জার্সি গরুর রচনা

পীযূষ ভট্টাচার্য

 

জার্সি গরুটা বাড়িতে আসবার পর আমার বাবার নামের আগে যোশেফ, মা’র এমিলি আর আমি জন অমূল্য সরকার হয়ে গেলাম। সে না হয় হলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছিলাম। কেননা গরুটা আমাদের দশ লিটার দুধের মালিক বানিয়ে দিয়েছিল। তার ফলে আমাদের পরিবার আবার চলতে শুরু করেছিল। কিন্তু মা’র একটাই প্রশ্ন ছিল সেসময়ে, জার্সি গরু গরম হলে কী করা হবে? যখন শোনে বিদেশ থেকে ষাঁড়ের বীর্য আসবে, সুঁই চালিয়ে ঢুকিয়ে দিলেই গর্ভবতী। হেসে উঠে বলে — তাই হয়?

এসব অবশ্য বড়দিনের মাস খানেক আগের ঘটনা। বড়দিনের সপ্তাহ খানেক আগে একদিন মটরগাড়ির চাকা লাগানো গরুর গাড়িতে এক বস্তা চাল, এক টিন সর্ষের তেল, নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে গোটাকয়েক মোমবাতি সহ একটা আস্ত কেক দিয়ে জানানো হয় বড়দিনে গির্জায় যেতে হবে তখন পাকাপাকিভাবে যোশেফ-এমিলি-জন নামকরণ হবে। যিশুর ছবিটা হাতে দেবার সময় গির্জার লোক জলদগম্ভীর স্বরে ঘোষণা করে ‘বড়দিন’। আমার কেন যেন মনে হয় এই লোকটাই সান্তাক্লজ সাজবে বড়দিনে — এখন অবশ্য ভীষণ কুৎসিত দেখতে।

‘প্রভুর ছবিটা কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে রাখবে’ বলে লোকটা গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে যায়, আসবার সময় রাস্তায় যে ধুলোর ঝড় তুলেছিল গাড়ি সেখানেই মিশে যায়। এই কাজটা যে দুধ বিক্রির টাকা থেকে করতে হবে তা না বললেও বাবা সহজেই বুঝে যায়। কিন্তু এর জন্য অবশ্য শহরে যেতে হবে। প্রায় একদিন নষ্ট হয়ে যাবে। বাবা দুধ বিক্রি বন্ধ হয়ে যাবে বলে যেতেই পারেনি। গ্রামদেশে এত দুধ তাও আবার জার্সি গরুর! বিক্রিবাট্টার সমস্যা চলছিলই। তাই শহরে যাবার মতো বাড়তি সময় না পেয়ে দেয়ালে ক্যালেন্ডারের মতো টাঙানো হয়। সন্ধ্যা প্রদীপ মা যেমন লক্ষ্মী-কালী ঠাকুরের ক্যালেন্ডারে দেখায় সেরকমই যিশুর ছবিকে দেখানো চালু করে দেয়। লক্ষ্মী-কালীর ক্যালেন্ডারে দুটি ভিন্ন বছরের সূর্য চন্দ্র তাদের গতি নিয়ে উপস্থিত। যিশুতে এসব নেই, বছরের কোনও হিসেব নেই — যেন অনন্ত। আমার কিন্তু ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ছবিটার দিকে তাকালেই মনে হত ক্রুশবিদ্ধ যিশুর পেরেকগুলো ক্ষয়ে যাবার শব্দ উঠে আসছে। তাই ভয় হত পেরেক আলগা হলে যদি যিশু নেমে আসেন। লক্ষ্মী-কালী যে স্থির তা মোটামুটি জানা হয়ে গেছে ঘরে অনেকদিন আগে থেকে টাঙানো বলে।

বড়দিনের উৎসবে আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তার দুদিন আগে বাবা গোয়ালে সাপের দংশনে মারা যায়। যা কেউ দেখেনি, অথচ দৃশ্যের বিভীষিকা আমাকে এখনও তাড়া করে। সাক্ষাৎ মনসা কালনাগিনীর বেশে জার্সি গরুর দুধ খেতে এসেছিল, সেই ছোবল মেরেছে বাধা পেয়ে। বাবা নাকি গরুর ছটফটানি শুনতে পেয়েছিল ঘুমের মধ্যেই। বিষে কালো হয়ে পড়েছিল গোয়ালে। এই নিথর পড়ে থাকা দেহটার দুঃস্বপ্নে পুনরাবৃত্তি দেখলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর ঘুম আসে না, দেহটা মাতব্বররা দেখে বলেছিল হাসপাতালে নিয়ে গেলে শুধু শুধু কাটা ছেঁড়া হবে দেহটা, তবে ওঝার একটা মতামত জেনে নেওয়া হোক।

ওঝা এসেই বাবার শরীরের ওপর সিঁদুর দিয়ে একটি টেলিফোন আঁকে, হৃদপিণ্ড জুড়ে নীল রং। তার মধ্যে লালরঙের টেলিফোন, সেখান থেকেই সরাসরি মনসাকে ডায়াল করে মনসাকে ধরবার চেষ্টা চালিয়ে যায়। ডায়াল-রিডায়াল করে যখন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন চরম খিস্তি — তোক দেখি তোর বাপ কামাতুর হইল, রমনের ইচ্ছেয় তোর বাপ ধাইয়া আইল। কোনদিকে তোর মন — তার মধ্যে এক সময় বলে ওঠে —

‘অনন্তর জানটা নিয়ে নিলি? কী বললি, জার্সি গরুর দুধ খাইবার ইচ্ছে হইছিল। এ কী বললি মা, দেশি গরু ছাড়ি বিদেশি গরুর দুধ! কুনোদিন খাস নাই। টেস্ট করবার চাইছিলি? তাই বলে একজন মানুষের জেবন? বাধা দিল যে — মান্দাসে ভাসানো।’

এরপর কলাগাছের মান্দাস তৈরি। ওঝা নিজের হাতে আলতা দিয়ে এঁকে দেয় পতাকাতে ছবি। এক রমণী, তার হাতে ছিপ, বঁড়শিতে গেঁথে আছে এক মাছ। আর বিড় বিড় করে বলে — মাছ মনসা ঘরে তুললে অক্ষয় স্বর্গবাস, বঁড়শি থেকে মুক্ত করলেই মুক্তি।

শীতে নদী টানহীন। যেটুকু চোরা স্রোত ছিল তা শীত পড়তে না পড়তেই হয়ে গেছে জরদগব। লগিতে ঠেলে নিয়ে গেলে মান্দাস ভাসবে নচেত নয়। জলের কী বিলিব্যবস্থা তার সঠিক তথ্য না থাকায় চরে মান্দাস দাঁড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃতদেহের বিলিব্যবস্থা করা হবে মেম্বার জানিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট হয়ে যায় ভাসতে ভাসতে যদ্দুর যাওয়া যাবে ততদূরই যেন মৃতের পথ।

এসব চিন্তার মধ্যেই একজন উস্কে দেয় — অনন্ত তো খেরস্তান হইছিল?

–হয় নাই বড়দিনে হবার কথা ছিল

–তার আগেই সব শ্যাষ, জয় বিষহরি

–যিশুর তো ডাহা লস, দাদনের কি হবি এখন? দশ লিটার দুধ দিত গাইটা

মেম্বারটা এবার উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলে — সে দেখা যাবে-খন।

পরীক্ষামূলকভাবে মান্দাস ভাসিয়ে দেখা গেছে একচুলও নড়ছে না। যেখানে ছিল সেখানেই স্থির। তা দেখে ওঝা বলে উঠেছিল — যাবার চাইছে না, বড্ড মায়া, এ লিশ্চয় লখিন্দর হইয়া ফিরা আসপি।’

তখনই মেম্বারের মাথাতে পঞ্চায়েতের ডিঙি নৌকার কথা মনে পড়ে যায়। ডিঙি থেকে লগি দিয়ে মান্দাসে ধাক্কা মারলেই চলতে শুরু করবে। ভেসে যাওয়াটাও সচল থাকবে।

কিন্তু মা একপ্রস্থ সিঁদুর মাথায় দিয়ে ডিঙিতে চেপে বসে, আমিও কিছু না ভেবেই ডিঙিতে উঠেছিলাম। পরে প্রমাণ হয়েছিল এটা একটা বুদ্ধিমানের মতন কাজ হয়েছিল। একসময় ডিঙি থেকে লগি মেরে মান্দাস ঠিকঠাক চলছিল না। মাঝে মধ্যে এদিক ওদিক লগির ঠেলা খেয়ে একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তখনই ঠিক হয় ডিঙি ও মান্দাসকে একসঙ্গে বেঁধে দিলে ডিঙি চললে মান্দাসও চলবে। সেই বাঁধাবাঁধির সময় মাঝিকে সাহায্য করতে পেরেছিলাম। এইভাবে চলতে চলতে এক বেলার মধ্যে বর্ডারে পৌঁছে যাই।

মাঝি ধীরে ধীরে পাড়ের কাছে ডিঙি নিয়ে এসে বিএসএফ ক্যাম্পের দিকে চিৎকার জানান দেয় — মান্দাস ভাসি যাইছে গো…

বিএসএফের নজরেই ছিল সবকিছু। তারা ঠিক কী করা উচিত এক্ষেত্রে বুঝে উঠতে না পেরে অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু মাঝির চিৎকার শেষ হবার আগেই বলে উঠেছিল — হল্ট।

আর এক লগি বা দুই লগি ঠেলা দিলেই মান্দাস বর্ডারের ওপারে চলে যাবে। এই দূরত্বে দাঁড়িয়ে সেদিন শুধু মনে হয়েছিল এপারের নদীর জল ওপারে, তারপর নয়নবিল, পদ্মানদী হয়ে মহাসমুদ্র। দেশের এই জলে মনসা না দেখা দিলে বাংলাদেশের জলে কি দেখা দেবে? মহাসমুদ্রে তো উঁচু উঁচু ঢেউয়ের মাথাতে মান্দাস নাচবে, মনসা কি পারবে সেই প্রাণ ফিরিয়ে দিতে? একটাই ভরসা নদীর মোহনায় জোয়ার ভাঁটার খেলা চলে সেই খেলাতে যদি মান্দাস মেতে ওঠে এবং খেলাচ্ছলে ভাটিতে গেলে তখন অবশ্য কিছু সময় পাবে মনসা। তখন যদি কিছু হয়!

ঠিক সন্ধের মুখে বিএসএফ ডিঙি থেকে মান্দাস বিচ্ছিন্ন করবার হুকুম দিল। রাত একটু গড়ালে লগি দিয়ে ঠেলা মারার হুকুম। মান্দাস ওপারে চলে গেছে কিনা তীব্র আলো জ্বালিয়ে দেখে নিয়ে বলে ওঠে — ঠিক হ্যায়। যে যাত্রার সূচনা করেছিল মেম্বার মান্দাসে লগির ঠেলা দিয়ে তা শেষ হয়। তখনই মা প্রথম ও শেষবারের মতো ডুকরে ওঠে — এমিলি ছন্দা সরকারের বেহুলা হইবার সখ চাগাছিল — আরে অমূল্য তোর বাপ ব্ল্যাক হইয়া ওপারৎ চলি গেল, কাঁদ বাপ একবারের জন্যি কাঁদ –। এই কান্নাও থামে বিএসএফের হুকুমে। চোপ।

ডিঙা উজানে, আসবার সময় যে শক্তিতে লগি ঠেলতে হয়েছিল এখনও সেই। প্রায় একইরকম শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছে ফেরার পথে। যাওয়া আসার মধ্যে যেন কোনও পার্থক্য নেই। সঙ্গে মান্দাস না থাকলে কী হবে, মা যে শোকে পাথর। এরও যেন জ্ঞান আছে। পিছনে ক্যাম্পের আলো জলের গভীরে চলে গিয়েও কাঁপছে। তা দেখে মা আরও একবার ডুকরে উঠতে গিয়েও ঢোঁক গিলে নিল। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে মাঝি বলল — একটু পরেই চাঁদ উঠবি। তখন এর থিকে জোরে যাওয়া যাবি।

জল, নদীর তীর, আবছা অন্ধকার। কোথাও কেউ নেই। যাবার সময় কত মানুষ দু’পাড়ে। জয় বিষহরি, হুলুধ্বনি, শঙ্খে একাকার ছিল। এখন কিছুই নেই। যেন যে যায় সেই যায়, ফিরবে না বলে কেউ নেই।

একসময়ে চাঁদও ওঠে — ডিঙা কিছুটা গতি পায়। বাড়িতে পৌঁছেই মা গোয়ালের দিকে ছুটে যায়। শূন্য গোয়ালে জার্সি গরু নেই দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। মাথার উপরে যে চাঁদ সেদিকে লক্ষ্যই নেই, এই অবস্থায় নিজেকে তুলে নিয়ে রাতারাতি বৈধব্যে পৌঁছে যায়।

পাদ্রি মেম্বারকে ঘাটাতে মানা করা সত্ত্বেও কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর মা একদিন সাতসকালে মেম্বারের দেখা পেয়ে যায় বাড়িতেই। কোনওরকম সুযোগ না দিয়ে বলে ওঠে — লোকটা চলি গেল এদিকে জার্সি গরুটাও হাওয়া। লোকটাকে না হয় বিষহরি দংশাইছিল কিন্তুক গরুক কি গিলি খাইছে বিষহরি?

নিরুত্তর মেম্বারকে বসিয়ে রেখে মা বাড়ি এসে দরজায় তালা দিয়ে গির্জায় চলে আসে। কেন যেন মনে হল পাদ্রি সবকিছুই জানেন, তা সত্ত্বেও আরও একবার শুনছেন কেননা তিনি ছিলেন নির্বিকার। এইভাবেই উঠে গিয়ে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর সামনে মোমবাতি জ্বেলে যোশেফ অনন্ত সরকারের জন্য প্রার্থনা করেন এবং আমাদের শিখিয়ে দেন কীভাবে ক্রশচিহ্ন শূন্যের ভিতর আঁকতে হয়।

এরপর একদিন সুযোগ বুঝে মা বলেছিল — ঘরের চাল ডাল শুধা শুধা পচিছে, আনবার ব্যবস্থা করলি হয়।

–হবে হবে সব হবে, প্রভুর অসীম দয়ায় আবার জার্সি গরুও হবে।

তারপর কোনও প্রশ্ন না করে আমরা প্রতিদিন সুসমাচার শুনতাম। শুনতে শুনতে কোনও কোনও দিন ঘুমিয়েও পড়তাম। যদি সুসমাচারে নরকের বর্ণনা থাকে তা স্বপ্নে দেখা দিত, মাটির নীচেই তার অবস্থান। ঘুম ভাঙলেই নানান বিভ্রান্তি, কতখানি মাটির ভিতরে নরক? কেন না কুঁয়ো তৈরি নিজের দেখা, খননকারীরা একে বলে জলের প্রথম স্তর। শ্যালো, ডিপটিউবওয়েল বসানো দেখবার পর মনে হয়, জলের কতরকম স্তর আছে? তখন মনে হয় জগৎটাই মাটির নৌকা। প্রথম স্তর থেকে শুরু করলেই খেই হারিয়ে নৌকায় ভেসে যাবার প্রথম মুহূর্তে টাল সামলে স্থির হয়ে ভাবি মাটির কত গভীরে নরক! যেন পৃথিবীর মূলেই নরক। তার ওপরে আমরা।

ইদানিং স্বপ্নে মাটির গভীরে বিভিন্ন জলস্তর উঠে আসে, চোখ মেলে তাকাতেই ঘুম ভেঙে যেত। আর ঘুম আসত না। কিন্তু মা ঘুমের মধ্যে বলে চলেছে — জার্সি গরু দুধের বন্যায়… শুধু দুধ আর দুধ — দুধের মধ্যে সাঁতার কেটে কী সুখ।

একদিন স্বপ্নে মাটির গভীরে, মনে হয় নরকের কাছাকাছি জলস্তর থেকে একটি শূন্য ডিঙাকে ভেসে উঠতে দেখি। পাদ্রিসাহেবকে তা বলতেই তিনি বলে ওঠেন — ওটা নোয়ার নৌকা।

সুসমাচারে আছে পৃথিবীতে প্রবল বন্যার সময় নোয়া নৌকায় তুলে নিয়েছিলেন মানুষ থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কিছুর নমুনা। তারপর আবার নতুন করে সব কিছুর শুরু।

স্বপ্নে এসব থাকে না, শুধু জলের এ স্তর থেকে অন্য স্তরে শূন্য ডিঙা ছোটাছুটি করে। এভাবে চলতে চলতে একদিন স্বপ্নে দেখি, নদীতে প্রবল বন্যার তোড়ে মেম্বারের বাড়িঘর সমেত জার্সি গরুটা ভেসে যাচ্ছে।

এটা যে স্বপ্ন নয় সত্যি একথা মেম্বার নিজের মুখেই বলেছিল। সব শুনেটুনে বলেছিলাম — আমেন। মেম্বারের চোখ মুখ বলে দিচ্ছে কিছুই বোঝেনি; ‘তথাস্তু’ বললেও যে বুঝত তার ঠিক না থাকায় সোজা বাংলায় বললাম — তবে তাই হোক।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...