তৃষ্ণার্ত বাংলাদেশ

রুখসানা কাজল

 


বুড়োরা পচে গেছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের লোভ। ছাত্ররা কতদিন পারবে? ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন আমেরিকা চিন ভারতের কাছে কাড়াকাড়ির মধুর হাড়ি। পাল্লা আমেরিকার দিকে হলেও ভারত কি নিশ্চেষ্ট থাকবে? চিন বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যাচ্ছে। কে জিতবে এই মধুভাগাভাগির প্রতিযোগিতায়! বাংলাদেশ কি কেবল ভাগের পিঠা হয়ে থাকবে নাকি এই ভূমণ্ডলে নিজস্ব পরিচয়ে ক্ষুদ্রতম পৃথক শক্তি হয়ে উঠতে পারবে! শক্তিই যদি বলি, তো সেই শক্তির রূপ কেমন হবে? বাংলাদেশ কি বাংলাদেশ নামেই থাকবে নাকি ‘খিলাফা ই বাংলা’ হয়ে যাবে? আবারও ব্যবচ্ছেদ অপেক্ষায় বাঙালি এবং বাংলাদেশ

 

কানামাছি ভোঁ ভোঁ  

বেশ একটি ‘Tug of War’ হয়ে গেল বাংলাদেশে। বাক্যটি হয়তো সঠিক বললাম না। আসলে এখনও হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আরও হবে। হতে হতে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে থির হবে হয়তো আগামী কয়েকদিন বা মাসখানেক লেগে যাবে মালুম করতে। যদিও এই মুহূর্তে দড়ির সিংহভাগ রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামি সরকারের মুঠিতে। তিনি পরিণাম চিন্তা না করেই স্বৈরাচারী শাসকের উল্লাসে সবলে চাবকে দিচ্ছেন আপাত দমিত প্রতিপক্ষের বুকে পিঠে মাথায় হাতে এবং প্রাণে।

ওহো এক মিনিট, এই যে প্রতিপক্ষ কথাটি বললাম, একথাটিও কি ঠিক বললাম? কয়েকটি শিক্ষার্থী তরুণ মুখ। সাহসে দৃপ্ত, প্রত্যয়ে অনড়। এরা সময়ের কাছে অপ্রোজনীয় একটি বিধিবদ্ধ দয়ার দান, সরকারি চাকুরিক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধর নাতিপুতিদের জন্য সংরক্ষিত ‘কোটা’ সংস্কারের দাবিতে জোটবদ্ধ হয়েছিল নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে। মনে রাখা দরকার, মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে সম্মান জানিয়ে এই শিক্ষার্থীরা শুধু ‘কোটা সংস্কারের’ দাবি তুলেছিল। ‘কোটাব্যবস্থা’ সম্পূর্ণ বাতিল হোক এটা  চায়নি। এদের দাবি  ছিল, ৫৬ শতাংশ কোটার পরিমাণ কমিয়ে মেধার ভিত্তিতে চাকুরিক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়ার।

কোটা সংস্কারের এই দাবি সরকারের কাছে নতুন নয়।

২০২৪ সালের রক্তঝরা জুলাইয়ের আগে ছাত্ররা ২০১৮ সালে বিভিন্ন খাত অনুযায়ী বিদ্যমান ৫৬ শতাংশ সংরক্ষিত ‘কোটা’র সংস্কার চেয়ে পাঁচ দফা দাবি করেছিল। তারা যৌক্তিক প্রমাণ দেখিয়ে নানাভাবে আবেদন-নিবেদন করে বিফল হয়ে শেষপর্যন্ত আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়েছিল। ছেচল্লিশ বছর ধরে প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। অবশ্য এদের পরিণতি যে খুব ভাল হয়েছিল তা নয়। একদিকে সরকারপ্রধান ‘কোটা রাখবই না’ বলে কিছুটা ছেলেমানুষি অনুযোগের ঘোষণা দেখালেও তলে তলে শিক্ষার্থীদের উপর অত্যাচার নির্যাতন করতে মোটেও পিছপা হননি। যৌক্তিক দাবি মেনে নিলেও তলে তলে ছিল কুবুদ্ধি। তাই ২০১৮ সালে প্রথমে ধমকানি, শাসানির আদরের শেষে মারপিট, গুমখুন, গ্রেফতার, নির্যাতন এমনকি মৃত্যুও ঘটেছিল।

তবে সমগ্র বাংলাদেশ জেনেছিল এবং  শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতাকে অভিভাবক-সহ সাধারণ জনগণ সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছিল। সরকারও কিছুটা নমনীয় হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ কার বা কাদের নির্দেশে আওয়ামি লিগের ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্রলিগ’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে ধাওয়া, হামলা, নির্যাতন করতে শুরু করে দেয়। সরকারও হঠাৎ প্রচুর বারুদ উড়িয়ে, টিয়ার শেল-শুল ছুড়ে, ঠান্ডা গরম রঙিন পানি খরচা করে, লাঠিচার্জ, গুমখুন, গুলিগোলা মেরে অবশেষে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি মানতে বাধ্য হয়েছিল এবং কোটা বাতিল ঘোষণা করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর একটি পরিপত্রও জারি করেছিল।

 

সরকারের অপখেলা  

এবার কথা হল, ২০১৮ সালে সরকার যদি কোটা বাতিল করেই থাকে তাহলে এখন কীসে কামড়াল যাতে শিক্ষার্থীরা আবার কোটা সংস্কার দাবি নিয়ে একজোট হয়ে দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু করে দিল?

সহজ বাংলা কথায় এর উত্তর দিলে বলতে হয়, সরকার হেগেছিলেন কিন্তু ছুচু করেননি। অর্থাৎ পরিপত্র জারি করলেও কোটা বাতিলের কার্যকরী আইন পাকাপোক্ত করে কোনও সরকারি প্রজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়নি। কেন হয়নি? বুঝো হে সুজন, ভবিষ্যতে কোটা নিয়ে আবার পাশা খেলবে বলে খেলার মূল ছক হয়তো এখানেই গুপ্ত রেখেছিল সরকার।

 

সুযোগসন্ধানী মনোভাবের সুযোগ্য পুত্ররা

তো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে, ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ফাউখোর কয়েকটি সন্তান ফস করে ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’ নাম ধারণ করে সরকারকৃত পরিপত্রের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে  রিট আবেদন করে বসে। ওসব বাতিল-টাতিল চলবে নাকো। ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা তাদের চাই-ই চাই। ছেচল্লিশ বছরের প্রৌঢ় বাংলাদেশ দেখল, তার স্তন্যচোষা এই মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা বিশ্বাস করে যে, যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় ‘কোটা’য় খেয়েপরে থাকার জন্যই তাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছিল। তাঁদের বীর্যে সাহস আর মেধা ফুরিয়ে গেছে। তাই তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম ধন্বন্তরি ভাইটামিন এই ‘কোটা’ না পেলে মেরুদণ্ড তুলতে পারবে না। ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতপামুখমাথা সব থাকলেও তাদের মস্তিষ্কের ত্যালত্যালে ঘিলু অনুকম্পার ‘কোটা’ পাওয়ার জন্য হাহাকার করে কাঁদবে। একমাত্র ‘কোটা’ নামক সঞ্জীবনী দাওয়া পেলেই তাদের ঘিলু পাকাপোক্তভাবে সরস হবে। তাই মুক্তিযোদ্ধা ‘কোটা’ দিতেই হবে। সে-সময়ে কয়েকজন মন্ত্রীও ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিনাতনিদের বংশপরম্পরায় ভোগের’ এই কোটা থিওরিকে কোন উদ্দেশ্যে, কেন সমর্থন করেছিল কে জানে! ফলে, ২০২১ সালের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ‘কোটা বাতিল’ প্রজ্ঞাপনটি বছরের পর বছর সরকারের উদাসীনতায় গোপনে বিষফল হয়ে ঝুলে ছিল আদালতে।

 

বিষফলের প্রতিক্রিয়া

অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ জুন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড’-এর করা ২০২১ সালের রিট আবেদনের রায় ঘোষিত হয়। বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ সরকারের বহালকৃত কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে কোটা পুনর্বহালের রায় দেন বিচারকরা। এই যে সুশীল মাননীয়রা যারা এতক্ষণ বলছিলেন, সরকার তো কবেই ‘কোটা’ বাতিল করে দিয়েছে, তাহলে শিক্ষার্থীরা আবার আন্দোলন শুরু  করল কেন? আপনারা এবার এটা জেনে নিন, বাতিলের পরিপত্র ছিল, আইনত কোনও প্রজ্ঞাপন ছিল না বলেই বিচারপতিদ্বয় কোটা পুনর্বহালের রায় দেওয়ার সুযোগ এবং ক্ষমতা পায়।

 

সুপরামর্শের বদলে হঠকারিতা 

এই রায়ের ফলে ‘কোটা’ সংস্কারের দাবিতে আবার উত্তাল হয়ে উঠে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো মুখরিত হয়ে উঠে প্রতিবাদী স্লোগান, মিছিলে। সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের ইশকুল কলেজ, মাদ্রাসা, সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। সংগঠিত হয় কোটা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন। মিছিলে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গন। এই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ সিনিয়র মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সরকারকে কোটা সংস্কারের যৌক্তিকতা না বুঝিয়ে বরং কোটা সংস্কারবাদী শিক্ষার্থীদের তুচ্ছজ্ঞান করে দম্ভোক্তি করেন, এদের ঠেকাতে ছাত্রলিগই যথেষ্ট। ছাত্রলিগও ঠ্যাঙারে বাহিনির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। খেলা শুরু হয়ে যায়। অথচ খুব সহজেই সরকার এবং শিক্ষার্থীরা একপক্ষ হতে পারতেন। সমঝোতার পথে না গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরং মুখ ফসকে কোটা সংস্কারবাদীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে প্রতিপক্ষ বানিয়ে নিলেন। অগ্নিতে তাৎক্ষনিক ঘৃত পড়ল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠল বিদ্রোহ। ‘আমরা কারা, রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’— স্বাভিমানে গর্জে উঠল শিক্ষার্থীরা।

 

এই প্রজন্মের তারুণ্যশক্তিকে অপমান

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের এমন কোনও পরিবার নেই যারা তাদের প্রিয়জনকে হারায়নি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বসতবাতি লুটে আগুন জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়েছে বাঙালির জীবন। স্বাধীনতা অর্জনে এ-দেশের জনগণের প্রত্যেকের রক্ত, ঘাম, শ্রম, প্রাণ, ত্যাগ, তিতিক্ষা রয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বর্তমান তারুণ্য তাই অপমানিত হয়ে ফুঁসে ওঠে। সমগ্র বাংলাদেশের ইশকুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা নেমে আসে আন্দোলনে। সংঘর্ষ অনিবার্য ছিল। হয়ও। সরকারের নজিরবিহীন হঠকারী সিদ্ধান্তে আইনশৃঙ্খলাবাহিনি নেমে আসে ইউনিভার্সিটি চত্বরে। এবার মার খাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সচেতন শিক্ষক এবং অভিভাবক ক্রমে সাধারণ জনগণও যুক্ত হয়ে পড়ে। লাশ পড়ে। ছাত্রদের লাশ। আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে। এবার লাশ পড়ে সাধারণ মানুষের। লাশ পড়ছে এখনও। এমনকি ঢাকার আকাশ ফুঁড়ে অবাধ্য গুলি ছুটে এসে নিহত করল মায়ের আদরের সন্তান শিশু-কিশোরদের, সন্তানের পিতা, পিতার কন্যা, স্ত্রীর স্বামীকে। সরকার স্নাইপার নামিয়ে দিয়েছে নগরের বিভিন্ন বহুতলের ছাদে। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, পাবনা, বরিশাল-সহ বাংলাদেশের সমস্ত শহর-গ্রামে পুলিশের জিপ, সেনাবাহিনির ট্যাঙ্ক থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণের খবর আসতে শুরু করে। বিদ্রোহ আর মৃত্যু। মৃত্যু আর বিদ্রোহ। ফুঁসছে বাংলাদেশ। জনতার ক্ষোভ মিশে গেল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। এত বছরের ফাঁকি, চোট্টামি, অবৈধ অর্থ পাচার আর অন্যায়কারী খুনি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠল জনগণ।

 

‘বুঝবি সবই ফেলি, বুঝলি দিন গেলি

দেরিতে হলেও সরকার বুঝল। ছাত্রদের দাবি মেনেও নিল এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা সম্পূর্ণ বাতিল করে দ্রুত পরিপত্র জারি করে প্রজ্ঞাপনেরও ব্যবস্থা করে ফেলল। কিন্তু এবারেও ২০১৮ সালের মতো খেলতে শুরু করল। কার্ফু দিয়ে ঘর ঘর তল্লাসি করে গুম গ্রেফতার করতে শুরু করলেন সমন্বয়কারী এবং আন্দোলন সমর্থক এবং অংশগ্রহণকারীদের। আবার ফেটে পড়ল শিক্ষার্থীরা। ক্রমাগত লাশ পড়তে থাকল রংপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঢাকা-সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। রাতে পাড়া মহল্লায় ঢুকে বাসাবাড়ি থেকে তরুণদের ধরে নিয়ে যেতে থাকল পুলিশ, র‍্যাব। মিছিলে মরছে মানুষ, ঘরের ভেতরে মায়ের সঙ্গে, বাবার কোলে মারা যাচ্ছে  শিশু কিশোর তরুণ। অস্বীকারের উপায় নেই, ক্রমে গণআন্দোলনের রূপ নিয়ে নিয়েছে এই আন্দোলন। ওদিকে সমন্বয়কারীদের গুম করে নির্মম অত্যাচারের মুখে জোর করে আন্দোলন থামানোর বিবৃতি দেওয়ানো হলেও পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন সমন্বয়কারীরা এসে নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছে। ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আর সাধারণ মানুষের লাখো বিদ্রোহ। বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়ছে ছাত্রছাত্রী, সমর্থক অভিভাবকরা। একজন মারা গেলে আরেকজন এসে বুক পেতে দিচ্ছে। কতজনকে ঠেকাবে সরকার? পারবে? এ সরকার যে বেবুঝ। এবার দেওয়ালে দেওয়ালে জ্বলে উঠল রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি। পনেরো বছরের অন্যায় অবিচার শোষণ, স্বজনপোষণ, নির্বাচনের বায়স্কোপ, লাগাতার বিচারহীনতা, টাকা পাচার, মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী, দেশরক্ষা বাহিনির দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে শিক্ষার্থীরা এবার ক্ষমতাসীন সরকারের পতন-সহ রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি নিয়ে এসেছে। জনগণ পরিণতি যাই হোক না কেন, এই দুঃশাসনের খাঁচা থেকে মুক্তি পেতে আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সমর্থন দিয়ে পথে নেমেছে। ট্র্যাজেডি এই যে, ছাত্র জনতা যে ভাষায় কথা বলে চলেছে, সরকার সেই ভাষা পড়তে বা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। ছাত্র আন্দোলনের ঘরে ফেউ ঢুকে পড়েছে। সঙ্কেত দিচ্ছে ফেউ। কেউ কেউ বুঝলেও সরকারের কেন যে এমন অবুঝমন!

 

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়

সরকার এবং রাজনীতিবিজ্ঞান শাস্ত্র বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে, যে-কোনও প্রকারে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা ও দখলে রাখা। ফলে চোরাস্রোতের মতো আন্দোলনে মিশে গেছে কথিত বিএনপি, জামাত-সহ ধর্মীয় এবং বাম ঘরানার দলগুলো। সরকারের ভুলের পথ বেয়ে ছাত্রদের উপর হালকা কিংবা সম্পূর্ণ ভর দিয়ে এই রাজনৈতিক দলগুলো সরকার পতনের আন্দোলনে আসতেই পারে। এটাই রাজনীতি। এ-জন্য শিক্ষার্থী ছাত্ররা দায়ী নয়। দায়ী এই সরকার, সরকারের দাম্ভিক মন্ত্রিবর্গ এবং তাদের কৃত অন্যায়, লুণ্ঠনের চক্ষুলজ্জাহীন বেপরোয়া লোভ এবং অভ্যাস।

একবার ভাবুন তো, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকলে আওয়ামি লিগ ঠিক কী করত এসব মুহূর্তে? ক্যাসিনোতে সময় কাটাত? বিদেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়ত, নাকি টাকার বস্তা জমাতে ব্যস্ত থাকত?

যতদূর জানি, আওয়ামি লিগ এবং ছাত্রলিগ আরও ভয়ঙ্করভাবে জান লড়িয়ে দিত ছাত্রহত্যাকারী সরকারের বিরুদ্ধে। কে না জানে বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামি লিগের ভূমিকা কতখানি সৎ এবং অপ্রতিরোধ্য। আওয়ামি নেতা ও কর্মীদের এই গুণের কথা শত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না।

 

ইন্টারনেট বন্ধ: হা হা হি হি

না ভাবতে চাইলেও এই সরকার আমাদের ভাবিয়ে ছাড়ছে, এত এত মানুষের ঘৃণা, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ আর শত শত মৃতদের রক্ত মুছে দিয়ে সরকার কি পারবে এই রাষ্ট্রে টিকে থাকতে?

ইতিহাস সাক্ষী, বাংলার মাটিতে কখনও কোনওদিন কোনও ছাত্রহত্যাকারীর ঠাঁই হয়নি। ছাত্রহত্যার রক্ত মেখে কেউ পারেনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে। পাকিস্তানি হানাদারদের মতো ঘরে ঘরে ঢুকে ছাত্র তরুণ, বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে আওয়ামি সরকার। এরশাদ ছাত্রদের গায়ে ট্রাক তুলে দিয়ে মেরেছে আর এই সরকার হেলিকপ্টার থেকে ফুলের মতো গুলি ছড়িয়ে শিশুকিশোর-সহ নাগরিকদের খুন করছে। ইয়াহিয়া, এরশাদের মতো দেশের দেওয়ালে দেওয়ালে রক্তচোষা ড্রাকুলা হিসেবে আঁকা হচ্ছে শেখ হাসিনার ব্যঙ্গচিত্র। বোকারও অধম এই সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে ফেসবুক, মেসেঞ্জার অকেজো করে এই দাবাগ্নি থামাতে চাইছে। অথচ একবারও ভেবে দেখল না, নব্বই সালে কোনও ফেসবুক, মেসেঞ্জার না-থাকলেও এরশাদ সরকারের পতন আন্দোলন সফল হয়েছিল। তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী পলকবাবা না-জানলেও মানবতার মা শেখ হাসিনা কিন্তু সব জানেন।

 

ভাঙবে তবু মচকাবে না

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এক বিশাল পরিবর্তনের মুখে। পিছু হটছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি। অনেকে আবার একাত্মতা ঘোষণা করছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। পুলিশ, সেনাবাহিনিতে কর্মরতদের সন্তানও আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহিদ হচ্ছে। এমন বিরল মুহূর্তে সরকার বাংলাদেশ জামায়েত-ই ইসলামি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিল। তাতে সরকারপক্ষের জুটল লাভের গুড়ে বালি। বরং সরকার পতনের দাবি আরও উচ্চকিত হয়ে হচ্ছে। শত শত মানুষ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসছে গণভবন দখল করতে। পথনাটক হচ্ছে। দেওয়াল জুড়ে শহিদদের ছবি কথা বলছে। ইতোমধ্যে গুজব কি সত্যি কে জানে, সরকারের অনেকেই চিকিৎসা-সেবা নেওয়ার নাম করে সপরিবারে দেশ ছাড়ছে। কিন্তু সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা? তিনি আরও দাম্ভিক এবং একনায়কের কুরূপ নিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছেন।

 

রাঙিয়ে দিয়ে যাও

মাননীয়ার কাছে অনুরোধ, যদি কখনও ওইসব পেটফোলা স্তাবকহীন অবস্থায় একা একা নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় জোটে, একবার ভেবে দেখবেন প্লিজ—

ক। গণতন্ত্রের সুফল পেতে দেশে কি কোনও বিরোধী দলের অস্তিত্ব রেখেছেন? আপনি এবং আপনার আস্থাভাজনরা যা খুশি তাই করছেন, ভুল হলে, অন্যায় হলেও বলার কেউ নেই যে সংশোধনের কথা বলবে। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দল হচ্ছে ছায়া সরকার। ক্ষমতাসীন দলের কাজকে সমালোচনা করে ছায়াবন্ধুর মতো কর্তব্য পালন করে বিরোধী দল। যতটা গণতন্ত্রের কথা বলেন তার চেয়ে শতগুণ স্বৈরাচারী আপনি এবং আপনার সরকার।

খ। বাঙালিজাতির মন থেকে বঙ্গবন্ধুকে আপনি ছিনিয়ে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এখন কেবলই আপনার পিতা। এই পরিণত বয়সে কথায় কথায় মা, বাবা, ভাইদের হারানোর কথা বললে ভাল লাগে না, মায়া জাগে না। কেন যেন মনে হয়, জাতিকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছেন আপনি।

গ। একটি পুরনো ভিডিও দেখলাম। সেখানে আপনি বলেছেন, জনগণ না চাইলে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবেন। শহরে শহরে আইনজীবীরা আন্দোলন সমর্থন করছে। ছাত্রহত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। কী বলছে এখন আপনার মন? জনগণ এখনও চাইছে আপনাকে? ছাত্র-জনতার রক্তে আপনি আপাদমস্তক রেঙে গেছেন। আচ্ছা, আপনিও কি চাইতেন রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ জুড়ে থাকুক কোনও খুনপিয়াসি সরকার! নব্বইয়ের আন্দোলনে ছাত্রহত্যাকারী এরশাদকে কি চেয়েছিলেন আপনি?

ঘ। এই প্রজন্মকে বুঝতে পারেননি আপনি এবং আপনার সরকার। মারপিট ঘুষ ফুসমন্তর দিয়ে সাময়িকভাবে দমন সম্ভব হলেও এরা কি থামবে? প্রতিটি দলেই নতুনরা আসছে। এরা নতুন কিছু চায়। মাতৃত্বও জানে নতুনদের ছেড়ে দিতে হয় স্থান। আপনি এখন জানলেন কিন্তু মানলেন কি!

ঙ। হয়তো সামান্যর জন্য এবার টিকে গেলেন। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতা ভেঙে একদিন হয়তো নতুন কোনও নেতা বেরিয়ে আসবে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে আপনার তখ্‌ত আর আস্তাকুঁড়ে জায়গা হবে আওয়ামি লিগ, যুবলিগ, স্বেচ্ছাসেবক লিগ-সহ ছাত্রলিগের। তারা অভিশাপ দেবে আপনাকে।

চ।  স্বৈরাচারী আওয়ামি শাসনের অবসান ঘটাতে যদি সামরিক শাসন বা কোনও ধর্মান্ধ দল চলে আসে ক্ষমতায়, তার জন্যে আপনি এবং আপনার দল ইতিহাসের কাছে সম্পূর্ণ দায়ী হবেন। বাঘ বাঘ করে আপনারাই বাঘের মুখে ফেলে দিচ্ছেন বাঙালি এবং বাংলাদেশকে। মুখ ফুটে সব কথা বলাতে হয় না। অনুভূতিতে অনুভব রাখতে হয়। ১৯৮১ সালের এক বৃষ্টিমুখর দুপুরে অসংখ্য মানুষের ভালবাসা পেয়ে আপনি ফিরে এসেছিলেন দেশসেবা করতে। অনেক তো হল। আজ ভালবাসাহীন অগৌরবে কিছুটা হলেও সুবুদ্ধি হোক আপনার। চোখ মেলুন। দেখুন তো কে আছে আপনার পাশে? আপনিই কি আপনি আছেন? আয়নায় ওই কার ছবি? কার প্রতিচ্ছবি ভাসছে আজ রক্তচোষা ড্রাকুলার মতো?

 

সব ভেসে গেল পলায়নের পথে

আজ ৩ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুয়ার খোলা আছে বলে সংলাপের ইঙ্গিতময় অভিলাষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার জনরোষ থেকে দাবি উঠেছে— এক দফা এক দাবি, হাসিনা তুই কবে যাবি। সমুদ্রগর্জনের মতো সেই দাবি ছড়িয়ে পড়েছে জনসমুদ্র থেকে জনসমুদ্রে।

ফেরার পথ নেই। কী করবে এখন সরকার?

৪ আগস্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের নেতাকর্মীরা মোকাবিলা করতে নামলে আন্দোলন ভয়াবহ মৃত্যুখেলায় পরিণত হয়।

৫ আগস্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা আজ ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। ঢাকা অভিমুখে জনতার ঢল নেমেছে। আন্দোলনের রণকৌশল দেখে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, ছাত্রদের পাশে পশ্চাতে কেউ বা কারা তো অবশ্যই আছে। তারা সঘন প্রচ্ছন্নতায় ঢাকা। রাজনীতির সূত্র অনুযায়ী এই কেউ বা কারা হয়তো দেশি এবং বিদেশি কোনও শক্তি হবে! কিন্তু তারা কে? ছায়া ছায়া অবয়ব। চেনা চেনা তবুও অচেনা। প্রগতিশীলরা চিন্তিত। সুশীল সমাজ শঙ্কিত। তবে কি শঙ্কা আশঙ্কার ডঙ্কা বাজিয়ে সেই তারাই চলে এল! বাঘ এসেছে, বাঘ আসবে বলে এতদিন যাদের কথা শুনেছি, শুনে শিউরে উঠেছি, তারাই কি!

এবার কী হবে শেখ হাসিনা? কী হবে এই আওয়ামি সরকারের? বাঁধভাঙা বন্যার মতো ছাত্র শিক্ষক জনতা নেমে এসেছে রাস্তায়। মরছে পাখির মতো। উত্তরা, যাত্রাবাড়ি, মোহাম্মাদপুর, মিরপুর-সহ ছাত্রজনতার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ চলছে। পুলিশ মরছে। থানা জ্বালিয়ে দগ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে অসংখ্য পুলিশ। শুধু ঢেউয়ের মতো ভেসে আসছে স্লোগান, এবার গদি ছাড়তে হবে। ছাড়তেই হবে।

সেও ভাল। ছাড়ুন তবে। আপনার গৌরবে কালিঝুলি ছাইভস্ম লাগলেও দেশের প্রাণটুকু তো বাঁচবে।

৫ আগস্ট। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জনতার ঢল পৌঁছে গেছে ঢাকার উপকণ্ঠে। বেলা আড়াইটায় নানা বায়নাক্কা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুমতি হলে, তিনি পদত্যাগ করেন এবং দ্রুত উড়ান যানে করে পালিয়ে যান। আর দেশ?

 

শেষ বলে কিছু নেই প্রিয় স্বদেশ

কেমন আছে বাংলাদেশ? কয়েকটি দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনিহীন বাংলাদেশ লুণ্ঠিত লাঞ্ছিত হয়েছে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে। হাতুড়ির ঘায়ে লুটিয়ে পড়েছে জাতির পিতার স্ট্যাচু, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য। লুটপাট, ভাঙচুর কালিমালিপ্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামফলক, ছবি, বাসভবন এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র পোশাক পরিচ্ছদ। কথিত দ্বিতীয় স্বাধীনতার কোনও একক নেতা এবং নেতৃত্ব নেই বলে নির্দেশনাও ছিল না। তবে কি আবার সামরিক শাসন? কিন্তু সামরিক পথে না হেঁটে আওয়ামি লিগ বাদে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-সহ জামাত-ই ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মীয় দলগুলো রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনাসভা করে, দেশবাসীকে চমক দিয়ে অতঃপর প্যারিস থেকে উড়িয়ে এনেছে নোবেলজয়ী ডঃ ইউনুসকে। তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা করে, ছাত্র আন্দোলনের দুজন আন্দোলন সমন্বয়ক ছাত্রকে উপদেষ্টার দায়িত্ব দিয়ে এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। সদ্য-গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করতে কয়েকটি ক্যু হলেও সফলভাবে সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছে এই ছাত্ররাই। ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণে নেমে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। ধ্বংসের পাশাপাশি এ যেন এক অন্যমাত্রার বসন্তযাত্রা।

 

বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় মৃত্যু:বাঙালির বিবেক এবং শঙ্কাআশঙ্কা

সুশীল সমাজ, বোদ্ধা নাগরিকবৃন্দ আশা করেছিল অন্তরবর্তীকালীন সরকার হয়তো স্মরণ করবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। সে-রকম কিছুমিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল। অথচ ১৫ আগস্টের রাতে ঘটে গেল মহাতাণ্ডব। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, জাদুঘর আগুনে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে উদ্দাম নেচেছে একদল উন্মত্ত। এদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে শোকপালনকারীরা। দ্বিতীয়বারের মতো মৃত্যু হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের। দলমতনির্বিশেষে এই প্রথম মেজরিটি বাঙালির বিবেকে খিঁচ ধরে। বঙ্গবন্ধুকে অসম্মানের জন্য সমালোচিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কেমন যেন বিষাদের বীণ বাজছে বাংলাদেশে। সংশয়ে আকুল হচ্ছে একটি শ্রেণি। সেই ছায়া ছায়া অবয়বগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কি! কী হবে এবার? কেউ কেউ মজাচ্ছলে বলছে, এবার বুঝি এনজিওর শাসন চলবে বাংলাদেশে! এদিকে বিএনপি তড়িঘড়ি একটি জনসভাও করে ফেলেছে। কেউ কেউ আবার জামাত-হেফাজতের কর্মকাণ্ড দেখে শঙ্কা-আশঙ্কায় দুলছে, তবে কি দেশে পাখা মেলছে ধর্মান্ধ দলগুলো! শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাতে ধর্মীয় দলগুলো বিশেষ করে হিবুত তাহরির গেরিলা অংশগ্রহণকে ত্রাণকর্তা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিংবা যদি রাজনৈতিক পাশাখেলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যর্থতায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে যায় সামরিক শাসকের বুটের তলায়! তবে?

 

শ্রীলঙ্কাই মডেল!

অনেকে আবার আশাবাদী। অনেকের ধারণা পলাতক ক্ষমতাসীন দলের প্রচ্ছন্ন মদত, ছলচাতুরি এই সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে, তুলবে। ক্রমাগত নির্বাচনের দাবি করে চলেছে বিএনপি। এদিকে সরকারের আইনগত ক্ষমতার ন্যায্যতা না জেনে পেশাজীবীরা এই দাবি সেই দাবি করেই চলেছে। এ যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়, দাবিদারদের বায়নাঘর। কিন্তু এর মধ্যেই কাজ করে চলেছে সরকার। রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে প্রথমেই সংবিধান সংস্কার, পুনর্বিন্যাস বা পুনর্গঠন করে লিখতে হবে। সে-প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। এদিকে সৌজন্যের নিয়ম ভুলে পূর্ব-সতর্কতা না জানানোর ফলে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ভয়াবহ বন্যার পানি নেমে আসায় প্রতিরোধের সময় না পাওয়ায় ভেসে গেছে নোয়াখালি, ফেনি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম। পানির তোড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কয়েকটি গ্রাম। ধ্বংস হয়ে গেছে অসংখ্য মানুষ, গৃহপালিত অগণিত পশুপাখি। আশ্চর্য তৎপরতায় বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থী-সহ বহু সমাজসেবক মানুষ। প্রবাসীরা দু-হাতে সাহায্য পাঠিয়েছে। এমন গণজোয়ারের শুভসময়ে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার মতো তরল ইচ্ছা এই সরকারের নেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষক-সহ সাধারণ মানুষরা এ-মুহূর্তে নির্বাচন নয়, দেশটিকে নতুন করে গড়ে নিতে চাইছে। সে-ক্ষেত্রে অনেকেই শ্রীলঙ্কার উদাহরণ সামনে আনছে।

 

মধুর হাড়ি বা ভাগের পিঠা

অনেকেই আবার হতাশ। তাদের ধারণা, যে লাউ সেই কদুই থাকবে বাংলাদেশ। বরং আরও খারাপ অবস্থা হবে। বুড়োরা পচে গেছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাদের লোভ। ছাত্ররা কতদিন পারবে? ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এখন আমেরিকা চিন ভারতের কাছে কাড়াকাড়ির মধুর হাড়ি। পাল্লা আমেরিকার দিকে হলেও ভারত কি নিশ্চেষ্ট থাকবে? চিন বহুদিন ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যাচ্ছে। কে জিতবে এই মধুভাগাভাগির প্রতিযোগিতায়! বাংলাদেশ কি কেবল ভাগের পিঠা হয়ে থাকবে নাকি এই ভূমণ্ডলে নিজস্ব পরিচয়ে ক্ষুদ্রতম পৃথক শক্তি হয়ে উঠতে পারবে! শক্তিই যদি বলি, তো সেই শক্তির রূপ কেমন হবে? বাংলাদেশ কি বাংলাদেশ নামেই থাকবে নাকি ‘খিলাফা ই বাংলা’ হয়ে যাবে? আবারও ব্যবচ্ছেদ অপেক্ষায় বাঙালি এবং বাংলাদেশ।

রাজনীতি গিরগিটিসম। বর্ণচোরা। রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই, থাকে না হে সুজনেষু নাগরিক!

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...