রাহুল সাংকৃত্যায়নের চোখে আকবর

শুভেন্দু সরকার

 


আকবরকে নিয়ে লেখার পেছনে কাজ করেছে আধুনিক ভারত সম্বন্ধে রাহুলের ভাবনা। ভারতে ইসলামি শাসন কায়েম হওয়ার পর থেকে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ধীরে ধীরে দুটি পরস্পর-বিরোধী ধারা গড়ে ওঠে; এমনকি, দুইয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও দেখা দেয় মাঝেমধ্যে। এরই চূড়ান্ত পরিণাম ১৯৪৭-এর দেশভাগ। এর উল্টোদিকে অবশ্য শান্তি ও সমন্বয়ের চেষ্টাও চলেছে। আকবর ছিলেন সেই ধারার এক অতি উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তাই আকবরের পথকে নিজের আর সব প্রগতিশীল মানুষের পথ হিসেবে চিহ্নিত করেন রাহুল

 

১৯২৩-এ ইসলাম ধর্মের রূপরেখা লিখেছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন (১৮৯৩-১৯৬৩)। মুহাম্মদের জীবন আর ইসলাম ধর্মের মূল রীতিনীতির পাশাপাশি সেখানে পাওয়া যায় আরবের সমসাময়িক আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির খতিয়ান। বোঝা যায়, এই ছোট্ট বইটি লেখার পেছনে কাজ করেছিল রাহুলের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। বৈষ্ণব ধর্ম, বেদান্ত দর্শন আর আর্যসমাজ পেরিয়ে বৌদ্ধধর্মে শরণ নেওয়ার পরও তাঁর অস্থির মন শান্ত হয়নি। ১৯২০-র দশক থেকে রাহুলকে টানল সক্রিয় রাজনীতি। জাতীয়তাবাদী চেতনা পেরিয়ে ধীরে ধীরে মার্কসবাদে আস্থাশীল হয়ে উঠলেন তিনি। বাস্তববোধ থেকে রাহুল বুঝেছিলেন, ভারতের সংহতি নির্ভর করবে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সদ্ভাবের ওপর। তাই “হিন্দুদের আপন প্রতিবেশী মুসলমান ভাইদের ধর্ম সম্বন্ধে একটা ধারণা” তিনি দিতে চেয়েছিলেন ইসলাম ধর্মের রূপরেখা-য়। স্বাভাবিকভাবেই রাহুল বিশেষভাবে তুলে ধরলেন শান্তি, ভ্রাতৃভাব আর স্ত্রীজাতি নিয়ে ইসলামের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।

সন্দেহ নেই, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের অ-ধর্মীয় মনোভাব জোরালো হয়েছিল। ১৯৪৭-পরবর্তী ভারতে ধর্ম-বিযুক্ত সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ঘটুক— এমনটাই চেয়েছেন তিনি। মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার প্রসারের জন্যে রাহুল ছিলেন আমরণ সচেষ্ট। দর্শন ছাড়াও অন্যন্য স্বাদের লেখা দিয়ে পাঠকের মনে তিনি প্রগতিশীল ধ্যানধারণা চারিয়ে দেন। রাহুলের কাছে বিদ্যাচর্চা ছিল রাজনীতির অন্যতম ফ্রন্ট।

১৯৫০-এর দশকে রাহুলের হাত দিয়ে বেরোয় বেশ কয়েকটি জীবনী। তার মধ্যে ছিল আকবর (১৯৫৬)। আকবরের জন্মের (১৫৫৬) চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বইটি লেখেন তিনি। জীবনীর পরিবর্তে বইটিকে অবশ্য ইতিহাসচর্চার নমুনা বলেই দেখা উচিত। এর কারণ: সেটির সামগ্রিক পরিকল্পনা ও বিন্যাস। বইটির কেন্দ্রে আকবরের চিন্তা ও কাজ থাকলেও সেসবকে একটি বৃহৎ প্রেক্ষাপটে বিচার করেছেন রাহুল। তাই শুধু ইতিহাসচেতনাই নয়, লেখকের মনোজগতেরও হদিশ পাওয়া যায় আকবর-এ।

দেখার বিষয়, প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল— ইতিহাসে দুটি বিপরীতধর্মী সমান্তরাল ধারা লক্ষ করছেন রাহুল। এই দুই মনোভঙ্গির মধ্যে সঙ্ঘাত ঘটে সর্বদা; জয়-পরাজয়ের প্রক্রিয়া চলে নিরন্তর। তবে অতীতের প্রগতিশীল ঐতিহ্য শুধু শনাক্ত করেই থামেননি রাহুল; বর্তমানে সেটির বিস্তারও চেয়েছেন। বলা চলে, অতীতের বিষয়বস্তু নিয়ে লিখলেও বর্তমান পেরিয়ে ভবিষ্যতের দিকে ছিল আকবর-এর অভিমুখ। দেশি-বিদেশি তথ্যসূত্রের সাহায্য নিলেও[1] রাহুলের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই মৌলিক।

আকবরকে নিয়ে লেখার পেছনে কাজ করেছে আধুনিক ভারত সম্বন্ধে রাহুলের ভাবনা। ভারতে ইসলামি শাসন কায়েম হওয়ার পর থেকে সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে ধীরে ধীরে দুটি পরস্পর-বিরোধী ধারা গড়ে ওঠে; এমনকি, দুইয়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও দেখা দেয় মাঝেমধ্যে। এরই চূড়ান্ত পরিণাম ১৯৪৭-এর দেশভাগ। এর উল্টোদিকে অবশ্য শান্তি ও সমন্বয়ের চেষ্টাও চলেছে। আকবর ছিলেন সেই ধারার এক অতি উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। তাই আকবরের পথকে নিজের (আর সেইসঙ্গে সব প্রগতিশীল মানুষের) পথ হিসেবে চিহ্নিত করেন রাহুল। প্রাক্‌কথনে তিনি স্পষ্ট জানালেন:

আকবরের পথ আজ অনেক দূর অবধিই আমাদের পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকবর ষোড়শ শতাব্দীর নয়, বরং বিংশ শতাব্দীর আমাদের দেশের সংস্কৃতির পয়গম্বর। অথচ আজও তাঁকে বুঝবার মতো মানুষ আমাদের দেশে ক-জন আছেন? ক-জন এটা মেনে নিতে প্রস্তুত যে অশোক ও গান্ধির মাঝখানে তাঁদের সমকক্ষ আরও একজন পুরুষ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি আকবর?

আকবর-এর দুটি ভাগ— পূর্বার্ধ[2] আর উত্তরার্ধ[3]। ঘটনা হল, স্রেফ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্রভাবনার বেলাতেও আকবরের শাসনকালের আগে ভারতে সমন্বয়ের বৈশিষ্ট্য নজরে আসে। এ-ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন শেরশাহ। পনেরো শতকে জৌনপুরে যে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির নজির চালু হয়, তা তিনিই এগিয়ে নিয়ে যান। শেরশাহের শাসনব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতেন হিন্দুরা— হেমচন্দ্র (হেমু) ছিলেন তারমধ্যে অন্যতম। ১৫৪০-এ শেরশাহের কাছে হেরে সিন্ধুনদের ওপারে পালিয়ে যান হুমায়ূন। পাঁচ বছরেই শেরশাহের অধীনে এক বিরাট রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্প্রীতি আর সুখশান্তি বজায় ছিল সেখানে। ইসলাম শাহর শাসন সম্বন্ধেও মোটামুটি একই কথা খাটে। রাহুল অবশ্য শুধু অতীতের উদার ও প্রজাদরদি শাসকদের কথাই বলেননি। একইসঙ্গে তিনি উপস্থাপন করেছেন সৈয়দ মুহম্মদ জৌনপুরী, মিয়া আব্দুল্লা নিয়াজি আর শেখ আল্লাঈ-এর মতো আর্থিক সাম্যবাদী ঘরানার মুসলমান সন্তদের।

আকবরকে এই প্রগতিশীল ধারায় সামিল করেছেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। উল্লেখ করা দরকার, আকবরের মনোজগতের সন্ধান দিতে শুধু তাঁর কাজকর্মই নয়, একে-একে বাদশাহর সহযোগীদের কৃতিত্বর কথাও এসেছে। রাহুল বুঝেছিলেন, তৎকালীন প্রগতিশীল বাতাবরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণার জন্যে আকবরের দরবারের সদস্যদের অবদান নিয়ে জানাও অত্যন্ত জরুরি। সেইজন্যেই বীরবল (আসল নাম মহেশদাস), তানসেন (আসল নাম ত্রিলোচন পাণ্ডে), আবুল ফয়েজ ফৈজি, আবুল ফজল, টোডরমল, মানসিংহ প্রমুখদের নিয়ে বিশদে লিখেছেন তিনি। কীভাবে আকবর ও তাঁর সহযোগীরা তৎকালীন কট্টর মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়েন, সকলে মিলে এক উদার সংস্কৃতি কায়েম করেন আর সেইসঙ্গে ভারতে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হয়— তা-ই পাঠককে বারবার মনে করানো হয়েছে আকবর-এ। রাহুল নিজেই জানিয়েছেন, শেখ মুবারকের দুই পুত্র, ফৈজি আর ফজল বাদশাহর সভায় সামিল হওয়ার পর অবস্থা কতখানি পালটায়:

আকবর চাইতেন না যে তাঁর অগণিত প্রজার আশা-আকাঙ্ক্ষা ও তাদের কল্যাণের ভাবনাকে তাকে তুলে রাখবেন আর শরিয়তের জোয়ালের চাপে তারা নিষ্পেষিত হতে থাকবে ও আর্তনাদ করতে থাকবে এবং তিনি তা অবাধে চলতে দেবেন। তিনি জানতেন, বিদেশি তুর্কি অ-তুর্কি মুসলমানদের উপর নির্ভরশীল যে সিংহাসন, তা বস্তুত বালির উপর প্রতিষ্ঠিত অস্থায়ী। ভারতের আপামর হিন্দুর সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠলেই তা সুদৃঢ় হতে পারে। তিনি জানতেন, যদি সেই আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন, তাহলে তাঁর কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পাররে, এমন সাহস হবে না কারও। তখন গণতান্ত্রিক যুগ ছিল না যে ধর্মকে কুসংস্কার বলে গণতন্ত্রর নামে নিজস্ব মতামত মানুষকে স্বীকার করাতে সক্ষম হবেন। ইসলামি শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানের দৌলতে ফৈজি ও আবুল ফজল বাদশাহকে পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি ঘোষণা করে মোল্লাদের অস্ত্রশস্ত্র ভোঁতা করে দেন। তাহলে তো মোল্লাদের আর কোনও প্রয়োজন নেই। তাঁরা আক্ষেপ করতে করতে ভ্রাতৃদ্বয়কে চাটুকারদের চূড়ামণি আখ্যা দেন। বর্তমানেও বহু মুসলমানই এ কথা বলে থাকে, তবে, তাঁরা শুধু নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য চাটুকার ছিলেন না, বরং তাঁদের ছিল এক মহান স্বপ্ন— সমস্ত ভারত-সন্তানের মধ্যে খাঁটি সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা এবং তার দ্বারা দেশের শক্তি-সামর্থ্য সুদৃঢ় করা।[4]

মোল্লারা হল্লা শুরু করেন যে, ফৈজি আর ফজলের পাল্লায় পড়েই আকবর হয়ে উঠেছেন বিধর্মী— ইসলামের শত্রু। এঁদের প্রভাবেই ১৫৭৪-৭৫ (৯৮২ হিজরি)-এ ফতেহ্‌পুর সিক্রিতে ইবাদতখানা তৈরি করেন আকবর। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান আর পারসি শাস্ত্রজ্ঞরা ধর্ম নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় মাততেন। এর জেরেই পরে ১৫৮২-তে জন্ম নিল দীন-ইলাহি। তবে রাহুল বারবার এও বলেন: যে উদার সংস্কৃতির ধারা আকবর চালু করেছিলেন তা পরবর্তীকালে স্তিমিত হয়ে পড়ে। তাই ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা থেকেই যায়।

যদি আকবর ও আবুল ফজলের পতাকা সম্মুখে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আর দুই প্রজন্ম পাওয়া যেত, তাহলে ভারতে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা থাকত না, পাকিস্তানও তৈরি হত না।[5]

আগেই লিখেছি, আকবর নিতান্ত জীবনী অথবা ইতিহাসচর্চার নমুনা নয়, বরং রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখাজোখা যে কতখানি লক্ষ্যমুখী ছিল, এখানে সে-কথাই বেরিয়ে আসে। অতীতের পাঠ নিয়ে তিনি আদতে নিজের চারপাশটাই পাল্টাতে চাইছিলেন।

আকবরের ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয়ই ছিল রাহুলের কাছে প্রধান। সাংস্কৃতিক সমন্বয় যে ক্রমশ তাঁর শাসনের মূল উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে, তা জোর দিয়ে বারবার বলেন রাহুল।

আকবরের কৃতিত্ব শুধু সম্প্রীতি, ঐক্য আর একজাতীয়তার বাতাবরণ তৈরিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাশাপাশি তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা। বিভিন্ন রাজ্যকে নিজের অধীনে এনে তিনি শুধু সাম্রাজ্যবিস্তারই করেননি, প্রশাসনিক ও ভূমি-রাজস্ব বন্দোবস্তের দিক দিয়েও নিয়েছিলেন নানা উদ্ভাবনমূলক সিদ্ধান্ত, যার কিছু কিছু ইংরেজ আমলেও বহাল থাকে। সাম্রাজ্যবিস্তারে আকবরের প্রধান দুই সহায় ছিলেন টোডরমল আর মানসিংহ। অতীতে বেশিরভাগ সময়েই যে ধর্মের ভিত্তিতে যুদ্ধ বাধেনি, বরং লড়াইয়ের পেছনে ছিল নিছক ক্ষমতাদখলের বাসনা, তার খুব ভাল নমুনা হল আকবরের শাসনকাল। রাহুলের পর্যবেক্ষণ এখানেও যথার্থ:

বাংলায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য সমস্ত কাজের ভার শাহ মনসুরের উপর ছেড়ে দিয়ে টোডরমলকে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে বাংলা রওনা হতে হয়। আগে বাংলায় বিদ্রোহ করত পাঠানরা, কিন্তু তখন বাদশাহি অমাত্যরাই বিদ্রোহের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়েছিল। প্রশংসনীয় যেটা, তা হল, সকলেই তুর্কি ও মুঘল অর্থাৎ আকবরের রক্ত-সম্পর্কের। আকবর তিন পুরুষ থেকে দেখে আসছিলেন যে উদ্দেশ্য-চরিতার্থের ক্ষেত্রে রক্ত-সম্পর্কের কোনও মূল্য নেই এবং জাতভাই তুর্কি-মুঘলদের উপরেও বিশ্বাস রাখা যায় না। আর সেই কারণেই তো তিনি মানসিংহ ও টোডরমলকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। আকবর যদি হিন্দুদের কাছে টেনে না নিতেন, তাহলে তিনি এত সাফল্য লাভ করতে পারতেন না, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যাদের বাদশাহর আপনজন বলা হত, টোডরমলকে পাঠানো হল তাদের বিরুদ্ধে। তিনি আচারনিষ্ঠ হিন্দু, আর বিদ্রোহীরা সকলেই মুসলমান।[6]

অন্যদিকে, যথাক্রমে চিতৌড় অভিযান (১৫৬৭) আর হলদিঘাটির যুদ্ধে (১৫৭৬) রাজপুত শাসক রানা উদয়সিংহ আর তাঁর পুত্র রানা প্রতাপের বিরুদ্ধে আকবরের হয়ে লড়লেন সেনাপতি মানসিংহ।

বৈরাম খাঁর প্রভাব কাটিয়ে ওঠার পর ধীরে ধীরে সম্প্রীতির ধারণা দানা বেঁধেছিল আকবরের মনে। কিন্তু তাই বলে এমন ভাবা ভুল যে, ইসলাম ধর্মে তাঁর বিশ্বাস টলে গেছিল রাতারাতি। বলা চলে, শুরুতে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবেই হিন্দু প্রজাদের মন জয় করতে চেয়েছিলেন আকবর। ১৫৬৩-তে তিনি হিন্দুদের ওপর চাপানো তীর্থকর বন্ধ করেন। পরের বছর, ১৫৬৪-তে নেওয়া হল আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত— দীর্ঘদিন ধরে হিন্দুদের ওপর চালু জিজিয়া কর উঠে গেল (১৬৭৯-তে সেটি আবার ফিরিয়ে আনেন ঔরঙ্গজেব)। এর পাশাপাশি অবশ্য সুন্নি মুসলমান হিসেবে ধর্মাচরণ চালিয়ে যান আকবর। পির সেলিম চিশতির প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভক্তি। ইবাদতখানা তৈরির পরও ১৫৭৯ অব্দি আকবর আজমের জিয়ারত করে চলেন।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো, সিক্রিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করার পর যে ইমারতগুলি গড়ে ওঠে সেখানে ভারতীয় স্থাপত্যশিল্পের ছাপ পড়ল। এমনকি, ১৫৭২-এ সেলিম চিশতির মৃত্যুর পর যে-মাজারটি বানানো হল সেটির নির্মাণশৈলীও ইসলামি নয়, বরং হিন্দু। এর মানে: সাংস্কৃতিক সমন্বয় আকবরের কাছে তখন আর শাসনব্যবস্থার নিছক বাহ্যিক কৌশল ছিল না; সেটি তাঁর মনোজগতের গভীরে ঢুকেছে। ১৫৭১ থেকে ১৫৮২ অব্দি সিক্রিতে ছিলেন আকবর। সেখানকার ইবাদতখানায় বিশেষ করে ১৫৭৭-৭৮ থেকে বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতরা যেসব আলোচনা করেন তার অন্তিম প্রভাবে তিনি হয়ে পড়েন অ-মুসলিম। এর পাশাপাশি, কট্টর মোল্লাদের দুর্নীতি দেখেও ইসলাম সম্পর্কে আকবরের বিশ্বাসে চিড় ধরে। উল্টোদিকে, হিন্দুধর্ম অনুসারে তিনি পুজো শুরু করেন, এমনকি, গো-হত্যা বন্ধর আদেশ দেন। কিন্তু তা-ই বলে হিন্দুধর্মর প্রতি আকবরের অন্ধ ভালবাসা জন্মেছিল— এমন ভাবাও ঠিক নয়। মনে রাখা দরকার, সতীদাহের মতো ধর্মীয় কুপ্রথা রদ করেন তিনি। দাস-প্রথা নিয়েও তাঁর আপত্তি ছিল। নিজের দাসদের তিনি মুক্তি দেন। এছাড়া, খ্রিস্টান, জৈন ও পারসি ধর্মের নানা দিক নিয়েও আকবর ছিলেন খুবই উৎসাহী। এমনও রটে যে, তিনি সেইসব ধর্ম গ্রহণ করবেন। বাদশাহের পোশাকেও অন্যন্য ধর্মের নানা ছাপ চোখে পড়ত। রাহুল জানিয়েছেন,

বাদশাহ ও সভাসদেরা তুর্কি পোশাক— লম্বা চোগা, কোমরে কোমরবন্ধ— পরতেন, এবার থেকে তিনি ভারতের চৌবন্দী পরতে শুরু করলেন, চোগা ও পাগড়ি খুলে ফেলে গায়ের চড়ালেন জামা, মাথায় দিলেন ফাঁক-ফোকরওলা পাগড়ি। দাড়িকে তো জঞ্জাল বলা হল এবং তখ্‌তের বদলে সিংহাসনে বসতে লাগলেন। দরবারের সমস্ত সাজসজ্জা বদ্‌লে হিন্দু ঢঙে সাজানো হল। বাদশাহের দেখাদেখি আমিরেরাও তুরানী পোশাক ছেড়ে ভারতীয় পোশাক স্বীকার করে নিল।[7]

আকবরের সমন্বয়ের মনোভাব ছড়িয়েছিল আরও বড় এলাকায়। স্থাপত্যশিল্প, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের পাশাপাশি অক্ষরজ্ঞান না-থাকা সত্ত্বেও তিনি সাহিত্যের খুবই কদর করতেন। ফৈজি আর ফজল নিজেদের মৌলিক রচনাগুলির প্রেরণা পেয়েছিলেন তাঁর থেকে। এছাড়া, আকবরের উদ্যোগে রাজভাষা ফারসিতে বহু সংস্কৃত ও আরবি রচনার অনুবাদ হয়। দেখার ব্যাপার, নিজে কট্টর মুসলমান হলেও মোল্লা আব্দুল কাদির বদায়ুঁনি[8] সংস্কৃত সাহিত্য অনুবাদের কাজে লাগেন বাদশাহর নির্দেশে। ১৫৭৫ থেকে ১৫৮৮ অব্দি একে-একে অনূদিত হল সিংহাসন বত্তিসি, অথর্ববেদ, মহাভারত, রামায়ণ  আর রাজতরঙ্গিনী। এসব কাজে বদায়ুঁনি অবশ্যই সংস্কৃত পণ্ডিতদের সহায়তা পেয়েছিলেন।

আকবর চাইতেন, ভারতীয়দের মধ্যে একজাতীয়ভাব জন্ম নিক। তাঁর মতে, বিভিন্ন ধর্ম সেক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠছিল। সেইজন্যে সব ধর্ম থেকে কিছু-কিছু উপাদান নিয়ে ১৫৮২-তে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন এক নতুন রাজধর্ম— ‘দীন-ইলাহি’ (ভগবানের ধর্ম)। সেই ধর্ম ১৬০৫-এ আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে বিলুপ্ত হয়, যদিও তার অনুগামীর সংখ্যা ছিল লক্ষ লক্ষ।

আকবর কখনওই ধমর্হীন হননি। সম্রাট অশোকের মতো ধর্ম সম্বন্ধে উদার মনোভাব দেখান তিনি। ভারতের মতো দেশের শাসনব্যবস্থায় তা নিঃসন্দেহে অন্য মাত্রা যোগ করে। শরিয়ত নয়, জনগণের কল্যাণই ছিল তাঁর শাসনতন্ত্রের ভিত্তি। প্রশাসকের পক্ষে পুরোপুরি ধর্ম-বিরোধিতা সে-যুগে সম্ভবও ছিল না। সে যা-ই হোক, ঐতিহাসিক বিচারে কিন্তু আকবরকে প্রগতিশীল মানতেই হবে। অনেক দিক দিয়েই তিনি ছিলেন নিজের যুগের নিরিখে আগুয়ান। রাহুল সাংকৃত্যায়নের কাছে আকবরের সেই পরিচয়টিই প্রধান।

আকবর ও তাঁর আস্থাভাজন সহায়কদের জীবনী পাঠ করলে জানা যাবে, আকবর নিজের দেশ ও রাষ্ট্রের জন্য অনেক দূর পর্যন্ত চিন্তাভাবনা করতেন। তিনি তাঁর কাজকর্মের সুফলকে নিজের কালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইতেন না। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ভারতকে এক রাষ্ট্র এক জাতিতে পরিণত করার যে-প্রয়াস, সমস্ত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি যা করেছেন, তা নিরর্থক হয়ে যাবে না। নিরর্থক হয়ে গেছে— এ কথা আমরা বলতে পারিনে, যদিও আমাদের দেশ তা থেকে যতটা উপকার লাভ করতে পারত, ততটা উপকার গ্রহণ করতে সমর্থ হয়নি। যদি সমর্থ হত, তাহলে আমাদের তিনশত বিয়াল্লিশ বছরের কালরাত্রি অতিবাহিত করতে হত না, দেশ দ্বিখণ্ডিতও হত না। শুধু তাই নয়, এমনকি আমাদের দেশ পৃথিবীর এক মহান রাষ্ট্রে পরিণত হত। তাছাড়া সমগ্র এশিয়া ইউরোপীয়দের দাসত্ব করতে বাধ্য হত না, এশিয়ার সমুদ্রে জনশূন্য অথবা জনবসতিপূর্ণ দ্বীপগুলি ইউরোপীয়দের হাতে চলে যেত না।[9]

আধুনিক ভারতে রাহুল সাংকৃত্যায়নই প্রথম আকবরের কাজকর্মকে বিশদে জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সে-কাজে পরবর্তীকালে অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করেছেন।

 

রচনাপঞ্জি:

  1. সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আকবর। অনু. চৌধুরী, আশরফ। চিরায়ত প্রকাশন। ১৪২৪ ব.।
  2. সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। ইসলাম ধর্মের রূপরেখা। অনু. চট্টোপাধ্যায়, মলয়। চিরায়ত প্রকাশন, ১৪২৬ ব.।

[1] এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক শামশুল-উল্‌মা মওলানা আজাদ আর ভিনসেন্ট স্মিথ, যাঁদের বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
[2] এখানে জায়গা পেয়েছে আকবরের সহযোগী ও বিরোধী।
[3] এই অর্ধের বিষয়বস্তু আকবরের চিন্তা ও কাজ।
[4] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আকবর। পৃ. ৯৪-৯৫।
[5] পূর্বোক্ত, পৃ. ১১০।
[6] পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪৪-৪৫।
[7] পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪৫।
[8] ধর্মান্ধ ও নৃশংস সেনাপতি হুসেন খাঁ টুকড়িয়ার শিষ্য।
[9] সাংকৃত্যায়ন, রাহুল। আকবর। পৃ. ৩১৩।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...