স্বপন ভট্টাচার্য
ধ্রুপদী গোত্রচিহ্নটির সঙ্গে বিবর্তনশীলতার সম্পর্ক কিছুটা তেল ও জলের মতো বলেই জেনে এসেছি আমরা। অর্থাৎ যে-অর্থে সংস্কৃত বা ল্যাটিন ধ্রুপদী, বাংলা বা ওড়িয়া বা মারাঠিকেও কি সেই অর্থে ধ্রুপদী বলা সঙ্গত? সাধারণভাবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী সুবিস্তৃত প্রভাব ফেলেছে যে ভাষা, যার শব্দগুলি অন্য অনেক ভাষার শব্দভাণ্ডারে সংযুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে যা কথ্যভাষা নয়— এমন ভাষাকেই ধ্রুপদী বলে ভাবা হয়। তাহলে যে-অর্থে গ্রিক, ল্যাটিন, চাইনিজ, আরবি বা সংস্কৃত ভাষাকে ধ্রুপদী মানা হয় বাংলা বা অহমিয়া বা ওড়িয়া ভাষাকে কি সেই একই অর্থে একই তকমা দেওয়া যায়? আমরা কি ভাবতেও চাই যে বাংলা, ধরা যাক, কালে কালে, কেবল লক্ষ্মীর পাঁচালিতে আটকে পড়ল? চাই না তো! তাহলে আমরা ধ্রুপদী তকমা পেয়ে এত পুলকিত হয় পড়লাম কেন?
এডওয়ার্ড স্যাপির (১৮৮৪-১৯৩৯) সেই কবে তাঁর ‘ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে বলেছিলেন ভাষা হল আদতে একটি সাংস্কৃতিক ইনহেরিটেন্স, বায়োলজিক্যাল ইনহেরিটেন্সের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। অতি সম্প্রতি কেন্দ্রের সরকার বাংলা ভাষাকে অন্যতম ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর আমরা, অর্থাৎ বায়োলজিক্যাল বাঙালিরা যে আহ্লাদ অনুভব করছি তার সঙ্গে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সম্পর্ক কার্যত এতটাই ব্যস্তানুপাতিক যে স্যাপির সাহেবকে বলাই যেতে পারত, মশাই আপনি এইসব সিদ্ধান্ত প্রণয়নের আগে একবার বঙ্গভূমি ঘুরে আসুন। ভাষা যে সংস্কৃতির এক বিবর্তনশীল উপাদান তা-ও বলেছেন তিনি। ধ্রুপদী গোত্রচিহ্নটির সঙ্গে বিবর্তনশীলতার সম্পর্ক কিছুটা তেল ও জলের মতো বলেই জেনে এসেছি আমরা। অর্থাৎ যে অর্থে সংস্কৃত বা ল্যাটিন ধ্রুপদী, বাংলা বা ওড়িয়া বা মারাঠিকেও কি সেই অর্থে ধ্রুপদী বলা সঙ্গত? সাধারণভাবে দীর্ঘ সময়ব্যাপী সুবিস্তৃত প্রভাব ফেলেছে যে ভাষা, যার শব্দগুলি অন্য অনেক ভাষার শব্দভাণ্ডারে সংযুক্ত হয়েছে এবং বর্তমানে যা কথ্যভাষা নয়— এমন ভাষাকেই ধ্রুপদী বলে ভাবা হয়। ধ্রুপদী ইউরোপিয়ান স্টাডিজ-এ কেবলমাত্র গ্রিক এবং ল্যাটিনকেই ধ্রুপদী ভাষা বলে মনে করা হয় যা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের সাহিত্যচর্চার ভাষা ছিল। আধুনিক গ্রিক তার অন্তর্নিহিত শক্তি বিবর্তনের সাপেক্ষে অভিযোজনের জেরে অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছে, কিন্তু ল্যাটিন ধ্রুপদী হলেও স্থাণুবৎ। তবে, ল্যাটিন উৎসের বাইরে থেকে শব্দ ধার করে ইংরেজি বা ফরাসি বা ইতালিয়ান একটা বাক্যও সম্ভবত সম্পূর্ণ হবে না। একইভাবে প্রাচীন চাইনিজ ভাষার সাহায্য না নিয়ে একজন জাপানি বা একজন কোরিয়ান একটা সম্পূর্ণ বাক্য দাঁড় করাতে পারবেন বলে মনে হয় না। আরবি ছাড়া উর্দু বা পার্সিয়ান বা কুর্দ বা সোহেইলি এবং অবশ্যই কথ্য হিন্দির বাক্যরচনা মুশকিল। এবং অবশ্যই সংস্কৃত। পালি, প্রাকৃত বা উত্তরভারতের ভাষাগুলি যেমন হিন্দি, মারাঠি ইত্যাদি ছাড়াও ইন্দোচিনের একটা বড় অংশের ভাষায় এমনকি জার্মান বা ফরাসির মতো একই ইন্দো-ইউরোপিয়ান পরিবারের ভাষাগুলিতে সংস্কৃতের নিশ্চিত প্রভাব রয়েছে। তাহলে যে অর্থে গ্রিক, ল্যাটিন, চাইনিজ, আরবি বা সংস্কৃত ভাষাকে ধ্রুপদী মানা হয় বাংলা বা অহমিয়া বা ওড়িয়া ভাষাকে কি সেই একই অর্থে একই তকমা দেওয়া যায়? আমরা কি ভাবতেও চাই যে বাংলা, ধরা যাক, কালে কালে, কেবল লক্ষ্মীর পাঁচালিতে আটকে পড়ল? চাই না তো! তাহলে আমরা ধ্রুপদী তকমা পেয়ে এত পুলকিত হয় পড়লাম কেন? পড়লাম কারণ একটা ভাষা-রাজনীতির শিকার হয়ে বসেছিলাম আমরা অনেক দিন ধরে, সেটা একরকম অ্যাড্রেস করা হল বলা যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই! ভাষাবিশ্বে এতে ইতরবিশেষ কিছু পরিবর্তন হবে না দৃষ্টিভঙ্গির, এমনকি ভারতের বাইরে যে ষোলো-সতেরো কোটি লোক বাংলাভাষায় কথা বলে, বিদ্যাচর্চা করে, লেখাজোকা করে তাদেরও সাহিত্যের ইতিহাস নতুন করে লেখার দরকার হবে বলে মনে হয় না।
ভারতে ধ্রুপদী তকমা লাগানোর শুরুটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট ফর ক্লাসিকাল তামিলের ভাইস চেয়ারম্যান ভিসি কুলন্দাইস্বামী এই শতাব্দীর গোড়ায় ইউনেস্কোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক কোনগুলি এবং কোন কোন মানদণ্ডে তাদের সে খেতাব জুটেছে! ইউনেস্কো জানাল ধরাবাঁধা কোনও নিয়ম নেই যার ভিত্তিতে ক্ল্যাসিক্যালত্ব নির্ধারণ সম্ভব, এবং তথাকথিত ধ্রুপদী বা ক্লাসিক্যাল ভাষা বলে দু-একটিকে দেখানো হয় বটে, কিন্তু কোনও ধরাবাঁধা শর্ত পালন করে তাদের সে জায়গায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে এমন নয়। সুতরাং মাঠ ফাঁকা দেখে তামিল ভাষাকে ভারতের প্রথম ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা এনে দিতে সচেষ্ট হল তামিলনাডু। ২০০৪ সালে ইউপিএ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর তামিল ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষা ঘোষণা করবার জন্য সাহিত্য অ্যাকাডেমি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। তারা জানাল যেহেতু ধ্রুপদী ভাষা নির্ধারণের জন্য কোনও শর্তাবলি নেই, সেই কারণে যে-ভাষাগুলি সর্বসম্মতভাবে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃত, সেগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্যই ধ্রুপদী ভাষার বৈশিষ্ট্য ধরা যেতে পারে। এর নিরিখে সাহিত্য অ্যাকাডেমির বিশেষজ্ঞ কমিটি তিনটি প্রধান শর্তকে ধ্রুপদী ভাষার বৈশিষ্ট্য রূপে নির্ধারণ করেন:
১) ভাষাটির প্রাচীনত্ব। অন্তত এক হাজার বছরের লিখিত ইতিহাস।
২) প্রাচীন সাহিত্যপরম্পরা যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দ্বারা মূল্যবান ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।
৩) ভাষাটির মৌলিকত্ব যার প্রমাণ সেটির প্রাচীন সাহিত্যে প্রতিভাস এবং অন্য ভাষা থেকে ধার করা নয়।
ইউপিএ-১ সরকারের হাতে ২০০৪ সালে প্রথম ধ্রুপদী ভারতীয় ভাষা হিসেবে তামিল স্বীকৃত হয়ে গেল। ২০০৫ সালে শর্তগুলো একটু অদলবদল করা হল। বলা হল ভাষাটির লিখিত টেক্সট অন্ততপক্ষে ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরনো হতে হবে এবং চতুর্থ একটি শর্ত আরোপিত হল:
৪) ধ্রুপদী ভাষা ও সাহিত্য বর্তমান ভাষা ও সাহিত্যের থেকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক হতে হবে।
ইন্দো-ইউরোপিয়ান উৎসের সংস্কৃত ভাষাকে ২০০৫ সালেই এবং দ্রাবিড় উৎসের অন্য দুটি ভাষা— কন্নড় এবং তেলুগু ভাষাকে ২০০৮ সালে এই তালিকায় নিয়ে আসা হল। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের নির্বাচনের ঠিক আগে আগেই এই ঘোষণা এসেছিল। ঠিক একইভাবে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে মালয়ালাম ও ওড়িয়া ভাষাকে এই তালিকায় নিয়ে আসা হয়।
২০২৪-এ সাহিত্য অ্যাকাডেমি বাংলা-সহ বাকি ভাষাগুলির জন্য যে শর্তাবলি নির্ণয় করেছিল তাতে চতুর্থ শর্তটি একটু অদলবদল করে বলা হল— “দি ক্লাসিক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড লিটারেচার কুড বি ডিস্টিংক্ট ফ্রম ইটস কারেন্ট ফর্ম অর কুড বি ডিসকন্টিনিউয়াস উইথ ল্যাটার ফর্মস অফ ইটস অফসুটস।” অর্থাৎ ফর্মের তফাৎ কেবল নয়, উৎস ভাষাটির থেকে উৎসারিত শাখাসমূহের বর্তমান ধাঁচ পূর্বের ধাঁচের থেকে মাঝপথে কোথাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার দরুন যদি সম্পূর্ণ আলাদাও হয়, তথাপি ধ্রুপদী মর্যাদা পেতে তা বাধা হবে না। এবং এই শর্তাবলি পালিত হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায় বাংলা ছাড়াও আরও চারটি ভাষা, যথাক্রমে পালি, প্রাকৃত, অসমিয়া, মারাঠির জন্য। ৩ সেপ্টেম্বরের ঘোষণাটি এল বর্তমান সরকারের গেজেট নোটিফিকেশনে। এক কথায় ভারতীয় ভাষাসমূহের মধ্যে যাদের ডিপরুটেড অ্যান্টিকুইটি এবং ভাস্ট লিটারেরি ট্র্যাডিশন রয়েছে, ভারতের সাংস্কৃতিক বুনোটে যারা দেড় দু-হাজার বছর ধরে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এসেছে, একদিকে তাদের প্রোমোশন, প্রোগ্রেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর সুযোগ বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে “টু এনসিওর দেয়ার কন্টিনিউড রেলেভ্যান্স ইন দ্য মডার্ন ওয়ার্ল্ড।” এই দ্বৈত উদ্দেশ্য সাধনে সরকারি উদ্যোগের নামই হল ভারতীয় ধ্রুপদী ভাষা প্রকল্প। মনে হওয়া স্বাভাবিক, ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী দেশে বিশেষ কয়েকটিকে বেছে নেওয়ার এই রসায়ন কোনও কালেই অবিতর্কিত হওয়ার কথা নয়, হয়ওনি। কালে কালে এটা সংরক্ষণ রাজনীতির চেহারা না নেয়, এই আশঙ্কা থেকেই যায়, বিশেষত প্রকল্পটির সঙ্গে যখন বাজেট ও ফান্ড অ্যালোকেশনের সম্পর্ক রয়েছে। সরকারের তরফ থেকে ইতোমধ্যেই কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেখা যেতে পারে। ২০২০-তে সংস্কৃত ভাষার প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনটি নতুন সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা ঘোষিত হয়েছিল। এগুলো হবে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়য়। আগেই বলা হয়েছে এই উদ্যোগের শুরুই হয়েছিল তামিল ভাষার হাত ধরে। বাজেটের সিংহভাগ এখনও তামিলের জন্যই বরাদ্দ থাকে। কাজ করছে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ক্লাসিক্যাল তামিল। কন্নড়, তেলুগু, মালায়লাম ও ওড়িয়ার জন্য মাইসুরুর সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস্-এর অধীনে আলাদা আলাদা সেন্টার অফ এক্সেলেন্স গড়ে তোলা হয়েছে। ধ্রুপদী টেক্সট-এর অনুবাদ, পাঠোদ্ধার, রিসার্চ ইত্যাদির নিমিত্ত অর্থ-সংস্থান, বিশ্ববিদ্যালয়ে চেয়ার পদ তৈরি করা, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি ধ্রুপদী ভাষায় চোখে পড়বার মতো কাজের জন্য পুরস্কার ঘোষণা ইত্যাদি নানা সুযোগের কথা সরকারি নোটিফিকেশনে আছে। যদিও, উচ্চশিক্ষায় সামগ্রিকভাবে বাজেট সংস্থান ক্রমহ্রসমান। বস্তুত যে টাকা এই ধ্রুপদী ভাষাচর্চার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে এতাবৎকাল, তা অতি সামান্য। ভাষাচর্চাকে নেহাৎ বামহাতের ফুল দিয়ে প্রণামী না দিলে এত অল্প টাকায় বড় কোনও কাজ যে হওয়ার নয় তা সরকার জানে, সকলেই জানে, কিন্তু প্রশ্নটা যখন অস্মিতার তখন বিধেয় যে উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে যাবে তা আর বড় কথা কী! এসব সত্ত্বেও বাংলা যখন এই তালিকায় প্রচুর টালবাহানার পরে ঢুকেছে তখন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার তাগিদ থাকলে বেশ কিছু সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে, কারণ ঘোষিত এগারোটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা যে-কোনও অর্থেই সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত। সারা দুনিয়ায় ত্রিশ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে এবং শুধু বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক একটি দেশ রয়েছে (যদিও এই মুহূর্তে সে-দেশের বা সে-দেশে বাংলা নামক ভাষাটির গতিপ্রকৃতি ও ভবিষ্যৎ আন্দাজ করা যাচ্ছে না) যা তালিকার অন্য যে-কোনও ভাষার তুলনায় বাংলাকে একটি ঈর্ষণীয় আন্তর্জাতিক ফুটপ্রিন্ট দিয়েছে। সুতরাং কিছু উন্মোচনের সুযোগ তো রয়েছেই। কথাটা হল সদিচ্ছা রয়েছে কি না। সদিচ্ছা এই বঙ্গের আজকের বাঙালির এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের।
বাংলা ভাষার ধ্রুপদী স্বীকৃতি পাওয়া ঠিক কার বা কাদের কৃতিত্বে তা নিয়ে কিছু দাবি এবং পালটা দাবির কথা শোনা যাচ্ছে। জানা গেল, বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব প্রমাণে রাজ্য শিক্ষা-দফতরের অধীনস্থ ভাষা গবেষণাকেন্দ্র ২০০০ পাতার থিসিস জমা দিয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মহাস্থানগড় শিলালিপি, ব্রাহ্মী লিপি, ঐতেরেয় ব্রাহ্মণে বঙ্গীয় নজির ইত্যাদি প্রমাণ যদি একত্রিত করে আজকে জমা দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে আগে হয়নি কেন তা বোঝা মুশকিল, কেননা এর কোনওটাই তো সদ্য-আবিষ্কৃত নয় এবং কৃতিত্বের দাবিদাররাও যে এগুলি মৌলিক গবেষণায় খুঁজে বার করলেন এমনটাও নয়! এই প্রথমবার কি এ দাবি জানানো হল? না, একেবারেই তা নয়! ২০০৪ সালে তামিল ভাষাকে যখন প্রথম শাস্ত্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয় তখনই তৎকালীন রাজ্য সরকার প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠিচালাচালি করেছিলেন, যেমন বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছিলেন সংস্কৃত স্কলাররা এবং সাধারণ মানুষও, ‘শাস্ত্রীয়’ তালিকায় সংস্কৃতের জায়গা না হওয়ার জন্য। তা হলে কি প্রথা মেনে দাবিটা পেশ করা হয়নি এর আগে? প্রাচীনত্ব নির্ধারণে রাজনীতি ছিলই কেননা হিন্দি-আগ্রাসনের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে দ্রাবিড় উৎসের ভাষাগুলির মর্যাদা প্রেক্ষণের একটা দায় তো ইউপিএ সরকারের ছিলই, ফলে ২০০৮-এর মধ্যেই তামিল ছাড়াও বাকি প্রধান দ্রাবিড়িয়ান ভাষাগুলির জন্য এই তকমা এসে যায়। একই সঙ্গে বাংলাকে অন্ধকারে রেখে ওড়িয়ার স্বীকৃতিও অবাক করে দেওয়ার মতো কারণ বামফ্রন্ট তখন ইউপিএ সরকারের অংশ এবং নামকরা বাংলা ভাষাবিশারদরা তখন শিক্ষাজগতে জাজ্বল্যমান। জানি না, আমেরিকার পরমাণু না হয়ে দেশের ভাষার অছিলায় ফ্রন্টের সদস্যরা সরকার ছাড়লে আজ এমন দিন দেখতে হত কি না! একটা গা-ছাড়া ভাব ছিল বলেই মনে হয়— ‘কী হবে আমার ওই শচীনের শতরানে!’ সর্বভারতীয় বাংলা ভাষা মঞ্চও অনেকদিন ধরেই এই দাবি জানিয়ে আসছে। পার্লামেন্টে মেনশন হয়েছে আগেও অনেকবার। কিন্তু গবেষণায় বিজ্ঞানসম্মত মেটেরিয়ালস অ্যান্ড মেথডস্ বলে একটা বিষয় আছে, যা এতদিনে সঠিকভাবে মানা হয়ে থাকলে ভাল। খেটেখুটে ২০০০ পাতা বানানোর জন্যই তো ওঁদের একটা অভিনন্দন প্রাপ্য। এর ফলে স্বীকৃতি জুটলই যদি দায়ও তো বাড়ল এবং সেটা স্বীকার করলে বাংলা ভাষার জন্য সত্যিকারের কিছু কাজ হতে পারে। বাংলা ভাষায় সরকারি কাজ এবং বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ একদম প্রাথমিক স্তরের কাজ যা এখনও হয়ে উঠল না। এ বড় পরিতাপের বিষয়! শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করার সবচেয়ে সহজ ও প্রচলিত ভ্যাকেন্সি হল বাংলার শিক্ষক! কাদের কাছে প্রাইমারির ছেলেমেয়েরা বাংলা শিখছে সেটা যদি গুরুত্বপূর্ণ না হয় তাহলে ভাষাপ্রেম তো ওই শচীনের শতরান! বাংলা ভাষায় শিক্ষাদানের চেষ্টা যে কতটা বুমেরাং হয়েছে তা শিক্ষকতার জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। এখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ, কেননা বহু বাংলা স্কুল উঠে যাওয়ার মুখে। মিড ডে মিল ছাড়া সেখান থেকে পাওয়ার কিছু প্রত্যাশা অভিভাবকেরাও করেন না। প্রাইভেট স্কুল পৌঁছে যাচ্ছে এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামেও। সেখানে শিক্ষার অবস্থা হয়তো বা করুণতর, কিন্তু মিডিয়াম ইংলিশ হলেই হল! এই শিক্ষা-বাতাবরণই তৈরি করছে আমাদের সাংস্কৃতিক বাতাবরণ, ফলে ঠিক কী হবে যে এই তকমায় তা বোঝা মুশকিল! এমনিতে কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP 2020) আঞ্চলিক ভাষাকে উচ্চশিক্ষায় ব্যাপকভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করছে। বিজ্ঞান-বিষয়ক টেক্সটবই সব ভাষাতেই নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে। দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষী বিজ্ঞানশিক্ষকরা বাংলা ভাষায় প্রশ্ন করতে পর্যন্ত কষ্ট পান, সুতরাং পাঠ্যপুস্তক, যা আবার পাঠমধুর হবে ছাত্রের কাছে, তা তো ভাবতেই অসুবিধে হয় এই পরিমণ্ডলে। আ মরি বাংলা ভাষা বললেই কাজ সারা হয় না, সুযোগ যা এসেছে এই স্বীকৃতির ফলে, সেটাকে বাঙালির গর্বে রূপান্তরিত করতে গেলে অনেক কাজ করা দরকার নীতিগত এবং ব্যক্তি-স্তরে। যেভাবে একজন তামিলভাষী বা মালয়ালমভাষী মানুষের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল শাস্ত্রীয়, সেভাবে আমাদেরটাও যে কোনওদিন হয়ে উঠবে তা ভাবাই আপাতত বাতুলতা। তামিল সিনেমা রিলিজ হলে হলে ভাঙচুর হয় আজও, আর আমরা হেসে মরি। সেই আমাদের আধুনিক না বলে ‘শাস্ত্রীয়’ বলায় বাঙালি কি কিছুটা খাটো হয়ে গেল— এমন প্রশ্ন না উঠে যায়! প্রজন্মান্তরে বোঝা যাবে আমাদের সত্যিই কিছু এল-গেল কি না!
*মতামত ব্যক্তিগত