠী গড়ে তুললেন। তাঁদের লক্ষ্য কেবল নদীর মজে যাওয়া উজানি অংশকে জলভরা ভাটির অংশের সঙ্গে যুক্ত করাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁরা চাইছিলেন ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মানগঙ্গা নদীকে জড়িয়ে ধরে যে অনন্য বাস্তুপরিবেশ গড়ে উঠেছিল একসময়, তার পুনরুদ্ধার ও পুনঃসংস্থাপন। তাঁরা হিসেব করে দেখেছিলেন যে মানগঙ্গা নদীর জলবিভাজিকার বিস্তৃতি ৪৭৬৩ বর্গ কিলোমিটার। নদীকে নতুন করে বাঁচিয়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে তার অববাহিকা অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েও তাঁরা বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। ঘোঙ্গাডে সাহেবের অনুসন্ধানী দলে ছিলেন একজন উদ্যানবিদ্, একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, একজন সেচবিশেষজ্ঞ, একজন শিক্ষাবিদ, একজন সাহিত্যিক, একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা জ‌ওয়ান এবং একজন কৃষক। আসলে তিনি চাইছিলেন সমাজের সমস্ত ভাবনার মানুষজনকে এই মহতী উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত করতে যাতে তার রূপায়ণের কাজে কোনওরকম ফাঁক না থাকে।

বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য ডক্টর অশোক সিন্ধে এই প্রকল্পের রূপায়ণ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন—

আমাদের কাজ শুধু এলাকাটিকে পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখাতেই শেষ হয়ে যায়নি, আমরা প্রতিটি জায়গা থেকে মাটি সংগ্রহ করে এনে তার গুণাগুণ পরীক্ষা করেছি, জল পরীক্ষা করে দেখেছি, সেচের জন্য কোথায় কতটা জল পাওয়া যেতে পারে তা পরিমাপ করে দেখেছি, খোঁজ নিয়ে জেনেছি কোথায় কী ধরনের ফসলের উৎপাদন হয় ইত্যাদি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, এইসব তথ্য আমাদের কাজের জন্য খুবই জরুরি ছিল। দিনের বেলায় আমাদের বেশি সময় কেটেছে নদীর তীরে, এইসব তথ্য সংগ্রহের কাজে। আর রাতে আমরা থেকেছি কখনও পঞ্চায়েত সমিতির অফিসে, মন্দিরের সামনের চাতালে, স্থানীয় স্কুলবাড়িতে, কমিউনিটি সেন্টারে, এমনকি ওই এলাকার কোনও কৃষকের বাড়িতে। এভাবেই আমরা নিবিড় জনসংযোগের কাজ চালিয়ে গিয়েছি দীর্ঘ সময় ধরে। আমাদের এই পরিকল্পিত অভিযানের নাম আমরা রেখেছিলাম “চালা নদী লা জানুয়া”— “চলো, নদীকে জানি”। এভাবে কাছ থেকে নদীকে জানাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

একটা সদর্থক ইতিবাচক ভাবনা থেকে সমগ্র নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি পরিচালনা করেছেন বৈজিনাথ জগন্নাথ ঘোঙ্গাডে ও তাঁর সহযোগীরা। এই কাজে কেবল আবেগ নয়, ঘোঙ্গাডে সাহেবরা নির্ভর করেছিলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। তাই পদযাত্রায় পা মিলিয়ে চলতে চলতে তাঁরা মাটি পরীক্ষা করে দেখেছেন, নদীর জলের গুণাগুণ পরীক্ষা করে দেখেছেন, আগ্রাসী লতাগুল্মর অপসারণ করে সেখানে লাগিয়েছেন পরিবেশবান্ধব দেশীয় লতাগুল্ম, গাছগাছালি। এর পাশাপাশি নদীপাড়ের অধিবাসীদের জীবনযাপনের নানা খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে তাদের আগামী দিনগুলোকে সুন্দর ও নিরাপদ করতে বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণের ওপর জোর দিয়েছেন নদী বাঁচাও কমিটির সদস্যরা। স্থানীয় মানুষদের উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় মানগঙ্গা নবায়নের সুফলগুলোকে। আসলে এই দীর্ঘ পদযাত্রার মাধ্যমে স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস ও সহযোগিতা অর্জন করাই ছিল তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য।

“চালা নদী লা জানুয়া”-শীর্ষক পদযাত্রার মেয়াদ ছিল ২১ দিন। এই একুশ দিনে পদযাত্রীরা যে অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তা একটি চটি বইয়ে— ‘পরিক্রমা মাঙ্গানগেছি’— সুচারুভাবে নথিভুক্ত করা হয়। এই ব‌ইটিকে একটি প্রামাণ্য নথি হিসেবে ধরে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাশাপাশি এই পুস্তিকাটি স্থানীয় মানুষজন, স্কুলকলেজের শিক্ষার্থী, ওই এলাকার গ্রন্থাগারগুলো, পেশাদার লোকজন ও কৃষকদের মধ্যে বিক্রি করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।

এই পুস্তিকাটিতে যে-সব সমস্যার কথা বলা হয় সেগুলো হল—

১. মানগঙ্গা নদীকে নিয়ে রাজ্য সেচ দফতরের দীর্ঘ অবহেলা ও উপেক্ষা পরিস্থিতিকে ক্রমশ জটিল করে তুলেছে। এই কারণেই এককালের চিরপ্রবাহী নদী আজ এক নিকাশি নালায় পরিণত হয়েছে।

২. নদীখাতের অংশ অনেকক্ষেত্রেই বেদখল হয়ে গেছে। স্থানীয় মানুষজন নদীর শুকিয়ে যাওয়া খাতের ওপর বাড়িঘর গড়ে তুলেছেন।

৩. প্রাথমিকভাবে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত অংশকে বাদ দিয়ে পরবর্তী অববাহিকার অংশে গাছের সংখ্যা উদ্বেগজনক মাত্রায় কম। এর ফলে মাটি ক্ষয় পেয়ে নদীখাত ভরাট করে ফেলেছে। নদীখাতের বিভিন্ন অংশে বাবলা ও অ্যাকাশিয়া ঝোপের উপস্থিতি সমস্যা সৃষ্টি করছে।

৪. কোলাপুর মডেলের অনুসরণে মানগঙ্গা নদীতে যে আড়বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল সেচবিভাগের দ্বারা সেইগুলো অতিরিক্ত পলি জমার কারণে তেমন ফলদায়ক তো হয়ইনি, বরং এতে সমস্যা বেড়েছে। জলের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়েছে।

৫. নদীর পাড় জুড়ে বসবাসকারী মানুষজন নদী-বিষয়ে অসচেতন। তাঁদের কাছে নদী প্রাণধারা না হয়ে এখন আবর্জনার আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে। উৎসবের কাল এগিয়ে এলে কিছু মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে নদীখাতের পুরনো আবর্জনা পরিষ্কার করে নতুন বর্জ্যপদার্থ সেই নদীতেই বিসর্জন দেয়। ঘোঙ্গাডে সাহেব গভীর আক্ষেপ করে বলেছেন— এই প্রথা দীর্ঘদিন ধরে চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। মানুষ যতক্ষণ না নিজেদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে ততক্ষণ কোনও প্রয়াসের সফল রূপায়ণ সম্ভব নয়।

 

বৈজিনাথ জগন্নাথ ঘোঙ্গাডে আজকের সোলাপুর জেলার এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষ। অবসর গ্রহণের পর অর্থহীনভাবে সময় না কাটিয়ে, তিনি এক নতুন কর্মপথের অনুসরণ করেছেন নিরলস প্রচেষ্টায়। নদী বাঁচাও অভিযানে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন একান্ত সহযোগী এগারোজন কৃতবিদ্য যোদ্ধা-সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বহু বহু মানুষ। পুস্তিকা বিক্রি করে জমা করেছিলেন মাত্র ৫৪০০০ হাজার টাকা যা প্রকল্পের অনুমিত ব্যয়ের এক অতি নগণ্য অংশ। সেই অর্থেই কাজ শুরু করেন তিনি। অর্থের জোগান কোথা থেকে আসবে তা নিয়ে মোটেই ভাবিত হননি। তাঁর বিশ্বাস ছিল নিজের প্রতি। আর তাই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক সংস্থা। বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ এই আশ্চর্য কর্মকাণ্ডের সহযোগী হিসেবে ঘোঙ্গাডে সাহেবের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় আজ মানগঙ্গা নদী তার হারিয়ে যাওয়া মান ও মান্যতা ফিরে পেয়েছে। সব বাধা পেরিয়ে আবার কুলকুল শব্দে ব‌ইছে নদী এক নব্য ভগীরথের আহ্বানে যাঁর নাম শ্রী বৈজিনাথ জগন্নাথ ঘোঙ্গাডে, মাত্র ৭৭ বছরের এক যুবা স্বপ্নদ্রষ্টা।

 

ঋণস্বীকার:

  • দ্য বেটার ইন্ডিয়া
  • সোলাপুর নিউজ

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4892 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

5 Comments

  1. প্রণাম জানাই।এইসব লোকেরা আছেন বলেই পৃথিবী এখনও বাসযোগ্য।
    আর আপনি এইসব অসামান্য খবরগুলো তুলে নিয়ে আসছেন বলে আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।

  2. অসাধারণ একটি অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য নিবন্ধকারকে ধন্যবাদ। লাখো কুর্ণিশ জানাই বৈজনাথ জী কে। এঁরা এখনও নীরবে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে।

  3. লেখাটি শুধু বিশ্বাস জাগায় না গভীর প্রেরণার উৎস স্রোত হিসেবেও কাজ করে। বিষয়টিকে তুলে ধরার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাই।

  4. Adbhut ebong ek opurbo shundor jibon kahini. Eto shundor, shabolil bhashay chhobiti ankar jonyo Somnath Mukhopadhyay mahashay ke ashesh dhanyobad! Aro erokom lekha pawar asha rakhi.

  5. চারিদিকের হানাহানির মধ্যে এমন নীরব নিষ্কাম কর্ম সাধন মানুষগুলির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে। আনত শ্রদ্ধা জানাই।

আপনার মতামত...