আমরণ অনশন চরম ‘অস্ত্র’, তা প্রয়োগে ‘কৌশলী’ হওয়া দরকার বন্ধু

শুভ প্রতিম

 


‘বাঙালিকে খেপাইও না’ কথাটা এখন প্রবাদতুল্য। একবার খেপালে কী হয় তা দেখেছে ৪৭-এর আগের ভারতবর্ষ, ৭১-এ পূর্ববাংলা, হালফিলের বাংলাদেশ। এই ধারাবাহিকতায় প্রমাদ গোনে শাসক, পালিয়ে বাঁচে হাসিনা। তাই ভয় পেয়েছে শাসকদল। ‘সেনাপতি’ এনকাউন্টার ছেড়ে এখন নির্বাক চলচ্চিত্র। ভয় পেয়েছেন মমতা। তাই ভাল হত যদি উৎসবের মরসুমে আন্দোলন বজায় রেখে অনশনের মতো বড় কিছু এখনই না করা। সমাজ-মন উৎসব-উত্তর পর্বে আরও ‘প্রস্তুত’ হয়ে উঠত। এ অবশ্য আমার নিজস্ব বোধ

এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।।

অনশনকে ‘সত্যাগ্রহের বড় অস্ত্র’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন মহাত্মা গান্ধি। তবে অনশন ছিল তাঁর কাছে আত্মবলিদানের আধ্যাত্মিক অনুশীলন, কোনও রাজনৈতিক লাভালাভের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সারা ভারতবর্ষ জানে তাঁর অনশন ঘোষণা কতটা প্রভাব ফেলত জনজীবনে। কতটা কাঁপিয়ে দিত ব্রিটিশ সিংহাসন। পরাধীন ভারতে প্রায় ২০ বার অনশনে বসেছিলেন তিনি, একবার তো টানা ২১ দিন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে তাঁকে আটক করার প্রতিবাদে। স্বাধীন দেশে পট্টি শ্রীরামালুর অনশনের কথা আমরা জানি। ১৯৫২ সালের কথা, স্বতন্ত্র ‘অন্ধ্রপ্রদেশ’-এর দাবিতে অনশনে বসেছিলেন তিনি, ৫৮ দিনের আমরণ অনশনের শেষে মৃত্যু হয় শ্রীরামালুর। চারদিকে সহিংস প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত ১৯৫৩ সালে মাদ্রাজ স্টেট থেকে ভিন্ন হয়ে নতুন রাজ্য হিসাবে জন্ম নেয় অন্ধ্রপ্রদেশ। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বে সারা দেশে অনশনকে দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে আমরা দেখেছি। যুগপৎ দেখেছি তার সাফল্য ও ব্যর্থতা। পশ্চিমবাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলে ২০০৬ সালে টানা ২৬ দিন অনশন ছিল তাঁর রাজনৈতিক লাভ আদায়ের বড় চাল। তটস্থ বামফ্রন্ট সরকার কার্যত কোলাপ্স করতে শুরু করে তারপর থেকে। মজার কথা হল সেই স্থানের অনতিদূরেই জুনিয়র ডাক্তারদের আমরণ অনশন শুরু হয়েছে। এতদিন মাদ্রাসা শিক্ষকদের হোক বা এসএসসি চাকরিপ্রার্থীদের অনশনে তোয়াক্কা করেননি মমতা। কিন্তু এবারের ললাটলিখন যাই হোক, সরকার বেশ চাপে। নবান্ন-স্বাস্থ্যভবনের ধর্নামঞ্চ-কালীঘাট পর্বের দৌড়ঝাঁপ ও চেয়ারটেবিল নিয়ে অপেক্ষা সেই বার্তাই দেয়, চাপে আছেন তিনি।

‘রাতদখল’-এর আন্দোলন দুই মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে। আন্দোলন মূল্যায়নের সময় হয়তো এখনও আসেনি, এটি এখনও ‘ঘটমান বর্তমান’। তবে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলায় অন্যতম বড় গণআন্দোলন হিসাবে এই আন্দোলন ইতিমধ্যে ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করেছে। আরজিকর মেডিকেল কলেজে চিকিৎসক-ছাত্রী হত্যা-ধর্ষণের ন্যায়বিচার চেয়ে এই আন্দোলনের শুরু, কিন্তু বাস্তবে উচ্চারিত হোক বা না-হোক তৃণমূল সরকারের সার্বিক ‘অন্যায়’-এর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার চাইতেই সারা রাজ্যের মানুষ আজ পথে নেমেছে। আরজিকর মেডিকেল কলেজের ঘটনা এক স্ফুলিঙ্গের কাজ করেছে। ইতিমধ্যে এই বিষয়গুলি আলোচনায় ও বিশ্লেষণে স্থান পেয়েছে। আমি নতুন কিছু বলছি না।

সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন আসলে এক অসম যুদ্ধ। আজ এই অসম যুদ্ধে সামিল বাংলার ছাত্র-যুব-জুনিয়র ডাক্তার-প্রবীণ নাগরিক-সহ সমাজের এক বড় অংশ। আর রাষ্ট্র যখন তার নখ দাঁত নিয়ে আরও বেশি আক্রমণাত্মক তখন সেই লড়াইয়ে শুধু আবেগ নয় কৌশলও দরকার হয়। হ্যাঁ কৌশলও। কেননা সরকার প্রতিনিয়ত তার কৌশল (এবং ষড়যন্ত্র) করে চলেছে। বিভেদের রাজনীতি, আন্দোলন ভাঙার রাজনীতি, ভয় দেখানোর হরেক কৌশল।

আমরণ অনশন হল আন্দোলনের চরম ধাপ। গান্ধির ভাষায় ‘বড় অস্ত্র’। এই দু-মাসে আরজিকরের ন্যায়বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন তা গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি গ্রামের ক্ষেতমজুর, কারখানার শ্রমিক, শ্রমজীবী মহিলারাও নেমেছেন আন্দোলনে। উত্তর ২৪ পরগণার শাসন ব্লকে বিডিও অফিসে ১০০ দিনের কাজের জন্য দরখাস্ত দেওয়ার মিছিল হোক বা পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকে তফসিলি উপজাতি শংসাপত্র আদায়ের স্মারকলিপি প্রদান, ‘সব মানুষের একই স্বর, জাস্টিস ফর আরজিকর’ স্লোগান দিয়েছেন খেটেখাওয়া মানুষ। তৃণমূলের স্থানীয় মনসবদারি অগ্রাহ্য করে। এবারের দুর্গাপূজায় বেশকিছু প্যান্ডেলে স্থান পেয়েছে তিলোত্তমার বিচারের দাবি। সরকারের পূজা অনুদান অগ্রাহ্য করেছে বেশ কিছু পূজা কমিটি। জানি, তা প্লাবন হয়নি, রক্তচক্ষু আর তর্জনীর শাসন অতিক্রম করা কতটা দুষ্কর তা জানে ভুক্তভোগী মাত্র। তবে প্লাবন না তুললেও ঢেউ তুলেছে, সাহস জুগিয়েছে। ‘সাহসী’ হয়েছে গ্রামবাংলা।

গত পঞ্চায়েত ভোটের পরেপরেই এক সমীক্ষা-কাজে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে দেখেছি হিংসার স্বরূপ। হিংসার চোরাস্রোত নয়, হিংসার লেলিহান আগুন। নির্বাচনের দিন ঘোষণা থেকে পঞ্চায়েত গঠন পর্যন্ত প্রচার, মনোনয়ন (ও তা জোরপূর্বক প্রত্যাহার), ভোটদান, পুননির্বাচন, গণনা-সহ প্রতিটি খণ্ডে অখণ্ড হিংসা যেভাবে কায়েম করেছে তার রাজত্ব তা ত্রস্ত করেছে গ্রামের মানুষকে। তাই গ্রামে যখন মিছিল হয়, স্লোগান ওঠে ‘ভয় পেয়েছে চোদ্দতলা’, তখন সাহস বোঝা যায়।

আন্দোলন যখন আরও বিতত হতে যাচ্ছে তখনই চলে এল দুর্গাপূজা। শাসক তো আহ্লাদে আটখানা! আমাদের মনে আছে, নাগরিকত্ব আইন বিরোধী শাহিনবাগ-সহ সারা ভারতে বিস্তৃত গণআন্দোলন বানচাল করতে চেষ্টার কসুর কম করেনি কেন্দ্রের সরকার। ‘দেশ-বিরোধী’ তকমা, ‘দিল্লি দাঙ্গা’— চেষ্টা কম ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল কোভিড-১৯। সে ছিল তাদের কাছে ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা’।

তাই দুর্গাপূজার ঢাকে কাঠি পরলেই বাঙালি ভুলে যাবে, এই আনন্দে বিভোর ছিল রাজ্যের শাসক দল। অনুগত গোস্বামী-সরকারদের মূক করিয়ে বা ব্যাপারী-হকারি করে কামিয়ে নেওয়াদের সামনে নামিয়েও কিছু করা যায়নি। বন্যা করিয়েও মানুষের মন ঘোরানো যায়নি। আর মুখপত্র মুখ খুললেই যদি বাংলার ঘরে ঘরে মোবাইলে মোবাইলে গালিগালাজের অনর্গল বন্যা বইতে থাকে তাহলে করারই বা থাকে কী? আশঙ্কা একটা ছিল শাসকের, তাই ‘উৎসবে ফেরার আহ্বান’ দেওয়া হল। পাল্টা মানুষ আন্দোলনের উৎসব আহ্বান করল। মহালয়ার পরেও রাস্তা ছাড়ল না বাঙালি, প্রতিপদে পদযাত্রা, দ্বিতীয়ায় মিছিল, কলকাতা যেন নতুন ইতিহাস রচনা করতে চলেছে। এই পর্যন্ত ঠিকই চলছিল।

‘বাঙালিকে খেপাইও না’ কথাটা এখন প্রবাদতুল্য। একবার খেপালে কী হয় তা দেখেছে ৪৭-এর আগের ভারতবর্ষ, ৭১-এ পূর্ববাংলা, হালফিলের বাংলাদেশ। এই ধারাবাহিকতায় প্রমাদ গোনে শাসক, পালিয়ে বাঁচে হাসিনা। তাই ভয় পেয়েছে শাসকদল। ‘সেনাপতি’ এনকাউন্টার ছেড়ে এখন নির্বাক চলচ্চিত্র। ভয় পেয়েছেন মমতা। তাই ভাল হত যদি উৎসবের মরসুমে আন্দোলন বজায় রেখে অনশনের মতো বড় কিছু এখনই না করা। সমাজ-মন উৎসব-উত্তর পর্বে আরও ‘প্রস্তুত’ হয়ে উঠত।

এ অবশ্য আমার নিজস্ব বোধ। আমি এই বোধের কথা জানিয়েছিলেম নিজ বৃত্তে। ভুল হতে পারি, যাঁরা অনশন আন্দোলনের বিষয়ে মত দিয়েছিলেন তাঁদের দৃঢ়তা বা একনিষ্ঠতা নিয়ে আমার শ্রদ্ধা আছে প্রশংসা আছে; কিন্তু প্রশ্ন আছে দূরদর্শিতা নিয়ে। তাঁদের এই সিদ্ধান্তে শাসক যদি পরাস্ত হয়, খুব আনন্দিত হব। তাঁদের চিন্তাভাবনা হয়তো অন্য কোনও বড় কিছু ভেবে!

তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের আন্দোলন শহর ও গ্রামাঞ্চলের মানুষকে ‘ভয়মুক্ত’ করেছে। শাসক তার আঁচ পেয়েছে জয়নগরে, পটাশপুরে। বাম আমলের শেষ সময়ের মতো এই ‘ভয় পাওয়া’ অবস্থার শেষ অস্ত্র হতে পারত ‘আমরণ অনশন’। খুব চিন্তায় রইলাম অনশনকারী তাজা প্রাণগুলির জন্য। সম্প্রতি নিকটাত্মীয় বিয়োগ হয়েছে আমার, খুব খারাপ লাগা এই পর্বে রয়েছি সপরিবারে। সব কিছু ছাপিয়ে মন পড়ে আছে ওই অনশনমঞ্চে। তাঁদের বিপি, পিআর, সিবিজি-র চার্টে……।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...