শুভ্রদীপ ঘোষ
সমস্যাটা কাঠামোগত। কীরকম সেই ব্যাপারটা? তার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোয়। সামন্ততন্ত্রের অবশেষ, এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদের সংমিশ্রণে তৈরি খিচুড়ি মূল্যবোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ-দেশের সমাজ-রাজনীতি যা বর্তমানে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদের কবলে চলে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। বাংলা তথা ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্রমাগত একের পর এক হাড় হিম করা ঘটনার কারণ বুঝতে গেলে ফিরতে হবে সেই উৎসেই। লড়াইটা লড়তে হবে এই কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে
গত ১৫ অক্টোবরের দ্রোহের কার্নিভালে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ার পর আমরা অনেকেই খুব আপ্লুত এবং উত্তেজিত, এবং খুব সঙ্গত কারণেই। তবে এই যে কার্নিভাল শেষ হল, আমার ধারণা এই সময়টা ক্রিটিক্যাল। ধুরন্ধর রাজনীতিক মুখ্যমন্ত্রী এই সময়টা ব্যবহার করার চেষ্টা করবেনই করবেন। তাঁকে পাল্টা দিতে গেলেও কিন্তু স্পষ্ট রাজনীতি দরকার। কথা হল এই গোটা আন্দোলনটা কি তার রাজনীতির স্পষ্টিকরণ করতে পেরেছে? গোটা আন্দোলন বলতে আমি কেবলমাত্র ডাক্তারদের দাবি সংক্রান্ত আন্দোলনের কথা বলছি না। ডাক্তারদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নারী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন, ধর্ষণ সংস্কৃতি, সাধারণভাবে ভয় দেখানোর সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণ, অপরাধের তদন্ত এবং বিচার বিষয়ে পক্ষপাতিত্বের বিরোধিতাও এর অন্তর্ভুক্ত। জুনিয়র ডাক্তাররা এই বিষয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। তাঁদের পেজে দেওয়া বিবৃতির অংশটা এইরকম:
কিন্তু আমাদের এই আন্দোলনের একটি স্পষ্ট রাজনীতি রয়েছে, ভয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর রাজনীতি, ধর্ষকামকে প্রতিরোধ করার রাজনীতি, শাসকের রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়ার রাজনীতি, কোনওরকম চাপের মুখে নতিস্বীকার না করার রাজনীতি, আপস না করার রাজনীতি এবং সর্বোপরি যে-কোনও গণআন্দোলনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর রাজনীতি।
এই বিবৃতিতে দেওয়া কথাগুলি বৃহদংশ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বটে কিন্তু এতে অনেক ফাঁকফোকর আছে। তাঁরা যে রাজনীতির বিরোধিতা করছেন সেই রাজনীতির উৎস কোথায় এবং কীভাবে সেই রাজনীতির বিরোধিতা করে নতুন রাজনীতি প্রতিষ্ঠা এবং তাকে sustain করানো যাবে সে-বিষয়ে দুটি কথা না বললে কিন্তু ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। যেমন, বিধানসভার প্রধান বিরোধী দলও কাগজেকলমে তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হবেন, সেই মর্মে দু-চারটি বিবৃতিও দেবেন কিন্তু রাজ্যে রাজ্যে তাদের ট্র্যাকরেকর্ড কি এক শতাংশও সামঞ্জস্যপূর্ণ? যেখানে যেখানে তারা ক্ষমতায় সেখানে সেখানেই কি তারা আরও ভয়ানকভাবে সেই সেই সংস্কৃতি বহন করে না যেগুলির বিরুদ্ধে জুনিয়র ডাক্তারদের এই বিবৃতি? এবার এই দলটির এই সংস্কৃতি বহনের উৎস কোথায় জানতে গেলে তাদের পিতৃ-সংগঠনের রাজনীতিতে ফিরে যেতে হবে, বিরোধিতা করতে হবে সেই জায়গা থেকে। সেটা না করলে কিন্তু অ-রাজনৈতিক, অ-দলীয় সংগঠনের মুখোশে পিতৃ-সংগঠন এবং বকলমে রাজনৈতিক দলটি ধীরে ধীরে জমি দখল করে নেবে।
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই বলতে পারেন (এবং সঙ্গত কারণেই) যে শুধু প্রধান বিরোধী দলকে বাছা হচ্ছে কেন? এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি লালনপালনের কোনও দায় কি এই রাজ্যের পূর্বতন শাসক বামপন্থীদের কিংবা কেন্দ্রে প্রধান বিরোধী দলের নেই? উত্তর হল, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেখানেও এইটাই ভাবতে হবে যে বাম থেকে অতি-ডান, গোটা সংসদীয় রাজনৈতিক বর্ণালী জুড়েই এই সংস্কৃতির প্রতিফলন কেন। এমনকি সংসদীয় রাজনীতিতে যারা ক্ষুদ্র অংশ বা সংগঠন হিসেবে তাতে অংশগ্রহণ করে না, তাদের ক্ষেত্রেও একাধিক উদাহরণ আছে এই সংস্কৃতি লালনপালনের। তাহলে নিশ্চয় সমস্যাটা কাঠামোগত। কীরকম সেই ব্যাপারটা? তার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোয়। সামন্ততন্ত্রের অবশেষ, এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদের সংমিশ্রণে তৈরি খিচুড়ি মূল্যবোধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ-দেশের সমাজ-রাজনীতি যা বর্তমানে পুরোপুরি ফ্যাসিবাদের কবলে চলে যাওয়া কেবল সময়ের অপেক্ষা। বাংলা তথা ভারতের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্রমাগত একের পর এক হাড় হিম করা ঘটনার কারণ বুঝতে গেলে ফিরতে হবে সেই উৎসেই।
লড়াইটা তাহলে লড়তে হবে এই কাঠামো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে। কারণ এই কাঠামোয় মানিয়ে নিলে সরকার বদল হবে কেবলমাত্র। যে যে ব্যাধির বিরুদ্ধে ডাক্তারদের রাজনীতি ঘোষিত সেই সেই ব্যাধির হ্রাস বৃদ্ধি হবে কিন্তু রোগ নির্মূল হবে না। ফের তৈরি হবে আজকের পরিস্থিতি, হয়তো আরও ভয়াল চেহারা নিয়ে। এবার প্রশ্ন হল এই লড়াইতে তাহলে সাথী হবে কারা। বামপন্থীরাই হতে পারে স্বাভাবিক মিত্র। কিন্তু বামপন্থীদের, বিশেষত যাঁরা সরকারি ক্ষমতায় থেকেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সঙ্গত কারণেই অভিযোগ এই সংস্কৃতিকে জল হাওয়া দেওয়ার। ফলে বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হিসেবে মানুষের কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে গেলে পুরনো পাপের কথা স্বীকার করে নিতে হবে। সেইসঙ্গে তাঁরা যে সংশোধনে আন্তরিক সেটাও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আস্ফালন বা অভিযোগ কোনওটা করেই কিন্তু লক্ষ্যের ধারেকাছে পৌঁছনো যাবে না। একইসঙ্গে সমান্তরালে যে বিষয়গুলি আজকের আন্দোলনে উঠে এসেছে— নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের স্বাধীনতা হোক কিংবা বিচারবিভাগের পক্ষপাতিত্ব— সর্বক্ষেত্রে অভিমুখ রাখতে হবে কাঠামোর আমূল পরিবর্তনে। ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদ এবং নয়া-অর্থনীতিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে এই আন্দোলনকে জয়যুক্ত করা যাবে না। কিছু ছোটখাটো দাবিদাওয়া আদায়ের পর অবস্থা হবে পুনর্মুষিক ভব।
যাঁরা বিগত দু-মাস ধরে সব আশঙ্কা এবং ভবিষ্যদ্বাণী নিষ্ফল প্রমাণ করে লড়াইকে তীব্রতর করে তুলেছেন, এই সন্ধিক্ষণে বৃহত্তর ছবিটি মাথায় রেখে, মতান্তরকে সুস্থ আলোচনার জায়গায় রেখে, সর্বোপরি নিজেদের অহংকে পিছনে রেখে, যদি একটি নূন্যতম সাধারণ কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকে দিশা দিতে পারেন তবেই এই দ্রোহ তার কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনা দেখবে।
*মতামত ব্যক্তিগত