এবার বাড়ি আসুক প্রতিবাদ

রাই

 

 

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার শহরের রাস্তাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে ওঠা প্রতিটি স্বর সজোর এবং সুস্পষ্ট। তাঁদের অবিশ্রান্ত প্রতিবাদ, আবেগ, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের স্পষ্ট দৃঢ়তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে, আমি গর্ব অনুভব করছি। কিন্তু তারপরেই আমাকে ঘিরে ধরছে এক অসহায়তা, বিষাদ এবং বিভ্রান্তি

 

এই লেখাটা লেখার ইচ্ছে ছিল না আমার। অজুহাত খুঁজছিলাম এড়িয়ে যাওয়ার, টালবাহানা করে দেরি করছিলাম, ভাবছিলাম এই করে-করে সম্পাদকরা তাগাদা দিতে ভুলে যাবেন।

হঠাৎই গত সোমবার এক বোনের কাছ থেকে একটা ফোনকল পেলাম। আমার এই বোনটি কর্মসূত্রে বাইরে থাকে। তার ভয়ার্ত গলার স্বর শুনে বুঝলাম তার কোনও প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে। ধীরে ধীরে সে জানাল যে দালালটি তাকে ঘরের সন্ধান দিয়েছিল, ফাঁকা অফিসঘর এবং অন্ধকার সিঁড়ির সুবিধা নিয়ে সে তার শ্লীলতাহানি করেছে। আমরা বাড়িওয়ালাকে জানালাম। তিনি দালাল পরিবর্তন করার ‘ক্ষতি স্বীকার’ করতে রাজি নন। অতএব, নিজের চারদিকে অনেকরকম সুরক্ষার ব্যবস্থা করে সেই দিন থেকে আমার বোনটি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। এখনও তার ভয়, যদি এবার সেই দালাল তাকে দল বেঁধে আক্রমণ করে? কী করবে তখন সে?

এমনিতেই ওই শহর ছেড়ে চলে আসার কথা ওর। অতএব বাড়িটিও ছাড়তে হবে। ফলে বাড়িওয়ালাকে ডিপোজিট মানি ফেরত দিতে হবে। আমরা নিশ্চিত, যাতে আমার বোন যত কম ঝামেলায় অল্প পয়সা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে দেয়, তা নিশ্চিত করতেই এই কুৎসিত ঘটনাটি সে প্ল্যান করেছে দালালটির সঙ্গে। তাদের কাছে এটা একটা ছোট্ট চালাকি।

এই ঘটনার পরও ওদের জীবন এগিয়ে যাবে নিশ্চিত।

কিন্তু আমি জানি যে আমার বোন কোনওদিনই সেই ভয়াবহ স্পর্শগুলো ভুলতে পারবে না। এই আতঙ্ক কখনও যাবে না— সে যতবার খুশি স্নান করুক, যত খুশি থেরাপি সেশন অ্যাটেন্ড করুক, যত কান্নাই কাঁদুক সারা জীবন।

এই আতঙ্ক চিরস্থায়ী।

এই ঘটনাটার কামড়েই এই লেখাটা লিখতে বসা। কারণ, আরজিকরের ঘটনায় মাসাধিক কাল ধরে প্রতিবাদের ঢেউ রাজপথে আছড়ে পড়লেও আমার চারপাশের দুনিয়াটায় বস্তুত কিছুই পাল্টেছে বলে অনুভূত হচ্ছে না।

আমি দেখতে পাচ্ছি আমার শহরের রাস্তাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তিলোত্তমার বিচারের দাবিতে ওঠা প্রতিটি স্বর সজোর এবং সুস্পষ্ট। তাঁদের অবিশ্রান্ত প্রতিবাদ, আবেগ, প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের স্পষ্ট দৃঢ়তা আমার হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে, আমি গর্ব অনুভব করছি। কিন্তু তারপরেই আমাকে ঘিরে ধরছে এক অসহায়তা, বিষাদ এবং বিভ্রান্তি।

আমি এই সমস্ত কিছুই লক্ষ করে যাচ্ছি দূর থেকে, অন্য এক শহর থেকে, যে-শহর দেশের রাজধানী অঞ্চলের কাছাকাছি।

এমন একটা শহরে যেখানে আমি এখনও রাতে একা বেরোতে সাহস করি না। আমি— বলতে লজ্জা করলেও— “রাত দখল করতে পারিনি।” এবং অদূর ভবিষ্যতে আমি সে-চেষ্টা করেও দেখব না।

আমার কথা আপনাদের অপছন্দ হতে পারে। কিন্তু এর সততা নিয়ে সংশয় করবেন না। এবার, এর পরে, আপনি লেখাটি আরও পড়বেন কিনা একান্তভাবেই আপনার শ্রদ্ধেয় ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল।

যাঁরা প্রতিবাদ করছেন তাঁদের মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি আমার বান্ধবীটিকে যে তাদের পার্টিকে তার এক বন্ধু যখন আমাকে যথেষ্ট বিরক্ত করছিল তখন তাকে নিবৃত্ত করেনি। সে আজ চেঁচাচ্ছে— নো মোর সাইলেন্স! আমার বিরক্ত লাগছে। আমার অস্বাচ্ছন্দ্য সেদিন কেন নীরব উপেক্ষাই পেয়েছিল কেবল? তাদের এক বন্ধু মদ্যপান করে মহিলাদের সঙ্গে অভব্যতা করবে— কেন সেটা তাদের কাছে আপত্তিকর কিছু মনে হয়নি? কেন আমাকে তার পাশে বারবার বসতে বাধ্য করা হচ্ছিল যখন কিনা আমি বারেবারেই বলে যাচ্ছিলাম ছেলেটি তার চোখ, তার হাত, তার মন দিয়ে ক্রমাগত আমাকে বিরক্ত করে চলেছে? আমাদের টিজ করে মজা পাওয়াটাই কেন সেদিন তাদের কাছে এত উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল?

তারা এখনও সেই লোকটির বন্ধু। তাদের বন্ধুবৃত্তে, গ্রুপ-চ্যাটে, এখনও ‘রেপ’ শব্দটি ঠাট্টা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কেউ প্রতিবাদ করে না। জীবন চলতে থাকে।

আমার ক্ষতটা কিন্তু থেকে যাবে— চিরদিন।

প্রতিবাদে যত মা-দের, বাবা-দের দেখছি আমার জানতে ইচ্ছে করছে তাঁদের মধ্যে কতজন পুরুষরা যাতে “প্ররোচিত” না হয় সেই জন্য নিজেদের মেয়েদের পোশাক নিয়ে সচেতন হতে বলেছেন? জানতে ইচ্ছে করছে তাঁদের মেয়েরা কি কখনও আত্মীয়স্বজনের হাতে যৌন-নিগৃহীত হওয়ার কথা জানিয়েছে তাঁদের? জানালে তাঁরা কী করেছেন? মেয়েটিকেই “শান্ত হতে” বলেছেন, নাকি সেই লোকটির মুখোমুখি দাঁড়ানোর হিম্মৎ দেখিয়েছেন?

বাচ্চাদের ক্ষতচিহ্নগুলি কিন্তু তাদের সঙ্গে-সঙ্গেই বড় হতে থাকে।

যখন দেখছি পুরুষরা দলে দলে প্রতিবাদে সামিল হচ্ছেন, বুক ফাটিয়ে চিৎকার করছেন, তখন ভাবছি এঁদের মধ্যে কতজন বাড়িতে তাঁদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করেননি? বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের স্ত্রীদের কি নিজেদের মতের ওপর আদৌ আর কোনও অধিকার আছে? আমাদের দেশে বৈবাহিক ধর্ষণ তো অপরাধও নয়!

সেইসব মহিলাদের ক্ষতচিহ্নগুলিও কোনওদিনই মুছে যাবে না।

মেয়েরা দিনে-রাতে আমার শহরের রাস্তায় নিরাপদে ভিড় করছে দেখে মনটা আনন্দে ভরে যাচ্ছে। কিন্তু সেই আনন্দ তক্ষুনি আবার উবে যাচ্ছে যখন ইনস্টাগ্রামে দেখছি এই কলকাতারই কিছু যুবতী মেয়ে একটি মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ছবির জন্য কেবল দিনের বেলার শো-র আবেদন করছে। তাদের বয়ান হুবহু তুলে দিচ্ছি— please do not keep night shows for Kolkata, you know the condition of the city from the news. আমি অবাক হয়ে ভাবি, যখন এই নজরদারি উঠে যাবে, সবাই যখন আবার ঘরে ফিরে যাবে (প্রতিবাদ তো আর চিরকাল চলবে না, চলা উচিতও নয়), তখন কি আমার শহর আর সেরকম নিরাপদ থাকবে?

এই ভয় কোনওদিনও প্রশম হবে না।

একটা পোস্ট সমাজমাধ্যমে কয়েকদিন ধরে খুব ভাইরাল হল। অনেকেই শেয়ার করেছেন, বোধহয় আপনিও। লেখা ছিল— her death showed that Kolkata hasn’t lost her spirit. আচ্ছা, লোকজনকে আবার মানুষ হয়ে উঠতে একটা জীবনের প্রয়োজন হবে? আমাদের সমষ্টিগত বিবেককে ঝাঁকুনি দিতে একজন সুশিক্ষিত মেয়েকে জীবন দিতে হবে? অসংখ্য মহিলা প্রতিদিন গণ-পরিবহনে অভব্যতার শিকার হন, কুইয়ার মানুষদের প্রতিদিন নানা হয়রানির শিকার হতে হয়, পুরুষদেরও নানারকম যৌনহেনস্থার শিকার হতে হয় যা আবার তাঁরা বলতেও পারেন না পৌরুষে আঘাত লাগার ভয়ে, বাচ্চারা নানাভাবে কাছের মানুষদের হাতেই প্রতিনিয়ত নিপীড়িত হয়— কই, এসব তো আমাদের ঘুম নষ্ট করে না!

সেই অগণিত প্রান্তিক মহিলারা, যাঁরা প্রতিনিয়ত ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা, এমনকি নিহতও হয়ে যাচ্ছেন, সেইসব বর্বরতার বিরুদ্ধে আমাদের হৃদয় ক্ষোভে ফেটে পড়ে না কেন?

কারণ, যখন বোঝা যায় যে শিক্ষিত হওয়া এবং ভাল চাকরিবাকরি করার প্রিভিলেজটা আমাদের সেই জন্তুদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারছে না যারা হিংস্রভাবে আমাদের চারপাশে গণ্ডি কেটে রেখেছে, কেবল তখনই সেই আঘাতটা তীব্রতর হয়ে ওঠে।

জানি, যখন আমার সহকর্মীরা, বন্ধুরা, আমার কলকাতার সহনাগরিকরা আশায় বুক বেঁধে লড়ে যাচ্ছেন, আমি তখন কেবল অসহায়তাই উচ্চারণ করে চলছি। কিন্তু আমার যে কেবল এরকমটাই মনে হচ্ছে। একমাত্র যে প্রশ্নটা আমার মাথায় হাতুড়ি মেরে চলেছে সেটা হল— এর পরে কী?

ক্ষতচিহ্নগুলি নিরাময়ের একটাই পথ— সেগুলিকে ঘটতে না দেওয়া। এই একটি কারণেই আমার এই লেখাটা লেখা। যাঁরা এটা পড়লেন, তাঁদের একটাই অনুরোধ— এবার বাড়ি আসুক প্রতিবাদ।

যে-সব ‘বন্ধু’রা মেয়েদের একতাল মাংস কেবল মনে করে তাদের মুখের ওপর বলার এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সাহস অর্জন করি।

নিজের নির্যাতিতা কাজিন বা বন্ধুটিকে এই কথা বলার সাহস রাখি যে সে মলেস্টারদের বিরুদ্ধে যে-সিদ্ধান্তই নিক না কেন, আমরা তার পাশে আছি। কারণ প্রতিটি ভিকটিমের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়।

যে-সব আত্মীয়রা আমাদের সন্তানদের গায়ে অন্যায়ভাবে স্পর্শ করছে তাদের তাড়িয়ে দেওয়ার হিম্মৎ রাখি।

নিজেদের ছেলে, ভাই বা বন্ধু যখন তাদের স্ত্রীদের নিজের সম্পত্তির মতো আচরণ করবে মুখের ওপর তার প্রতিবাদ করি।

এবার বাড়ি আসুক প্রতিবাদ।

না হলে “জাস্টিস ফর তিলোত্তমা” শুধুমাত্র একটা তিলোত্তমার জন্য ন্যায়বিচারের দাবি হিসেবেই থেকে যাবে। এই ঐতিহাসিক আন্দোলন থেকে যাবে শুধুমাত্র একটা খবর হয়ে। আর সামনের বহু শতাব্দী ধরে আরও বহু মন এবং হৃদয়ে ওই দগদগে ক্ষতচিহ্নগুলি আঁকা হতে থাকবে।

এ-প্রতিবাদ যেন একটা আবেগী আন্দোলন হিসেবেই না থেকে যাকে যায়, বরং সর্বস্তরে এক গণজাগরণ হয়ে ওঠে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...