কৌশিক দত্ত
রোগা হয়ে যাবার কারণ আমি কাউকে বলিনি, চৈতালিকেও না। সকলে বুঝতে পারছে না, কারণ ওজন কমেনি, ঢিলে হয়নি পোষাক। আয়নাতেও স্বাভাবিক দেখায়, অথচ আমি টের পাই, আয়না মিথ্যেবাদী, আমার ক্রমশ রোগা হওয়া সে লুকোচ্ছে আমার কাছেও। অথবা আমিই লুকোচ্ছি তার কাছে। অবয়ব সম্বল করে সুস্থ মানুষের অভিনয় করে চলেছি, যেমন সবাই করে। এভাবেই মানুষ বেঁচে থাকে, চাকা গড়ায় সংসারের।
নীলরতন হাসপাতালের সামনে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সান্ধ্য সিগারেট ঠোঁটে… ভেতরে বাইরে ধোঁয়া… দেখি, মানুষ! অজস্র! বাসের পেটে বোঝাই, চলেছে। ক্লান্ত যন্ত্রের মতো হেঁটে আসছে ভাঙা দিনের বিকট আওয়াজ পেরিয়ে কাতারে কাতারে শিয়ালদামুখো। ট্রেন ছুটবে কৃষ্ণনগর, গেদে, লালগোলা। কোথায় যেন ফিরবে সবাই! যেন সবারই একটা ফেরার কোটর আছে! যেন একবার সেখানে পৌঁছতে পারলেই এই বাজার-কাছারি, যুযুধান বনগাঁ লোকাল, কোলে মার্কেটের গন্ধ, সব মুছে যাবে! সেখানে ফিরতে পারলেই উর্দি খুলে ফেলা চলে, “মিস্টার অমুক” অফিস ব্যাগে গচ্ছিত রেখে ফিরে পাওয়া যায় ডাকনাম! যেন ফিরে পাওয়া যাবে ঢাল নামিয়ে রাখার, ভুল করে ফেলার অধিকার। রোগা হয়ে যেতে থাকা আস্ত শহরটাও যেন সেরে উঠবে! তাহলে ফেরাই ভালো, ভাবি।
ফেরার পথে ট্রেনেই শুনতে পেলাম খবরটা। চারজনেরই ফাঁসির সাজা বজায় রেখেছে সুপ্রিম কোর্ট। খুশি উপচে পড়ছে ঘামের গন্ধ ছাপিয়ে। যাক, এতদিনে মেয়েটার আত্মা শান্তি পাবে, তার ফেলে যাওয়া বিক্ষত শরীর সুবিচার পেয়েছে জেনে।
“এবার ধর্ষকেরা ভয় পাবে, নিরাপদে রাস্তায় বেরোতে পারবে আমাদের মেয়েরা,” নীল হাফ শার্টের কলারের উপর গ্রীবা উঁচু করে দৃপ্ত গোঁফে বিশ্বাস এঁকে বলছিল প্রবালদা। ট্রেনতুতো দাদা। সৃষ্টিশীল খিস্তি, আদিরসাত্মক চুটকি আর হট টপিকে চটপট ভাষণের জন্য শিয়ালদা-নৈহাটি লাইনের ডেইলি প্যাসেঞ্জার মহলে বিখ্যাত। রঞ্জিতের অভিমত, লোকগুলোকে রামলীলা ময়দানে জ্যান্ত রাবণপোড়া করা উচিত। শ্যামনগরের অনিতা আমাদের কম্পার্টমেন্টেই যায়; বলে, “তার আগে ডান্ডা ঢুকিয়ে ওদের নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে আনা উচিত।”
অনিতা কথা বললে অনিন্দ্যকে কিছু বলতেই হয়, এটা তার রিফ্লেক্স। জগদ্দলে বাড়ি, অতএব ভৌগোলিক নৈকট্যের একটা সহজ অধিকার তার আছেই। বয়সও কাছাকাছি এবং দুজনেরই ভবিষ্যৎ পড়ে আছে, তাই এই প্রতিবর্ত প্রতিক্রিয়া সহজবোধ্য।
“এভাবে হবে না,” সে উল্টো সুর গাইতে চেষ্টা করে। “ধর্ষণের ফ্যান্টাসি তো সমাজের মনে। এত রেপ জোকস, প্রতিটা গালাগালিতে মা-বোন তুলে ধর্ষণের হুমকি। ক্রিস গেইল বেধরক পেটালেও বলবে রেপ করে দিল! ধর্ষণ তো আমোদ আমাদের।” রেপ-কালচার সম্বন্ধে এই ভাষণটা ও আগেও দিয়েছে। আজ ভয়ানক আওয়াজ খেয়ে থামতে বাধ্য হয়। গোড়ায় প্রতিরোধের চেষ্টা করছিল, কিন্তু অনিতাও মুখ বেঁকিয়ে “যত্তোসব আঁতলামি” বলে তার মেরুদণ্ডটাই দুমড়ে দিল। সোদপুর এসে গেল, কামড়া খালি হতে শুরু করেছে। নৈহাটি লোকালের পেটের ভিতর পরাস্ত অনিন্দ্যকে তীব্র হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের প্রদাহে ফেলে গুটিগুটি এগোই দরজার দিকে। খড়দায় নামব।
বাড়ি ফিরে দেখি জয়ন্ত এসেছে। আরেকজন বিদগ্ধ বক্তা। এরই মধ্যে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে তর্ক জুড়ে দিয়েছে চৈতালির সঙ্গে। কিছুটা আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করি, চৈতালি মৃত্যুদণ্ডে খুশি নয়। এ নিয়ে আগে কথা হয়নি ওর সাথে, খুবই কম কথা হয় আজকাল, কিন্তু দিল্লী বা কামদুনির ঘটনার পর এমনভাবে ক্রোধ প্রকাশ করেছিল যে আমি নিশ্চিত ছিলাম, বহুদিন পর আজ ওকে খুশি দেখব।
“এইসব জানোয়ারদের মানবাধিকার নিয়ে ভাবছেন বৌদি, অথচ একজন মেয়ে হয়ে একটা মেয়ের যন্ত্রণা ভুলে যাচ্ছেন?” জয়ন্তর প্রশ্ন আমার যুক্তিসঙ্গত লাগে।
“মৃত্যুদণ্ড সমর্থন অনেকেই করে না, কিন্তু বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধে ফাঁসি তো দিতেই হবে,” ভাববাচ্যে যোগ করি আমি।
“ভুলে যাচ্ছি? আপনার মনে হল?” আমার কথাটা আদৌ শুনতে না পাওয়ার ভান করে জয়ন্তকে বলে চৈতালি, “বরং আপনারাই ভুলে যাচ্ছেন। গত চার বছরে দেশে কতগুলো ধর্ষণ হয়েছে, কটা মেয়েকে ভোগ করার পর খুন করা হয়েছে, কজনের যোনিতে পাথর ঢোকানো হয়েছে, তার হিসেব রাখেন? তার পরেও বলবেন এটা বিরলের মধ্যে বিরলতম?” আমার কথাটা শুনতে পেয়েছিল তাহলে!
“সেইজন্যেই তো এই শাস্তি দরকার বৌদি। এবার ধর্ষকেরা ভয় পাবে, মেয়েরা নিরাপদ বোধ করবে।” জয়ন্তর গলায় প্রবালদার সেই প্রত্যয় শুনতে পাই। জয়ন্তর গোঁফ নেই, পাঞ্জাবি পরেছে, তার কলার পাতলা এবং বাদামি রঙের, কিন্তু তার গ্রীবা টানটান হয়ে ওঠে প্রবালদার মতোই।
“বটেই তো! মাত্র চারটে লোককে ফাঁসি দিলে তো দেশে আর পুরুষ থাকবে না, তাদের নোলা থাকবে না! মেয়েরা ছু-মন্তরে নিরাপদ হয়ে যাবে। এমনকি বাড়িতে কাজ করতে আসা মেয়েগুলোও, তাই না? কাকা-দাদাদের থেকেও বাচ্চা মেয়েদের আর ভয় নেই কাল থেকে! এমনকি বেডরুমেও বিবাহিতা মেয়েরা এবার নিরাপদ, বলুন? এমনকি বেডরুমেও? বলুন, বলুন!”
কথার প্রথমার্ধে চৈতালি চেয়ে থাকে সরাসরি জয়ন্তর চোখের দিকে। শেষে “এমনকি বেডরুমেও” দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করার মুহূর্তে, আজ রাতে এই প্রথম, সে তাকায় আমার দিকে। আমি তার চোখের ভেতর দেখতে পাই আমার ছায়া পড়েছে টিউব লাইটের আলোয়। ময়লা হয়ে গেছে গায়ের অফ-হোয়াইট জামাটা, আর হাড় হিম করা রুগ্ন দেখাচ্ছে জামার ভেতর শরীরটাকে। মনে পড়ে গেল, আমি রোগা হয়ে যাচ্ছি। আয়না মিথ্যে কথা বলে, দৈবাৎ চৈতালি আমার দিকে তাকালে আমি সত্যিটা জানতে পারি।
জয়ন্তও যেন কী একটা দেখতে পেয়েছে। শেষ চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে, “আজ একটু কাজ আছে, উঠি,” বলে উঠে দাঁড়ায়। ম্যারিটাল রেপ বা খুচরো অভব্যতা যে এসব অপরাধের সঙ্গে আদৌ তুলনীয় নয়, সেই যুক্তি, যা আমি প্রাণপণে চাইছিলাম তার কাছে এই মুহূর্তে, তার ধারেকাছে যায় না সে। জয়ন্তও কি তবে রোগা হয়ে যাচ্ছে? ওর ঘরে কি সৎ আয়না আছে? নাকি জয়ন্ত জানে যে চৈতালি জানে মিনুর কথা?
চৈতালি এমন করে কথা বলত না আগে। বিয়ের সময় সে ছিল আদর্শ সুশীল। মসৃণ দাম্পত্যজীবনের প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন “ওয়াইফ মেটেরিয়াল” আর উপযুক্ত পরিমাণে রবীন্দ্রসঙ্গীতের কম্বো-প্যাক, তার ওপর সদবংশজাত এবং ইংরেজিতে এম এ! মা বড় পছন্দ করেছিলেন।
খুশি তো আমিও ছিলাম! খুশি এবং সুখী। শরীর এবং অহং, দুটোই বেশ যত্ন পাচ্ছিল। চেহারার জেল্লা আর কনফিডেন্স, দুটোই বাড়ছিল বিয়ের পর। অফিসে সেটা চোখ এড়ায়নি কারও। মৃদু হেসে আমি তাদের হিংসেটা নিতাম, কারণ পড়শির ঈর্ষা ছাড়া “ওনারস প্রাইড” পূর্ণতা পায় না।
অশান্তি সব সংসারেই হয়, কিন্তু শান্তি ফেরত আসার সহজ টোটকা হল স্ত্রীর মেনে নেওয়া, যে দোষটা আসলে তার। চৈতালি সেটা খুব তাড়াতাড়ি মেনে নিত। মাতৃহীনা এবং অন্তর্মুখী বলে আমাদের পরিবারের বাইরে বস্তুত কোনও সাপোর্ট সিস্টেম ছিল না ওর। তার প্রয়োজনও কি ছিল আদৌ? আমি কি যথেষ্ট খেয়াল রাখিনি ওর? গান শেখার ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলাম, টানতে পারেনি সে নিজেই। পাড়ার অনুষ্ঠানে, আমাদের অফিসের সোশ্যালে আমিই জোর করে গাইয়েছি ওকে। প্রশংসা পেলে আমার প্রতি কিছুটা কৃতজ্ঞ থাকত, সেটা বেশ উপভোগ করতাম।
“মফস্বলের মেয়েই ভালো, জানিস তো?” সম্বিৎদা বলেছিল, “সংসার চালানোর জন্য একটা ট্র্যাডিশনাল ভ্যালু-সিস্টেম দরকার, সে যতই আমরা আধুনিকতার বুলি কপচাই না কেন।” সম্বিৎদা তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। ওর বউ যখন ওর প্রেমিকা এবং যাদবপুরের ক্লাসমেট, আর আমি ক্লাস ইলেভেন, তখন থেকে ওদের চিনি। ওদের সংসারে কোনও অশান্তি দেখিনি, তবু ওর কষ্টটা বুঝতে পারি। চৈতালির জীবনে আমি একচ্ছত্র হতে পেরেছি, সম্বিৎদা পারেনি ঝুমাদিকে সেভাবে দখল করতে। এটুকু পারা আর না পারার মধ্যে পুরুষ হয়ে ওঠা কতটা বদলে যায়, তা আমিও বুঝতাম না বিয়ের আগে। সেদিন বুঝতে পেরে সম্বিৎদার দিকে একটা উইলস ফিল্টার বাড়িয়ে ধরি।
সেই চৈতালি এখন রান্নাঘর থেকে ফোনে তার বান্ধবী রিয়াকে বলছে, “চারটে লোককে ঝুলিয়ে দিলে, বুঝলি, তোর আমার বেডরুমও নিরাপদ হয়ে যাবে। হাহা! বেডরুমও, বল? হাহাহা…” দুই বান্ধবী ফোনের দুই তীরে কূল ছাপিয়ে হাসছে আর আমি ডুবে যাচ্ছি। আজকাল আমি আর চৈতালিকে বোঝাতে পারি না যে আমি পরিস্থিতির শিকার মাত্র, আমাকে প্ররোচিত করেছে সে নিজেই, অথবা মিনু, এমনকি শীলুও। তারাই আমাকে ঠেলে দিয়েছে খাদের দিকে, নইলে আমি কি পশু? জয়ন্ত চলে গেল একা ফেলে! ও না এলেই ভাল হত।
জয়ন্তর বাড়ি সেদিন না গেলেই ভাল হত। সাড়ে চার বছর আগে, দিল্লী তখন ফুটছে আজকের এই রায়টা আদায় করার দাবিতেই। ঘটনাটা ঘটার পর দিন পাঁচেক গেছে। এর মধ্যে পাঁচবার অপারেশন হয়ে গেছে মেয়েটার। টিভিতে দেখাচ্ছে ইণ্ডিয়া গেটের সামনে তুলকালাম।
“কোনও বিচার না, এসব ক্রিমিনালদের পাব্লিকের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এরকম ওপেন অ্যান্ড শাট কেসে তদন্ত, বিচারের প্রহসন অর্থহীন। অপরাধ তো পরিষ্কার। সৌদি পদ্ধতিতে পাথর ছুঁড়ে মারতে হয় শালাদের।” বলছিল জয়ন্ত। প্রতিবাদের উত্তাপ আর হঠাৎ-পাওয়া মনুষ্যত্ব টিভি থেকে ঠিকরে পড়ছিল আমাদের উপর। ডিসেম্বরের শীতে এই উত্তেজনা আগুন পোহানোর মতো কাজ করে। সোচ্চারে জয়ন্তকে সমর্থন জানাই আমি, আর সে উঠে যায় সিগারেট আনতে।
ফেসবুকে জ্বালাময়ী পোস্ট দিয়েছে রণিতা, তাতে লাইক দিতে গিয়ে বাথরুম যাবার প্রয়োজন অনুভব করলাম। জয়ন্তর বাড়ির ভেতর যেতে অনুমতি লাগে না কোনওদিন। মোবাইল হাতে পর্দা সরিয়ে করিডোরে এসে দেখি আমসিপানা মুখ করে জয়ন্তর হাতে নিজের গুটিয়ে নেওয়া শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে কদিন আগে কাজে যোগ দেওয়া বছর সতেরোর মিনু। সেই প্রথম মিনুর শারীরিক অস্তিত্ব খেয়াল করলাম। আমাকেও ভাগ দিতে ছেয়েছিল জয়ন্ত, “চাপ নিস না, আলাদা পয়সা দিই এজন্য।” সেদিন সাহস পাইনি, সময় লেগেছিল মাসখানেক।
বাড়ি ফিরে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সবকিছু ছাপিয়ে মিনুকে মনে পড়তে থাকে। রাতে ঘুম আসে না। চৈতালির শরীর ভাল ছিল না, কিন্তু ওকে আমার প্রয়োজন। আপত্তি অগ্রাহ্য করে তার শরীরে মিনুকে খুঁজতে থাকি আমি। “বাবা গো!” একবার বলেছিল চৈতালি, মনে আছে। বাঁ পাশ ফিরে সম্ভবত কেঁদেছিল অনেকক্ষণ, কিন্তু শব্দ করেনি। তখনও বেশি শব্দ শেখেনি চৈতালি।
তার বছরখানেক পর ভিলাই থেকে চৈতালির দিদিরা এসেছিল বেড়াতে। দিদির মেয়ে শীলু ক্লাস এইটে উঠল। তাকে কোলে নিয়েছিলাম সোফায় বসে। মিনুর কথা মনে পড়ছিল। শীলু বলে দিয়েছিল তার মাসিকে।
“কী করেছ তুমি আমার বোনঝিকে? তোমরা মানুষ?” রাতে ফুঁসে ওঠে চৈতালি।
“আমি কী করলাম? আমি তো…” প্রতিরোধ গড়ে তুলি আমি।
“জানি না ভেবেছ? তুমি, তোমার ইয়ার জয়ন্ত! জানি না কিছু?”
তার হপ্তাদুয়েক আগে জয়ন্তদের কাজ ছেড়ে গেছে মিনু। চলে যাবার আগে আমার বাড়িতে এসেছিল, আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই। আমাকে পায়নি, পেয়েছিল চৈতালিকে। এতদিন জানতেও পারিনি।
সেই প্রথম রুখে ওঠে শীলুর মাসি, আমার বউ যা পারেনি এতদিনে। সেদিন থেকে আলাদা শোয়। তার এজলাসে কিছুতেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারি না। ঘরের কথা বাইরে যেতে দেয়নি চৈতালি, কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। সাম্রাজ্যচ্যুত সুলতানের মতো ক্ষয়ে যেতে থাকি আমি। প্রথমেই হাল ছাড়িনি, রাজ্যপাট ছেড়ে দেওয়া অত সহজ নয়। কনফিডেন্স চৈতালিই দিয়েছিল আমাকে। একদিন তার মুখ চেপে ধরেছিলাম, চুলের মুঠিও। তিন বছরের ঘুমন্ত রুমির পাশ থেকে তাকে জোর করে তুলেও এনেছিলাম মাঝরাতে। সে রাতে আর বাবাকে স্মরণ করে কাঁদেনি চৈতালি, আহত বেড়ালের মতো নিঃশ্বাস ফেলেছিল। পরদিন থেকে নিজেদের ঘরে ছিটকিনি দিয়ে ঘুমায়।
“আমার মেয়েও সেফ নয় তোমার কাছে।”
এ অন্যায় আঘাত! রুমিকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। অথচ প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠতে পারি না। মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘেমে উঠি। তারপর চেহারার জেল্লা কমে যেতে থাকে। আত্মপ্রত্যয় নুয়ে পড়ে “ওনারস প্রাইড” নিভে যাবার সাথে সাথেই। অফিসে দু-একজন খেয়াল করে। মৃদু হেসে আমার নেমে আসাটা উপভোগ করে তারা। একজন পুরুষ নেমে না এলে অপরজনের ওঠা পূর্ণতা পায় না।
রোগা হয়ে যাবার কথা আমি কাউকে বলিনি, চৈতালিকেও না। তবু সে জানে, তাই তার রাগ নেই আর আমার প্রতি। আমার মৃত্যুদণ্ড চায় না সে। আমাকে সে আজকাল ঘৃণাটুকুও দেয় না।
রুমি-চৈতালির ঘরে দরজা বন্ধ, ছিটকিনি দুর্লঙ্ঘ্য। ওরা এতক্ষণে ঘুমোচ্ছে অকাতরে। ঘুমোক। একবার তাদের নিদ্রামগ্নতার সীমানায় নিষেধের কপাটে কান পাতি আমি। দরজার ওপাশে আলতো বাতাস বইছে বিজলি পাখায়। নিশ্চয় অল্প দুলছে নীল মশারি। তার ভেতরে আমার হারিয়ে ফেলা সবকিছু। ফিরে এসে নিজের ঘরের দরজা লাগাই। ছিটকিনি তুলে দিই সন্তর্পণে। তারপর আয়নার সামনে বিবস্ত্র হতে থাকি ধীরে ধীরে। নিজেকে খুঁজতে শুরু করি। জামা খুলি, গেঞ্জি খুলি, পাজামা ছুঁড়ে ফেলি, চুল অবিন্যস্ত করি… পরতে পরতে খোলস ছাড়তে থাকি।
রাত তিনটে নাগাদ হাত-পা-মাথাওয়ালা রঙচটা, মাটিওঠা, খড়-বেরোনো এক প্রাক্তন মানুষের মূর্তি আমার মুখোমুখি দাঁড়ায়। এতক্ষণে চিনতে পারি তাকে। চৈতালি ঠিকই বলেছিল। এর কাছে আমার মেয়েও সেফ নয়। তাকে হত্যা করব বলে বিয়ের ধুতিটা বের করে দড়ি পাকাই। এ মরলে আমার মেয়েটা যদি বাঁচে!
“দেখ রুমি, তোর বাবা একবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল!”
ভুল হয়ে গেল। চেয়ারটাকে পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দেবার পর দেখতে পেলাম, সেই খড় বেরনো রঙচটা দানব আয়না থেকে বেরিয়ে এসে মিটিমিটি হাসছে। হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে আমাকে। সুখের প্রতিশ্রুতি সেজে আসা এক উৎসবকালীন পরিধেয় ততক্ষণে আমার গলা জড়িয়ে ধরেছে। তার আলিঙ্গনে প্রগাঢ় আশ্লেষ আছে, স্নেহ নেই। ক্ষমতা থাকলে চৈতালির মতো “বাবা গো” বলে কেঁদে উঠতাম এই সময়ে, এতক্ষণে তার সেদিনের কান্নাটা আমি বুঝেছি। কিন্তু এখন আমি শব্দ ভুলে যাচ্ছি, কান্না তো কোনওকালেই শিখিনি। আওয়াজ কেড়ে নিলে আমি চৈতালির থেকেও অসহায়। আমার অসহায়তা দেখে আয়নার মানুষটা হাসছে। তাকে মারতে গিয়ে আমি নিজেকেই মেরে ফেলছি। হয়ত সেই হত্যা করছে আমাকে। হৃদয় মস্তিষ্ক দখল করে বহুদিন আগেই সে শুরু করেছে হত্যাপ্রক্রিয়া, এই নৈশ দৃশ্য তার অতিনাটকীয় ক্লাইম্যাক্স মাত্র। আমি মরে গেলে ওই লোকটা থেকে যাবে। অন্য কারও শরীর দখল করবে, মগজ দখল করবে। তার সামনে রুমিও নিরাপদ নয়। আমি মরে গেলে এর হাত থেকে কে বাঁচাবে আমার মেয়েটাকে?
আর একটু পরে চৈ উঠে পড়বে ঘুম থেকে। দিনের কাজ শুরু করবে, মেয়েকে তৈরি করবে স্কুলের জন্যে। আমার উঠতে দেরি দেখে বিরক্ত হবে। একটু চিন্তিতও হবে না কি? একসময় হয়ত সন্ধ্যা মাসিকে বলবে আমাকে জাগাতে। যদি সে কাজে না আসে, তাহলে হয়ত নিজেই ধাক্কা দেবে দরজায়, বহুদিন পর। আমার সাড়া না পেলে কি চৈ আমার দরজায় কান পাতবে, যেমন আমি কান পাতি ওদের দরজায়? দরজা ভাঙা হবে। হয়ত পাশের বাড়ির তারক ওদের শাবলটা নিয়ে আসবে। “খুব দামি কাঠ তো বৌদি! ভাঙব?” চৈ বলবে, “ভাঙুন, ভাঙুন।” সেই মুহূর্তটিই ব্রাহ্ম মুহূর্ত। মেহগনি কাঠের দরজার চেয়ে আমার মূল্য বেশি বলে প্রমাণিত হবে। ভাঙা দরজা পেরিয়ে ঝুলন্ত আমার সামনে স্তম্ভিত দাঁড়াবে ওরা। পাড়ার লোকে হৈহৈ করে শরীর নামাবে, পুলিশ ডাকবে। আর ওরা কী করবে? চৈতালি আর রুমি? কাঁদবে কি? খুব কাঁদবে আবার আমার জন্য?
আসলে এটাই বোধহয় আমি চেয়েছিলাম। বিকৃত দানবটাকে মেরে ফেলা নয়, আমার উদ্দেশ্য ছিল চৈতালিকে কাঁদানো, রুমিকে অধিকার করা। অপদার্থ নায়কের মতো এভাবেই আমি জিততে চেয়েছিলাম। বিয়ের ধুতিটাকেই দড়ি হিসেবে বেছে নেওয়াও সেই কারণেই নয় কি? অলস জীবনে অজস্র সেন্টিমেন্টাল বাঙলা সিনেমা দেখে বোধহয় এটুকুই শিখেছিলাম আমি। খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা, চোখ বসে যাওয়া নায়কের হাতে পেরেক ফুটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, আর তাই দেখে দর্শক এবং নায়িকা একযোগে কাঁদছে। করুণা! করুণা আর প্রেমের তফাৎ বুঝলাম না। দেবদাস আমাদের আদর্শ। জমিদারি আর ভিক্ষাবৃত্তি, দখলদারি অথবা দয়া প্রার্থনা, এটুকু শিখে জীবন ফুরিয়ে গেল। ভালবাসা অর্জন করতে শেখা হল না।
ঝুলে পড়ার আগে আবার জামাকাপড় পরে নিয়েছিলাম আমি। আয়নায় দেখতে পাওয়া নিজের নগ্ন চেহারা সকলের কাছে আড়াল করতে চেয়েছিলাম। তার মানে এই দরজা ভেঙে দেহ আবিষ্কারের দৃশ্যটি আমি সচেতন যত্নে নির্মাণ করেছি। অনুতাপ নয়, আমার মন জুড়ে ছিল প্রত্যাশাই। ভুল বড় হওয়ার পথে কুড়িয়ে নেওয়া ভুল প্রত্যাশা। চৈতালিকে আরেকবার নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলাম। যেন ধরেই নিয়েছিলাম, আমার চিত্রনাট্য মেনে আবার সে অভিনয় করবে। আসলে আমি বড়ই কাঁচা পরিচালক। মনে ছিল না, শ্বাসরোধের মুহূর্তেরা অসুন্দর। চক্ষু বিস্ফারিত হয় অমানুষী, জিভ যেন বুক ছুঁতে চায়। রেচনাঙ্গের আগল খুলে যায়, ভেতরের দুর্গন্ধ লুকিয়ে রাখা যায় না।
এখন দেখতে পাচ্ছি, সকালে নটা। দরজা ভাঙা হয়েছে। প্রতিবেশীরা কর্মব্যস্ত। রুমিকে এঘরে আসতে দেয়নি চৈতালি, সুমনাদির সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে ওদের বাড়ি। নিজে দাঁড়িয়ে আছে ঝুলন্ত আমার মুখোমুখি। চোখে জল নেই, আগুন নেই, ঘৃণা নেই। হতাশা আছে। নিরুচ্চারে বলছে, “কাপুরুষ! তবু লড়তে পারলে না?”
ক‘বছর পর রুমি বড় হয়ে যাবে। চৈতালি তাকে পূর্ণ মানুষ করবে, আমি জানি। আমার মেয়ে হয়ে উঠবে না রুমি, চৈতালির মেয়ে হবে। কোনও চৈত্র–বৈশাখের বিকেলে আমার ছবির সামনে দাঁড়াবে সেই মেয়ে। চৈতালি বাধা দেবে না। বলবে, “তোর বাবা যদি একবারের জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করত!”
ভুল হয়ে গেল। চৈতালি ফাঁসি চায়নি, এমনকি আমারও। চৈ চেয়েছিল আমি ঘুরে দাঁড়াই, আবার নায়ক হয়ে উঠি। ওই লোকটাকে মেরে ফেলার কথাই বলছিল, যে এখন আমার সামনে পায়ের ওপর পা তুলে বসে হাত নাড়ছে আর মিটিমিটি হাসছে। এই দানবকে শেকল খুলে ছেড়ে রেখে আমি পালিয়ে যাচ্ছি! আমার মেয়েটার কী হবে?
না, এভাবে শেষ হতে পারে না কাহিনী। বড় দেরি হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি। দড়ির গিঁট খুঁজে পাচ্ছি না, পেলেও খোলার শক্তি নেই। মাথার ওপর দুহাত তুলে ধুতিটাকে প্রাণপণ চেপে ধরি। এতদিনে আমি শত্রুকে চিনেছি, বিজয় চিনেছি। আমাকে নিঃশ্বাস নিতে হবে। আর একটু পরে চৈ জাগবে। আমাকে জাগাতে চাইবে। আমার সাড়া না পেয়ে দরজায় কান পাতবে। মেহগনি কাঠের বাজারদর চুরমার করে আমার ঘরে ঢুকবে। বিয়ের ধুতি ছিঁড়ে আমাকে নামিয়ে আনবে ঝুলন্ত অসহায়তা থেকে। সেই অব্দি আমাকে শ্বাস নিতে হবে। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে।
ভোর হচ্ছে জানালার বাইরে। চৈতালি আমার ঘরে আসবে আজ। আমরা ঘুরে দাঁড়াব। দুজনে মিলে রঙচটা দানবটাকে তাড়িয়ে দেব আমাদের মেয়ের জীবন থেকে।
বাঃ! ভালো লাগলো।
অসাধারণ! মৃৃত্যুতে নয়, সমাধান আছে জীবনের মধ্যেই৷