সাত্যকি হালদার
সেটা ছিল আমার প্রথমবার যাওয়া। ছাত্রজীবনে। হস্টেল থেকে বেরিয়ে হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেন ধরে বর্ধমান। সেখান থেকে আমোদপুর যাওয়ার লোকাল ট্রেনে বোলপুর। একাই চলে গেছি সেবার।
তখন উঠেছিলাম মেলার মাঠের কোণার ডানদিকে বড় গেস্টহাউসের ডর্মিটরিতে। সে-কালে আগেভাগে বুকিংয়ের তত ঝামেলা ছিল না। পাশের পিআরও অফিসে গিয়ে কথা বললেই ডর্মিটরির হলে একটা সাধারণ বেডিং পাতা কাঠের খাটিয়া পাওয়া যেত। খুবই সহজ ও সাধারণ ব্যবস্থা। খাওয়াদাওয়াও সেখানে।
তখন শান্তিনিকেতনে অনেক টোটো এবং অনেক গাড়ির যুগ আসেনি। যানবাহন বলতে একমাত্র পায়ে চালানো রিকশা। বোলপুর স্টেশন থেকে গেস্টহাউস অনেকটা দূর। ফলে রিকশা নিতে হয়েছিল। সেই রিকশাই আমাকে চিনিয়ে পিআরও অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে কাজ মিটলে নামিয়ে দিয়েছিল গেস্টহাউসের সামনে। ভাড়া মেটানোর সময় রিকশাওয়ালা বলল, আপনি মনে হয় প্রথমবার আমাদের এখানে এলেন।
খেয়াল করে দেখলাম মাঝারি বয়সের রোগা একটি মানুষ। পরনে নড়বড়ে একটি ফুলপ্যান্ট, কোঁচকানো ঢিলেঢালা জামা। বলল, শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখবেন তো! আমারে তবে বলতে পারেন। আজকে বিকেল হয়ে গেছে। আশ্রমের দিকটা বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি বললে কাল সকালে রিকশা নিয়ে আসি।
আমি খুচরো গুণে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে। এই তো এলাম। কাল দেখার কথা ভাবব। তা ছাড়া পায়ে হেঁটেও তো শুনেছি অনেক কিছু দেখে নেওয়া যায়।
ডর্মিটরির মস্ত হলটায় আমাকে নিয়ে বোর্ডার সেদিন তিনজন। দু-পাশের সার সার খাটিয়ায় বেডিং গুটিয়ে রাখা। যে কোনও একটি খাটিয়ায় বেডিং টান করে নিয়ে নিজস্ব বিছানার চাদরটি পেতে নিলেই নিজের জায়গাটি হয়ে যায়। নিজস্ব ছোট ব্যাগ মাথার পাশে বিছানার ওপর। আমি অন্য দুজনের থেকে দূরেই বিছানা পাতলাম। সন্ধেবেলাটা কাটল সামনের রাস্তায় পায়চারি করে। সেটি সম্ভবত ছিল মার্চ-এপ্রিল মাস। রাতে শোয়ার সময় বাইরে বৃষ্টি হল খানিকটা। বাইরের বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দ শুনে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে যেতে যেতে ভাবলাম অকালবৃষ্টি চলতে থাকলে পর দিনের বেড়ানোটা মাটি না হয়ে যায়।
যদিও পরদিনের সকালটি বেশ ঝকঝকে। রাতের ঝড়ে ছোট ছোট পাতাসমেত ডাল ছড়িয়ে ছিল চারদিকে। শুকিয়ে যাওয়া জলের দাগ গেস্টহাউসের মোরামের রাস্তায়। আমি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে আবারও পায়চারি করছিলাম। সকাল আটটা-সাড়ে আটটা হবে। কীভাবে দিনের পরিকল্পনা করব ভাবছি। তখন হঠাৎই সামনের রাস্তা থেকে ডাক। বাবু…
মুখ তুলে দেখি আগের দিনের লোকটি। রিকশা নিয়ে হাজির। একইরকম পোশাক। তবে চুল আঁচড়ে সেদিন যেন একটু পরিপাটি। আমাকে দেখে বলল, বেরাবেন কখন? ছয়টা বাজতেই আপনার জন্য এইখানে রিকশা লাগায় দিছি।
ভোর ছটা না বাজতে রিকশা! তা ছাড়া ওর রিকশাতেই যে শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখতে হবে এতটা সে ধরে নিলই বা কেন। আগের দিন আমি তো তাকে নিশ্চিত করে কিছু বলিনি।
আমার দ্বিধা সম্ভবত আঁচ করতে পারল সে। এগিয়ে এসে বলল, আপনি জলখাবার খেয়ে রেডি হয়ে নেন। দশটায় আশ্রমের উত্তরদিকের গেট খুলে দেবে। আপনাকে ঘুরায় সব দেখাব।
আমি বললাম, এখান থেকে শুনলাম আশ্রম এলাকা পায়ে হাঁটা পথ। ঘুরে ঘুরেই সব দেখে নেওয়া যায়।
ম্লান হাসল লোকটি। বলল, সে আপনি ঘুরেও দেখে নিতে পারেন। কিন্তু আপনি তো সব চিনবেন না। রবি ঠাকুর কোথায় কোনটি লিখেছেন তাও জানবেন না। তা ছাড়া কোপাই-র দিকটা দেখবেন তো!
বেশ গায়ে পড়া মানুষ। আসার পথে আমার দু-একটা প্রশ্নেই আঁচ করে ফেলেছে আমি নতুন আসা। আমাকে এদিক-ওদিক দেখানো মানে ওর জন্য দিনের বড় একটি ভাড়াও। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি থাকলে আমার দেখার সুবিধার চাইতে অসুবিধা বেশি হবে না তো! তবে কোপাইয়ের দিকটা যা শুনেছি বেশ খানিকটা দূরও।
বললাম, কতক্ষণ লাগবে, আর কত দিতে হবে তোমাকে?
লোকটি আবারও হাসল। খানিকটা লাজুক হাসি। মাথার চুলে হাত দিয়ে বলল, ভাড়া আপনার যা মনে হয় সেটিই দিবেন। তবে টাইম ধরেন সব মিলে তিন-চার ঘন্টা। আপনি রেডি হয়ে আসেন, মাঝখানে অসুবিধা লাগলে আমাকে নয় ছেড়ে দিবেন।
শেষের প্রস্তাবটুকু শুনে অতঃপর রাজি হয়ে গেলাম। আধঘন্টার মধ্যে প্রস্তুত হয়ে এসে চড়ে বসলাম রিকশাটিতে। শান্তিনিকেতন দেখা শুরু হল আমার।
দেখার জন্য আমার পূর্বপ্রস্তুতি কিছুটা ছিল। উত্তরায়ণ দক্ষিণায়ণের কথা জানি। উত্তরায়ণের ভেতরে মিউজিয়াম আর রবীন্দ্র বাসভবনগুলির কথাও জানা। দক্ষিণায়ণের আশ্রম-বিদ্যালয় চত্বরে ভাস্কর্যের কাজগুলোও দেখে নিতে হবে। কোপাই যেতে পারলে ভালই লাগবে, তবে সে-ক্ষেত্রে রিকশাই ভরসা।
আমি উঠে বসতে প্যাডেলে চাপ দিয়ে চালাতে শুরু করে সে। সামান্য এগিয়ে বলে, মেলার মাঠ যেইটা বাঁদিকে দেখেন সেইটা এখন শুধুই একটা মাঠ। ছেলেমেয়ারা গায়ে গা ঠেকায়া আড্ডা দেয় সন্ধ্যার পর। তবে পৌষের শেষে যদি আসেন তো পা ফেলার জায়গাটিও পাবেন নাই। সবই আপনাদের কলকাতার লোক।
আমি কিছু বলি না। লোকটি তারপরেই বলে, ডানদিকের বড় বাড়িখান লাইব্রেরি। এটি নিয়ে বলার কিছু নাই। রবি ঠাকুর মারা যাওয়ার পরে শান্তিনিকেতনের লোকেরা এইটি বানাইছে। যারা এইখানে আসে তাদের মুখে শুনাছি ভিতরে ভরা বই, তবে পড়ার লোক কম। আপনি শুধু বাইরে থেকে দেখে নেন।
রানিং কমেন্ট্রি যাকে বলে। পথে নেমেই শান্তিনিকেতন নিয়ে ধারাবিবরণী শুরু। কিন্তু এই বিশদ বিবরণে আমার কী দরকার! কতক্ষণই বা সহ্য করা যাবে!
কথা পাল্টে দেওয়ার জন্য বললাম, তুমি কি এদিকেরই লোক! তোমার নামটি তো জানা হয়ে ওঠেনি।
লোকটির গলায় উৎসাহ। প্যাডেলের চাপ যেন একটু দ্রুত হল। বলল, আজ্ঞাঁ আমি মানিক। মানিক কাহার। শুনাছি আমার বাপের বাপেরও যিনি বাপ, তিনি দেবেন ঠাকুরের পালকি নিজের কান্ধে টানতেন। ঠাকুরবংশের সাথে মোদের বংশের সেইদিকে সরাসরি যোগ। তবে এইসব কথা এখন আর কাউরে বলি না।
লাইব্রেরি ছাড়িয়ে সামনের রাস্তায় ডাইনে ঘুরে যায় রিকশা। রাস্তার ধারে দু-একটি অস্থায়ী দোকান। লোকটি বলে, এইবার বাঁহাতে শুরু হয়া গেল আশ্রমের এলাকা। কাঁটাতারের ওইপাশে ঢিবিমতন যে জায়গাটার উপর বড় গাছটা দাঁড়ায় আছে ওইখানে বসে রবি ঠাকুরের ওই পদ্য লেখা। কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি… আপনি পড়েছেন তো নিশ্চয়ই।
খানিক এগিয়ে মানিক কাহারের রিকশা আবার বাঁয়ের পথ ধরে। উল্টোদিকে রাস্তার ওপর শান্তিনিকেতনের পোস্টঅফিস। রিকশা বাঁয়ের পথে খানিকটা এগিয়ে উত্তরায়ণের গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রিকশাওয়ালা সিট থেকে নেমে বলে, এই হচ্ছে আসল জায়গা। রবি ঠাকুরের যখন পদ্য লেখার কথা মনে হত তখন কলকাতা ছেড়ে সোজা এইখানে আসতেন। এর ভিতরে পাশাপাশি সব বাড়ি। একেকটা বাড়িতে একেকটা পদ্যবই লেখা। বাড়ির নাম দেখলেই আপনি সব বুঝা যাবেন।
মানিক কাহারের রিকশার সেই যুগে উত্তরায়ণের গেটে টিকিট বা পাহারাদারি শুরু হয়নি। সবারই অবাধ যাতায়াত ভেতরে। মানিক রিকশা একপাশে রেখে বলে, চলেন আপনার সঙ্গে ঢুকি। বাইরে থেকে আপনারে ওনার ঘরগুলা দেখাই। ওনার যখন বউ মারা গেল তখন তিনি রাতে একা একা এইখানের মোরামের পথে হাঁটতেন।
ভেতরে পুনশ্চ উদীচি দেখা হল। মাটির বাড়ি পুনশ্চর সামনে তখনও চাঁপাফুলের গাছটি ছিল। সেসব জায়গায় আমার পাশে পাশে মানিক কাহার। রবীন্দ্রনাথের বাড়িগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে যখন দেখছি তখন অবশ্য সে একেবারেই চুপ। যেন আমার দেখার নীরবতা থেকে একটু আলগা থাকতে চায়। পরেই অবশ্য কাচে ঘেরা একটি ঘরে পুরানো মডেলের বড়সড় মোটরগাড়িটি দেখিয়ে বলল, এই হচ্ছে ওনার গাড়ি। হাম্বার কোম্পানি। এই গাড়ি শুনেছি উনি নিজে চালাতেন। নোবেল পুরস্কার আনতে যাওয়ার সময় আমাদের এই বোলপুর থেকে একাই গাড়ি চালায় চলে গেলেন সোজা বিলাত।
মানিক কাহারকে সংশোধন করি না। করার মানেও হয় না কোনও। সে বলে যায়, রবি ঠাকুর মারা যাওয়ার পর শান্তিনিকেতনের ভিতর গাড়িখান দু-একবার চালানোর চেষ্টা করেছিল এইখানের বড়কর্তারা। সাহেবদেরও ডেকে আনা হয়েছিল। কেউ পারে নাই। উনার মতো পদ্য কেউ যেমন আর লিখতে পারবে নাই তেমনি উনার গাড়িটিও উআদের পক্ষে চালানো অসম্ভব।
মানিকের সঙ্গে উত্তরায়ণ দেখা শেষ হয়। রবীন্দ্রভবনের মিউজিয়ামটিতে অবশ্য সে ঢোকেনি। বিচিত্রা বাড়ির গেটের মুখে আমাকে ছেড়ে সে রিকশার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করে। যাওয়ার আগে বলে যায়, ভাল করে দেইখবেন বাবু। শুনাছি নিচে-নিচে সব লিখা আছে। রবি ঠাকুরের কলমগুলা আর জুতার পাটি অবশ্যই দেইখবেন।
তবে দক্ষিণদিকের চত্বরে এসে মানিক কাহারের গল্প একেবারেই আলাদা। সেই যেখানে ছাতিমতলা এবং ঘেরা জায়গাটুকুতে তিনি আমার প্রাণের আরাম ইত্যাদি লেখা সেখানে সে কথা বলে নিচু গলায়। আশেপাশে আর কেউ নেই, শুধু সে আর আমি, সেখানে যেন সে গোপন বিস্ময়ের কিছু শোনায়। বলে, সুরুল থেকে জমিদারি দেখে ফেরার পথে আমার ঠাকুর্দার বাপের পালকি থেকে নেমে দেবেন ঠাকুর এই জায়গাখান খুঁজা পান। ওনার ভিতরটা কেমন হয়া যায় সেদিন। মনে শান্তি পেয়ে জায়গার নাম দেন শান্তিনিকেতন।
এরকম ঘটনার কাছাকাছি কিছু কাহিনি বইয়ে পড়ে জানা। ফলে একটু অবাকই হই রোগাটে রিকশাওয়ালার কথায়। ওকে বলি, এত সব তোমার জানা হল কীভাবে?
মানিক একইরকম গোপন গলায় বলে, এ তো আমাদের ঘরের কথা। জানব না ক্যানে! এ আমার ঠাকুর্দা শুনেছে, আমার বাপ শুনেছে, পরে বাপ আমাকেও জানায় দিয়া গেছে। আরও শুনাছি এই ছাতিমতলায় ধ্যানে বসার পর দেবেন ঠাকুর আর সংসার বা জমিদারি দেখেন নাই। আর কিছুতে মন লাগে নাই তার। পরে সাধু হয়ে চলে গেলেন হিমালয়।
সামান্য কিছু সত্য আর অজস্র গল্প আর গুজবে তৈরি মানিক কাহারের শান্তিনিকেতন-পরিচিতি। আমার মন্দ লাগে না। নিজে যতটুকু জেনে এসেছি তা ধরে আমার দেখা তো চলেই, সঙ্গে এমন একজন কথক রিকশাওয়ালা যে অন্তত ঠিকঠিক জায়গায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। সামান্য হেঁটে গেলে একই জায়গায় যেখানে কাছাকাছি রামকিঙ্করের বিখ্যাত সব ভাস্কর্য সেখানে নিয়ে এসে বলে, এইগুলা আপনি দেখেন। ভাল করে দেখেন। আমি এগুলার কিছু বুঝি না, খাপছাড়া লাগে। তবে এইগুলা যিনি বানাইছেন সেই মানুষটাও শান্তিনিকেতনে খাপছাড়া।
কালের বাঁশি ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে মানিককে বলি, কেন তিনি খাপছাড়া কেন?
মানিক কাহার বলে, আশ্রমের ভিতর তার বানানো এত মূর্তি, তার সঙ্গে দেখা করতে বাইরের দেশের মানুষ আসে, কিন্তু তিনি আশ্রমের কোয়াটারঘর ছেড়ে পাশের গাঁয়ে গিয়া থাকেন। তার ঘরের মেয়াছেলাটিও গাঁয়েরই একটা বিটিবউ।
ছাতিমতলা কলাভবন চত্বর দেখা শেষ করে বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানিকের সঙ্গে চা খাই। মানিক বলে, আশ্রম দেখা মোটামুটি শেষ। আপনি চাইলে এবার কোপাইয়ের দিকে যাই। আপনার থাকার জায়গা থেকে পিছনের পথে নদী খুব দূরে নয়।
আবার গেস্টহাউসের কাছে ফেরা। প্রায় পাশ দিয়েই পিছন বরাবর টানা রাস্তা। পথ যে স্বল্পব্যবহৃত তা বোঝা যায় চেপে থাকা গাছপালা দেখে। শেষের দিকে পথের দুপাশ জুড়ে শালবাগান। অনেক দূরের কোনওদিক থেকে ট্রেনের হুইসেল আর ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়ার হালকা শব্দ পাওয়া গেল। তারপর শালবন আর গাছপালা যেখানে শেষ সেখান থেকে লালমাটির ধু ধু চত্বর। মাঝেমাঝে সামান্য ঝোপঝাড়। খোলা লালমাটির প্রান্তর ঢালু হয়ে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে।
এইখানে রিকশা থেকে নেমে পড়ে মানিক কাহার। আমাকে সিটে বসিয়েই রিকশাটি টানতে শুরু করে। আমিও নির্দিষ্ট পথ নেই দেখে নেমে পড়তে চাইছিলাম। কিন্তু প্রান্তরের রোদের জন্য আমাকে ও নামতে দেয় না। রিকশা টেনে টেনে সোজা হাজির করে বালুময় এক সরু নদীর সামনে।
দূর থেকে বাঁক নিয়ে আসা নদী আমাদের সামনে হয়ে বাঁদিকে আবার বেঁকে মিলিয়ে গেছে। মানিক বলে, নামেন বাবু। শান্তিনিকেতনে এসে এই জায়গাটায় কেউ আসতে চায় না। আমি অনেককে বলি, কিন্তু সবাই ভাবে মাঠের ভিতর আশ্রম নাই রবি ঠাকুরের কিছু নাই, অত দূর যাব ক্যানে!
আমি চারপাশে তাকিয়ে বলি, আমার না হয় হাতে আজ সারা দিন, কিন্তু যারা কাজের মানুষ, তাড়াতাড়ি আরও কিছু দেখতে চায়, তারা আসবে কেন এখানে!
মানিক সকালের মতো চুলে হাত বুলিয়ে বলে, না এলে তারা তো জানতেই পারল না কোথায় এসে রবি ঠাকুর ওই কবিতাখান খুঁজে পেলেন। ওই যে, আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে…
—তুমি জানো সেই কবিতা?
মানিক কাহার চুলে হাত রেখে লজ্জিত হাসে। জানি বাবু ওই এক লাইন। আমার ছেলাটা যখন নিচু কেলাসের বইতে পড়ত তখন সন্ধ্যাবেলা রিকশা চালায় ফিরে একেক দিন শুইনতাম। শুইনতাম আর ভাইবতাম নদীটার কথা। নদীর পাড়ে দাঁড়ানো বউ মরে যাওয়া, ছেলা মরে যাওয়া একা মানুষটার কথা। … আমি ভাবি বাবু, সেই মানুষটা যদি হঠাৎ একদিন ফিরা আসে তো এই শান্তিনিকেতন কি চেনা লাগবে তার! এত ঘরবাড়ি, এত ব্যস্ত মানুষ, হয়তো তার দিকে কারু তাকানোর সময় নাই।
মানিক কাহার আমাকে বলে ঠিকই কিন্তু মনে হয় হাঁটুজলের কোপাইর ধারে এসে তাকে কথায় পেয়েছে। যেন নিজের সঙ্গেই তার কথা। সে বলে, কিন্তু এই নদীর ধারে এলেই ওনার মনে পড়ে যাবে সব। মনে পড়বে জোছনা রাত, কাশবন, বোলপুরের হাটফেরতা মানুষ আন্ধার-আলোয় গরুর গাড়ি নিয়ে বালি আর জল পার হয়ে দূরের গাঁয়ে ফিরছে। … আর রাতে আশ্রমে নিজের ছোট ঘরটিতে ফিরে তিনি লন্ঠন জ্বালায়ে কবিতার খাতা খুলে বসবেন। চারপাশে সবাই যখন ঘুমে তিনি একা বসে লিখবেন। জোছনার কথা, নদীর কথা, নদীর সঙ্গে আর কখনও দেখা না-হওয়ার কথা…
আমার মনে হয় লোকটিকে ফেরানো দরকার। তাছাড়া সময়ও অনেকখানি চলে গেছে। যদিও আমার আর কোনও গন্তব্য নেই তবু তাকে বলি, আজ না হয় ফেরা যাক, পরে কখনও এলে এই রিকশাতেই না হয় আর একবার আসা যাবে। তখন তোমার কথা শুনব আবার।
লোকটি আবার সেই লাজুক হাসিটি হাসে। মাথার চুলে হাত দেয়। বলে, নেন, আপনি উঠে পড়েন বাবু। আমার আর কোনও কথা নাই। আমি উনার লেখা এক লাইনও জীবনে পড়ি নাই। আমার আর কোনও কথা থাকবে ক্যানে?