বনদেবী সিনি শুধু গ্রামরক্ষী নন, বিচারকও বটে

অঞ্জুশ্রী দে

 


রাঢ়-বাংলা বৌদ্ধ, জৈন এবং হিন্দু সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনক্ষেত্র। এখানেই আর্য এবং অনার্যরীতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। ধৰ্মীয় সংস্কৃতির এই বিনিময় বাংলার লৌকিক দেবদেবীর ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এইভাবেই বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র রাঢ়বঙ্গে সিনিদেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছে, যা কালে কালে সমাজের নানান স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষজন যাঁরা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকেন তাঁরা প্রকৃতিপুজোর সনাতন ঐতিহ্যকে এখনও মেনে আসছেন। আজও বছরের পর বছর সিনির পুজো করে চলেছেন

 

গোহালি তোডে বন্দিব ঠাকুর সনকাইসিনি
জলভূমে বন্দিব মৌলার রঙ্কিনী
পাথরাসিনি বন্দিব করি জোড পানি
তারপরে বন্দিব হে ঠাকুর জান্দাসিনি

এটা সিনিঠাকুরের বন্দনাগীত। এরকম বন্দনাগীত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়েছিটিয়ে অনেক আছে। লৌকিক বনদেবী হিসেবেই সিনির পরিচিতি। লৌকিক দেবী হওয়ায় তিনি প্রধানত গ্রামাঞ্চলে পুজো পেয়ে থাকেন। এই বনদেবীর নির্দিষ্ট কোনও নাম নেই। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন নামে তাঁকে ডাকেন, বিভিন্ন রূপে তাঁর আরাধনা করেন। বিনপুরের কাঁকো গ্রামে ডেলমা সিনি, গোঘাটের কয়াপাটে কয়া সিনি, বেলপাহাড়ির ঘাঘরাতে ঘাঘরা সিনি, গড়বেতাতে কুমা সিনি, পুরুলিয়ার দুয়ার সিনি, বাঁকুড়ার সিমলাপালের তেঁতুল্যা গ্রামের ন্যাংটা সিনি প্রভৃতি।

সিনিদেবতার নাম প্রথম পাই গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর বাংলার লৌকিক দেবতা বইয়ে। কিন্তু তাঁকে দেখার সুযোগ হয়নি। এ-বছর পৌষসংক্রান্তির সময়ে ঝাড়গ্রামের বিনপুর ব্লকের কাঁকো গ্রামে প্রথম তাঁকে চাক্ষুষ করি। রাজ্যব্যাপী এক রচনা প্রতিযোগিতার বিচারক থাকার সুবাদে আলাপ হয় ওই গ্রামের সুমিতের সঙ্গে। লৌকিক দেবদেবী নিয়ে আমার আগ্রহের কথা জানার পর সে আমায় তাদের গ্রামের ডেলমা সিনি, কালুবীরের কাহিনি শোনায় এবং স্বচক্ষে ওই দেবতাদেরকে দেখার অনুরোধ জানায়। ওর আন্তরিকতার টানে আর নিজস্ব উৎসাহে পৌষসংক্রান্তির দিন সপরিবারে পৌঁছে গেলাম কাঁকো গ্রামে। কলকাতা থেকে গাড়িতে প্রায় ১৭৫ কিমি ঝাড়গ্রাম। সেখান থেকে আরও ২০ কিমি বিনপুর হয়ে কাঁকো গ্রাম। পৌঁছতে প্রায় সন্ধে। সেদিন আর সিনির দেখা মিলল না। সুমিতের বাড়িতে আমাদের রাত্রিযাপন। রাতে খাওয়ার টেবিলে ঠিক হল পরদিন সকালে টিফিনের পর সিনির থানে যাওয়া হবে। জঙ্গলমহলে রাত্রিবাস একটু গা ছমছমে ভাব। ভিতরে একটা চাপা উত্তেজনা। তার উপর লম্বা জার্নির ক্লান্তি। সব মিলিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। নতুন জায়গায় রাত কাটানো, ফলে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু কিছু করার নেই। মেয়ে আহেলি, স্বামী অরিন্দম সবাই তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। শহর থেকে বহু দূরে প্রত্যন্ত একটা গ্রামে বসে দেখছি চোখের সামনে ভোরের আলো ফুটছে। কানে আসছে নানারকম পাখির ডাক। একটু সময় গড়াতেই দেখলাম পুরুষ-মহিলারা যে যার কাজে বেরিয়েছে। ছাত্রছাত্রীরা সাইকেলে চেপে টিউশন পড়তে চলেছে। কেউ কেউ গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে। স্বপ্নের মতো লাগছে।

ঘড়িতে তখন সকাল ৮টা, সুমিতের নেতৃত্বে আমরা সপরিবারে চললাম কাঁকো গ্রামের সিনির থানে। ওদের বাড়ি থেকে হেঁটে ১০ মিনিট। থানে গিয়ে দেখি দেবীর থান এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ভালভাবে পরিষ্কার করে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। কারণ আজ দেবীর বিশেষ পুজো। এখানে সিনিদেবীর বিশেষ পুজো হয় প্রতিবছর মাঘ মাসের প্রথম দিনে। কাঁকো গ্রামে সিনিদেবী ‘ডেলমা সিনি’ নামেই পরিচিত। ডেলমা নামের বড় এক জলাশয়ের পাড়ে গাছের নিচে দেবীর অবস্থান বলেই জলাশয়ের নাম অনুসারে দেবীর নাম হয়েছে ডেলমা সিনি। আগেই জেনেছি পুজোর শুরু বেলা ১২টায়। অর্থাৎ আর কয়েক ঘন্টা বাদেই এখানে শুরু হবে ডেলমা সিনির পুজো। সেটা দেখতেই এখানে আসা। গাছতলায় টাইলস বসানো থান। তাতে অসংখ্য পোড়ামাটির হাতি, ঘোড়া। থানের সামনে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি। পুজো শুরু হতে তখনও অনেকটা দেরি। মেয়ের ইচ্ছেতে আমরা কাছেই মালবির জঙ্গলটা দেখতে গেলাম। এখানে শীতকালে হাতির দল আসে ধান খাওয়ার লোভে। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে বুনো শুয়োর, বনমুরগি।

 

ডেলমা সিনি

মালবির জঙ্গল থেকে সরাসরি ডেলমা সিনির থানে পৌঁছালাম। ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সূর্য প্রায় মধ্যগগনে। এসে দেখলাম পুরোহিত মহাশয় পুজোর প্রারম্ভিক আয়োজন শুরু করছেন। থানের সামনে খোলা জায়গায় দুজন লোক পোড়ামাটির ঘোড়া, হাতি সাজিয়ে বসে পড়েছেন। ভক্তরা পুজো দিতে আসবেন, এই হাতি ঘোড়া কিনে সিনির থানে দেবেন। একটু সময় এগোতেই ভক্তদের আনাগোনা শুরু হল। সিনিদেবীর পুজোর কোনও বিশেষ ‘মন্ত্র’ নেই। তবে পুজো আরম্ভ করার আগে পুরোহিত কিছুক্ষণ ধ্যানে বসলেন। ডেলমা সিনির পুজোর এই পুরোহিত কিন্তু অব্রাহ্মণ। কাঁকো গ্রামে প্রধানত হাড়ি, বাউড়ি, ডোমেদের মধ্যে সিনিপুজোর আগ্রহ বেশি। অন্যান্যরাও গ্রাম্য দেবতা হিসেবে পুজো দিলেন। যাইহোক, সময় যত এগোতে থাকল ভিড় তত জমাট হচ্ছিল। পুরুষমহিলা-নির্বিশেষে সিনির থানে পুজো দিচ্ছেন। পরনে নতুন পোশাক, হাতে পুজোর ডালা। পুজোর উপকরণ খুবই সামান্য। আতপ চাল, আলু, কলা, দুধ, বাতাসা প্রভৃতি। এছাড়াও দেবীর থানে পোড়ামাটির হাতি, ঘোড়া দিতে দেখলাম। তবে কাঁকো গ্রামের ডেলমা সিনির পুজোয় বলি দেওয়ার প্রথা রয়েছে। দেবীর সামনে পায়রা, মুরগি এমনকি ছাগল বলি দেওয়া হল। এছাড়া লাউ, আখ ও চালকুমড়ো বলি দিতে দেখলাম। বলি শেষে, ভক্তরা মাটির পাত্রে পশু-পাখির রক্ত দেবীকে অর্পন করলেন। আর বলি দেওয়া প্রাণীর মাথাগুলো পেলেন পুরোহিত। অর্থাৎ এখানে সিনিকে নিরামিষ ও আমিষ দু-ধরনের নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। পুজো শেষে বাতাসা ছড়াতে দেখলাম। উল্লেখ করার বিষয় হল, ডোমদের মধ্যে যিনি প্রধান তিনিই গোটা পুজোপর্বটি নিজে হাতে সঞ্চালনা করলেন। এটাই নাকি রীতি। এভাবেই ডেলমা সিনির পুজো চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।

ডেলমা সিনি

 

পূজো শেষে ডেলমা সিনির পুরোহিত কমল ধাড়ার সঙ্গে কথা বলে জানলাম— “এই পুজোর বয়স ১০০ বছরেরও বেশি। গ্রামের মানুষের বিশ্বাস সিনি শস্যের দেবী। তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে চাষির ফসলকে রক্ষা করেন। গ্রামবাসীদের মহামারির হাত থেকে বাঁচান। এছাড়াও গ্রামবাসীরা মনে করেন সিনি হলেন গ্রামরক্ষী। তিনি সমস্ত বিপদ থেকে গ্রামকে রক্ষা করবেন।” তিনি সিনির থান দেখিয়ে আরও বললেন— “অনেক জায়গায় সিনিপুজোর জন্য প্রতিবছর দেবী-র পুরনো থান ভেঙে নতুন থান তৈরি করা হয়। তবে আমাদের গ্রামের ডেলমা সিনি-র ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এখানে একই থানে প্রায় ১০০ বছর ধরে সিনিদেবীর পুজো হচ্ছে।” কথা বলতে বলতে পুরোহিত দৌড়লেন। এখনও পুজো বাকি আছে। একটু অবাক হলাম। কী বলছে? ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেলের কোলে ঢলে পড়েছে। যেটা জানলাম, এখন পুজো হবে কালুবীরের। একটু দূরেই কালুবীরের থান। সম্পর্কে তিনি ডেলমা সিনির ভাই। রীতি হল আগে দিদির পুজো শেষ হবে তবেই ভাই পুজো পাবেন। পুজোপদ্ধতি একইরকম। সিনি ও কালুবীরের পুজো করেন একই পুরোহিত। কালুবীরের পুজো শেষ হতে সন্ধে হয়ে গেল। বিকেলে পুজো চলাকালীনই থানের সামনে গ্রামের লাঠিয়ালরা জড়ো হয়েছেন। মাঠে লাঠিখেলার প্রস্তুতি শুরু করেছে। বলা হয়নি, কালুবীরের পুজোর শেষেও পুরোহিত বাতাসা ছড়ালেন। সেই লুটের বাতাসা কুড়োতে ভিড় মূলত মহিলাদের। একটা নতুনত্ব চোখে পড়ল বাতাসার সঙ্গে লজেন্সও আছে দেখলাম। খবর নিয়ে জানলাম বাতাসা লুটের আকর্ষণ বাড়াতেই এই উদ্যোগ। বাতাসা ছড়ানো শেষ হতেই শুরু হল লাঠিখেলা। লেঠেলরা লাঠি ঘোরাচ্ছেন, বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে কিছু লোকে ব্যারিকেড করে দর্শকদের নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। এই লাঠিখেলা ডেলমা সিনিপুজোর বিশেষ আকর্ষণ। সেখানে ছেলে-বুড়োদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। সবাই আনন্দ নিচ্ছেন। থানের সামনে খোলা জায়গায় ততক্ষণে মেলা জমে উঠেছে। মেলার আকার ছোট হলেও মানুষের সমাগম চোখে পড়ার মতো। তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ততা যে-কোনও বড় শহুরে মেলাকে হার মানাবে। মেয়ে-বউদের ভিড় ও উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছিল দৈনন্দিন অভাব অনটন থেকে কিছুটা মুক্তি। অনেকটা খোলা হাওয়া। ডেলমা সিনি-র থান বছরের অধিকাংশ সময় ফাঁকা পড়ে থাকলেও প্রতিবছর পুজোর সময় তা শত-শত মানুষের কোলাহল এবং আনন্দে ভরে ওঠে।

সিনি রাঢ়বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় লৌকিক দেবতা। আদিবাসীরা দেবী অর্থে ‘সিনি’ শব্দটিকে ব্যবহার করেন। তথাকথিত অনুন্নত সম্প্রদায়ের হিন্দুদের মধ্যে এই পুজোর চল বেশি। তবে বহু এলাকায় বর্ণহিন্দুরাও সিনিপুজো করেন। সিনির নিজস্ব কোনও মূর্তি নেই অথচ অন্যান্য লৌকিক দেবতাদের তুলনায় গ্রামগঞ্জে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। তিনি গ্রাম-দেবতা। গ্রামগতভাবেই তিনি পুজো পান। ফলে কারও বাড়িতে আলাদা করে সিনিপুজো হয় না। নিত্যপুজোরও কোনও রীতি নেই। তবে, গোঘাটের কয়াপাটের ‘কয়া সিনি’ সেদিক থেকে ব্যতিক্রম। যার মূর্তি আছে, যিনি মন্দিরে থাকেন এবং গ্রামের বিশ্বাসপরিবারে তিনি নিত্যপুজো পান। এ-তথ্য জানার পর যোগাযোগ করি গোঘাটের কাঁঠালিয়ার বাসিন্দা প্রধানশিক্ষক ডঃ সুব্রত নায়েকের সঙ্গে, তিনি আমার পূর্বপরিচিত। সুব্রতবাবুর অন্য একটা পরিচয় আছে, উনি ২০২৩ সালে জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন। নিজের চোখে কয়া সিনিকে পরখ করতে এ-বছর দোলের পরদিন সুব্রতবাবুর সঙ্গে কয়াপাট যাই।

 

হুগলির গোঘাট থেকে কামারপুকুর নতুন চটি হয়ে সোজা ২০ কিলোমিটার গেলে বদনগঞ্জ। সেখান থেকে পশ্চিমে আরও ২ কিলোমিটার গেলে কয়াপাট গ্রাম। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘মেসার্স রবার্ট ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’ লাভের আশায় কয়াপাঠ ও বদনগঞ্জ গ্রামের সীমান্তবর্তী স্থানে হাট বসান। সেই থেকেই জায়গা দুটির পরিচিতি। কয়াপাট গ্রামটি পূর্বে মেদিনীপুর জেলায় ছিল। বর্তমান অবস্থান হুগলি জেলায়। শাস্ত্র অনুযায়ী জলক্রীড়া দেবীর নাম কয়া। লোকশ্রুতি, সেই নামানুসারেই গ্রামের নাম হয়েছে কয়াপাট। কথিত আছে বহু বছর আগে এই স্থান নিচু জলাভূমি ছিল। সারাবছর নৌকবাইচ, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা চলত। তখন মাছ ধরে বিক্রি করা লাভজনক ছিল। তবে, লোকসংস্কৃতির গবেষকদের কাছে কয়াপাটের গুরুত্ব অন্য কারণে।

 

কয়া সিনি

কয়াপাট বিখ্যাত তার আরাধ্যা দেবী কয়া সিনির জন্য। অতীতে নাম ছিল কয়াস্থানী। অপভ্রংশ হয়ে নাম হয়েছে কয়া সিনি। এর জন্মলগ্ন সঠিক জানা নেই। অনেকে মনে করেন টুসু, ভাদুপুজোর আয়োজন থেকেও কয়াস্থানী আসতে পারে। পূজারী বলছিলেন, “হঠাৎ করে গ্রামে মহামারি দেখা দেয়। সেই মহামারির হাত থেকে বাঁচতে গ্রামবাসী আরাধ্যা দেবী কয়াস্থানীর আরাধনা শুরু করেন। কয়াপাটের সন্তানদের কাতর আহ্বানে মা কয়াস্থানী আবির্ভূত হয়ে গ্রামকে মহামারির হাত থেকে বাঁচান। সেই থেকে গ্রামবাসীদের ভরসার জায়গা মা কয়াস্থানী।” তিনি আরও বলেন, মায়ের স্বপ্নাদেশ হয়। মা বলেছিলেন যেহেতু তোরা আমায় দুর্গারূপেই পুজো করেছিস বরাবর এই রূপেই পুজো করিস। মায়ের স্বপ্নাদেশকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আজও এখানে গ্রামবাসীরা সিনিকে দুর্গাজ্ঞানে পুজো করে চলেছেন। কয়া সিনি-ই গ্রামের  সব।

গ্রামের বিশ্বাস-পরিবার সাতপুরুষ ধরে কয়া সিনির নিত্যপূজা করে আসছে। এখানে দুর্গাপুজোতে যষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত দুর্গাপুজোর নিয়ম মেনেই সিনির পুজো হয়। বিশ্বাসপরিবারের মাধব বিশ্বাস বলছিলেন, “সিনি বনদেবতা। সিনির কোনও মূর্তি হয় না। পাথরের উপর সিঁদুর দিয়ে চোখ এঁকে দেবীর মূর্তি তৈরি হয়। শুধুমাত্র কয়া সিনির-ই মূর্তি আছে। যদিও গোটা শরীর কাপড়ে ঢাকা। শুধু মুখটা বাইরে থাকে। পূজার সময় মাকে নূতন কাপড় পরানো হয়। আমরা এখানে সিনির নিত্যপুজো করি। দুর্গাপুজোয় ইনি-ই মা দুর্গা। এই সময় সমস্ত গ্রামবাসী কয়া সিনির পুজোয় অংশগ্রহণ করেন। সকলে আনন্দে মেতে ওঠেন। তবে, পুজো উপলক্ষে এখানে কোনও মেলা হয় না। পুজোর জাঁকজমক আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। কয়াপাটে কয়া সিনির এতটাই প্রভাব অন্য কোনও বারোয়ারি পুজো এখানে হয় না।”

কয়া সিনির মন্দির

 

লালমাটি অঞ্চলের বিশাল জনজীবনের সঙ্গে মিশে আছে লৌকিক দেবদেবীর হাজারো গল্পগাথা। রুক্ষ জঙ্গলঘেরা অঞ্চলে সরল প্রান্তিক মানুষদের বিশ্বাস, প্রচলিত কাহিনি ও সিঁদুরের মহিমায় পাথর জাগ্রত হয়ে ওঠে। এই লোক-দেবতাদের চরণে নিবেদিত হয় তাদের দৈনন্দিন সুখ-দুঃখের নৈবেদ্য। প্রকৃতিকে ঈশ্বরজ্ঞানে অর্চনা করার আবহমান ঐতিহ্যকে বয়ে চলেছেন এঁরা। লোকদেবতারা মানুষের দিনযাপনের সঙ্গে মিশে গেছেন। বর্তমানের নাগরিক সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করেই জঙ্গলমহল-সংলগ্ন গ্রামগুলি ঘটা করে সিনিদেবীর পুজো করে চলেছেন। বাঁকুড়া জেলায় সিনিপুজোর আধিক্য সবচেয়ে বেশি। বাঁকুড়ার সিমলাপাল, ছাতনা, পাঁচাল, ওন্দায় সিনিপুজোর চল খুব বেশি। বাঁকুড়া জেলার লোকসংস্কৃতি-গবেষক মিহির চৌধুরী প্রায় ৯৬টি সিনিদেবতার নাম পেয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে পুজো চলে আসায়, সিনিপুজোয় নানা ধর্মমতের ধর্মাচরণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কোথাও গাজনের মতো আগুনের ওপর দিয়ে ভক্তরা হেঁটে যায়। কোথাও সঙ্কীর্তন হয়, আবার কোথাও বলিদানের প্রথা রয়েছে। বাঁকুড়ার সিনিপুজোতে লৌকিক ধর্মের সঙ্গে শাক্ত ও বৈষ্ণব ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানকে মিশে যেতে দেখা গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিনিপুজো হয় নীরবে, অনাড়ম্বরভাবে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে, সিনিপুজো বেশ জাঁকজমকভাবে আয়োজিত হয়। লোকসমাগম হয়। মেলা বসে। পৌষসংক্রান্তি বা পয়লা মাঘে বাঁকুড়া জেলার বেশিরভাগ সিনিপুজো হয়। আবার মাঘীপূর্ণিমা বা বছরের অন্য দিনগুলিতেও সিনিপুজো করতে দেখা গেছে।

বাঁকুড়ায় সিনির নানা কাহিনি। তাঁর পুজোয় বৈচিত্র্যও অনেক। নিজে চোখে না দেখলে তা কল্পনা করা কঠিন। এ-বছর রথের আগের দিন রবিবার পৌঁছে গেলাম বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে। সিমলাপাল ব্লকে। সাঁতরাগাছি থেকে রূপসী বাংলা ধরে বিষ্ণুপুর, সেখান থেকে ৩৬ কিমি দূরে সিমলাপাল। সাতটি পঞ্চায়েত নিয়ে এই ব্লক। সিমলাপাল ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্টাফ নার্স অনন্যা কোলে আমার পরিচিত। রাতে ওর বাড়িতেই রাত্রিযাপন। পরদিন রথ, ওইদিন সকালে অন্যনার স্বামী সুরজিৎ-এর বাইকে সিমলাপাল থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে দুবরাজপুর পঞ্চায়েতে সিনিঠাকুরের দর্শনে গেলাম। সুরজিৎ ভজহরি কুমারডোবা প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। দুবরাজপুর পঞ্চায়েতের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে অনেকগুলি সিনির দর্শন মিলল। বেশিরভাগ সিনির থান ঘন ঝোপঝাড়ে ঢাকা। যেহেতু বছরে একবার পূজা হয়, ওই পুজোর সময়েই ঝোপ কেটে থান পরিষ্কার করা হয়। দুবরাজপুর অঞ্চলে এমন ৫টি সিনির খোঁজ পেলাম তাঁরা সম্পর্কে নাকি পাঁচ বোন! গ্রামবাসীরা তেমনটাই শুনিয়েছেন। পাঁচ বোনের পুজো পাঁচটি ভিন্ন দিনে হয়। মাঘের ১ থেকে ৫ তারিখ অবধি। তবে এঁদের কে বড় কে ছোট তা তাঁরা জানেন না।

 

গ্রাম্য সিনি

দুবরাজপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কড়াকানালি গ্রামে গ্রাম্য সিনির থান। প্রতি বছর পয়লা মাঘ দেবীর পুজো হয়। তাছাড়া প্রতি শনি ও মঙ্গলবার দেবীর নিত্যপুজো হয়। স্থানীয় ব্রাহ্মণরা পুজোর দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ পুজোর দিন এখানে কোনও মেলা বসে না। তবে মেলা না বসলেও গ্রামবাসীরা উৎসাহের সঙ্গে জাঁকজমকভাবে দেবীর পুজো করেন। সমস্ত গ্রামবাসীদের খিচুড়ি প্রসাদ বিতরণ করা হয়। পুজো হয় টেরাকোটার হাতি ও ঘোড়া দিয়ে। দেবীর থান ঘন গাছপালায় ঢাকা হলেও বেশ পরিচ্ছন্ন। তার কারণ অবশ্য প্রতি শনি-মঙ্গলের পুজো।

গ্রাম্য সিনির থান

 

ন্যাকড়া সিনি

দুবরাজপুর গ্রামপঞ্চায়েতের ন্যাকড়া-কাপড় গ্রামে পূজিতা হন ন্যাকড়া সিনি। প্রতিবছর মাঘ মাসের ২ তারিখ তাঁর পুজো হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুজো চলে। পার্শ্ববর্তী ধুলোপুর গ্রামের শ্যাম মাঝি আগে পুজো করতেন, কিন্তু ওঁর অবর্তমানে এখন ওঁর পুত্ররা এই দায়িত্ব পালন করছেন। বিশাল বটগাছের নিচে দেবীর থান। অনেকে এথানে মানত করেন। প্রতি সোমবার দেবীর সাপ্তাহিক পূজা হয়। এখানে ছাগলবলির প্রথা চালু আছে। তাছাড়া অনেকে পোড়ামাটির কালো হাতি এবং লাল ঘোড়া মানত করেন। মেলা বসে বিশেষ পুজোর সময়। মেলাতে মোটামুটি সবরকমের দোকান বসে। তবে গ্রামবাসীদের মতে মেলার জৌলুস আগের থেকে অনেকটা হারিয়েছে। প্রতি সোমবার পুজো হয় বলে থান পরিষ্কার, কোনও ঝোপঝাড় নেই।

 

বোলতাবুড়ি সিনি

দুবরাজপুর পঞ্চায়েতের রায়বাঁধ গ্রামে ঢোকার মুখে এই বোলতাবুড়ির থান। স্থানীয় মাঝি সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পুজোর দায়িত্বে। প্রতিবছর মাঘ মাসের ৩ তারিখে এঁর পুজো হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা বসে, আশপাশ এবং দূরদূরান্ত থেকে প্রায় ৪-৫ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। মেলাতে প্রায় সবরকমের দোকান বসে। যদিও মেলার প্রধান আকর্ষণ জিলিপি। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুসারে ওই একদিনের মেলায় প্রায় ৮-১০ কুইন্টাল জিলিপি বিক্রি হয়।

 

লক্ষীয়াপাল সিনি

লক্ষীয়াপাল গ্রামে পূজিতা দেবী হলেন লক্ষীয়াপাল সিনি। প্রতিবছর মাঘ মাসের ৪ তারিখে এই সিনির পুজো হয়, বিশাল বটবৃক্ষের নিচে দেবীর থান। পূজোর আগের দিন গ্রামের মানুষেরা পাঁচমুড়া থেকে পোড়ামাটির কালো হাতি ও লাল ঘোড়া কিনে নিয়ে আসেন। এখানে কোনও বলিপ্রথা চালু নেই। পুজোয় সমস্ত গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করেন এবং একদিনের জন্য ছোট মেলা বসে।

 

ঝমকা সিনি

শিলাবতী নদীর তীরে ঝমকা গ্রামে পূজিতা হন ঝমকা সিনি। পুজোর দায়িত্বে আছেন গ্রামের খয়রা সম্প্রদারের মানুষজন, মাঘ মাসের ৫ তারিখে পূজা হয়। ওই সময় দেবীর প্রতিমা তৈরি করা হয়। প্রতিমার দুই হাত এবং উনি ঘোড়ার উপর অধিষ্ঠিতা, আটদিন পর দেবীপ্রতিমার বিসর্জন হয়, অন্যান্য সময় পোড়ামাটির হাতি ও ঘোড়া (লাল ও সাদা রং-এর) দিয়ে পূজা হয়। দেবীর থান বটগাছের নিচে। এই পুজো প্রায় ৭৫ বছরের পুরনো। এখানে বিশেষ পুজোর সময় দুদিনের ছোটখাট গ্রামীণ মেলা বসে। পুজোকে কেন্দ্র করে দু-দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান চলে, প্রথমদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পরের দিন যাত্রানুষ্ঠান। পুজো ও মেলাকে কেন্দ্র করে এখানে বহুলোকের সমাগম হয়। মাটির প্রতিমা তৈরি করে সিনিঠাকুরদের পুজো বিরল। এ-ব্যাপারে ঝমকা সিনি ব্যতিক্রম।

ঝমকা সিনির থান

 

মাদার সিনি

শিলাবতী নদীর তীরে গ্রাম মাদারিয়া। এই গ্রামেই পূজিতা হন দেবী মাদার সিনি। স্থানীয় ব্রাহ্মণরা এই পুজো করে থাকেন। এখানে পাথরের উপর খোদিত মূর্তি দেখলে মনে হয় নারায়ণের মূর্তি। এর অনেকটা মাটিতে পোঁতা। অগ্রহায়ণ মাসের ২০ তারিখের পর যে-কোনও শনিবার বা মঙ্গলবার পুজোর তারিখ গ্রামবাসীরা ঠিক করেন। পুজোর মূল আকর্ষণ প্রসাদ। খিচুড়ি, গুড়ের পায়েস ও বেগুনপোড়া— মাদার সিনির প্রসাদ। বেগুনপোড়া এই পুজোতে অবশ্যই লাগবে। গ্রামবাসীদের মতে এই পুজোর পর মাঠের কাটা ধান খামারে আনা হয়। জনশ্রুতি আছে বহুবছর আগে এক চাষি ধান কেটে গরুর গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলেন, তাঁকে রাস্তায় দুই বাঘে ধরে। সেই থেকে এই পুজো চলে আসছে। এখানে সেভাবে মেলা না বসলেও গ্রামবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুজোতে অংশগ্রহণ করেন।

 

ন্যাংটা সিনি

বৃষ্টির প্রার্থনায় জঙ্গলমহলের মেয়েরা ন্যাংটা সিনির পুজো করেন। বাঁকুড়ার সিমলাপালের তেঁতুল্যা গ্রামে আছেন ন্যাংটা সিনি। এই অঞ্চলের লোহার, মাঝি, হাড়ি, ডোমদের মেয়েরা বৃষ্টির কামনায় পয়লা মাঘ ন্যাংটা সিনির পূজা করেন। তাঁদের বিশ্বাস দেবী শস্যদাত্রী ও দয়াবতী। তিনিই গ্রাম-রক্ষয়িত্রী। তাঁকে খুশি করতে পারলেই সব বিপদ থেকে মুক্তি। ব্রতিনীরা পুজোর আগের দিন নিরামিষ খান ও শুদ্ধাচারে থাকেন। পুজোর দিন সকালে স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরে সিনিদেবীর ভোগ সাজান। গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মহিলা লৌকিক রীতিতে এই পূজা করেন। পূজা চলাকালীন সিনির থানের পাশের মাঠটিতে বিবাহিতা মহিলারা বৃত্তাকার দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে নাচতে থাকেন। দেবতার উদ্দেশ্যে আদিরসাত্মক গান করেন। বৃষ্টির প্রার্থনাতেই এই নাচ, গান। বৃত্তের ভেতরে কয়েকজন বিবস্ত্র হয়ে নাচেন, তাঁদের ঘিরে রাখেন বাকি মহিলারা যাতে বাইরে থেকে তাঁদের দেখা না যায়। শুধুমাত্র বিবাহিত মহিলারা মাঠের নাচ-গানে যোগ দেন। এইসময় ওই মাঠে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। মেয়েদের বসনহীন ব্রত প্রসঙ্গে ইন্দ্র মিত্র বলেছেন— “নারী আর পৃথিবী, এরা আদিম কৃষিনির্ভর মানুষের মনে একই সংস্কারের সুতোয় গাঁথা! আদিম যুগে সন্তান প্রসবের নারী ও শস্যপ্রসবিনী ভূমিকে এক অভিন্ন রূপে কল্পনা করা হয়েছে!”

 

সিমন সিনি

সিমলাপাল থানার অন্তর্গত পার্শ্বলা গ্রামে পয়লা মাঘ সিমন সিনির পুজো হয়। মূলত খয়রা সম্প্রদায়ের মানুষরা এই পুজোর আয়োজক হলেও পুজোয় অংশগ্রহণ করেন গ্রামের সবাই। পুজোর বড় আকর্ষণ আগুন সন্ন্যাস। যাঁরা দেবীর কাছে মানত করেন, তাঁরা (স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে) আগুনের ওপর দিয়ে হেঁটে যান। এখানে দেবী একান্তভাবেই পার্শ্বলা গ্রামের। সিমন সিনির পুজো নিয়ে প্রচলিত কাহিনি হল, গ্রামের বর্ধিষ্ণু পরিবারের কোনও এক ব্যক্তির সন্তান হয়নি। গ্রাম্য পুরোহিতের পরামর্শে তিনি সিমন সিনির পুজো করেন। তারপর তাঁর এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। সেই থেকে দেবীর পুজোর জনপ্রিয়তা বাড়ে। গাছতলাতেই দেবীর থান। তবে মূর্তি বলে কিছু নেই। পুজো উপলক্ষে প্রতি বাড়িতে আত্মীয়রা আসেন। পুজোর দিন এখানে মেলা বসে। এই মেলাতেও জিলিপি বিখ্যাত। প্রত্যেকে জিলিপি কিনে ঘরে ফেরেন।

হুগলি জেলার গোঘাট থানার কয়াপাটের কয়াসিনি তো তার ব্যতিক্রমের জন্যই বিখ্যাত। কয়া সিনির অন্য বৈশিষ্ট্য হল তিনি বর্ণহিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলে সিনিপুজোর সঙ্গে অদ্ভুত সব কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে। তেমনই বেলপাহাড়ির ঘাঘরা সিনি।

 

ঘাঘরা সিনি

মেদিনীপুরের বেলপাহাড়ি অঞ্চলে তারাফেনি নদীর তীরে ঘাঘরা সিনির থান। গ্রামের নামানুসারে এখানে সিনির নাম হয়েছে ঘাঘরা সিনি। ঘাঘরা গ্রামে সিনি পুজো উপলক্ষে মেলা বসে। বিপুল জনসমাগম হয়। লৌকিক দেবদেবী নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁরা বলেন সিনিদেবীদের মধ্যে ঘাঘরা সিনি সবচেয়ে বিখ্যাত। একটি প্রস্তরমুণ্ড দেবীর প্রতীক। সিঁদুর, কাজল আর মেথি দিয়ে পাথরের মধ্যে দেবীর চোখ আঁকা হয়। পুজোর অর্ঘ্য হিসেবে ফল, চিঁড়ে, গুড় নিবেদন করা হয়। এছাড়া দেবীকে আয়না, চিরুনি, শাড়ি, সিঁদুরের ঠোঙা, টাঙ্গি, লাঠি দেওয়া হয়। গ্রামপতি ও তাঁর স্ত্রী এই পুজোয় পৌরোহিত্য করেন। এখানেও পশুবলির চল রয়েছে। বলির পরে, সিনিদেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা পশুর মাথাটি পুজোর পৌরোহিত্য করা দম্পতি নিয়ে নেন। ভক্তেরা ছোট ছোট মাটির পাত্রে বলির রক্ত দেবীকে উৎসর্গ করেন। বলি শেষে নাচগানের আয়োজন করা হয়। স্থানীয়েরা এই নাচগানে অংশ নেন। সন্ধ্যায় আরম্ভ হয়ে সারারাত উৎসব চলে।

ঘাঘরা সিনির পুজোর দিন, দেবীকে বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আদপে গ্রামপতিই এই কাজটি করে থাকেন। যদিও দেবী স্বয়ং করেন বলেই প্রচার। কোনও সন্তানের জন্ম নিয়ে বা বাবা মায়ের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ-সংশয় থাকলে দেবী নিজেই এ-দিন তা দূর করেন বলেই প্রচলিত বিশ্বাস। বাংলার লৌকিক দেবদেবতার ইতিহাসে ঘাঘরা সিনিকে অন্য একটি রূপে পাওয়া যায়। তিনি বনদেবী, ঘাঘরা বুড়ি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, এই ঘাঘরা বুড়ি আর ঘাঘরা সিনি এক এবং অভিন্ন।

সিনিদেবী কেবল কৃষিদেবী নন, তিনি বিপদনাশিনী দেবীও বটে। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, তিনি যে পল্লীতে অবস্থান করেন, সেখানকার সকলকে তিনি বিপদ-আপদ এবং বহিরাগত ভূতপ্রেতের হাত থেকে রক্ষা করেন অর্থাৎ সিনিদেবী হলেন গ্রামরক্ষাকর্তী।

রাঢ়-বাংলা বৌদ্ধ, জৈন এবং হিন্দু সংস্কৃতির এক অনন্য মিলনক্ষেত্র। এখানেই আর্য এবং অনার্যরীতির মেলবন্ধন ঘটেছিল। ধৰ্মীয় সংস্কৃতির এই বিনিময় বাংলার লৌকিক দেবদেবীর ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। এইভাবেই বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র রাঢ়বঙ্গে সিনিদেবীর পুজোর প্রচলন হয়েছে, যা কালে কালে সমাজের নানান স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। জঙ্গলমহলের প্রান্তিক মানুষজন যাঁরা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকেন তাঁরা প্রকৃতিপুজোর সনাতন ঐতিহ্যকে এখনও মেনে আসছেন। বছরের পর বছর সিনির পুজো করে চলেছেন।

 

তথ্য-ঋণ:

  • রাজ, সৌভিক। গ্রামের রক্ষাকর্তী সিনি দেবী। জিওবাংলা.কম।
  • পালমাল, মনীষা। জঙ্গলমহলে বৃষ্টির প্রার্থনায় ন্যাংটা সিনির পুজো। বাংলাসাহিত্য.নেট।
  • বসু, গোপেন্দ্রকৃষ্ণ। বাংলার লৌকিক দেবতা।
  • নস্কর, দেবব্রত। বাংলার লোকদেবতা ও সমাজসংস্কৃতি।

*লেখার ভেতরের সব ছবি লেখকের তোলা

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...