বাংলাদেশ: মূর্তিভাঙার রাজনীতি

দেবকুমার সোম

 


কথা উঠছে বাংলাদেশ ফের জামাতিদের হাতে পড়বে। হ্যাঁ পড়তেই পারে, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে? ভারতে কী চলছে? ব্রিটেন? ফ্রান্স? ইতালি? আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন? চিনে কি গণতন্ত্র আছে? না মায়ানমারে? ইজ়রায়েল সকলের মদতে চোখের সামনে প্যালেস্তাইনকে শেষ করে দিতে চাইছে। রাশিয়া ইউক্রেনকে চরম শাস্তি দিতে জী-জান এক করে নেমেছে। আজ দেশে-দেশে ছদ্ম-একনায়কতন্ত্র। এইসময় বাংলাদেশে জনবিপ্লব ঘটে যাবে এমনটা ভাবা কি বাড়াবাড়ি নয়? তবুও বাংলাদেশে যা ঘটল তাকে আমার মনে হয়েছে তিয়েন-য়েন-মেন স্কোয়ারের ছাত্রবিক্ষোভ, ইউক্রেনে লেনিনের মূর্তি ভাঙা, বার্লিন পাঁচিল ভেঙে দেওয়া কিংবা পশ্চিমভারতের সাম্প্রতিক সময়ের কৃষি আন্দোলনের মতো তীব্র এক জনপ্লাবন। মানুষই ইতিহাস গড়ে, কোনও শাসক নন। বাংলাদেশ কোন পথে যাবে আমি জানি না, তবে আমার এই ভেবে খানিক স্বস্তি হচ্ছে যে মূর্তি ভাঙার মধ্যে দিয়েই মূর্তিপুজোর হুজুগটা আপাতত কিছু বছরের জন্য বাংলাদেশ বর্জন করল

 

এই লেখা যখন লিখছি, তখন পরিস্থিতি স্পষ্ট নয়। অস্পষ্টতার পাশাপাশি পরিস্থিতি দ্রুত পালটেও যাচ্ছে। ফলে এই লেখার কতটা শেষতক প্রাসঙ্গিক থাকবে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবু লিখছি, কারণ লিখতে হয় তাই। বাংলাদেশ আমাদের কাছে কেবল প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয়, যেমনটা নেপাল-ভুটান। আমার মতো বহু পাশ্চিমবাংলার বাঙালির দু-পুরুষ আগেও সেখানে ছিল বাস্তুভিটে। এছাড়া ভাষা-সংস্কৃতির দিক থেকেও বিশেষ আলাদা কিছু নয়। এসব মিলেই গত এক মাস ধরে ঘটে চলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বহুজনের মতো আমারও রাতের ঘুম হারাম করেছে। তবে শুরুতে জানিয়ে দিই বাংলাদেশ নিয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কিছু নেই। সরকারি কিংবা ব্যক্তিগত কোনও স্তরেই আমি এই লেখার উপযুক্ত নই। তবু, গত প্রায় তিন দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের হাল-হকিকত বুঝতে চেষ্টা করি নিজের গরজে। খবরের কাগজ কিংবা সরকারি তথ্যাবলি ছাড়াও কিছু সাহিত্যিক বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনার মধ্যে দিয়ে আমি তাই বাংলাদেশ নিয়ে কিছু লিখতে সাহস পাচ্ছি।

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলে একটা অবয়বহীন অবয়ব বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহলে খুব চালু, তবে সেই চেতনা নিয়ে সন্দেহে অবকাশ কিছু কম নয়। একাত্তর সালে বাংলাদেশ পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার সময় যেমন নেতৃত্বে অগ্রগণ্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামি লিগ। বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভারতের সহযোগিতাও ছিল তেমন উল্লেখযোগ্য। তার মানে এই তো নয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক এবং একমাত্র হকদার শেখ মুজিব এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ? ব্যাপারটা যেন এমন: গান্ধিজির নেতৃত্বে কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা এনেছে। এমনটা লাগাতার প্রচার ইতিহাসের পক্ষে ক্ষতিকর। যার ফল আজ যেমন ভারতের গান্ধি-নেহরু পরিবার ভুগছে।

১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজিয়ে নিতে গিয়ে খোদ মুজিবুর রহমান একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিলেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের হত্যাকাণ্ডের নতুন নতুন যেসব তথ্য পরের দিকে উঠে এসেছে, সেগুলোও সব মুজিব পরিবারের (বিশেষত শেখ কামালের আচরণ) অনুকূলে সাক্ষী দেয় না। আজকের প্রজন্ম যাদের বয়স তিরিশের নিচে, তাদের কাছে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল স্মৃতি বিশেষ থাকার কথা নয়। শেখ মুজিব পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্ম নির্বাসন কাটিয়ে এক রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় ক্ষমতায় এসেছিল (১৯৯৬ সালে)। সময়ের দাবি মেনেই সেদিন বাংলাদেশের যুবসমাজ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছিল। তখন তাদের এই প্রত্যাশাই ছিল যে, ‘বঙ্গবন্ধু’র অসমাপ্ত কাজগুলো তাঁর বড় মেয়ে সমাধান করবেন। আর আজ সেই সময়ের দাবি মেনেই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হল নির্বাচনের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ছ-মাসের মধ্যেই।

মূর্তিপুজোর (এর সঙ্গে ভাবমূর্তিকে জড়িয়ে ফেলা অনুচিত) মতোই ব্যক্তিপুজো আচারসর্বস্ব। আসলে ব্যক্তিকে মূর্তি বানিয়ে পুজো করা ক্ষমতাশালীদের একটা ধারাবাহিক কৌশল। দ্বিতীয় দফায় (২০০৯ সাল) ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের মধ্যে একনায়কতন্ত্র আমদানি করলেন, সামনে রাখলেন ‘বঙ্গবন্ধু’র ইমেজ আর ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। আওয়ামি লিগের স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকরা ‘আপা’কে ঘিরে তোষামোদের মেলা বসালেন। ক্ষমতাবানরা এমনিতেই অন্ধ হন, তার ওপর খোশামুদি তাঁদের পেট-ফোলা ব্যাং করে দেয়, যাকে ঈশপের গল্প বলছে কূপমণ্ডূক। সরকারি, বেসরকারি সর্বস্তরে শেখ মুজিবের পিতৃদত্ত নামের বদলে তাঁকে দেওয়া শিরোপা ‘বঙ্গবন্ধু’ প্রতিষ্ঠা পেল। প্রতিটি কথা, আচরণ, লেখা, ভাবনা ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণের পরেই শুরু করার রেওয়াজ চালু হল। এমনকি ঘোষণা করা হল ‘হাজার বছরে শ্রেষ্ঠতম বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। এহ বাহ্য, হাসিনা সরকার আদেশ জারি করল, সরকারের নির্দেশ ছাড়া কোথাও ‘বঙ্গবন্ধু’র ছবি, ভাষণ, বাণী ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। আর এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ থেকে দেশের অতীত ইতিহাস সবই শেখ পরিবারের নিজস্ব অধিকারে এসে গেল। এ খানিকটা শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক পরিবারের মতো। সবচেয়ে কাপুরুষোচিত হল বুদ্ধিজীবীদের আচরণ। এক সময় যে শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কর্মীরা পাকিস্তানি সেনার বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁরাই হলেন হাসিনার গায়েন আর বাজনদার। অর্থনীতির যে উর্ধ্বগামী লেখচিত্র নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা বাজার সরগরম করেছেন, সেগুলো গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রকের উপাত্ত। বিশ্বায়নের পর পৃথিবীর অর্থনীতিতে বাঁকবদল ঘটেছে। বিভিন্ন বড়লোক রাষ্ট্র প্রায় বিনাশর্তে বিনিয়োগ আর ঋণের ব্যবস্থা করে গরিব রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি খাটায়। যাকে বলা যায় ছদ্ম-ঔপনিবেশিকতাবাদ। এছাড়া অনেক আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাও দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অপুষ্টি নির্মূলে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। গরিব বা অনুন্নত রাষ্ট্র সেসব গ্রহণ করে, কারণ তাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হলেও সাময়িক লাভ আছে। আজ বাংলাদেশের এই অস্থিরতাকে বুঝতে গেলে এই দিকটায় প্রথম নজর দিতে হবে।

একাত্তর সাল থেকে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশের ওপর ভারতের প্রভাব আছে। মাঝে বিএনপি-র সময় খানিক ভাঁটা পড়লেও মোটের ওপর ভারতের তপ্ত নিশ্বাস সবসময় মালুম করে এসেছে বাংলাদেশ। শেখ মুজিবের সঙ্গে ভারতের সখ্য স্বাভাবিক ছিল। কারণ তাঁর রাজনীতি শুরু কলকাতায়, কলেজে পাঠও এখানে। তাঁর মতো আরও বহু বাংলাদেশি স্বাধীনতার আগে-পরে এই শহরেরই সন্তান ছিলেন। এসব কারণে ভারতের প্রতি তাঁদের একটা আবেগ কাজ করে। পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে কিছু ছোট-বড় ভাগ থাকে, যেমন আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে। গরিব আত্মীয় বা প্রতিবেশীকে সময়-অসময়ে টাকা-পয়সা ধার দেওয়ার মধ্যে কোনও মহানুভবতা থাকে না, যেটা থাকে তা হল বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নেওয়া। ইঁদুরের সঙ্গে সিংহের সখ্য হওয়ার কথা নয়, উচিতও নয়, কিন্তু হয়। কারণ সিংহ জালে পড়লে ছোট্ট ইঁদুরই তাকে বাঁচাতে পারে। এছাড়া আমাদানি-রফতানির মধ্যে সামঞ্জস্যও দরকার। দেশীয় পণ্য রফতানি করার নির্ভযোগ্য বিদেশি বাজার খুঁজতে তাই বন্ধুত্বের হাত বাড়াতেই হয়। আর এসব মিলেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধান উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশে প্রথম, পোশাক তৈরিতে দ্বিতীয়, প্রবাসী আয়ে অষ্টম, পাট রফতানিতে প্রথম। এছাড়া সবজিতে তৃতীয়, আমে অষ্টম, কাঁঠালে দ্বিতীয়, আলুতে ষষ্ঠ, ছাগলের দুধে দ্বিতীয় এমন সব চমকপ্রদ তথ্য তাদের হাতে। এর মধ্যে একমাত্র পোশাক তৈরি ছাড়া আর কিছুই প্রভাববিস্তারী ইনডেক্স নয়। প্রবাসী আয়ে অষ্টম, এটাই সাব্যস্ত করে যে, সম্পন্ন ঘরের ছেলেপুলেরা সব বিদেশে বসবাস করে। গণ-অর্থনীতির প্রধান তিন স্তম্ভ শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর আয় এই তিনটের কোনওটিতেই বাংলাদেশের আশাতীত কোনও সাফল্য নেই। গড় আয়ের যে-রিপোর্ট নিয়ে উচ্ছ্বাসের কারণ সম্প্রতি লক্ষ করা গেছে, তা হল বাংলাদেশের স্থান তালিকায় পাকিস্তানের ওপরে এই জন্য। এখানেই সেই পণ্যটি আবার ফিরে আসে যার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ’। যেহেতু পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ গঠিত, তাই পাকিস্তানকে টেক্কা দিলেই বাংলাদেশের অগ্রগতি মাপা যাবে। এখানে কেউ এই প্রশ্নটা তোলেন না যে, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ভুটান, ক্যারিবিয়ান দেশগুলো, যাদের আয়তন, আবহাওয়া, অর্থনৈতিক-সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমান, তাদের চেয়ে বাংলাদেশ কতটা এগোল? সেসব কোথাও আলোচিত হয় না। আর দুর্নীতিতে? ইন্টারন্যাশানাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্ডেক্স অনুযায়ী পৃথিবীর ১৮০টা দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান ১৪৯তম। নেপাল, শ্রীলঙ্কা তো বটেই তালিকায় পাকিস্তানও বাংলাদেশের থেকে অনেক ওপরে থাকে। বোঝা যায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’কে সামনে রেখে আওয়ামি লিগের নেতারা দেশটাকে দুর্নীতির আখড়া বানিয়ে ছেড়েছেন। এদিকে দেশের বেকারি সমস্যা কোভিড-সময়ের দুর্দশা থেকে বের হতে পারেনি। অথচ, আওয়ামি লিগের নেতা-কর্মীদের আয় বেড়েছে নজরকাড়া। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে আদালতের রায় অনুঘটকের মতো কাজ করেছে মাত্র।

এই প্রজন্মের বাংলাদেশিদের মধ্যে ভারতবিদ্বেষ ক্রমশ মাথা চাড়া দিচ্ছে। এর কারণ দ্বিবিধ। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক। গত প্রায় দেড় দশক ধরে ভারতের মুসলমানদের পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোরালো হয়ে উঠেছে। একসময় ‘ভারতীয় মুসলমান’ নামে একটা শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হত, এখান সেখান থেকে ভারতীয়ত্ব মুছে ফেলার আয়োজন প্রতিবেশী বাংলাদেশিদের ক্রমেই অসহিষ্ণু করে তুলছে। যে প্রতিবেশী দেশের ৯১ শতাংশ মুসলমান, তাদের কাছে বর্তমান ভারত সরকারের মুসলিম-বিদ্বেষ অন্যতম উপদ্রব তো বটেই। ভারতের ইসলামোফোবিয়ার রকমসকম ক্রমশ অস্থির করে তুলছে প্রতিবেশী মুসলমান সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রগুলোকে, যার মধ্যে এনআরসি অন্যতম। আফগানিস্তানের তালিবানদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কারণ পাকিস্তানের প্রতিবেশী শত্রু ভারত আর আফগানিস্তান দুইই। ফলে বিজেপি-শাসিত হিন্দু ফান্ডামেন্টালিস্টরা ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্ট তালিবানদের বড় দাদা হয়ে আজ দাঁড়িয়েছে। এই দ্বিচারিতাও যুক্তিবাদী বাংলাদেশি, যাঁরা পারিবারিকভাবেই ভারতের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেন, তাঁদের কাছেও উষ্মার। আজ বাংলাদেশের জনরোষ যদি ফের জামাতের মতো কোনও রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় আনে, তার দায় কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এড়াতে পারবেন না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে হসিনা ভারত আর চিনের সঙ্গে ব্যালেন্স রেখেই চলছিলেন। কিন্তু চিন আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এক নয়। প্রথমত বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানপন্থী চিন ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সীমানা। দক্ষিণ থেকে পশ্চিম হয়ে উত্তর পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঘিরে রেখেছে ভারত। ফলে সীমানার এপার-ওপারে বহু বিষয় আছে যা ভারতের দাদাগিরিকে স্পষ্ট করে। যেমন তিস্তার জল। ভারতের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলো বয়ে গেছে। অথচ, দীর্ঘ সাত দশক ধরে বাংলাদেশের ওপর খবরদারি করে ভারত, এটা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মধ্যে মস্ত বড় অসন্তোষ। ক্ষোভ আরও আছে। ভারতের আদানি, আম্বানি গোষ্ঠীর হাতে যেভাবে বাংলাদেশ সরকার আত্মসমর্পণ করে তাদের মুনাফা লুঠ করতে সাহায্য করে চলেছে, তা কারও নজর এড়ায় না। এরপর যখন-তখন সীমানা দিয়ে পেঁয়াজ, সরষের তেল, পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট ইত্যাদি রফতানি বন্ধ করে ভারত বাংলাদেশের রোজকার জনজীবনের নাভিশ্বাস তুলে দেয়। সঙ্গে যোগ করুন ক্রিকেট। ভারত, পাকিস্তানের মতো ক্রিকেট বাংলাদেশের আবেগ এবং অর্থনীতি দুইই। কিন্তু ক্রিকেটে ভারতের ক্রমবর্ধমান দাদাগিরিতে তরুণ বাংলাদেশ আজ ক্ষুব্ধ। তাদের স্মৃতিতে পাকিস্তানের অত্যাচার নেই, থাকার কথাও নয়। তাদের চোখে তাই আজ ভারত খলনায়ক। শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ায় যা আরও ব্যাপক হল বলা যায়।

শেখ হাসিনা তাঁর পিতা এবং পার্টিকে সামনে রেখে যে গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র কার্যকর করেছিলেন তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ছিল বিস্তর অসন্তোষ। মাত্র কুড়ি-পঁচিশ শতাংশ মানুষ ভোট দেয় যেখানে, আর সেই ভোটে ৯৯ শতাংশ ভোট পেয়ে নেত্রী প্রধানমন্ত্রী হন, সেখানকার গণতন্ত্র নিয়ে বোধহয় বাড়তি শব্দ ব্যবহার করার বিশেষ প্রয়োজন নেই। বিরোধী কণ্ঠস্বর, তা তিনি খালেদা জিয়া হোন বা মহম্মদ ইউনুস সকলকে জেলে পুরে দেওয়ার ফ্যাসিস্ট রাজনীতিতে নিজের হাত কলুষিত করেছেন শেখ হাসিনা। শুধু জেলে পুরে দেওয়া নয়, সর্বত্র সেন্সর করা হয়েছে। গণমাধ্যম থেকে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তক কিছুই বাদ যায়নি। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার নিজের নামে স্টেডিয়াম থেকে আরও বহু সরকারি স্থাপত্য তৈরি করা হয়েছে। তাঁর পুত্র জয় বিদেশে বসেই মায়ের ব্যক্তিগত প্রচারসচিব থেকেছেন। পার্টির মধ্যেও হাসিনা কোনও বিরোধী স্বরকে রাখেননি। গত জুন মাসের শেষের দিকের একটি ঘটনা। একটি নামী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যারা সরকারের আর্থিক সাহায্য নিয়ে শিক্ষার প্রসার ঘটায়, তাদের একজন কর্মকর্তা কোটা ব্যবস্থা নিয়ে ফেসবুকে মৃদু সমালোচনা করেছিলেন। তার দরুন সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারি আর্থিক অনুদান পরদিনই বন্ধ করে দেওয়া হয়। আওয়ামি লিগের কর্মী এবং কর্তারা কলকাতা, দিল্লি তো বটেই, বিদেশেও তাঁদের সম্পত্তি বানিয়েছেন। তাঁরা অপরাধচক্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছেন যে কলকাতায় এমপি আনোয়ারুল আজিমের খুনে কোনও রহস্য-রোমাঞ্চ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমন অপরাধকাহিনি হিমশৈলের চূড়া মাত্র। ধরে নেওয়া যায় মুজিবহত্যার অন্যতম খলনায়ক মেজর ডালিমের মতো আওয়ামি লিগের এই নেতারা পাকাপাকিভাবে বিদেশবাসের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। যুক্তিগ্রাহ্য কথা হল, একজন রাজনীতিবিদ যদি সৎ এবং মানুষদরদি হন, যদি তিনি বিরোধীদের ওপর কোনও অন্যায় অত্যাচার না করেন, তবে কীসের ভয়ে তাঁকে দেশত্যাগ করতে হয়? বাংলাদেশে তো এবার কোনও সামারিক অভ্যুত্থান ঘটেনি? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের প্রধান কেন এভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান? যাঁরা শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামি লিগের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করছেন, অনুগ্রহ করে তাঁরা এই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজবেন।

কথা উঠছে বাংলাদেশ ফের জামাতিদের হাতে পড়বে। হ্যাঁ পড়তেই পারে, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে? ভারতে কী চলছে? ব্রিটেন? ফ্রান্স? ইতালি? আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন? চিনে কি গণতন্ত্র আছে? না মায়ানমারে? ইজ়রায়েল সকলের মদতে চোখের সামনে প্যালেস্তাইনকে শেষ করে দিতে চাইছে। রাশিয়া ইউক্রেনকে চরম শাস্তি দিতে জী-জান এক করে নেমেছে। আজ দেশে-দেশে ছদ্ম-একনায়কতন্ত্র। এইসময় বাংলাদেশে জনবিপ্লব ঘটে যাবে এমনটা ভাবা কি বাড়াবাড়ি নয়? তবুও বাংলাদেশে যা ঘটল তাকে আমার মনে হয়েছে তিয়েন-য়েন-মেন স্কোয়ারের ছাত্রবিক্ষোভ, ইউক্রেনে লেনিনের মূর্তি ভাঙা, বার্লিন পাঁচিল ভেঙে দেওয়া কিংবা পশ্চিমভারতের সাম্প্রতিক সময়ের কৃষি আন্দোলনের মতো তীব্র এক জনপ্লাবন। মানুষই ইতিহাস গড়ে, কোনও শাসক নন। এটা শাসকরা কতটা বুঝবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও এমন ঘটনায় সাধারণ মানুষের নিজেদের ওপর আস্থা ফিরে আসা উচিত। গণতন্ত্রের মধ্যেই আছে সেই আশ্চর্য প্রতিরোধশক্তি। বাংলাদেশ কোন পথে যাবে আমি জানি না, তবে আমার এই ভেবে খানিক স্বস্তি হচ্ছে যে মূর্তি ভাঙার মধ্যে দিয়েই মূর্তিপুজোর হুজুগটা আপাতত কিছু বছরের জন্য বাংলাদেশ বর্জন করল। ভারতের মানুষজন কি সেটা অনুভব করছেন?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...